সাদমা : সমান্তরাল অতীত–বর্তমান
‘সাদমা’ ছবির সবচেয়ে স্পর্শী দৃশ্য হলো শেষদিকে যখন ট্রেনে চড়ে চলে যায় শ্রীদেবী। আর তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে কমল হাসান। এটা বোধহয় নতুন করে বলার বিষয় না- ওই দৃশ্যে শ্রীদেবীর অভিব্যক্তি অদ্ভুত রকম সুন্দর। যার জন্য পুরো সিনেমা জুড়ে অপেক্ষা করা যায়।
কমল বারবার বিরক্ত করলেও কী যেন ভাবছিলেন শ্রী, মায়ের সাথে কথাও বলছিলেন। মনে হচ্ছে, সে বুঝতে পেরেছে হারিয়ে যাওয়া অতীত ছাড়িয়ে তার সামনে আরো অনেক উজ্জ্বল দিন আছে। কিন্তু মনের গহনে থেকে যাওয়া সুন্দর অতীতও কি হাসায় না?
বাট, যেটা ধাক্কা দিল আমায়। আমরা অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতকে একটা সরলরেখার মতো ভাবতে অভ্যস্ত। মনে হতে পারে, অতীত আর বর্তমান পাশাপাশি চলতে পারে না। ‘সাদমা’র এ দৃশ্যটা যেন বলে দেয় পাশাপাশি চললেও লাভ নাই। তারা সমান্তরাল হয়ে যায়। কেউ কাউকে ছুঁতে পারে না। তার চেয়ে চেতনের আড়ালে চাপা পড়লেই ভালো কখনো কখনো!
শ্রী যখন কমলকে ভিক্ষুক মনে করে টাকা দেয়- তখন কেউ কাউকে ছুঁতে পারে না, এমনকি টাকাটা কমলকে স্পর্শ করে না। উড়ে যায়। বাট, শ্রী কন্টিনিউটিটা ধরতে না পারলেও কমল তো পারে। তাইলে? সমস্যা হলো- অতীত বর্তমানের মুখোমুখি হলো সরলরেখার পেছনে পড়ে থাকে। তাই সে এমন আচরণ করে।
তো, আমরা হয়তো প্রতিদিন এমন অনেক দৃশ্যের মুখোমুখি হই- হয়তো স্রেফ মনোভঙ্গি নয়তো প্রাকৃতিক কোনো শৃঙ্খলা আমাদের মুখোমুখি হতে দেয় না।
মাছের ঝোল অথবা ওস্তাদ হোটেল
মালায়লাম ‘ওস্তাদ হোটেল’ কয়েক বছর আগের সিনেমা হলেও সম্প্রতি দেখলাম। যদিও ভাষা বোধগম্য ছিল না। কলকাতার ‘মাছের ঝোল’ গতবছরের ছবি, ওই সময়ে দেখেছি।
মোটামুটি লাগছিল- এভাবে শিল্পের ক্ষিদেটা কি? এর ধরনের পারফেকশনের ব্যাপার থাকতে পারে। ‘মাছের ঝোল’-এর নায়ক সেই স্বাদটা পেলে আচার-আচরণ বদলে যায়। ভাব-ভাষায় আরেকটু উঁচুতে যায় বোধহয়! আগের মতো চড়া গলায় কথা বলে না। তার আলাদা স্পেসের দরকার হয়। কিন্তু মায়ের জিহ্বায় পুরানা স্বাদ এনে দিতে পারে না। মানে, যেন হারিয়ে ফেলে অনিচ্ছুক শেকড়। কিন্তু ‘ওস্তাদ হোটেল’ তার উল্টো। নায়ককে বরং খালি চোখে যতটুকু শেকড় দেখা যায়, তারচেয়েও গভীরে নিয়ে যায়। তার সাথে যোগ করে দেয় চিহ্ন।
তো, এই পারফেকশনের ব্যাপারটা কেমন যেন আছে, একটা ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের গল্পের সিনেমা। যেমনটা আজকাল অনেক কিছু নিয়া বলা হয় আরকি! ধরেন মুক্তিযুদ্ধ বা একটা শহরের গল্প- কেউ বলছেন এটা ব্যক্তিগত টানাপোড়নের গল্প। সেটার একটা ফাঁদ আছে মনে হয়। ব্যাপারটা এমন যে, ব্যক্তিগত কথা কইতে গিয়ে সে ব্যক্তিটা আসলে কই অবস্থান করে সেটা স্পষ্ট হয় না। আর স্রেফ ভালো বা মন্দ লাগার থেকে স্বাধীন হতে চাওয়ার দুরত্ব চোখে পড়ে।
কেন যেন মনে হয় ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের নামে আমরা বৃহৎ আখ্যানে যুক্ত হওয়ার অক্ষমতাটা লুকাতে চাই। অথবা এ ব্যাপারটা ধরতে ব্যর্থ হই।
‘মাছের ঝোল’ দেখতে দেখতে ভালো লাগালাগির ভেতর এই খচখচ ছিল। ‘ওস্তাদ হোটেল’ সেদিক থেকে খচখচানি কিছুটা কমায়। এ সিনেমা বড় অর্থে ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের জটিলতাকে মীমাংসা করতে গিয়ে অনেক মানুষের জীবনে, স্বপ্নে কড়া নাড়ে। অনেক মানুষ, সমাজ বা বৃহত্তর আখ্যানের মাঝে নিজেরে আবিষ্কার করে। সেখানে ব্যক্তির মুক্তি আসলে কই- স্রেফ ভালো ‘শেফ’ আর যা যা হতে চাওয়া তা নয়! আরও বেশি কিছু। হ্যাঁ, এতদূর যাওয়া হয়তো কঠিন। এটার একটা প্রেক্ষিত হয়তো দরকার। আমার মনে হয় কলকাতা আর কেরালার স্পিরিটগুলা এভাবে আলাদা করা যায়। মানে তারা কে কী চর্চা করছে।