আহমদ ছফার ‘সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস’ বইয়ের পরিচায়িকা অংশ থেকে কিছু অংশ পাঠ করা যাক। এই পরিচায়িকাটি লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার।
‘সমগ্র ভারতে এবং পাকিস্তানের অংশ বিশেষে ১৯৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ শতবার্ষিকী পালন করা হয়েছিল, ঘটনাবহুল সভা-সমিতি ও উৎসবানুষ্ঠানের মাধ্যমে। তখন বহু ঐতিহাসিক সিপাহি যুদ্ধের বিভিন্ন দিকের উপর আলোকপাত করে জনপ্রিয় ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ও বই-পত্র লিখেছিলেন শত বার্ষিকীর বছরটিকে উজ্জ্বলভাবে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে। তাদের মধ্যে অনেকের ধারণা ছিল, সিপাহি যুদ্ধ ছিল ভারতবাসীদের জন্য একটি ব্যাপক স্বাধীনতা সংগ্রাম অথবা একটি সুসংহত জাতীয় আন্দোলন। অন্য এক দল ঐতিহাসিকের মতে, এই বিদ্রোহ মূলত এটি সাময়িক অভ্যুত্থান, নতুন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার আওতায় এসে যাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছিল, সেই অপরিতৃপ্ত রাজা, মহারাজা ও জমিদার শ্রেণী এই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ অথবা শ্রেণী স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিলেন। পরস্পর বিরোধী এসব মতামতের যথার্থ বিচার না করেও বলতে চাই, তখন আমার মনে হয়েছিল [এবং এখনো মনে হয়] উপরোক্ত দুই ধরণের অভিমতের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মানসিকতা প্রশ্রয় পেয়েছিল; নইলে উপমহাদেশের খ্যাতনামা ঐতিহাসিকগণ বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদে এবং বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশে সিপাই যুদ্ধ সম্বন্ধে মতামত প্রকাশের জন্য অতটা আগ্রহ কেন দেখিয়েছিলেন? ইংরেজ শাসন অবসানের মাত্র দশ বছর পর ঐতিহাসিকদের তরফ থেকে ঐ ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়তবা স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছিলাম যে, তখনকার দিনের পূর্ব-পাকিস্তানে সিপাহি বিদ্রোহের ওপর কোন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বা প্রবন্ধ লেখা হয়নি’। প্রফেসর তরফদারের এই আকুতি শুধু সিপাহি বিপ্লবের ইতিহাস নিয়ে নয়। তিনি একইভাবে আক্ষেপ জানান ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোন কাজ না হওয়ার।
ইংরেজ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সিপাহিরা ১৮৫৭ সালের ১০ মে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে মূল ভূমিকা পালন করে। যা স্ফুলিঙের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করে। কিন্তু এর মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা। লক্ষ্যণীয় বিষয়, যেটাকে সাধারণত সিপাহি বিদ্রোহ বা বিপ্লব বলা হয়, সেটাকে আহমদ ছফা বলছেন সিপাহি যুদ্ধ। তিনি কোন মহিমা আরোপের দিকে যান নাই। এর বলাবলির মধ্য দিয়ে বাস্তব অবস্থাকে বিবেচনা এবং পুনর্বিবেচনার বিষয় নিশ্চিত আছে। কোন গৌরবের মধ্যে না যাওয়ায়, এতে ইতিহাসের এক ধরণের নৈব্যক্তিক পর্যালোচনাও উপস্থিত। আহমদ ছফা এই বইটি লিখেছিলেন ১৯৬৩ সালের দিকে। যাকে তিনি প্রথম যৌবনের অপরাধ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। প্রথমে নানা কারনে ও পরে তার অনাগ্রহের কারণের অবসান ঘটিয়ে প্রায় ষোল বছর [১৯৭৯ সাল] পর বইটি প্রকাশ হয়। কলকাতার একটি সংস্করণ ও বর্তমান সংস্করণসহ এই বইটি পাচেঁর অধিক বার মুদ্রিত হয়েছে।
দার্শনিক ফরহাদ মজহার চিন্তা পাঠচক্রের আলোচনায় বলেছিলেন,’একাত্তর সালে পাকিস্তানীরা মনে করতো [পূর্ব বঙ্গের মানুষ সম্পর্কে] এরা মুসলমান, বাঙ্গালী না। আর ইন্ডিয়ানরা মনে করতো এরা মুসলমান না বরং বাঙ্গালী। এই দুইয়ের মধ্য দিয়ে এখানে একাত্তর পরবর্তী যে রাজনীতি গড়ে উঠেছে এটাই তো বড় বিপজ্জনক। একাত্তরে এখানকার জনগণ যে স্পিরিট নিয়ে লড়াই করে যে বিপ্লবটা করে ফেলেছে এর কোনো বয়ান নাই। কোনো কর্তাসত্ত্বা এর ভিত্তিতে বিকশিত হয়নি। এখানকার যারা ভার্সিটিতে পড়ে তাদের ক’জনের আগ্রহ আছে, এখানে যে ১৮৫৭ সালে আজকের বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে শুরু করে বর্তমান রিং রোড [শ্যামলী] পর্যন্ত হাজার হাজার সৈনিক আর স্বাধীনতাকামীদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো সেটা নিয়ে স্টাডি করার, ভাববার? নাথিং! সেই ইতিহাস তাদের কজনকে নাড়া দেবে বলা মুশকিল। আহমদ ছফাকে সেটা নাড়া দিয়েছিলো। তাই তাকে সিপাহি বিদ্রোহের ইতিহাস লিখতে হয়েছিলো’।
১৯৯৬ সালে বইটির তৃতীয় সংস্করনের ভূমিকায় আহমদ ছফা নিশ্চিত করে বলেন, বাহাদুর শাহ থেকে শুরু যতো রাজা-মহারাজা এই যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন, ‘তারা পরাজিত হবার জন্যই লড়াই করেছিলেন’। সেটা যেমন তাদের মনন একই সাথে কৌশলের সমস্যাও বটে। এই পর্যবেক্ষণ ঐতিহাসিক বিকাশ এবং রাষ্ট্র-সমাজের টিকে থাকার গতিশীল অবস্থান দিয়েই বুঝতে হবে। শুধুমাত্র অতীত বা হারানোর কাতরতা দিয়ে নয়। তিনি বলছেন, ‘ সিপাহি যুদ্ধের নায়কদের একের পর এক পরাজয়ের করুণ স্মৃতি মনকে বেদনা-ভারাক্রান্ত করে একথা সত্য বটে, কিন্তু এ সামন্তদের থেকে শ্রদ্ধা করার মত একজন মানুষকেও খুজে পাওয়া যাবে না একজন ব্যতিক্রম ছাড়া’। তার এই পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। কেন না তিনি এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে আবেগ দিয়ে বিচার করছেন না। বরং, তার সময়ে এসে একটি রাষ্ট্র কি করে হয়ে উঠে বা কোন কোন শক্তির বলে টিকে থাকে সে বিচারে গেছেন। তিনি যাকে ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি হলেন মহীশুরের টিপু সুলতান। কারণ ব্রিটিশদের মোকাবেলা করার মতো মানসিক ও সামরিক শক্তি একমাত্র তারই ছিলো।
এই বইয়ে তিনি একই সাথে ব্রিটিশ দ্বারা এই অঞ্চলের শাসন কাঠামো , মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে কি কি গুণগত পরিবর্তন ঘটেছিলো সেই আলোচনাও করেছেন। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়- হিন্দু-মুসলিম সমাজের ভেতরকাল আশরাফ-আতরাফ বিভেদ। ইংরেজদের ‘সকলে সমান’ এই ধরণের বিধির মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে কি ধরণের প্রতিক্রিয়া পরবর্তীতে তৈরি হয়, এবং পরবর্তী শিক্ষিত-আধুনিক হয়ে উঠার যে প্রবণতা তার মধ্য দিয়ে সমাজের পরিবর্তন সহজে অনুমান করা যায়।
প্রফেসর মমতাজুর রহমার তরফদারের আক্ষেপ হয়তো একজন আহমদ ছফা কিছুটা পূরণ করেছিলেন। প্রতিটি প্রজম্মেরই লাগে ইতিহাসের পর্যালোচনা। সেই পর্যালোচনা দ্বারা তারা ভভিষ্যতকে নির্মাণ করবে। কিন্তু ছফা পরবর্তী সময়ে এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও আমরা কোনো ধরণের পর্যালোচনামূলক পাঠ পাই না। সব সংগ্রামকে শুধুমাত্র ইতিহাস বলে পাঠ করার মধ্য দিয়ে কোন লাভ হয় না। ছফা বিলকুল তা জানতেন। তিনি জানতেন এর নির্যাস চুষে ভবিষ্যত নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে হয়। এর মধ্যে আছে নিজেকে ও নিজের জাতির হিম্মত বুঝার তাখত আছে। সেই দায় সব প্রজম্মের। সেটা বুদ্ধিতে আবার গায়ে-গতরেও বটে। পুরোপুরি নাহলেও এই কাজটুকুতে ছফা তার প্রজম্মের দায় নিজ কাধেঁ তুলে নিয়েছিলেন। যদিও মাঠে-ময়দানে সেই পর্যালোচনার নগদ লাভ উসুল হয় নাই।
দুইশ আটারো পৃষ্ঠার বইটি মোট আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত। অধ্যায়গুলোর শিরোনাম- বিদ্রোহের কারণ বীজ, ঘটনা পরশ্পরা, এই যে দিল্লী-এই সে নগরী, কানপুর: ধাবমান দাবানল, অযোধ্যা: গজল কাননের অগ্নি গোধূলি, বিহার: ওহাবি সিপাহী যুগল সম্মিলন, মেরে ঝাসি নেহি দেওঙ্গি এবং অবনমিত রোহিলা ঝান্ডা। তিনি মোটামুটি সিপাহী যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত একটি ইতিহাস এই বইয়ে তুলে ধরেছেন। বইয়ের শেষে যোগ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের তালিকা ও নির্ঘন্ট। তিনি বিভিন্ন সময় লেখক শিবিরসহ নানা প্রতিষ্ঠানের পুরষ্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই বইয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছিল। এই বইকে উপলক্ষ্য করে দেয়া ১৯৮০ সালের ইতিহাস সমিতির পুরস্কারটি তিনি গ্রহন করেছিলেন।
এই বইয়ের উৎসর্গ পত্রে আহমদ ছফা লিখেছেন, পিতৃপ্রতীম বরিশালের উলানিয়ার পূণ্যশ্লোক মরহুম আরিফ চৌধুরী এবং অবহেলিত জ্ঞানসাধক, অজাতশত্রু ইতিহাসবেত্তা শ্রুতকীর্তি প্রফেসর আগা মাহদী হুসেইন এই দুই মহান ব্যক্তির পবিত্র স্মৃতি এই অপরিপাটি গ্রন্থের প্রতিটি অক্ষর।
> লেখাটি রাজনৈতিক.কম-এ পূর্ব প্রকাশিত।
> লেখাটির নতুনবার্তা লিংক: ছফা’র সিপাহি যুদ্ধ।
অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার ঠিকই বলেছেন, এই দেশে সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে যেমন কারো পড়াশুনার আগ্রহ দেখিনা তেমনি ভাষা আন্দোলন নিয়েও না। শুধু ভাষার মাস আসলেই আমাদের আকুতি বেড়ে যায় ফেব্রুয়ারী মাসকে ঘিরে!
আপনার সাথে একমত।
আহমদ ছফাকে যত জানছি ততই তার প্রতি শ্রদ্বা বেড়ে যাচ্ছে।
আসলেই।
চমৎকার লাগল এই লেখাটি। দুই বছর আগে রাজস্থানে চিত্তর গিয়েছিলাম – জেই জাগায়ে মুঘল দের সাথে লরাই করে এত বির রাজপুত জান দিয়েছিল সে জাগা গুলি তে গেলে গায়ে কাটা দেয়। ওখানে প্রতি পাথরে জেন ইতিহাসের স্মৃতি জুরে আছে।
ধন্যবাদ। শুভ কামনা।