কিছু কথা ‘সমুদ্রতটে কাফকা’ ছাড়া হয়তো ভাবা হতো না

মনে করতে পারি। হারুকি মুরাকামির ‘অফটার দ্য ডার্ক’ উপন্যাসে সমান্তরালে দুইটা কাহিনি চলতে থাকে। একটাতে সম্ভবত একটা মেয়ে স্বপ্ন দেখে। এর বাইরে তার কোনো অ্যাক্টিটিভি নাই। অন্য একটা ক্যারেক্টার সারারাত টোকিও রাস্তায় কী কী যেন করে। ওই স্বপ্নের ঘটনাটা মনে হয় খোলাসা হয় না, এমনকি দুইটা ঘটনা একইসঙ্গে কেন বলা হইতেছে; জানা যায় না; সরাসরি। এই রকম কিছু হয়তো। ব্যাপারটা একটু বেদিশাকর হইলেও ততটা না শেষ পর্যন্ত। কারণ, লেখককে খোদা হওয়া থেকে আমাদের বাঁচানো দরকার। নইলে লেখক সম্পর্কিত কিছু ধারণা তৈরি হয়, সেটা শুধু লেখক নয় সমাজের জন্যও ক্ষতিকর। তাইলে লেখকের মানুষ হয়ে থাকাটা সুবিধা হয়।

এমনিতে ফিকশন বা যেকোনো লেখার একটা গুন হইলো টানটান হলে বা কোনো একটা লক্ষ্য বা প্রশ্ন সামনে থাকলে আগানো সহজ হয়। লেখক বা পাঠক হিসেবে। কিন্তু গোয়েন্দা গল্পের মতো সব পাজল, উত্তর বা লক্ষ্য পৌঁছানো তার কাজ না। গোয়েন্দারাও সবসময় পারে না। তা সত্ত্বেও এই জনরা বা গোয়েন্দা গল্পের মধ্যে বানায়া বানায়া বলা হচ্ছে বলে এটা ভাব বিদ্যমান থাকে।

মানে লেখকরে সব জাইনা যাইতে হবে এমন তো না। চরিত্ররে অনুসরণ করা একটা কাজ হইতে পারে তার। আর যেকোনো লেখা একটা ফিলোসফিক্যাল জার্নি। এ জার্নির মধ্য দিয়া তিনি কিছু একটা অবহিত হইতে পারেন। এবং যে লেখার ভেতর চরিত্রগুলোরে যতটা তার কর্মকাণ্ড ও নিয়তির ওপর ছেড়ে দেয়া যায়; তাতে ততটা আনন্দজনক পরিস্থিতি ও গভীরতা তৈয়ার হয়। মাঝে মাঝে বিরক্তকর একটা অবস্থা হয়, সেটা লেখকের অনুসন্ধানের ধরনের ভেতর দিয়ে খারিজও হওয়ার কথা। যদি না তিনি আসলেই বিরক্ত করার কথা।

মোটা ও দাগে ‘কাফকা অন দ্য শোর’-এর অনুবাদ ‘সমুদ্রতটে কাফকা’ পড়ে ভাবতেছিলাম এসব কথা। নইলে হয়তো কখনো ভাবতাম না। ভাবলেও অন্যভাবে ভাবতাম। এ উপন্যাসে তামুকা কাফকা নামের এক কিশোর যে কিনা দুনিয়ার সবচেয়ে টাফ কিশোর হইতে চায়, ১৫তম জন্মবার্ষিকীতে বাড়ি থেকে পালায়া যায়। ঠিকঠাক কোনো গন্তব্য নাই। তবে আছে একটা ভবিষ্যদ্বাণী। বাবাকে খুন করবে আর মা ও বোনের সঙ্গে সঙ্গম করবে সে। ভবিষ্যদ্বাণী যা মূলত মেটাফোর, এর প্রভাব কতটা গভীর যে খুন না করেও রক্তাক্ত হওয়া সম্ভব এবং অনুতপ্ত্ও হওয়া সম্ভব।

ভবিষ্যদ্বানী যেকোনো কিছু হইতে পারে। সেটা হয়তো সব মানুষের থাকে, বাট সবাই এটা আগে-বাগে জানতে পারে না। আর যারা জানতে পারে, এবং কাটায়া উঠতে পারবে না সত্ত্বেও চেষ্টা করে তারা বীর। মানে তাদের জেনে যাওয়ার একটা ফজিলত আছে।

অন্যদিকে আছে নাকাতা নামে একজন মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইস্কুলের ছাত্র সে অদ্ভুত এক ঘটনার পর অনেকদিন অজ্ঞান অবস্থায় ছিল। জ্ঞান ফেরার পর একদম হাবাগোবা হয়ে যায়। যারে সে বলে, নাকাতার মাথার ভেতরটা একদম ফাঁপা। তবে একটা গুণ হলো, বিড়ালের সঙ্গে আলাপ করতে পারে নাকাতা। শুধু বিড়ালের কথাও নয়, দৈববাণীর মতো কিছু একটাও শুনতে পায়।  

তো, গল্প হইলো তামুকা ও নাকাতার ভাগ্য কীভাবে একসঙ্গে মিলে যায়। কীভাবে এক জায়গা এসে পৌঁছায়। দুজনই ভাগ্যকে অনুসরণ করে বা ভাগ্য তাদের অনুসরণ করে। সব প্রশ্নের উত্তরও নাই, এবং সেগুলো দেয়ার তাড়াও থাকে না হারুকি মুরাকামির। শেষমেষ আমারো মনে হইছে, কী দরকার!

হারুকি মুরাকামি

অনুমান করা যায়, ‘কাফকা অন দ্য শোর’ মুরাকামি খুবই উচ্চাভিলাষী প্রজেক্ট আকারে লেখা। শুধু তিনি নিজে যে গল্পটা জানতে চান তাই বলছেন। তাই চরিত্রগুলোরে খুব একটা বাধা-বিপত্তি ও নাটকীয়তা ছাড়াই কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। কিন্তু সম্ভবত আমাদের দেখার জগতকে বাস্তবিক অবস্থা হিসেবে পানির উপর বরফখণ্ডের মতো ছোট অংশ বলে জাজ করছেন। মিথ সৃষ্ট আদিকল্প ও সংগীত-সাহিত্যের ভেতর দিয়ে মানুষ কীভাবে যোগাযোগ করে, সেটা উঠে আসছে। দুনিয়াতে দেখা বা বোঝার অনেকগুলো লেয়ার আছে, সেটা কখনো ফর্সা হয়ে উঠবে তা হলো কথা। এবং কেন বিশেষ বিশেষ মানুষের সামনে হয়, সেটাও কথা। এ ভাবনা জাগায়া তুলতে পারে ‘সমুদ্রতটে কাফকা’।

জাপানের মতো জায়গা যেখানে মানুষগুলো আমাদের তুলনায় অদ্ভুতভাবেই আলাদা হওয়ার কথা। মানে যতটুকু পড়ি-টড়ি বা মুরাকামির লেখায় আসে। সেখানে তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ হয়তো বা সময়ের নিরিখে অনেক জটিল জায়গা পৌঁছে গেছে। কিন্তু মানুষ তো যোগাযোগ না কইরা থাকতে পারে না। তাইলে কিছু একটা ঘটে যেখানে মানুষ এই কাজটা মানে যোগাযোগটা করছে। যেটা অসচেতন কোনো স্তরের কোনো ঘটনা। যে জায়গাটাই শুধু মানুষ এই জগতরে এক্সপ্লোর করে না, মৃতদের জগতে যাওয়ার সক্ষমতা রাখে। সাহিত্য বা সংগীত দিয়া বাইর হয়ে আসতেছে। আমাদের এখানে কি ধর্ম বা আধ্যাত্মিক বন্ধন দিয়া আমরা দেখি না তেমন কিছু! যেটা মুরকামিরে প্রতিস্থাপন করতে হইছে। হয়তো না! কিন্তু আমারেও তো আমার অভিজ্ঞতার নিরিখে কথা বলতে হয়।

এই গল্পে চরিত্রগুলোরে ছেড়ে দিছে টাইপের যে ভাবটা আছে; পছন্দ হইছে। আনপ্রিডেক্টিবল ঘটনা আছে। কিন্তু ঘটনাগুলো যে ঘটতে হবে সেটা মুরাকামি জানা আছে। যেমন বাংলা সিনেমার ঘটনাই ধরেন, মেলায় হারায়া যাওয়া বাবা-মা যে কে দর্শক জানে। কিন্তু হারায়া যাওয়া পোলা বা মাইয়া ও তার বাবা-মা তো জানে না। কিন্তু তাদের মিল দেখাইতে গিয়া কজাল রিলেশন দেখাতে হয়। এখানে দর্শককে সন্তুষ্ট করে ঘটনাটা ঘটানোর একটা ব্যাপার থাকলেও সত্য যে তারা এক পরিবারের মানুষ সেটা তো দর্শক জানে। এ জায়গায় একটা দৌড় দিতেছে মুরাকামি। ইন্টারেস্টিংলি, মুরাকামির এ গল্পে ঈশ্বর বা দৈব কোনো সত্তার উপস্থিতি নাই। যেটা আছে সেটা হলো মন, মানুষের মন। যার ফাংশান তার সব সময় জানা হয়ে উঠে না। তো, এখানে কেএফসির ‘কর্নেল স্যান্ডার্স’ হয়ে হাজির হয় আইডিয়া। দৈব ইন্টারভেশন হয়ে। এখানে মানুষের জানা-অজনার যে জটিলতা সেই লেয়ার মুরাকামি ভাঙেন না। দর্শক অসন্তুষ্ট হবে কিনা এমন একটা বিষয় থাকার পরও। এ জায়গাটা উপন্যাসটাকে ডিপ ফিলোসফিকাল জায়গা নিয়া গেছে যে মানুষ তার জীবন ও এ জগতের সব পাজল মেলাতে পারে না। যখন মেলাতে তাকে সর্বেসর্বা হইতে হয়, যেটা সম্ভব না। ইভেন একটা ফিকশনাল জায়গায় গিয়ে মানুষ পারে না। তখন মানুষ নয়, বরং আইডিয়া আকারে তার মধ্যে শেয়ারিং একটা মাইন্ড আছে; তাকে এসে হাজির হতে হয়।

এখানে বিষয় হলো একজন লেখক তো শুধু গল্প বলেন না বা একটা আইডিয়ারে লজিক্যাল করে তোলা তার কাজ করেন না। বরং তিনি বিভিন্ন ঘটনারে যেখানে এনে দাঁড় করাইতে চান সেখানে মানুষের কাজটা আসলে কী, মানুষ আসলে কী অনুসন্ধান করে সেটা হলো প্রশ্ন। ওই জায়গা পৌঁছাতে গিয়ে কী অ্যাচিভ করে সেটা হলো ব্যাপার। ‘কাফকা অন্য দ্য শোর’ মুরাকামি অন্যান্য বইয়ের মতো না হইলেও দীর্ঘ সব বর্ণনা ও ঘটনার কোনো পরিবর্তন ছাড়াই এবং অনেক কিছুর ব্যাখ্যা বা রেফারেন্স ছাড়াই শেষ হয়ে যায়। আমাদের বিপন্ন হৃদয়ের কাছাকাছি চলে আসে। এবং শেষ পর্যন্ত দরকারি ধাধাঁ হয়ে উঠে। যে আমারে অনেক উত্তর না দিয়ে, শটকাটে সব কিছু মিলে যাওয়ার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়।

Comments

comments