অচিন মানুষের স্মরণে

সন্তানের মঙ্গল কামনায় মিয়া রাজি সাহেবের দরগায় আসা একজন। পেছনে মিয়া রাজির দরগা। বিশাল বটগাছে আছে রহস্যময় পাখি।

২০১১ সালের মার্চ মাসের কোন একদিন (বাংলায় ফাল্গুন মাস) হাজির হয়েছিলাম মিয়া রাজি সাহেবের দরগায়। তখন দরগা ঘিরে চলছিল মাসব্যাপী মেলা। মিয়া রাজি সাহেব রহস্যময় মানুষ। তিনি কে ছিলেন এটা কেউ জানে না। সম্প্রতি এ কে এম গিয়াস উদ্দিন মাহমুদের ‘নোয়াখালীর ওলি-দরবেশ’ নামে একটা বই কিনেছি। সেখানে অনেক ওলি দরবেশের কথা থাকলেও মিয়া রাজি সাহেবকে নিয়ে কিছু লেখা নাই। এমন হতে পারে তার ভক্তি-অনুরাগীরাও তার সম্পর্কে জানতে চায় না। সেই অচিন মানুষটিকে নিয়ে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও উদযাপন আমাকে বেশ আপ্লুত করেছিলো। এখানে যেন এক মানুষের অপরাপর মানুষের যোগসুত্র দেখেছিলাম। মনে কিছু প্রশ্নও জেগেছিলো। সেই অভিজ্ঞতাটি লিখেছিলাম রাজনৈতিক.কম-এ। আরেক ফাল্গুনে লেখাটি ইচ্ছাশূন্য মানুষে শেয়ার করলাম। আরেকটা কথা পরে জেনেছি- অনেকে মানত পূরণ করতে এই দরগার মাটি খান। এই রকম একজনকে আমি চিনি।

মিয়া রাজি সাহেব পরিচয়হীন মানুষ। কিন্তু তিনি অনেক চিন-পরিচয়ওয়ালা মানুষের আত্মার খোরাক। যখন সেই মিয়া রাজি সাহেবের দরগার সামনে দাঁড়ালাম, শহুরে অশ্রদ্ধা ভরা নফসটা কেমন যেন নড়া চড়া শুরু করে দেয়। অনেক বছর আগে মেলা উপলক্ষে এই দরগায় এসেছিলাম। সবাই দুটো হলুদ পাখির কথা বলছিল। পাখি দুটো মিয়া রাজি সাহেবের স্মরণের চিহ্ন। আমরা পাখি দুটোকে এক নজর দেখার জন্য নানা কসরত করছিলাম। মানুষের বগলের নিচ দিয়ে উঁকি-ঝুকি মারছিলাম। খুব খাটা খাটনি করলাম। অলৌকিক বিষয়ের প্রতি মানুষের অশেষ কৌতুহল যেমন হয় আর কি। চারদিকে গুঞ্জন, এই দিকে, না ওই দিকে। না, আমরা কেউ সেই রহস্যময় পাখির দেখা পাই নাই। শুধু শুনেছিলাম এই পাখিগুলোর নাকি বয়সের হাত-পা নাই।

এই মাজারটায় এক ধরনের শূন্য শূন্য ব্যাপার আছে। বিস্তীর্ণ ফসলী মাঠের মাঝখানে এই মাজার শরীফ। সেখানকার লোকজন বলে দরগা। এখানকার জমি উচুঁ হওয়ায় সারা বছর কোন না কোন ফসল হয়, প্রধানত- ধান। সবুজ প্রাণের মাঝে জেগে থাকে মিয়া রাজি সাহেবের দরগা। একপাশে কিছু বাড়ি আছে বটে। নোয়াখালী সদর থানার আবদুল্লাহ মিয়ার হাট থেকে কালা মুন্সী বাজারে যাবার পাকা সড়কের পাশে এই মাজারের মূল ফটক। রাস্তা থেকে একটা সরু পথ মাজারে এসে পৌঁছেছে। গ্রামে রাস্তার দুই পাশে গাছ-পালা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই মাজারের প্রবেশ পথ ব্যতিক্রম। তাই, বেড়ে উঠা ধান গাছের আড়ালে থাকে সেই দরগামুখী রাস্তা। মাজারকে দূর থেকে মনে হয়ে এক টুকরা দ্বীপ। যখন মাঠে ফসল থাকে না মাজারের চারপাশের ক্ষেত সহ সব মিলিয়ে পুরো পরিবেশের অবস্থা খুব রুক্ষ হয়ে ওঠে। একটা খাঁ খাঁ অবস্থা বিরাজ করে যেন। এছাড়া এই মাজার নিয়ে লোকজনের মাঝে ভীতি আছে। গত কয়েক বছরে এই মাজার এলাকায় অনেকগুলো খুন হয়েছে। কিছু ছিল রাজনৈতিক খুন। আর কিছু লাশের তো চিন পরিচয়ই পাওয়া যায় নাই। এই নিয়ে মানুষজনের মাঝে নানা কথার চল আছে।

তুলনামূলক উঁচু জমিগুলোতে আমন ধান কাটা হয়ে গেছে। রাস্তা ব্যবহার না করে ন্যাড়া জমির কোনাইচা পথ ধরে হাঁটা কমিয়ে নিলাম। তখন পাশের নিচু জমিগুলোতে ইরি-বোরোর চারা বেশ বড়ো হয়ে গেছে। সেইসব জমিতে পুকুরের পানি খালি করে সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই জমিগুলোতে বর্ষা থেকে শীতকাল পর্যন্ত পানি জমে থাকে। শীতকালে জমি শুকিয়ে এলে চাষ করা হয়। তাই জমির উচ্চতা ভেদে একই এলাকায় চাষাবাদের দুইরকম ব্যবস্থা জারি থাকে।

আমরা যখন মেলায় ঢুকলাম সকাল এগারোটা বাজে তখন। মেলার দোকানপাট সব খোলা হয় নাই তখনো। দুপুরের পর থেকে মেলা জমতে শুরু করে। রিকশায় করে একলোক মোড়া-মুড়কি নিয়ে আসল। এইগুলো সের-দরে বিক্রি হয়। বিক্রেতা কি যেন বলল। প্রথমে বুঝতে পারি নাই- আমাদের বলেছে কি না। পরে বুঝলাম বলছে, এই রাস্তায় রিকশা করে আসার নানা ঝামেলা। এই বলাবলিতে আগিলা-পরিচয়ের কোন বালাই নাই। গ্রামে সাধারণত কথা বলাবলি শুরু করার কেতাবি কোন ধরন নাই। যেকোন ভাবে কথা শুরু করা যায়।

নোয়াখালীতে ইদানিং মৃত পীরের চেয়ে জীবিত আধ্যাত্মিক গুণধারীদের প্রকোপ বেশি। মর্যাদাও বেশি। কিছু দিন পর পর এখানে অদ্ভূত গুণধারী ব্যক্তিদের আবির্ভাব ঘটে। আমরা যেসময় রাজি সাহেবের দরগায় গেলাম- তখন রাজগঞ্জের জনৈকা বোবা কিশোরীর অদ্ভূত ক্ষমতার গল্প চারদিকে মশহুর। সে কিশোরী জন্ম থেকে বোবা আর পঙ্গু। অদ্ভূতভাবে সে সুস্থ্ হয়ে ওঠে। লোকজনকে দোয়া পড়া ফল খেতে দেয়। এই ফল খেলে কিডনি রোগীরা ভালো হয়ে যায়। যদিও গঙ্গাপুর গ্রামের তিন জায়গায় তিন রকম গল্প শোনা গেল। সে তুলনায় মিয়া রাজি সাহেবের মাজার অনেক বেশি জাগ্রত। তার টিকে যাওয়ার ইতিহাসও শত বছরের। এ মাজার যেন বোবা কিশোরীর মতো কিছুদিন পর হারিয়ে যাবে না।

বলা হয়ে থাকে, এই সাধক পুরুষের প্রকৃত নাম মিয়া রাজি। সম্মান করে বলা হয়, মিয়া রাজি সাহেব। গ্রাম্য বিকৃত উচ্চারণে ‘রায়’ সাহেব’রই বেশি চল। প্রায় দুইশ বছর আগে নোয়াখালীর সোন্দলপুর এলাকায় আসেন। কোত্থেকে তিনি এসেছেন- সেই খবর কারো জানা নাই। এখন যেখানে তার মাজার-সেটার নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই সবসময় থাকতেন। এর বাইরে যেতেন না। অন্যান্য মাজারের মতো তার আস্তানায় বহু বছরের পুরনো একটি বটগাছ আছে। সেই বটগাছের নিচে তার কবর। কবরটির কোন আলামত নিশানা নাই। বটগাছ ঘিরে মোটামুটি বর্গাকৃতির একটা জায়গা কোমর সমান ইটের দেয়ালে ঘেরা। মেলা উপলক্ষে সাদা আর লাল রং করা হয়েছে। প্রতিবছরের ফাল্গুন [নোয়াখালীর উচ্চারণে হাগুন মাস] মাসের ৭ তারিখে এই মাজারে ওরস হয়। তারপর পুরো ফাল্গুন মাসব্যাপী মেলা চলে।

মেলায় একটা ব্যানারে লেখা আছে মিয়া রাজি সাহেবের মসজিদের জন্য দান করুন। বয়ষ্ক একজন মানুষ চাঁদা তুলছেন। তার কাছে মিয়া রাজি সাহেবের গল্প শুনতে চাইলাম। তিনি বেশি কিছু বলতে পারলেন না। মাজার ঘুরে খাদেমের দেখা পেলাম না। বয়ষ্ক দুই-একজনের সাথে হলো। তাদের একই কথা, এই রহস্যময় মানুষ নিয়ে কিছু জানা যায় না। মাজারের সামনে টিনের ছাউনি দেয়া একটা ঘর দেখা গেল। ঘরে কেউ নাই। তার সামনে একটা সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডটা স্বাক্ষ্য দিচ্ছে এটা ছারছিনা দরবার শরীফের সনদপত্র পাওয়া মাজার। ছারছিনা দরবার শরীফ কড়া রক্ষণশীল নক্সবন্দিয়া সিলসিলা। শরিয়া এবং মারফতের তরিকা মিলে এ সিলাসিলার আকিদা। কাজেই এইসব আয়োজনের সাথে যায় না এ সিলসিলা। কিন্তু বছরের পর বছর চলতে থাকা এই মেলাতে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি-বাড়াবাড়ি আছে। রাজি সাহেবের মর্যাদা-অমর্যাদা নিয়ে কোন ধরনের গোলযোগের কথা শোনা যায় নাই।

মেলায় কি নাই! খেলনা, মোয়া-মুড়কি, মিঠা-মণ্ড, পান-সুপারি, খাবার হোটেল থেকে যাত্রা, পুতুল নাচ, অনেক কিসিমের জুয়ার আসর সবই আছে।

সেই অনেক আগের কথা। শুধু একদিনের জমায়েত।৭ ফাগুন মিয়া রাজি সাহেবের ওফাত দিবসে। সেই উপলক্ষে তার ভক্তরা মাজারে ওরসের প্রচলন করেন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন আসত। তারপর একসময় মেলা কমিটি হলো। ওরসের চেয়ে মেলাই প্রধান হয়ে ওঠে। এর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, নানা বিনোদন ও ইজারাদারের সম্পর্ক। চেয়ারম্যান-থানা পুলিশ জড়িত হলো। সেই একদিনের মেলা পরে হল সারা মাস জুড়ে। মেলায় কি নাই! খেলনা, মোয়া-মুড়কি, মিঠা-মণ্ড, পান-সুপারি, খাবার হোটেল থেকে যাত্রা, পুতুল নাচ, অনেক কিসিমের জুয়ার আসর সবই আছে। আছে নির্ভেজাল মুদির, ফার্মের মুরগীর দোকানও। দোকানটিতে মাইক বাজিয়ে এক ভদ্রলোক গান গাইছিল। মটর সাইকেল, সাইকেল, ভ্যান রাখার জন্যও ইজারা দেয়া হয়। এটা নিয়েও নানা গণ্ডগোল মারপিট হয়।

মিয়া রাজি সাহেব কেমন মানুষ ছিলেন, কোন তরিকার ছিলেন, তার আধ্যাত্মিক গুণপনা কি, ধর্ম বিস্তারে তার ভূমিকা কি- তা জানার কোন উপায় নাই। মেলা কমিটি তারে নিয়ে যে লিফলেট ছাপিয়েছে, সেখানে অন্যান্য পীর-দরবেশের নামের আগে ও পরে সম্মান ও পরিচয়সূচক যে কথা দেখা যায় তার কোন বালাই নাই। সরাসরি মিয়া রাজি সাহেবের মেলা। সে মেলায় কি কি আয়োজন আছে, সেটার উল্লেখ আছে। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম মাজারের সামনে। মনের মধ্যে নানান কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। জানি না, কেমন যেন উদাসিনতা ভর করল নিজের মধ্যে। মসজিদের জন্য যিনি চাঁদা তুলছিলেন, তিনিও পাখি দুইটার কথা বলছিলেন। আমরা বুড়ো বটগাছে খুঁজতেছিলাম, যদি হলুদ পাখি দুটাকে দেখা যায়। হয়তো এরা মিথের পাখি। যাদের কেউ কখনো দেখে না। কিন্তু মানুষের ভক্তির মধ্যে এরা নানারূপে মিশে যায়। আবার মনে হচ্ছিল বায়েজীদ বোস্তামীর কচ্ছপ বা খান জাহান আলীর কুমীর বা জালালী কবুতর তো অদৃশ্য কিছু না। হয়তো এই দুটি পাখির দেখার ক্ষেত্রে মানুষের রকমফের আছে।

একই সময়ে দুইজন মহিলা এসে মাজারের গেইটে দাঁড়ালেন। একজন বোরকা পড়া আর অপরের জনের মাথায় সিঁদুর। দুইজনের চোখে বিস্ময় আর ভক্তি। উনারা ভেতরে ঢুকলেন না। দুইজনেই বেদির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভক্তিতে কোন জাত-পাত, ধর্ম-অধর্ম নাই। সবসময় এমনিই দেখে এসেছি।

এই সুযোগে শ্রী প্যারীমোহন সেনের নোয়াখালীর ইতিহাস [দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৪০, অনুমান করা হয় প্রথম প্রকাশ ১৯৮৬] বইয়ে নজর দিলাম। বইটির একটি দীর্ঘ উদ্বৃতি হল এরকম-‘বঙ্গের মুসলমান রাজধানী হইতে এই দূরবর্তী জিলায় [নোয়াখালী] অধুনা বহু সংখ্যক মুসলমানের বাস দৃষ্ট হয়। এই সুদূর পূর্ব্বাঞ্চলে মুসলমান ধর্ম্মের এইরূপ বিস্তৃতির বিষয় অনুসন্ধান করিলে জানিতে পারা যায় যে মুসলমান বিজেতৃগণের বাহুবল অপেক্ষা অন্য কোন শক্তি মুসলমান ধর্ম্ম বিস্তারে সহায়তা করিয়াছিল। এই দেশের স্থানে স্থানে পীর ও ফকিরের প্রতি সম্মানোর্থ প্রতি বৎসর তাহাদের বাসস্থানে মেলা হইয়া থাকে। এইরূপ মেলা এই দেশে দরগা নামে অভিহিত। অতএব প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমান পীর ও ফকিরগণ মুসলমান ধর্ম্ম প্রচারে যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছেন। তাদের প্রভাবে অনেক নীচ জাতীয় হিন্দুই অধিক পরিমাণে ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া অনুমিত হয়।‍ মুসলমান পীর ও ফকিরদের প্রভাবে এই দেশীয় অনেক হিন্দু ভদ্রলোকের পরিবারে মুসলমান ধর্ম্মের কোন কোন কার্য্যের প্রতি অনুরাগ দৃষ্ট হইত। এখনও এই দেশের কোন কোন জায়গায় হিন্দু ভদ্র মহিলাগণ আমন পীরের রোজা কারিয়া পূর্ব্ব পুরুষদিগের মুসলমান ধর্ম্মের প্রতি অনুরাগের পরিচয় প্রদান করিয়া থাকে। এই জিলায় প্রায় সর্ব্বত্র তিন লক্ষ পীরের ও সত্যপীরের সিন্নী দেওয়ার প্রথা প্রচলিত আছে। বর্তমান সময়ে রুচি মার্জ্জিত ভাষায় ইহারা ত্রৈলক্ষ্য নারায়ণ ও সত্য নারায়ণ নামে হিন্দু দেবতারূপে পূজিত হইতেছেন। এই দেশীয় মুসলমানগণ অল্পদিন পূর্ব্বেও অনেক হিন্দু আচার পালন করিয়া চলিত। বর্ত্তমান সময়ে মাওলানা কেরামত আলী ও এই দেশীয় বহু সংখ্যক মৌলবীর প্রভাবে এই দেশীয় মুসলমানগণ সংস্কৃত মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছেন। ইহাতে অনুমান হয় যে পীর ও ফকিরের প্রভাবে প্রথমত মুসলমান ধর্ম্মের আচার ব্যবহার প্রবর্ত্তিত হইয়া পরে মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণের প্রবৃত্তি জন্মাইয়া দিয়াছিল।’[পৃষ্ঠা ৩১, নোয়াখালীর ইতিহাস, শ্রী প্যারীমোহন সেন, ভূমিকা আবু হেনা আবদুল আউয়াল, বইপত্র, ২০০৭] । প্যারীমোহন সেন কোনটাকে হিন্দুয়ানী আচার বলছেন তাতে সন্দেহ আছে। কারণ এই দেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির অনেক কিছু হিন্দুয়ানী বলে প্রচলিত। তা নিয়ে কাইজা-হুজ্জোতও কম নয়। সেই ভেদ শ্রী প্যারিমোহন সেনের আলাপে নাই। কেরামত আলীকে জৈনপুরের মাওলানা সাব নামে লোকে এখনো শ্রদ্ধা করে।

দশ বারটা ফার্নিচারের দোকান-তার মধ্যে একটা দোকানেই সোফা আছে। বাকিগুলো সব খাট-পালংক, চেয়ার, টেবিল, মিটসেফে ভর্তি। দোকানি বোধ হয় তার কালেকশন নিয়ে কিছুটা গর্বে আছেন। এক সেট সোফার দাম পনের হাজার টাকা। একটা খুঁত দেখিয়ে দিতে লজ্জিতভাবে বললেন, আনার সময় ঘষা লেগে একজায়গায় কাপড় ছিঁড়ে গেছে। বেচারি রিফু করিয়ে দাম কিছুটা কমালেন। আমরা বাহির হয়ে খুঁজছিলাম পিঁড়ি-বেলনের দোকান। দা-বটির দোকান। খুঁজে পেলাম না। এমন না যে, এইসব জিনিসের দরকার আছে। মনে পড়ছিল ছোটবেলায় আম্মার কাছে মেলা মানে দা-বটি-পিঁড়ি-বেলন। মনে হয় এইসবের দোকান বিকালে বসে। এখনো জমে নাই গজা-খাজা-বাদাম-বাতাসার দোকান।

অনেকগুলো খাবারের হোটেল। সব হোটেলের ব্যানারে লেখা আছে ‘গুণে মানে স্বাদে অতুলনীয়’। থরে থরে নানা রকম খাবার সাজানো আছে। খাবারের দোকানের পাশে একটা ফার্মেসি। ভালোই মিলেছে। খাবারের দোকানের সামনে সারি সারি জুয়ার ঘর। একটা বড় ঘরের সামনে লাল কাপড়ে সাদা কালিতে লেখা ‘মিয়া রাজি সাহেবের মেলার জুয়ার আনন্দ মেলা’। একইসাথে কৌতুক ও আফসোস দুই-ই হলো। আবার একই প্রশ্ন মনে জাগে, মিয়া রাজি সাহেব আসলে কে ছিলেন? কোন দূর দেশ থেকে এসেছিলেন কে জানে। তার নাম কট্টর শরীয়তপন্থীদের সাইনবোর্ডে, আবার জুয়াড়িদের বিজ্ঞাপনে। কবি জুয়েল মোস্তাফিজের একটা কবিতার লাইনের কথা মনে পড়ল-জুয়ার আসরে কোন আঙ্গুলই মিথ্যা নয়। হয়তো বা। হয়তো বা সবকিছুতে জুয়ার ব্যাপার আছে।

খাবারের দোকানের সামনে সারি সারি জুয়ার ঘর। একটা বড় ঘরের সামনে লাল কাপড়ে সাদা কালিতে লেখা ‘মিয়া রাজি সাহেবের মেলার জুয়ার আনন্দ মেলা’।

জুয়ার আসর জমে ওঠে সন্ধ্যার পর। এখন বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। বছর কয়েক আগেও সবকিছু চলত হ্যাজাকের আলোতে। মেলার সময় এটা হলো সোন্দলপুরের লাগভেগাস। পুরো মেলার মধ্যে জুয়ার আসরের ব্যাপ্তি সবচেয়ে বেশি। নানান ধরনের জুয়া আছে। কোনটা ঘোরে, কোনটা ঘোরে না। সকাল বেলায় দেখলাম-বাচ্চা ছেলেরা নানা কিসিমের ছোট-খাট জুয়ার তালিম নিচ্ছিল। যেমন-পানি ভর্তি বালতির ভেতর থাকে কাচের গ্লাস। কাচের গ্লাসে যত ফেলা যায় তার দ্বিগুণ পাওয়া যাবে। এটা শুধু পয়সা দিয়ে খেলতে হয়। জুয়ার আসরের একপাশে চলছে দুর্ধর্ষ রকমের মটর সাইকেল খেলা। আরো কিছুটা গেলে নাগরদোলা। মেলার একেবারে অপরিহার্য জিনিস। জিনিসট খানিক উঁচাও বটে। তবু সবকিছুর মাথার উপর দিয়ে রাজি সাহেবের মাজারের বটগাছ্টাই দেখা যাচ্ছিল। সেই গাছ কি সবাইকে ছায়া দেয়?

যাত্রা দলের নাম সঞ্জিত অপেরা। এটি চট্টগ্রামের দল। যাত্রার প্যান্ডেলটি মেলার মূল আয়োজন থেকে বেশ দূরে। মেলার একপ্রান্তে। প্যান্ডেলের আশে-পাশে কেউ নাই। সবাই ঘুমিয়ে আছে। জেগে আছে নিউ আশার আলো লাকি কূপন। বড় দোকান। হরেক-রকেমর আইটেম সাজানো-গোছানো। আরো জেগে আছে দ্যা নিউ সুজাতা পুতুল নাচ। পুতুল নাচের দলটি এসেছে ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে। গানের তালে তালে জমজমাট পুতুল নাচ চলছিলো। হারমোনিয়াম, তবলায় কেউ একজন গান গাচ্ছে। বিখ্যাত, ‘ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না’। এরপর দেশাত্মবোধক গান। বুকের ভেতর কেমন যেন বেজে উঠল। আজো যাত্রা-পালায় দেশ-মাতার নাম আর বন্দনা না নিয়ে শুরু করা যায় না। সেটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। মনে মনে বললাম, নাম নিতে হয়। নাম না নিলে দুনিয়ার কিছুই আপন হয় না। যে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে থাকে না, নামেই তার সাথে সম্পর্ক হয়।

Comments

comments

2 thoughts on “অচিন মানুষের স্মরণে

  1. নাম নিতে হয়। নাম না নিলে দুনিয়ার কিছুই আপন হয় না। যে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে থাকে না, নামেই তার সাথে সম্পর্ক হয়।

Comments are closed.