এথিক্স আর মেটা-এথিক্সে বন্দী জীবন

ডেভিড হিউম।   যিনি সংশয়বাদী দার্শনিক নামে অধিক পরিচিত।  এই বছর তার তিনশতম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো। জন্ম: ৭ মে ১৭১১ সাল। মৃত্যু: ২৫ আগষ্ট ১৭৭৮ সাল।

বছরখানেক আগের কথা, মেটা-এথিক্স বা পরা-নীতিবিদ্যার কাঠ-খোট্টা একটা বই পড়ছিলাম। মানে আমার কাছে কাঠ-খোট্টা। একটা পোষ্ট লিখেছিলাম সামুতে। এটা সেই পোষ্টেরই সামান্য পরিবর্ধিত অংশ। তো, মোটের উপর একখানা বই। তার উপর নির্বাচিত চ্যাপ্টার। এথিক্সে বা নীতিবিদ্যার প্রতি এক সময় ব্যাপক আগ্রহ ছিলো। একই সাথে এথিক বুঝার জন্য গুরু ও গুরুপনার দরকার ভেবেছিলাম। কিন্তু সবকিছুর জন্য এমন খোজাখুজির দরকার আছে কি? তবে সিস্টেম বলে তো একখানা কথা আছে। (শিক্ষক আর গুরু এক না। আবার কখনো কখনো নিজেই নিজের গুরু। যা দেখিলাম না জগত সংসারে, তা দেখি নিজের মাঝে। তো, গুরু ও গুরুপনা নিয়ে নানা সংশয় ও ইতরপনা ছিল, বিলকুল আছে। এর সাথে এথিক্স-মেটাএথিক্সের সম্পর্ক কি। সম্পর্ক আছে, কিন্তু সে আলোচনা আজ থাক)।

এথিক্সের জন্ম কোত্থেকে? এটা নিয়া দর্শনের অপরাপর বিষয়ের মত এখানেও নানা মত পার্থক্য আছে। একটা বলে ইহা ধর্ম নির্ভর। ঠিক আছে। এই মতের সাথে এখন যা যোগ করি, ধর্ম নৈতিকতার ধারণার মূল হয়ে পড়লে– ধর্মের আসল স্পিরিট নষ্ট হয়ে যায়। তারপরও প্রাসঙ্গিক অর্থে এই নির্ভরতা ছাড়া নৈতিকতার কোন ব্যাখ্যাই যেন আমার তরীর হালে পানি পায় না। সুতরাং, ধর্মের নিজের প্রয়োজনে এর সাথে গাটছাড়া বাধা লাগে। ধর্ম বাদ দিলে বাকি থাকে একধরনের সুশীলতা। সুশীলতা আবার নানা ধরনের শ্রেণীগত বিভেদ তৈরী করে। যাতে মারাত্বক অহংকার থাকে। যা ধর্মীয় অহংকারের’ চে ভয়ংকর। যা আবার এথিক্সের কাম্য নয়।

এইসবের বাইরে নৈতিকতা তো এক প্রকার মূল্য সম্পর্কীয় ধারণা। যা কোন না কোন মানদন্ডের ভিত্তিতে সামাজিক মানুষের ঔচিত্য-অনুচিত্য নিয়ে আলোচনা করে। আকারটা আদর্শনিষ্ট। কিন্তু বর্ণনামূলক প্রেক্ষিতকে বাদ দিলে কোন কিছু কতটা বস্তনিষ্ট থাকে সেটা গুরুতর প্রশ্ন। বিশেষত, জ্ঞানের প্রশ্নকে আমরা বস্তুগত ধরে নিই। অন্যদিকে মেটা-এথিক্স হলো শব্দগত বিচার বিশ্লেষণ, ফ্যাক্টস আর বর্ণনার যে প্রভেদ তার সুক্ষ্ণ তারতম্য খুঁজে বের করা। এটা আমাদের ভাব-ভাষার ভেতরেই আছে। আমরা যখন কোন শব্দ বা বাক্য নির্বাচন করি, তখন এর অর্থ যেমন ভেতরকার একটা জিনিস আবার একই সাথে তার একটা বয়ান থাকে। কিন্তু সে বয়ানকে নির্দিষ্ট ভাব-ভাষার আলোর মধ্যে ফেললে দেখা যায়, আমার একই সাথে নানান নিয়ম¬কানুনকে জেনে বা না জেনে ব্যবহার করি। এগুলো আবার আমাদের বর্ণনামূলক বিদ্যার ফাদে আটকা না পড়া অলিগলিতে হাটে। আদর্শনিষ্ট নীতিবিদ্যার এই অলিগলি ধরতে চায় মেটা-এথিক্স বা পরা-নীতিবিদ্যা।

মেটা-এথিক্স বর্ণনামূলক এথিক্সের মধ্যে যে ভাব ভাষা আছে, তাকে খুলে দেখতে চায়। সে এক আশ্চর্য জগত। ভাষার মধ্যে কি করে ভাবের পরিবর্তন লুকিয়ে আছে। আপনি কি করে, কিছু দেখা জিনিস থেকে অদেখা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন। এই মজা টের পাবেন লজিক এবং মেটা এথিক্স-এ, যাকে বাংলায় বলা হয় পরানীতিবিদ্যায়। বাইরে থেকে ভালো কিন্তু বিশ্লেষণের যে জটিলতা, তা যেন বারবার চোরা কাদায় ফেলে। তো সেই পড়তে গিয়া যে পাকে পরলাম, তা হলো ডেভিড হিউম কেন নৈতিকতাকে ‘ভালগার সিস্টেম’ বলেছেন এটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা। সে আলোচনা আবার প্রকৃতিবাদী ও অপ্রকৃতিবাদী দুই দলকেই সন্তুষ্ট করছে। আজব। যাইহোক, যে জিনিস আমার নিজের কাছেই কঠিন লাগে, তারে নিয়া বেহুদা কথা না বলে ক্ষান্ত দিলে অনেকে নিশ্চয় খুশি হবেন।

এথিক্স ভালো লাগার পেছনে প্রথম কারণ, আগে নিজেকে ভয়ংকর ধরণের নীতিবাগিশ মনে করতাম। ভাবতাম, নীতিবান হবার জন্য এর দরকার আছে। এখনও যে মনে করি না, তা নয়, তবে এইটুকু বুঝতে সময় দিই, ঘটনা কি? কে করলো? কেন করলো? এইসব ভাবলে দেখি বেশীরভাগ অপরাধীর অপরাধ অর্ধেক মাপ। আমার মনে হয়, ভয়ংকর ধরণের নীতিবাগিশতা একধরনের কুসংস্কারের মতো। তাদের ভালো মন্দ বোধ নির্দিষ্ট স্থরে আটকে থাকে। সময় তাদের অনেক সুযোগ দেয়, তারা তা বুঝে না। একসময় নিজের ভেতর শামুকের মতো খোলস আবদ্ধ হয়ে যায়। সে সব মানুষরা আর বাড়তে পারে না। তাদের নীতিচিন্তাও নতুন কোন স্থর অতিক্রম করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, হয়তো বা নৈতিক মানুষই একজন উপযুক্ত গুরু হতে পারেন।

এছাড়া, এথিক্স ভালো লাগার আরেকটি কারণ হলো, মানুষ কেন সামাজিক হয়ে উঠবে? এই প্রশ্ন থেকে। মানুষ যতই প্রয়োজনকে বেশী গুরুত্ব দিক, মানুষের মধ্যে সকলের জন্য ভাবা’র দিকটা একদম জন্মগত। এইবোধের বড় স্থান মনে হয়- কেন মানুষ রাজনীতি করে। এই বিবেচনায় দেখা যায়, মানুষ সমাজকে একদম উল্টে পাল্টে দিতে পারে। তা-কেন? মানুষের ভেতর সাম্য প্রতিষ্টা করা। আর যদি নীতিবাগিশতা অপক্ক স্থরে সে আটকে থাকে তবে মহত্তর সামাজিক বিপ্লবের মধ্যেও ভয়ংকর অন্যায় সে খুঁজে পাবে। আর সমাজে এই ধরনের মানুষ বেশী হলে তো কথায় নাই- তারা নীতির স্থরে সবাইকে দম আটকে মারার চেষ্টা করে। এতে নিজেকে প্রকাশের’ চে ছদ্মবেশ বেশী। এবঙ এই নীতিবোধ নানাভাবে নানা বিষয়ে তৈরী হতে পারে। যেমন- কেউ নৈতিকভাবে বিজ্ঞানের পূজো করে অথবা ধর্মীয়ভাবে একরোখা থাকা। ক্ষেত্র বিশেষে নীতি-নৈতিকতা সুবিধাবাদের নামান্তর। এখন দুনিয়াতে যেকোন ইনসাফের লড়াইকে নীতির নামে দমন করা চলে। তবে, তারপরও একটা সাদা কাক যদি থাকে, তার প্রতি আমাদের সম্মান দেখানো দরকার। হে বীর, তোমার প্রতি স্যালুট।

মেটা-এথিক্সের যে শব্দগত বিশ্লেষন তাতে একটা ধাঁধা তৈরী হয় , তাহলো- কোন কিছু হওয়া থেকে তা কি প্রকারে হওয়া উচিতে পরিণত হয়। বিষয়টা একেবারে গুণগত। কিন্তু আমাদের চিন্তা এবঙ চিন্তার কর্ম এর যে রূপান্তর ঘটায় তাকে এই বিশ্লেষনের মধ্যে ধরা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন বিষয়টা ভয়ংকরভাবে যুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ে। তাই এখানে নায্য অনায্যের ধারনায় মারাত্বক গলদ তৈরী হয়, এটা যে বর্ণনা নির্ভর সাধারণ এথিক্সে নাই তা নয়। ফলে সাময়িক তুষ্টির স্থানটিও যুক্তির প্রয়োজনে অপরিহার্য হয়ে উঠে। তাছাড়া অধিবিদ্যার মতো মৌলিক অনুসন্ধান বা সম্ভাবনা এর দ্বারা নাকচ হয়ে যায়। আবার অপরদিকে, মানুষের সকল ধরনের প্রকাশকে কাঠামোবদ্ধ করার দুলর্ভ এবঙ রহস্যের প্রচীরে হানা দেবার অভিযান জমে উঠে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এটা নিছক বিদ্যায়তনিক লুডু খেলা মনে হয়।

থাক বাবা, মুর্খ মানুষ এইখানে ক্ষান্ত দিক।

………………………………………………………………………………………………

*David Hume যা বলেছেন,

In every system of morality which I have hitherto met with, I have always remarked, that the author proceeds for some time in the ordinary way of reasoning, and establishes the being of a God, or makes observations concerning human affairs; when of a sudden I am surprised to find, that instead of the usual copulations of propositions, is, and is not, I meet with no proposition that is not connected with an ought, or and ought not. This change is imperceptible; but is, however, of the last consequence. For as this ought or ought not, expresses some new relation or affirmation, ‘tis necessary that it should be observed and explained; and at the same time that a reason should be given, for what seems altogether inconceivable, how this new relation can be a deduction from others, which are entirely different from it. But as authors do not commonly use this precaution, I shall presume to recommend it to the readers; and am persuaded that this small attention would subvert all the vulgar systems of morality, and let us see, that the distinction of vice and virtue is not founded merely on the relations of objects, nor is perceived by reason.

……………………………………………………………………………………………….

সামহয়ার ইন ব্লগে এই বিষয়ে কার্ল মার্কসের লগে আলাপ:
কার্ল মার্কস বলেছেন: আপনার পেইজে লাইনের লাস্ট শব্দ ডিসপ্লে করতাছে না, তাই পাঠে সমস্যা করে, করণ কি ?

একখান ভালো জিনিসে হাত দিছেন, মুবারক হো।
মহান কার্ল মার্কস (নিক ধারী আমি না) এর এফিটাপে যে কথা লেখা আছে তার সুত্র ধইরা নতুন একখান আলোচনার দ্বার পাইছি, আড্ডায়ও কইছি। দার্শনিকরা একটা বড় গোলের মাঝে চলে যান, বলা যায় নিয়তির নির্মম পরিহাস। দর্শন শাস্ত্রে’র সংজ্ঞায় দেখা যায় এটা হচ্ছে জীবন ও জগতের সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রচেষ্টা। সমস্যা কাকে কেন্দ্র করে? নিশ্চয় মানুষ, অথ্যাৎ পিভোটাল পয়েন্টে মানুষ/গণমানুষ। একজন দার্শনিক যখন ভাবেন তখন তার ভাবনায় গণ মানুষ থাকে না, থাকে তিনি আর তার চিন্তা, দার্শনিক নিজে আর চিন্তা এ দু’টির ডায়ালগে এগিয়ে চলে সমস্যার সমাধান কল্পে। কিন্তু এতে সমস্যার ঐতিহাসিক প্রকটতার তৈরী হয়। ধর্মবেত্তাগণ/নবী রাসুলগণ করেন, গণমানুষের চিন্তা যেখানে তাদের ডায়ালগ চলে নিজে+গণমানুষের স্বার্থ। তাই তাদের সমস্যার বাস্তব সমাধান দ্রুত আসে।
…পরে আরো বিস্তারিত হবে।

ওয়াহিদ সুজন বলেছেন: আশা করছি…….. বিস্তারিত হবে।
গণমানুষ এই ধারনাটা কি? সেটা পরিস্কার হওয়া দরকার।
একজন দার্শনিক যখন ভাবেন তখন তার ভাবনায় গণ মানুষ থাকে না, থাকে তিনি আর তার চিন্তা, দার্শনিক নিজে আর চিন্তা এ দু’টির ডায়ালগে এগিয়ে চলে সমস্যার সমাধান কল্পে।

চিন্তা তার শ্বাশত ধারনার কারনেই চিন্তা। চিন্তা মানুষকে সংজ্ঞায়নের সুযোগ করে দিয়েছে। নাম, পরিচয়, বর্ণনার মাধ্যমে জগতের সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক তৈরী করে দিয়েছে। সে সর্বময় জাল তৈরীর মতো দিয়েছে মানুষকে। প্রতিনিয়ত সে নতুন নতুন ফর্মে আবির্ভূত হয়। এটা ধরা কার কাজ?
পয়ম্বর আর দার্শনিক এক জিনিস না। এই নিয়া তর্ক হইলে তা হবে বেহুদা কাজ। তবে পয়ম্বর আর দার্শনিকের কোন মিল আছে যে মিশনে বের হওয়া যায়। আসেন বের হই। আর মার্কস নিজে কি ছিলেন?

> পড়ুন হেইডেগারের ‘আছে’র আছে হয়ে থাকা

Comments

comments

Comments are closed.