সর্বশেষ পড়া উপন্যাসটি ছিলো ইয়েন্তন গার্ডার’র (Jostein Gaarder) ‘শুনছ, কোথাও আছো কি কেউ?’ (Hello! Is Anybody There?, বাংলা তর্জমা: দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মন, সন্দেশ, ঢাকা)। কাকতালীয়ভাবে এই সময় মাথার মধ্যে ঘুরছিল যমজ পৃথিবীর ধারণা। এই উপন্যাস ইয়েন্তন গার্ডারের অন্যান্য উপন্যাসের মতোই উত্তম পুরুষে লেখা। উপন্যাসের মূল চরিত্র জো, ছোট্ট ভাইয়ের জম্মের দিন মিকা নামক ভিনগ্রহবাসীর মুখোমুখি হয়। পৃথিবী এবং মিকা-র গ্রহের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। যেমন- সেই গ্রহের ভর পৃথিবীর চেয়েও বেশী। জো’র জম্ম মায়ের পেট থেকে সরাসরি আর মিকা ডিম থেকে।নানা বিষয়ে পাথর্ক্য থাকলেও চিন্তার দিক থেকে তাদের অদ্ভুত মিল।অন্তত চিন্তা জাগা ও ধরার দিক থেকে। বাংলায় কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা ‘কুয়াশা’ সিরিজের কোন একটা পর্বে যমজ পৃথিবীর কথা আছে বোধ হয়। এছাড়া সমান্তরাল সময়ের ধারণা নিয়ে অনেক গল্প উপন্যাস আছে। সবশেষে আছে সাম্প্রতিককালের একটি আবিষ্কার। এটার কথা একদম শেষে বলছি।*
এই লেখার আগের অংশটির শিরোনাম ছিলো-‘মানসিক অবস্থা কি করে বাইরের দুনিয়াকে উপস্থাপন করে’। যা মূলত: মানসিক অবস্থা ও বাইরের দুনিয়ার কার্য-কারণিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা। সেই আলোচনায় আমরা মুখোমুখি হই আরো দুটি ধারণার- বিস্তুত আধেয় ও সংর্কীণ আধেয় (Wide and Narrow content)। দর্শনের এই বিষয় আলোচিত হয় আর্টিফিয়াল ইন্টিলিজেন্সের দার্শনিক প্রস্তাবনার ক্ষেত্রেও। এই লেখার আগের অংশে আমরা ফ্রেগিয়ান ধারণা সম্পর্কে জেনেছিলাম। আর এই বিষয়ের দ্বিতীয় তর্কটি যমজ পৃথিবী’র (Twin earth) থট এক্সপেরিমেন্ট নামে পরিচিত। এই যমজ পৃথিবীর ধারণার জন্য আমরা হাজির হবো আমেরিকান গণিতবিদ ও কম্পুটার বিজ্ঞানী হিলারি পুটনামের (Hilary Putnam) কাছে। তিনি প্রয়োগবাদী ধারার দার্শনিক। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যা নিয়ে ঢের কাজ করেছেন, এখনো করে চলেছেন।
যমজ পৃথিবীতে যাবার আগে পুটনামের অন্য একটি লেখার রেফরেন্স টানছি। পুটনাম তার ‘Reason, Truth and History’ (1981) শিরোনামের বইয়ের পাঁচ ও ছয় নাম্বার পৃষ্ঠায় Biv (ব্রেন ইন ভ্যাট বা ভিটামিনের মধ্যে মস্তিষ্ক)এর আলোচনা করেন।তার মতে, সবল আর্টিফিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা AI’র সম্ভাব্যতা নিয়ে বলতে গেলে আমরা দুটি বিষয় পাই, যার মাধ্যমে মানুষ এবং যন্ত্রের পার্থক্য টের পাওয়া যায়।দুটি বিষয়ের একটি হলো মানসিক অবস্থা এবং অপরটি ইনপুট ও আউটপুট ভিত্তিক পদ্ধতি। ইনপুট ও আউটপুট ভিত্তিক পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হলো এটি আকস্মিক এবং কার্যকারণিক (Functionalism)।অন্যদিকে,মানসিক অবস্থা হলো উচুঁ স্থরের প্রকাশমান বৈশিষ্ট্য যা নিউরণের মধ্যে নিচুস্থরের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট (Biological naturalism). এখানে আমরা দ্বিতীয়টি অর্থ্যাৎ মানসিক অবস্থা নিয়ে কথা বলছি। সেই মানসিক অবস্থার সাথে বাইরের দুনিয়ার সম্পর্ক নিয়ে তার লেখায় নতুন ধরণের থট এক্সপেরিমেন্টের ধারণা পাওয়া যায়।
পুটনামের সেই বিশেষ পেপারটির নাম ছিলো ‘Meaning and reference’ (১৯৭৩)। এর সুত্র ধরে লেখেন ‘The meaning of meaning’ (১৯৭৫)। সেখানে প্রথম যে তর্কটি আসে,তা সিমান্টিক এক্সটারানালিজম নামে পরিচিত। ভাষা দর্শনে সিমান্টিক এক্সটার্নালিজম মতে, একজন বক্তার কাছে একটা পদের (টার্ম) অর্থ নির্ধারণ হবার যে শর্ত দরকার হয় সেগুলো সম্পূর্ণ বা অংশত বাইরের দুনিয়ার উপর নির্ভরশীল। এখানে বক্তা বলতে তার ব্রেনের কাজ বুঝাচ্ছে। এক্সটারনালিজমের দিক থেকে কোন বিরোধ ছাড়াই বলা হয়- ব্রেনের সমদর্শী অবস্থায় দুইজন ব্যক্তি কোন বিশেষ কিছু সম্পর্কে কিছু না কিছু বলে থাকতে পারেন, কিন্তু ঐ বিশেষ বস্তু সম্পর্কে তাদের বলাটা ভিন্ন ভিন্ন হয়। যদিও এই বলাটা একই ধরণেরও হতে পারে। পুটনাম একে সংক্ষেপে বলেন, “meanings just ain’t in the head!”। তার এই লেখায় দার্শনিক যুক্তির দিক থেকে যমজ পৃথিবীর ধারণাটির আমদানি করেন।
আসুন প্রথমেই পুটনামের পথ ধরে একটা অনুমান করি। ব্রক্ষ্মান্ডের কোন একখানে এই পৃথিবীর মতো একটা গ্রহ আছে, যাকে আমরা যমজ পৃথিবী বলছি। কোন কোন কল্প বিজ্ঞান উপন্যাস মতে, আমরা সূর্যের যে দিকে আছি ঠিক তার উল্টো দিকে এই যমজ পৃথিবীর অবস্থান। তাই সেটাকে কখনো পৃথিবীবাসির পক্ষে দেখা সম্ভব হয় না।যেমন চাঁদের একটা পিঠকে আমরা কখনো দেখি না। পুটনাম তার এই উদাহরণে কোন কল্প-বিজ্ঞানের কাহিনী শুনাচ্ছেন না। বরং, পরীক্ষার খাতিরে একটা অনুমানের কথা তুলছেন। যাই হেকে, যমজ পৃথিবীর সাথে এতই মিল যে এই পৃথিবীতে যেমন আমরা চাঁদ-তারা দেখি, সেখানকার অধিবাসীরাও একইভাবে চাঁদ-তারা দেখতে পান।
তো, যমজ পৃথিবী এমন এক জায়গা যেখানে সবকিছু পৃথিবীর মতো,যদি না এদেরকে বিশেষায়িত করে দেখা হয়।তাহলে পৃথিবীর যেকোন ব্যক্তির একজন যমজ পক্ষ আছে সেই যমজ গ্রহে। এখন দুইজন ব্যক্তি নিয়ে কথা বলছি- রহিম আর করিম। রহিম পৃথিবীবাসি আর যমজ পৃথিবীবাসি অপর পক্ষ করিম।তাদের মনের বিশেষ একটা কথা প্রকাশ করে এভাবে,‘পানি পিপাসা মেটায়’। শুধু কথায় নয়, বরং নিজের হাতে বাইরের দুনিয়া থেকে তারা পিপাসা মিটানোর ব্যবস্থা করে। আর পিপাসা মেটাতে লাগে পানি। বাকি সব ঠিক থাকলেও একটা পার্থক্য হলো যমজ পৃথিবীতে পানি নেই।
পুটনাম যে সময়কার কথা বলছেন সেটা পৃথিবীর হিসেবে ১৭৫০ সাল। তখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে পানির হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সংমিশ্রনের মৌলিক গঠনটি অজানা ছিল। সে সময়ে, পৃথিবীর মতোই যমজ পৃথিবীর সাগরগুলো টলটলে তরলে পূর্ণ ছিল এবং সেটা আবার আকাশ থেকে ঝরে পড়ত । কিন্তু সেই তরল পদার্থটি পৃথিবীর H2O কম্পোজিশনে (যেটাকে আমরা বলি) গঠিত নয়,পানির গঠনের সাথে মিল না থাকায় তাকে XYZ কম্পোজিশন বলা যায়। রহিম ও করিম অন্য সবার মতো এই রসায়ন সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল এবং যদি এই দুটি তরলের মধ্যে পার্থক্য করার সুযোগও থাকত তারা তা ধরতে পারত না।তারা দুইজন শুধুমাত্র পানি বলেই জানত।
এখন প্রশ্ন হলো দুই গ্রহের লোক যখন একই নামে ডাকে, তার দ্বারা কি বুঝায়? পানি বলতে তারা কি একই জিনিসকে বুঝায়? যেহেতু তাদের ব্রেনের প্রতিটি মলিকিউল অভিন্ন্।না,মৌলিক গঠনগত নির্দেশনা বলছে পৃথিবীর একজন মানুষ পানি দিয়ে যা বুঝাবে যমজ গ্রহের মানুষও একই জিনিস বুঝাবে না। তরলের মৌলিক গড়ন তো ভিন্ন। তাহলে,ফলাফলে যা দাড়ায়- কোন ব্যক্তি কোন বস্তুকে নিদের্শ করতে যে শব্দ (টার্ম) ব্যবহার করে তা নির্ধারণে তার ব্রেন পর্যাপ্ত নয়।এদের একজনও যদি সেই তরলের কার্যকারণিক ইতিহাস পরীক্ষা করতে সর্মথ্য হয় সেটা তাকে নিজস্ব কোন অর্জন দেবে হয়তো।সেখানেও একজন জানবে XYZ হলো পানি আর একজন জানবে H2O হলো পানি। যদি তা না হয়,তারা এটাকে কি নামে ডাকত? পুটনামের ধারণা,রহিম ও করিম সেই তরল পদার্থটি বুঝাতে ‘পানি’ শব্দটিই ব্যবহার করত। XYZ-কে রহিম যদি পানি হিসেবে সনাক্ত করে ভুল হবে। কারণ এর সারধর্ম পানির সাথে মিলবে না। অপর পক্ষ করিম H2O-কে পানি হিসেবে নিবে না, কারণ তার তো পানির ধারণায় নাই।
এইসব বিবেচনায় মূল প্রবন্ধে পুটনামের দাবি, স্নায়বিক প্রক্রিয়ায় তাদের কোন পার্থক্য না থাকলেও দুই গ্রহে ভিন্ন আধেয়গুলো (H2O ও XYZ) আছে ও সাথে সাথে আছে তাদের সঠিকভাবে ব্যবহারের শর্ত। তাহলে, তাদের মাথায় কি আছে তা দিয়ে এই (H2O ও XYZ) আধেয়গুলো নিয়ন্ত্রিত হয় না। কিন্তু এই যে মনোস্তাত্ত্বিক অবস্থা বাইরের অবস্থাকে নির্ধারণ করতে পারে না- তারা তা জানতে পারছে না, তাহলে আমার ব্রেন যদি কৃত্রিম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়, সেটাও বুঝতে পারব না। কারণ এটা আমাদের থেকে দূরবর্তী কেউ আমাদের জন্য নির্ধারণ করছে। তখন আমাদের কোন অভিজ্ঞতার পক্ষে সত্য দাবি ফেলনা নয়।তাহলে পানি বলার মধ্য দিয়ে বাইরের দুনিয়ার তরলের অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটছে না। কিন্তু এর সাথে নির্দেশনামূলক যে সম্পর্ক তার ব্যবহার বিধি ঠিকই নির্ধারিত হয়। অর্থ্যাৎ বিস্তৃত আধেয়ের ধারণাটি এখানে পাওয়া যাচ্ছে।
আরো অনেকের** মতো ইউসিএলএ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক টেইলর বার্জ (Tyler Burge/ ১৯৭৯) আরেকটি থট এক্সপেরিমেন্টের কথা বলেন। যেখানে তিনি দেখান সামাজিক পরিবেশের ভিন্নতা মানসিক আধেয়ের মধ্যে পার্থক্য তৈয়ার করে।ধরা যাক আয়নাল নামের পৃথিবীস্থ এক ব্যক্তি বাতের ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন।তিনি বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব বাত আমার উরুতে ছড়িয়ে পড়ছে’। সে বাত সম্পর্কে যা বলছে, তাতে বুঝা যাচ্ছে সে বাত জিনিসটা কি তা ধরতে পারে নাই। তার ধারণা নাই এই জ্বালাময়ী অসুখটি শুধুমাত্র হাড়ে হয়, বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে। এখন যমজ দুনিয়ার জয়নালের বিষয়টি বিবেচনায় আনা যাক। সে একই ধরণের সমস্যায় পড়েছে। সেখানে সে বাত বলতে হাড় বা অস্থিসন্ধির জ্বালাময়ী অসুখকে বুঝাচ্ছে।
জয়নালের ব্যবহৃত ‘বাত’ পদটি আয়নালের মতই, কিন্তু এটা ব্যবহার করা হয়েছে যমজ পৃথিবীতে, সে এটা ঠিক মতই বুঝেছে। এখন বার্জের অনুসরণে, নিজ নিজ গ্রহ অনুযায়ী দুইজনই ঠিক বলেছেন, তারা বিশ্বাস করে বাত হাড়ের রোগ, কিন্তু তাদের বিশ্বাসের পার্থক্যের কারণে জয়নালের বিশ্বাস সত্য আর আয়নালেরটা মিথ্যা।কিন্তু তাদের মধ্যে ভেতরের অবস্থার কোন পার্থক্য নাই। তারা যা বিশ্বাস সেটা অংশত বাইরের বিষয়। তাদের মাথার মধ্যে কি আছে বাতের আধেয় সেটা নয় এবং তার উপর পরিবর্তনও ঘটায় না।
কেন্ট বাখের (Kent Bach) মতে, এই থট এক্সপেরিমেন্ট বেশ মজাদার কিন্তু একই সাথে ব্যাপক পর্যালোচনাকে অগ্রাহ্য করে। এর একটা হলো, তারা নির্দিষ্ট কোন কিছু নির্বাচন করছে: সেই নির্বাচনে তাদের যে পার্থক্য তৈয়ার হয়- তা দেখার (Intuition) পার্থক্য থেকে জম্ম নেয়। যেমন- XYZ এক ধরণের পানি। এমনকি এটি পানি হিসেবে দেখাকে স্বাক্ষ্য দেয়। আবার অন্যভাবে বলা যায়, যেমন- XYZ পানির কোন ধরণ নয়, এটাকে তারা রহস্যময় হিসেবে ছেড়ে দিতে পারে, কেন না ভিন্ন ভিন্ন আধেয়ের নির্দেশনা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নির্ধারিত হয়।
পানি শব্দটি দ্বারা আমরা যে আধেয়ের প্রকাশকে নির্দেশ করব সেটা নির্ভর করে তার (H2O)
প্রকৃতির উপর। যেমন -স্বচ্ছতা, আমাদের চারপাশে পর্যাপ্ত পরিমানে আছে কিনা। কিন্তু এটা এমন পরিস্থিতি নয়, যেমন আমরা ‘পৃথিবী’,’বাতাস’ এবং ‘আগুন’ শব্দগুলো দ্বারা যে আধেয়গুলোকে প্রকাশ করি।এটা রাসায়নিকভাবে বৈচিত্রকে নির্দেশ করে এবং এটা ঠিক হয় কোন নির্দিষ্ট দৃশ্যমান শর্তের সন্তুষ্টের দ্বারা। পুটনাম আর তার অনুসারিরা এই কথার ব্যাখ্যা দেন না, কেন পানির আলাদা একটা প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক ধরণ আছে এবং পৃথিবী, বায়ু ও আগুনের আধেয়গুলো পানির আধেয়ের মতো তাদের আধেয়ের ধরণের দিক থেকে পৃথক নয়। কেন এই পার্থক্যগুলো মৌলিকভাবেই আলাদা, যদি আমরা ১৭৫০ সালে ফিরেও যাই। তাহলেও এটা চিন্তাকারির মাথার মধ্যে থাকে। এখানে পুটনাম আর তার অনুসারিরা নিজেদের দেখাকে অস্বীকার করছেন।
বাতের তর্কটি নির্ভর করে এই পূর্বানুমানের উপর যে, একজনের বিশ্বাসের আধেয়ের দাড়িয়ে আছে আরেকজনের অসম্পূর্ণ বুঝাপড়ার সাথে। উদাহরণে এটা অনুমিত যে, আয়নাল শুধুমাত্র বাত নিয়ে ভুল বুঝে নাই কিন্তু সে বাতের চেয়ে আর বড় কিছু বিষয় নিয়েই ভুলবশত কথা বলছে। ধরা যাক, এটাকে আমরা বিটকেলে বাত বলছি। সুতরাং আয়নাল জয়নালের মতো একইভাবে বাতকে বুঝেছে এই কথার বিরোধিতা করা যায়, এবং এটা একটা কাছাকাছি বিশ্বাস, বিটকেলে বাত উরুতে ছড়ায়। সেখানে যে প্রমান থাকুক না কেন, সেও বিশ্বাস করে তার বাত উরুতে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা ‘বাত’ শব্দটি সম্পর্কিয় তার নিজস্ব বোঝাপড়া সেটাকে অগ্রাহ্য করে। এখানে বলা হচ্ছে না সে বিশ্বাস করে যে তার উরুসন্ধি জ্বালাপোড়া করছে।
এমনও হতে পারে- কোন কারণে আমরা একটা বিষয় ধরতে পারছি না, নিদের্শনামূলক বাক্যে অহরহ ব্যবহৃত ‘that’ক্লজের দ্বারা কি ধরণের আধেয়কে মনোস্তত্ত্বের প্রাসঙ্গিক করে তোলে যায়। এই ‘that’ মানুষের আশেপাশের পরিস্থিতিকে বৈশিষ্ট্যায়িত করছে এবং তাদের কাজ ও অনুমানকে ব্যাখ্যা করছে। লোয়র (Loar)এবং প্যাটারসন (Patterson)দুইজনই তর্ক তুলেন, থট এক্সপেরিমেন্টে কিছু দেখানোর মধ্যকার যে সফল ভঙ্গি আরোপন করে তা নিয়ে কোন একজনের অনুমোদন থাকতে পারে, কিন্তু সত্য হবার শর্ত পদার্থিক দুনিয়া এবং তার সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে স্পর্শকাতর, যেখানে এটা মনোস্তাত্ত্বিক আধেয়ের ক্ষেত্রে ‘that’ ক্লজের কোন অনুমোদনই থাকে না। কেন না, ভাষাগত সিমান্টিক মনোস্তত্ত্ব নয়। তাহলে বিস্তৃত আধেয়কে আমরা অসম্ভব বলতে পারি না।
আরো অনেক দার্শনিক তর্কে সামিল হন এভাবে- রহিম আর করিম উভয়ের ‘পানি’ আসলে ‘পানির-মতন’ কিছু। সেই ‘পানি’র ধারণাকে আরো এগিয়ে নিলে আমরা H2O ও XYZ-কে পানিতে অন্তর্ভুক্ত করি। তারা পানিকে H2O-র অনমনীয় কাঠামোর মধ্যে থাকার বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করেন। এর উপর অনেকের যুক্তি দাড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে জন সার্লে, ডোনাল্ড ডেভিডসন, পল বগোসেন, ডেনিয়েল ডেনেটে, জন ম্যাকডুগাল, ফিল হাচিসন উল্লেখযোগ্য। এরমধ্যে জন সার্লের (John Searle)কথা শুনে আমরা যমজ পৃথিবীর তর্কে ক্ষান্ত দেব।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নানা তর্কের ক্ষেত্রে জন সার্লের কৃতিত্ব এখনো চলমান। এরমধ্যে আছে টুরিং টেস্ট (Turing test) নির্ভর বিখ্যাত মুরাভিক-সার্লের ‘চায়নিজ রুম’ বির্তকটি। এখন সংক্ষেপে সার্লের অভিযোগটি শোনা যাক। সার্লে তার ‘Intentionality: An Essay in the Philosophy of Mind’-এ তর্ক তোলেন- একদা আমরা পানিকে H2O হিসেবে আবিষ্কার করেছি। কিন্তু আমাদের পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার সম্ভবনাটি এখনো বহমান রয়ে গেছে। পানির ধ্রুপদী সংজ্ঞা বাদ দিয়ে আমরা চাইলে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি অথবা এই কাজ চালিয়ে যেতে পারি যে, পানি বলতে তার কিছু মৌলিক গুনাগুনকেই নির্দেশ করতে পারি, যেমন- স্বচ্ছতা, আর্দ্রতা ইত্যাদি। যমজ পৃথিবীর উদাহরণে তিনি দ্বিতীয় বিষয়টিকেই অধিক যুক্তিসঙ্গত মনে করেন। যদি যমজ পৃথিবীতে পানি নাও থাকত, তবে এর পানি-কেন্দ্রিক সকল দ্রব্যও আলাদা হতো। যেমন- যমজ আইসক্রীম, আমরা একে আইসক্রীম বলতে প্ররোচিত হলেও এটি গঠনগতভাবে আলাদা হতো। সার্লে অন্যদের সাথে মিলে এই সমস্যা সমাধানের জন্য পর্যাপ্ত যুক্তি খুজেঁছেন। যেখানে অনেক ধরণের পরীক্ষাকে একই উপসংহারে পৌছতে ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে সংজ্ঞায়নে আমাদের মনোস্তত্ত্বের ভূমিকা ব্যাপক।
তবে চমক হলো পুটনাম নিজেই নানা সময়ে তার তত্ত্বে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।তিনি নিজেই আবার যমজ পৃথিবীর ধারণাকে এন্টি ফাংশনালিস্ট হিসেবে সমালোচনা করেছেন। এরপরও বিস্তৃত ও সংর্কীণ আধেয় নিয়ে আরেকটি আলোচনা বাকি থাকে। দুটি আধেয়ের ধারণা মিলে তৃতীয় কোন ধারণায় পৌছতে পারি কিনা। যদি সেই ফুসরত মেলে…।
সংযোজনা-
*কেপলার-২২বি:সম্প্রতি নাসার কেপলার টেলিস্কোপ মহাশূন্যে নতৃন একটি গ্রহ আবিষ্কার করেছে। যার নাম নাম দেয়া হয়েছে কেপলার ২২ বি (Kapler-22B)। এটি পৃথিবী থেকে ৬০০ আলোক বর্ষ দূরে তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে। ১ আলোক বর্ষ হলো ১.৫ ট্রিলিয়ন মাইল। এর তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রী। যা অতি গরম বা অতি ঠান্ডা না। পৃথিবীর তাপমাত্রার কাছাকাছি। এর ভর পৃথিবীর চেয়ে কিছুটা বড়ো। সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রের চারিদিকে এর ঘুরে আসতে ২৯০ দিন সময় লাগছে। এইসব বিচারে আবিষ্কার সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন কেপলার-২২বি পৃথিবীর মতোই প্রাণের বিকাশে উপযুক্ত হতে পারে।কেপলার প্রকল্পের একজন বিজ্ঞানী ডগলাস হাজিনস বলেছেন, ‘এটি আসলে পৃথিবীর যমজ গ্রহ’।এই গ্রহে পৃথিবীর সবচেয়ে গতি সম্পন্ন মহাকাশযান হাজির হতে কয়েকশ কোটি বছর লাগতে পারে।তাহলে সেখানে যদি কোন রহিম বা জয়নাল থাকে, তাহলে তারা পানি বা বাতকে কি বলে তা জানতে আমাদের কয়েকশ কোটি বছর লাগবে পারে। যদি সম্ভাবনাটি সত্য হয় এবং যদি প্রযুক্তির গতি থেমে থাকে। কিন্তু প্রযুক্তি তো অহরহ পরিবর্তিত হচ্ছে। এইসব সম্ভাবনার কোনটা সঠিক হলে ‘যমজ পৃথিবী’র ধারণা নিছক কল্প-বিজ্ঞান বা থট এক্সপেরিমেন্ট হয়ে থাকবে না। পৃথিবীর ইতিহাসকে নানা অর্থেই পাল্টে দেবে।
** দি টুইন আর্থ থট এক্সপেরিমেন্টসহ ‘Contents of thought’ সর্ম্পকীয় ছয়টি ধাঁধা নিয়ে কাজ করেছেন অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক David J. Chalmers। সেখানে ফ্রেগিয়ান সমস্যাটিও আছে। এই লেখায় তিনি জ্ঞানতাত্ত্বিক ও শর্তমূলক- এই দুইভাগে ভাগ করে সমস্যাগুলোর আলোচনা করেছেন। এই লেখার শিরোনাম হলো: ‘The Components of Content’। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।
টুইন আর্থের ব্যাপারে প্রথম জেনেছিলাম কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা কুয়াশা সিরিজের কোনও একটা বইতে।
দারুণ লিখেছেন।
ধন্যবাদ কালো হিমু।
আপনার সাড়া পেয়ে আমি আনন্দিত।
অনেক চেষ্টা করেছি ‘কুয়াশা’ সিরিজের সেই বইটার নাম্বার মনে করতে পারলাম না।
ভালো থাকুন।