নোয়া: ইচ্ছার স্বাধীনতা নাকি স্বেচ্ছাচার?

ড্যারেন অ্যারোনোফস্কি পরিচালিত ও রাসেল ক্রো অভিনীত ‘নোয়া’ এ বছরের আলোচিত মুভিগুলোর একটি। মূলত নবী নূহ (আ.)-এর কাহিনী নিয়ে নির্মিত হওয়ায় প্রথম থেকেই এ মুভি আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। মুসলিম প্রধান বেশ কটি দেশে নিষিদ্ধও হয়েছে। কিন্তু মুক্তির পর দর্শক পছন্দের দিক থেকে পিছিয়ে থাকে। সেটা নির্মাণের প্রসঙ্গ, এখানকার আলোচনা তা নয়। সম্প্রতি মুভিখান দেখা হলো। এ মুভিতে একটা কথা বারবার আছে ‘খোদা তায়ালা মানুষকে তার আপন সুরতে বানাইছেন’। যে কথা সেমেটিক ধর্মগুলোর এজমালি প্রিমাইজের অন্যতম। সেকুলার কায়দা বলতে চাইলে- এটা অ্যানথ্রোমরফিক ধারণা নিয়ে নির্মিত। সে কায়দার করসত আপাতত না করি। মুভির শেষে মনে হলো ‘আপন সুরত’ মানে ‘খোদা তায়ালার ইচ্ছা’। অর্থাৎ তিনি মানুষরে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিছেন (কতটা সেটা অন্য তর্ক)। তবে কি মানুষের মধ্যে এই বুঝটা আনার জন্যই মহাবানের দরকার পড়ে!

নোয়া (রাসেল ক্রো)

নোয়া (রাসেল ক্রো)

মোটামুটি এ কথাগুলো ফেসবুকে শেয়ার করার পর একজন মন্তব্য করেন- ‘সুরত’ কোন্‌ আরবি শব্দের অর্থ কিনা জানি না, তবে একই লাইন অনেক জায়গাতে বলা হইছে ‘আদলে’, অর্থাৎ মানুষকে খোদার আদলে বানান হইছে। আদল মানে তো বুঝি অবয়ব, কিন্তু খোদার মতো দেখতে তো হইতে পারে না, তবে কি তার মতো চিন্তা ভাবনার অধিকারী মানুষ? নাকি সে একদিন নিজেকে খোদার লেভেলে নিয়ে যাবে? যাতে অসাধ্য কিছুই থাকবে না। বোধকরি এ বিষয়গুলোর জন্য সবসময় আল্লাহ নিয়ে তর্কের ক্ষেত্রে অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা খাড়া থাকে।

কিন্তু যে কোনো অর্থে এ প্রশ্নগুলো ইন্টারেস্টিং। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও পুরানা কিছু বিবাদ তুলে আনে। এ প্রসঙ্গে আমার জানাশুনা কম। তবুও কিছু অনুমান শেয়ার করি এবং শেষে একটা দীর্ঘ রেফারেন্স দেব। বলে রাখা ভালো, ইচ্ছার স্বাধীনতার তর্কটি আরো অনেকগুলো জটিল বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। শুভ-অশুভ, সত্য-মিথ্যার বাইনারি যুদ্ধ, মন্দের সমস্যা জাতীয় ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক (অবশ্য ধর্মতত্ত্ব থেকে রাজনীতি আলাদা করা যায় না) বাহাস থেকে শুরু করে কার্যকারণতত্ত্ব, মনোদর্শন ও নিউরোসায়েন্সসহ আরো অনেক কিছুর সঙ্গে ইচ্ছার স্বাধীনতার ধারণা জড়িয়ে আছে। এমন দাবি বাচালতা নয় যে, ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি কোনো সমাজ-সভ্যতা-মতাদর্শকে বুঝার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। নোয়া চলচ্চিত্রের প্রেক্ষিতে আমাদের কৌতুহলের বিষয়- ইচ্ছার পূর্ণ স্বাধীনতা, স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়ার ক্ষমতা না এখতিয়ারের বিষয়। আমাদের আলোচনা অবশ্য ততদূর আগাবে না। আমরা নোয়ার হাত ধরে সামান্য কিছু বিষয়েই আলোচনা করব।

শুরু করা যাক ‘সুরত’ শব্দটি দিয়ে। বিখ্যাত সেই আয়াতটি পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারায় আছে। আছে জেনেসিস ১: ২৭’তে। তবে এখানে আমি আক্ষরিকভাবে ব্যবহার করি নাই। একটু বিস্তৃত অর্থে; আমার ভূমিকাও ধর্মতাত্ত্বিকের নাএবং এখানকার রেফারেন্স অনেকটা ইসলামের দিক থেকে। যাইহোক মুভিতে শব্দটা ছিল ইমেজ। তবে ইমেজ, সুরত বা আদল যাই হোক, এটা কি আক্ষরিক কোনো বিষয়? যেমন- ইসলামে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হওয়ার কথা আছে। এটা গুণ বা সিফাতের বিষয়। আল্লাহর ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশকালের অধীন বিষয়ের মতো অস্তিত্ববাচক ধারণা খাটে না। তবে যে কোনো অর্থে অস্তিত্ব ধারণাটি আসলেও- অস্তিত্ব আর গুণ একাকার কোনো বিষয় নয়। তাই গুণ সেটা কিছু অর্থে ধারণ করা যায়। তবে আল্লাহর মতো নয়। তার মতো হয়ে ওঠার দাবি শিরক। যা ইসলাম নাকচ করে দেয়। একইসঙ্গে আল্লাহর সংজ্ঞার দিক থেকে তার রঙ পুরোপুরি ধারণ সম্ভব নয়। তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। বিশেষ করে মানুষের মর্যাদা ও কর্মগুণের দিক থেকে। যদিও সেখানে তার গুণ ধারণ করা এক ধরনের সসীম চেষ্টা। যা আবার সব গুণের প্রতিনিধিত্ব নাও করতে পারে। একটা সময়ে একটা ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে হয়তোবা। এখানে কোনো একটা সময়ে ইচ্ছাটাই মুখ্য হয়ে উঠতে পারে।

নোয়ার নৌকায় আশ্রয় নিচ্ছে সরীসৃপ

নোয়ার নৌকায় আশ্রয় নিচ্ছে সরীসৃপ

এখানে বলে রাখা ভালো নোয়া মুভির কাহিনীর সঙ্গে কুরআনে নূহ (আ.) সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে মেলে না। ছোট্ট উদাহরণ- শুধু নূহের স্ত্রী, তিন সন্তান ও এক ছেলের বউয়ের নৌকায় আশ্রয় নেন, কুরআনে আছে অন্য কথা। মজার বিষয় হলো আদি ‘অজাচার’ নূহের নতুন পৃথিবীতে খাটে। কারণ এখানে ভবিষ্যতে সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো তিনজন নারী থাকে। শামের বউ ইলা ও তার শিশু দুই মেয়ে। নূহের ছেলে হ্যাম দেশান্তরী হন। তাই থাকে শাম ও অপর ভাই। এবং ইলার ভবিষ্যত সন্তান। এটাও খুব ইন্টারেস্টিং বিষয়। ইসলামে বলা হয় নূহের কিছু শিষ্য নৌকায় স্থান পায়। নূহ (আ.)-এর আরেক ছেলেরও উল্লেখ আছে। কুরআন বলা হয়, নূহের অনুসরণকারীদের সম্পর্কে সে কালের অবিশ্বাসীরা বলত তারা কমজ্ঞানী মানুষ। যা ধার্মিকতা নিয়ে এখনও বিদ্যমান।

‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’ হয়তো মুভির মূল বিষয় না। কিন্তু এটাই আমার কাছে মজার বিষয় মনে হইছে। খেয়াল করার বিষয় হলো দুনিয়ার প্রাণীকূলকে বাঁচানোর জন্য নোয়াকে স্রষ্টা বাছাই করছেন। বিষয়টি নানাভাবে তার স্বপ্নে ধরা দেয়। তিনি ধরে নেন তার পরিবারের কম বয়সী সদস্যের মৃত্যুর পর পৃথিবীতে কোনো মানুষ থাকবে না। এটা হলো নাফরমান মানুষের ভবিতব্য। কিন্তু সমস্যা বাধে যখন নোয়ার দাদা মেথুসেলা শামের (সন্তান জন্মদানে অক্ষম) সঙ্গিনী ইলাকে সুস্থ করে তোলেন। যার কারণে সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম ইলা সক্ষম হয়ে উঠে। নোয়ার পক্ষে বন্যার কারনে পৃথিবীতে স্রষ্টার বিধান মেনে সকল মানুষকে মেরে ফেলা সহজ হয়। কিন্তু যখন জানতে পারেন ইলা গর্ভবতী তখন নতুন পরীক্ষায় পড়েন। ঠিক করেন ইলার ছেলে হলে বেঁচে থাকবে। কিন্তু মেয়ে হলে মেরে ফেলা হবে। কেননা, মেয়ে মানে আবার সন্তান জন্ম। আবার নাফরমান বান্দার আবির্ভাব।

এখানেই নোয়ার মূল ক্রাইসিস। কিন্তু যে মুহূর্তে ইলার গর্ভধারণের বিষয়টি জানা গেলে তখনই ঝড় থেমে যায়। আবার শেষ মুহূর্তে নোয়া ছুরি হাতে গেলেও দুই নাতনিকে খুন করতে পারেন না। কারণ তার হৃদয় গভীর ভালবাসায় আর্দ্র হয়ে যায়। তখন দেখা যায় ভূমির সন্ধান পাওয়া পাখি মুখে পাতা নিয়ে ফিরতেছে। এদের খুন না করে তো তিনি স্রষ্টার ইচ্ছার অমান্য করলেন, দায়িত্বের বরখেলাপ করলেন। আরো একবার দেখা গেলে আপন সুরতে বানানো মানুষের মধ্যে যে কিনা তার মনোনীত বান্দা, সেও নাফরমান। এ দ্বন্দ্বে নোয়া পরিবার থেকে আলাদা হয়ে মদের নেশায় ডুবে থাকেন। একসময় ছেলেদের ডাকে ফিরে আসেন। তখন পাহাড়ের চূড়ায় পরিবারের পুনর্মিলন (হ্যাম এর আগে নিরুদ্দেশ হয়। যে কিনা মানুষবিহীন পৃথিবীতে কেনানবাসীর পিতা হবেন) ঘটে। তখন ইলা যা বলে তা অনেকটা এ রকম, তার দুই সন্তান হলো একদম নতুন পরিস্থিতি। কারণ যে ধ্বংসের কথা এতদিন বলা হচ্ছিল, তাতে এরা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এটা ছিল নোয়ার প্রতি স্রষ্টার পরীক্ষা- কোনটা তিনি বেছে নেন। ব্যাপারটা এমন যে তার ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে মূল্যায়ন ও মানুষের মুক্তি। কথাটা নোয়া অনুমোদন করে। নোয়া কথাটা মেনে নেওয়ার পর আকাশে স্বর্গীয় জ্যোতি বা রামধনু খেলতে থাকে। এভাবে নোয়ার একটা স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে পৃথিবীতে আবারো মানবজাতির ভিত্তি রচিত হলো। হয়তো এ ইচ্ছাটাই স্রষ্টা দেখতে চান। তবে সে ইচ্ছা ঈশ্বর নিয়ন্ত্রণ করেন কিনা সেটা আরো গুরুতর প্রশ্ন। কি অর্থে করেন তাও। অথবা এ বেছে নেওয়ার বিষয়টাকে স্বাধীন ইচ্ছা (ইতিবাচক অর্থে) বা স্বেচ্ছাচার (নেতিবাচক অর্থে) কীভাবে বিবেচনা করা যায়?

খেয়াল করলে দেখবেন ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে কিনা- এটা একাধারে দর্শন ও ধর্মের এজমালি সমস্যা। এটি নিয়ে এন্তার কাজ হয়েছে। পশ্চিমা চিন্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মোড় হলেন রেনে দেকার্ত। তিনি জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তির জায়গা প্রতিষ্ঠা করেন এ কথার মাধ্যমে- আমি চিন্তা করি আমি তাই আছি। এটা আসলে মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে নিশ্চিত হওয়া। তবে এ চিন্তার সঙ্গে কাজের বিষয়টা যুক্ত তাও দরকারি আলোচনা। এ চিন্তা আসলে স্রষ্টার চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ারই ধারণা। দর্শনের জগতে এমনও ধারণা আছে- সবকিছু স্রষ্টার চিন্তার মধ্যে আছে, কিন্তু তিনি কোনো অ্যাক্ট করেন না। কারণ পুরো বিষয়টা কার্যকারণের সঙ্গেও যুক্ত। একই বিষয় ইমাম গাজালির ক্ষেত্রেও দেখা যায়। একই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে তিনিও পড়েন। তিনিও দেকার্তের মতো মানুষের অস্তিত্বে নিশ্চিত হতে চান। তার সূত্র হলো, আমি ইচ্ছা করি তাই আমি আছি। এ ইচ্ছার সঙ্গে যুক্ত করেন স্রষ্টার গুণ, ইচ্ছা। অর্থাৎ, ‘কুন’ বা হও মানে হয়ে যাওয়া। গাজালি কার্যকারণের দিক থেকে দেকার্তের উল্টা। তিনি মনে করতেন কার্যকারণ বলে কিছু নাই। বরং স্রষ্টা যা করেন তাই ঘটে। অর্থাৎ কিছু করার ইচ্ছাটা প্রধান। মানুষের গুণের মধ্যে এটাই মুখ্য। যেহেতু চিন্তার মতো এটা কার্যকারণবাদের সঙ্গে যুক্ত না। তাই ইচ্ছা নিজেই কাজ হতে চায়। কিন্তু আল্লাহর সার্বভৌমকে তিনি হাজির করলেও শেষ পর্যন্ত তা মানুষের ক্ষেত্রে বেশ সৃজনশীলভাবে প্রযোগ হয়ে শেষ বিচারে অদৃষ্টবাদে রূপান্তরিত হয়।

এখানে নোয়ার কাহিনীর ভিত্তিগত লেভেলটা আমার কাছে পরিষ্কার না। যেহেতু জেনেসিস আমার পড়া নাই। কিন্তু নতুন পরিস্থিতি তৈরি করে নোয়ার ইচ্ছাশক্তির পরীক্ষা নেওয়াটা আমার ইন্টারেস্টিং মনে হইছে। এমনকি মানুষের ক্রিয়েটিভি অর্থে। এখন প্রশ্ন হলো এতে মানুষ স্বেচ্ছাচারী হয়ে যাবে কিনা। এটা নিয়ে মেলা তত্ত্ব আছে। সে স্কলাস্টিক যুগ থেকে সেটা চলতেছে। যেমন- কুরআনে আছে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না আবার এও আছে মানুষ কর্মফলের জন্য শান্তি ও শাস্তি লাভ করবে।

নোয়ার নৌকা

নোয়ার নৌকা

আবারও পুরানা প্রশ্নের স্মরণ নেওয়া যাক। আল্লাহর গুণ থেকে পাওয়া ইচ্ছার স্বাধীনতা কেন যা ইচ্ছা করার স্বাধীনতা* বা স্বেচ্ছাচারিতা হবে না? আল্লাহর গুণ বলতে আমরা অশুভ (আমার তো ক্যাটাগরাইজ করে কথা বলি) কিছু ভাবি না। ফলে ইচ্ছার স্বাধীনতা নামে যা ইচ্ছা করা যাবে- এমন না। বরং, শুভ ইচ্ছাই হবে তার গুণের প্রতিফলন। এ ছাড়া একটা কথা আছে না- কখনও কখনও মানুষের হাত আল্লাহর হাত হয়ে যায়!

মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টা কি অসীম ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার বা অসাধ্য কিছু না থাকা? এ বিষয়ে একটা মজার থিওরি আছে। বইপত্র কাছে না থাকায় নাম উল্লেখ করতে পারছি না। বিষয়টা হলো মাত্রাগত ও ভিন্ন ভিন্ন স্তরের। মানুষকে কোনো কিছুর মাঝামাঝি ধরেন। যেমন- তার একটা গুণ ‘দয়া’  । আপনি যখন দয়াবান কথাটা বলেন- আসলে মানুষের মধ্যে থাকা একটা গুণ চিন্তা করেন। এখন যদি বলেন- ডলফিনের মধ্যে দয়ামায়া আছে। তাইলে আপনি কিন্তু ডলফিনের দয়াকে মানুষের দয়ার চেয়ে নিম্নস্তরের  মেনে নিয়েই বলেন। আবার যখন আল্লাহ দয়ালু বলেন। তখন আপনি উচ্চস্তরের একটা কিছু চিন্তা করেন। যা মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব না। তবে এর ছিটেফোটা বা  যৎসামান্য প্রতিফলন মানুষের মধ্যে থাকতে পারে। ফলে আল্লাহর রঙ ধারণ করার বিষয়টা যুক্তিগতভাবে এমনই হয়ত। ইচ্ছার বিষয়টা এ কারণে স্রষ্টার গুণ অর্থে স্বেচ্ছাচার বা অসীম অর্থে অনুবাদ করা যায় না।

পুরো বিষয়টা নিয়ে কিছু রেফারেন্সে যাব একদম শেষে। এখন এইটুকু তো বলা হয়, বিশ্বাস সিস্টেমের বাইরে গিয়া চিন্তা করলে, শুধু দাসত্ব বিষয়টা নৈরাশ্যেরও বটে! কিন্তু চিন্তা করেন দাসত্ব এখানে অবাধ্যতারও প্রতীক (বেহেশতে গন্দম খাওয়ার ঘটনা)। মানুষ দাসে পরিণত হয়েছে, কারণ গন্দম খেয়ে মানুষ বেহেশতে দোষ করছে। কিন্তু এর থেকে মুক্তি কোথায়? সেটা স্রষ্টার গুণ ধারণে। যা আবার গুণ, যা কিনা আগের দোষের বিপরীত অর্থে। ফলে স্রষ্টার গুণের নিজেকে রাঙানোর প্রথম কাজ হলো- আগের গুনাহ কাটানো।

কারণ সিনেমায় ভিলেনও বলছে, যেহেতু সে স্রষ্টার ইমেজে তৈরি, তাই দুনিয়ায় সে যা ইচ্ছা করতে পারে। সবকিছু তার জন্য তৈরি, ইচ্ছা মতো ভোগ করতে পারে। অথচ এ দাবি কিন্তু স্রষ্টার আদেশ পালনের ভিতর দিয়ে ঘটছে না।

এবার আরেকটা দিক দেখা যাক। স্বর্গে আদম-হাওয়ার জন্য শর্ত ছিল এটা করতে পারে সেটা করতে পারে (হয়তো ইচ্ছার স্বাধীনতা অর্থে), কিন্তু ওই গাছের ফল খেতে পারবে না। এটা কিন্তু স্বাধীনতার প্রশ্ন না, কেন না সে চাইলে আদেশ না মেনে খাইতে পারে। বরং, সে এটা করতে পারে কিনা সে প্রশ্ন।

আল কুরআন বলছে, এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং ওখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাক, কিন্তু এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। অন্যথায় তোমরা যালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়বে। (বাকারা, ৩৫)

যার একটা অর্থ হতে পারে, আসলে তার এ কাজ করার এখতিয়ার আছে কিনা। যদি না থাকে তবে তার অধঃপতন  ঘটে। এখানে ব্যাপারটা যত না আদমের কোনো ধরনের স্বাধীনতা ছিল, তার চেয়ে বড় ব্যাপার আসলে আদম কি করতে পারবে আর পারবে না। নিষেধ অমান্য করারে সবসময় স্বাধীনতা হিসেবে দেখলে সমস্যা। ফলে স্রষ্টার সুরত পাওয়া নোয়ার সামনে শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন হলো- এ সুরত পাওয়ারে কেমন বিচার করবে। এখানে মনে হইছে- সিনেমার ইন্টারপ্রিটেশন ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রশ্নে। এ ইচ্ছা শুভ ইচ্ছা। যেহেতু স্রষ্টার কোনো গুণের সঙ্গে অশুভ ব্যাপার জড়িত নাই। অন্যভাবে দেখলে স্রষ্টা মানুষের ইচ্ছা প্রকাশকে কোন পর্যন্ত গুরুত্ব দেন। তাইলে ইচ্ছার স্বাধীনতারে শুধু ইচ্ছা-স্বাধীনতা এ সরল বাক্য আকারে নেওয়া যায় না হয়তো। এর আরো গভীর মাজেজা থাকতে পারে।

*মুসলমানদের মধ্যে ইচ্ছার স্বাধীনতা নিয়ে প্রথম কাজ করেন হাসান আল বাসরী (৬৪২-৭২৮। তিনি ইচ্ছার পূর্ণ স্বাধীনতার ধারণা  নয়, কাজ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন। এ বিষয়টি তার সমকালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। সে সূত্রে জাবারিয়া, কাদারিয়া, আশারিয়া ও মুতাজিলাসহ কোনো কোনো  চিন্তাগোষ্ঠী এ বিষয়ে অবদান রাখেন।

সংযোজন:

এবার বিশাল কিছু কোটেশন দিব আমাদের শিক্ষক ড. মুঈনুদ্দীন আহমেদ খানের ‌‘ইসলামে দর্শন চিন্তার পটভূমি’ থেকে (ওয়ার্ড ফাইল থেকে, তাই পৃষ্ঠা নাম্বার উল্লেখ করা গেল না)। এর আগে বলে রাখা ভালো তার অধীনে ‌‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’ বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন ড. বদিউর রহমান। এ ছাড়া বদিউর রহমান স্যারের বই আছে হযরত হাসান বসরী (রা.)-এর ওপরে- যিনি ইসলামি চিন্তার ইতিহাসে ইচ্ছার স্বাধীনতা নিয়ে প্রথম কাজ করেছেন। তার হাতে ধরেই মুসলমানদের মধ্যে দর্শনচিন্তার বিকাশ। এ ছাড়া বদিউর রহমান স্যারের ‘মুসলিম দর্শনের ইতিহাস’ বইয়ে এ বিষয়ে অনেক আলাপ আছে।

. মুঈনুদ্দীন আহমদ খানের বই থেকে কোটেশন

১. “তাই গ্রীকদের মনে যেমন প্রশ্ন জেগেছিল: বিশ্বজগত কোথা থেকে অস্তিত্বে এলো, কি উপাদান দিয়ে এ বিশ্ব তৈরি? তদ্রূপ মুসলমানদের মনেও প্রশ্ন জেগেছিল: জীবন ছাড়া যেমন মানুষের চিন্তা করা যায় না, তেমনি স্বাধীনতা ছাড়াও মানবিক জীবনের চিন্তা করা যায় না, তেমনি স্বাধীনতার অর্থ ও তাৎপর্য কি? মানুষের চিন্তা ও কর্মের মধ্যে স্বাধীনতার পরিসর কতটুকু? মানুষের ইহজাগতিক দায়িত্ব ও পরকালীন কর্মফল ভোগের সাথে স্বাধীনতার কী সম্পর্ক? এ সব প্রশ্নের উত্তরে ইসলামের প্রথম যুগে তিনটি পরস্পরবিরোধী মতবাদের উদয় হয়। এগুলোর নাম (ক) জবরিয়া (খ) কাদরিয়া ও (গ) মরযিয়া অর্থাৎ (ক) জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতাবাদ, (খ) সক্ষমতা বা মুক্তবুদ্ধিবাদ এবং (গ) সিদ্ধান্ত স্থগিতবাদ বা ভরসাবাদ।’

২.“মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে মানবিক জীবনের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ ও উদগ্রীব, মানব জীবনের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা প্রশ্নের সাথে জড়িত ছিল। প্রশ্ন ছিল – অন্যান্য জীবজন্তুর মতই মানব জীবনও কি প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের অধীন? না এর ব্যক্তিক্রমে স্বাধীন ক্ষমতাসম্পন্ন?”

৩.“খ্রিস্টান থিওলজীর প্রথম ও প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল-মানুষের ইচ্ছা ও কর্ম-স্বাধীনতা বনাম বিধাতার বিধিলিপি। এক কথায় মুক্তবুদ্ধি বনাম বিধিলিপি। এই প্রশ্নে, খ্রিস্টান দার্শনিকেরা নব-প্লেটোবাদের সাহায্যে মানুষের চিন্তা ও কর্ম স্বাধীনতা অর্থাৎ মুক্তবুদ্ধির প্রতিপ্রাদ্য প্রমাণ করতে চেষ্টিত হয়। উমাইয়া খিলাফাতের প্রথম যুগে সেইন্ট জন অব ডেমাসকাস এবং তাঁর শিষ্য হাররান-এর বিশপ থিউডোর আবুকারা এহেন খ্রিস্ট মুক্তবুদ্ধিবাদী দর্শনের হোতা এবং স্তন্ত ছিলেন। ভন ক্রেমার-এর মত প্রাচ্যবিদ মহা-পণ্ডিতরা এতে স্থির নিশ্চিত যে ইসলামী ঐতিহ্যের প্রাথমিক যুগে কিছু সংখ্যক ইরানী ও আরব মুসলিম চিন্তাবিদ এদের চুলচেরা বিতর্ক পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে জবরিয়া, কাদরিয়া ও মরযিয়াবাদের উদ্ভাবন করেছিলেন”।

৪. “কাদা ও কদর তথা কাষা ও কদর: উল্লেখযোগ্য যে, হিজরী প্রথম শতাব্দীর মধ্যভাগে হাসান আল বসরী, হযরত আলীর জ্যৈষ্ঠপুত্র ইমাম হাসান, রাদি আল্লাহ আনহুর নিকট চিঠি লিখে কাদা ওয়া-কদর (কাযা ও কদর) অর্থাৎ আল্লাহর বিধান ও ক্ষমতা সম্বন্ধে তাঁর মতামত জানতে চান। পরবর্তীকালে উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক, ইমাম হাসান আল-বসরীকে “কাদা ওয়া-কদর” সম্বন্ধে তাঁর মতবাদ বিশ্লেষণ করতে অনুরোধ করেন এবং খলীফার নিকট তিনি লিখিতভাবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা হাসান আল-বসরীর ‘রিসালা’ নামে পরিচিত।

ইমাম হাসানের চিঠির সারমর্ম হল: কদর অর্থ ক্ষমতা এবং সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর। অতএব, কাদা এর প্রেক্ষাপট হল কদর, ও কদর হল কাদার জুড়ি। তাই মুসলমানেরা ‘কাদা ওয়া-কদরে’’একসাথে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে কদর মানে মানুষের ক্ষমতাবাদ বা মুক্তবুদ্ধিবাদ নয় এবং কাদরিয়াবাদ, ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহর ক্ষমতাবাদকেই সুচিত করে এবং আল-কুরআন ও সুন্নাহর পরিপ্রেক্ষিতে ইহাকে কাদা ওয়া-কদরবাদ, অর্থাৎ বিধানও ক্ষমতাবাদ বলাই সমীচীন। ইহাতে বিশ্বাস করা মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

হাসান আল-বসরীর বক্তব্যে সারমর্ম হলো: যেহেতু মানুষের চিন্তা ও কর্মস্বাধীনতার উদ্ভব আল্লাহর কাদা ও কদর থেকে হয়। তাই কাদা ওয়া-কদরবাদ বললেই মানুষের স্বাধীনতা তথা মানুষের ‘ইখতিয়ার’ বা ‘সক্ষমতা’’এতে প্রচ্ছন্ন থাকে। তাই আল্লাহর দিক থেকে যা ‘কদরবাদ, মানুষের দিক থেকে যা ‘কদরবাদ, মানুষের দিক থেকে ‘ইখতিয়ারবাদ’। অতএব হাসান আল-বসরী ‘আল্লাহর ক্ষমতাবাদ’ অর্থে ‘কাদরিয়া’ ছিলেন। ইহার মর্ম মানুষের মুক্তবুদ্ধিবাদ নয়, বরং মানুষের ‘ইখতিয়ারবাদ’। সুতরাং হাসান আল-বসরীর ‘কাদা ওয়া-কদরবাদ’ তথা ইখতিয়ারবাদ ইমাম হাসান রাদি আল্লাহু আনহুএর কাদা ওয়া-কদরবাদের বিশ্লেষণ মাত্র ছিল। ইহা কোনো নতুন সূত্র ছিল না।

এর বিশ্লেষণে আমরা বলতে পারি যে, আল্লাহ যখন কাদা বা ‘বিধি-বিধান’ করে দেন, তখন তা একটি বিশ্বজনীন, সুবিন্যস্ত সুশৃঙ্খল ও অলঙ্ঘনীয় বিধি-ব্যবস্থায় পরিণত হয়। ইহাকে চোখ বন্ধ করে মান্য করা ছাড়া হেরফের করার কারো কোনো শক্তি থাকে না। একে আমরা ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়তে পারে না। সবকিছু নিয়মের অধীনে থাকে। ইহা আল্লাহর শক্তির প্রতীক। আল্লাহ সর্বশক্তিমান।

কিন্তু আল্লাহ, যেমন শক্তিশালী, তেমনি ক্ষমতাবান। আল্লাহই নিজ কদর বা ক্ষমতাবলে যাকে ইচ্ছা তাকে হেরফের করার স্বাধীনতাও প্রদান করতে পারেন। আল্লাহ মানুষকে এইরূপ যে স্বাধীনতা প্রদান করেছেন, তা ব্যবহার করে মানুষ ভালমন্দ নিরিখ করতে পারে এবং নিজ ইচ্ছায় ভালমন্দের মাঠে বিচরণ করে নিজ স্বাধীন শক্তিবলে ভাল অথবা মন্দ কর্ম সম্পাদন করতে পারে।

আল-কুরআনের ভাষ্য, ‘তোমরা সেই প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা বর্ণনা কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন ও সুবিন্যস্ত করেছেন এবং যিনি কদর করেছেন ও সৎপথ প্রদর্শন করেছেন।’

এহেন নিরিখ বাছনী ও কর্ম সম্পাদনের মধ্যে যতটুকু স্বাধীনতা মানুষের রয়েছে যে অনুপাতে উক্ত কর্ম ও ইহার ফলাফলের দায়িত্বও সে বহন করে এরূপ দায়িত্ব সম্বলিত স্বাধীনতাকে ইখতিযার বলা হয়। মানুষের এহেন ‘ইখতিয়ার’ আল্লাহর কদর থেকে উৎসারিত হয়। অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতাবলে মানুষ ‘ইখতিয়ার’ লাভ করেছে। আমরা কথায় বলিঃ ‘আল্লাহর বলে হেঁইা’। এ কথায়, আল্লাহর বিধানের সঙ্গে আল্লাহর ক্ষমতা যেমন জড়িত, আল্লাহ ক্ষমতার সাথে মানুষের ইখতিয়ারও তেমনি জড়িত।’

*লেখাটি সাহিত্য বিষয়ক অনলাইন প্রতিপক্ষে পূর্ব প্রকাশিত।

Comments

comments

Comments are closed.