ঘুম ভেঙে দেখি শরীরজুড়ে রক্ত

(ব্যর্থ এক সার্জারি নিয়ে ভোগান্তির কাহিনি এটা। যার মূল পর্ব শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, এখনো চলমান। এখন একটা সিনেমাটিক ক্লাইমেক্সে দাঁড়ায়া আছে। তবে সেই গল্পে দুর্ধর্ষ কোনো অ্যাখ্যান নাই, বিরাট কোনো বাঁক-বদল নাই। অনেক বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস আছে। কিন্তু এ গল্প আমার খুবই কাছের, আমার বর্তমান। আমার স্বজনদের জন্য পরীক্ষার, আমাকে ভালোবাসার। সেই গল্পটা আমার বন্ধুদের জানাতে চাই, অন্তত এক অধ্যায়ের সমাপ্তির আগে আগে। … অবশ্য পুরো গল্পটা এভাবে শেয়ার করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই)

আগের পর্ব: একঅসুখের দিনদুইবাবা আর আমি পাশাপাশিতিনঅপারেশন টেবিলের ঝাপসা দুনিয়া, চার. বাসায় ফেরার আনন্দ

পদ্মা, পাবনা; অক্টোবর ২০১২। লালনের আখড়ায় কার্তিকের অনুষ্ঠানের ফাঁকে ঘোরাঘু্রি। নামলিপি: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

যখন এ অংশটা লেখা শুরু করলাম সে দিনের (১৭ মে ২০২১) আলোচিত ঘটনা হলো প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। পরে নথি চুরির অভিযোগ এনে শাহবাগ থানার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। রোজিনা কিছুদিন ধরে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে নড়েচড়ে বসার মতোই রিপোর্ট করেছিলেন। এর সঙ্গে বিষয়টিকে সম্পর্কিত করে দেখছেন সবাই।

২০২০ সালের মার্চের মাঝামাঝি। সার্জারির যখন কোনো ধরনের ওষুধ নিতে হচ্ছে না আর। কিন্তু আমার খাওয়া-দাওয়া স্বাভাবিক হয় নাই। বাসে করে আসা যাওয়া করছি অফিসে। তখন দিনে দেশে করোনা ধরা পড়ছে। এর মধ্যে বাস থেকে নামার জন্য দরজার কাছে দাঁড়িয়েছি। সামনে একটা গাড়ি স্লো করায় বা কোনো কারণে বাস হঠাৎ ব্রেক করায় হ্যান্ডেল ধরা হাতে ভীষণ টান লাগল। সেটা গিয়ে টান পারল বুকের কাছাকাছি কোথাও। ভয়ে পেয়ে গেলাম। হালকা একটা ব্যথা কয়েকদিন ছিল।

এর কদিনের মধ্যে করোনাভাইরাস একটা বিভীষিকা হয়ে হাজির। সব জায়গায় আতঙ্ক আর আতঙ্ক। মার্চের মাঝামাঝিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি হয়ে গেল। দেশজুড়ে লকডাউনের কথা শোনা যাচ্ছে। লকডাউন শব্দটা তখন প্রথম শোনা আমাদের। যেহেতু আমরা পত্রিকার অনলাইন ভার্সন, আমাদের অফিসে না এসেও কাজ করা যায়। তাই এ নিয়ে অল্প বিস্তর আলোচনা হচ্ছিল। একদিন আমাদের ডেপুটি এডিটর মাহবুব মোর্শেদ ভাই বললেন, যেহেতু আপনি অসুস্থ, আপনাকে দিয়েই হোম অফিস শুরু হোক। লকডাউন শুরু হলে ২৪ মার্চ থেকে আমি হোম অফিস শুরু করলাম। তখন নতুন উপদ্রুব শুরু হলো। সন্ধ্যার দিকে জ্বর আসতে থাকে। একদিন সেলাই মিলিয়ে যাওয়া জায়গাটা কেমন যেন ফোলা ফোলা ও ভেতরটা স্বচ্ছ মনে হচ্ছিল। বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলাম।

২৭ মার্চ শুক্রবার। সকাল ৬টার দিকে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে চমকে গেলাম। চারদিকে রক্ত। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মনে হচ্ছিল, ভুল দেখেছি। এমন কিছু তো হওয়ার কথা না। কোথাও ব্যথা নাই, কিচ্ছু নাই। চোখ খুলে দেখবো এমন কিচ্ছু ঘটে নাই। আসলেই, চোখ খুলতে প্রথমে কিছু চোখে পড়ল না। তারপর ভয়ে ভয়ে গেঞ্জির বুকের কাছ থেকে নিচের দিকে চোখ নামালাম। পুরো গেঞ্জি রক্তে ভরা। তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। গেঞ্জি খুলে দেখি সেলাইয়ের এক পাশে খুলে গেছে। বসার কারণে চাপ লাগতেই গলগল করে রক্ত আর পুজ বেরোতে শুরু করলো। গেঞ্জি চেপে আপার রুমের দিকে গেলাম। দেখি দুলাভাই নাই, মনিং ওয়াকে গেছেন। এ দিকে টিস্যু পেপার দিয়ে মুছেও রক্ত-পুজ শেষ হচ্ছে না। এমন আতঙ্কিত অবস্থায় একবার সোফায় বসি, একবার হাঁটতে থাকি। কখনো মনে হয় এ বুঝি রক্ত পড়া বন্ধ হলো, এরপর দেখি আরেক দিক থেকে গলগল করে পড়ছে।

সাতটার দিকে দুলাভাই আসলেন। ওনাকে জানাতে বললেন, হাসপাতালে ফোন দিতে। আরও কিছুক্ষণ পর হাসপাতালে ফোন দিলাম। তারা বলল, ডা. আকবর আহমেদ শুক্রবার রোগী দেখেন না। বললাম, খুব জরুরি। আমার সেলাইয়ের মুখ খুলে গিয়ে অনবরত রক্ত পড়ছে। তারা কাস্টমার কেয়ারের নাম্বার দিল। ওই নাম্বারে ফোন করার পর ডাক্তারের নাম্বার দিল। ফোন দিতেই আকবর আহমেদ ধরলেন। বললেন, দশটার দিকে হাসপাতালে আসবেন। এক ঘণ্টা থাকবেন। এর মধ্যে যেন আসি।

এখন সমস্যা হলো গাড়ি। কড়াকাড়ি লকডাউন চলছে। আমার বাসা থেকে মেইন রোড গিয়ে বাস, সিএনজি বা উবার এসেও উঠতে হয়। কিন্তু ওখানে গিয়েও লাভ হবে না যতটুকু জানি, সড়কে কোনো গাড়ি চলছে না। দুলাভাই এদিক-ওদিক ফোন দিয়ে একটা লক্কর-ঝক্কর মার্কা কার জোগাড় করলেন। রংচটা, ভেতরে মশার আস্তানা। আসা-যাওয়া মিলিয়ে তিন হাজার টাকা দিতে হবে, ফেরার পর বকশিস দিতে হলো দুইশ টাকা! উবারে আসা-যাওয়া করলে অর্ধেক খরচ। বাংলাদেশে যা হয় আরকি! আপনার বিপদে সুযোগ নিতে চায় সবাই। এমনকি অনেক কাছের মানুষও। আপনাকে আরও রক্তাক্ত করবে, এটা হয়তো সব দেশেই হয়!

বাসায় তুলা শেষ হয়ে গেছে, দরকারের সময় যেমন জিনিসপত্র আপনি পাবেন না, অন্য সময় হুদায় গড়াগড়ি খাবে। তাই টিস্যু ভাঁজ করে ক্ষতের ওপর ধরে আছি। ওই জায়গাটার কথা ভাবলেই গা শিরশির করে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, একটু পর দেখতে পাবো এটা সত্যি নয়।

এমন ঢাকা শহর আগে দেখি নাই। প্রতি বছর কমপক্ষে একটা ঈদে ঢাকায় থাকি, অফিস করি। কিন্তু কখনো ঢাকা শহরকে এতটা ভুতুড়ে মনে হয় নাই। একে তো শুক্রবার, তার ওপর লকডাউন। সব মিলিয়ে এক নিস্তব্ধ দুনিয়া। আমরা যখন কালশির দিয়ে যাচ্ছিলাম, সেখানে অসমাপ্ত ফ্লাইওভার, পরে মেট্রোরেল মিলিয়ে হলিউড সিনেমার মতো মনে হচ্ছিল। ড্রাইভার তো পথ হারিয়ে ফেলল। মনে হচ্ছিল, বিশাল কর্মযজ্ঞের মাঝ থেকে হুট করে সব মানুষ উধাও হয়ে গেছে। কালসী কবরস্থান দেখে বুঝতে পারলাম আমরা ঠিক পথে আছি। অন্য সময় এ পথ যেতে দেড় ঘণ্টা তো কমপক্ষে লাগে। আজ আমরা ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম।

বিশাল আল হামরা হাসপাতাল জুড়ে শুনশান নিরবতা। এমনিতে শুক্রবার চিকিৎসকেরা রোগী দেখেন না। তবে করোনার কারণে আগে থেকেই রোগী রেস্ট্রিকট্রেড। ডাক্তারের রুমের সামনে বসে আছি। আধাঘণ্টা পর উনি আসলেন। উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, এতক্ষণ অপেক্ষা না করে উনাকে ফোন করতে পারতাম। বেডে শোয়ার পর ক্ষতটা পরীক্ষা করে বললেন, এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক সময় টিস্যুর সঙ্গে সেলাইয়ের সুতো ম্যাচ না করলে এমনটা হয়। দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। যেহেতু ডায়বেটিস বা স্টেয়রেড নেওয়ার কোনো ব্যাপার নাই ক্ষত ভালো হতে বেশিদিন লাগবে না। হায়, এটা যদি সত্য হতো!

ড্রেসিং করে দিয়ে বললেন, সামনের দুই সপ্তাহ প্রতিদিন ড্রেসিং করতে হবে। আল হামরায় আসা অনেক খরচ ও সময় সাপেক্ষ, কাছাকাছি কোনো হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে বদলে নিতে পারি। এরপর কিছু ওষুধ দিলেন, রক্তের টেস্টও। এক সপ্তাহ পর দেখা করতে বললেন।

জানুয়ারিতে ভর্তি হয়েছিলাম সেই এফএফসি হাসপাতালে গেলাম পরদিন সকালে। ঢোকার মুখে সাবান দিয় হাত ধুতে হলো। এ অভিজ্ঞতা সম্ভবত কভিড পিরিয়ডে প্রথমবার হলো। জরুরি বিভাগে যাওয়ার পর বলল, অন্য হাসপাতালের রোগীর ড্রেসিং তারা করায় না। বললাম, আমি তো এখানেই ভর্তি ছিলাম। গলব্লাডারের অপারেশন তারা করান না দেখে অন্য হাসপাতালে যেতে হয়েছে। তারা বলল, যেটাই হোক কোনোভাবে সম্ভব না, ওপর থেকে মানা আছে।

খুবই খারাপ লাগলো। কারণ উত্তরা ছাড়া কিছুই মাথায় আসছে না। সেখানে আধুনিক হাসপাতালে আমার আত্মীয় আছে, কিন্তু তাদের এড়াতে চাই। আর ওই হাসপাতালে যেতে হলে তিনবার রিকশা পাল্টাতে হবে। এর মধ্যে একবার রাস্তা পার হতে হবে হেঁটে। দুলাভাই বললেন, কী আর করা। কোনো উপায় নাই। রিকশাওলাকে বললেন উত্তরার দিকে যেতে। কিছুদিন যেতে যেতে চালক বললেন, কাছাকাছি একটা হাসপাতাল আছে। ট্রাই করবো কিনা। আর্ক হাসপাতাল। বললেন, সেখানে না হলে আরেকটা হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।

যাই হোক, আর্ক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতেই তারা রাজি হয়ে গেলেন। ড্রেসিং চার্জ ৫০০ টাকা। প্রতিদিন ৫০০ টাকা ভেবে দমে গেলাম। তারা বলল, আস্তে আস্তে কমিয়ে রাখবে। আসলেই তা-ই, শেষদিকে ২০০ টাকা দিতাম। চিকিৎসকেরা হেল্পফুল ছিলেন। তাদের একজনই কয়েকদিন পর চার্জ কমাতে বললেন। নার্সরাও বেশ ভালো। আল হামরার নার্সদের কথাও মনে পড়ে। সত্যি বলতে কী সরকারি হাসপাতাল নিয়ে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নাই, সেখানকার অনেককিছু শুনি বা পড়ি। তবে আল হামরা বা আর্কের মতো বেসরকারি হাসপাতালে এরা বেশ স্নেহশীলভাবে কাজ করেন। অনেকক্ষেত্রে কর্মদক্ষতাকে শিল্প মনে হয়েছে। একটা সুই ফোটানো নিয়ে একেকজনের একের টেকনিক। কেউ কেউ এত যত্ন নিয়ে করেন বা রোগীর কষ্টের দিকে মনোযোগ দেন- তাদের কথা বলার ধরন, ভাবলেই ভালো লাগে। যাই হোক, দুই সপ্তাহের জন্য আর্ক হাসপাতালে আসা-যাওয়ায় এসে আটকে গেলাম প্রায় তিন মাস।

এক সপ্তাহ পর আবার আল হামরায় ডা. আকবর আহমেদের কাছে গেলাম। উনি বললেন ইমপ্রুভ হচ্ছে। টানা কয়েকদিন প্রতিদিন যেন ড্রেসিং অব্যাহত রাখি সেই কথা বললেন। এরপর যেন একদিন পরপর যাই। ওই দিন হাসপাতালে যাওয়ার পথে বাজে ঘটনা ঘটলো। ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় অনেক দেখা যাচ্ছে। আমাদের এক জায়গায় পুলিশ থামালো। কোথায় যাচ্ছি বলার আগেই ঝাড়ি। কারণ দুলাভাই আর আমি কাছাকাছি বসেছি। পুলিশ বলল, একজন নেমে ড্রাইভারের পাশে সিটে বসেন। আমি সরে আসলাম, নামলাম না। লাঠি উঁচিয়ে বলল, ঠিকমতো বাড়ি পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে। একজন বললেন, লকডাউনে বাসায় বাইরে বেরোনো নিষেধ, আপনারা বাড়ি ফিরে যান। দুলাভাই বললেন, আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি। উনি বললেন, কোনো হাসপাতাল খোলা নাই। বাড়ি ফিরে যান। মরিয়া হয়ে বললাম, ডাক্তারের অ্যাপয়মেন্ট নেওয়া আছে। ফাইল দেখালাম। অফিসার গোছের একজন ফাইল দেখে সাবধান করে ছেড়ে দিল। সেদিন এ দেশের উপর এত রাগ হলো! মার দিতে চাওয়ায় এত অপমান লাগলো। এরা তো আমাদের মানুষ মনে করে না। আবার এক দলকে দেখলে প্রভুভক্তি দেখায়।

সেদিন ডা. আকবর আহমেদকে একজন একটা কাগজ দিয়ে গেল। যেখানে বড় করে লেখো ‘ডাক্তার’। আমাদের দিকে ফিরে বললেন, রাস্তায় অনেক ঝামেলা হয়। গাড়িতে এটা লাগানো থাকলে আর ঝামেলা হবে না বলে আশা করি। পরে আরেকদিন বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন এই জন্য যে, করোনার কারণে রোগীরা আসতে পারছে না!

আর্ক হাসপাতালে আমার আসা-যাওয়া বিলম্বিত হয়ে গেল। হাসপাতালে লোকজন আমাকে দ্রুতই চিনে গেল, করোনার সময় তেমন রোগী তো নাই। বেশির ভাগ সময় দুজন ডাক্তারের যেকোনো একজনকে দিয়ে ড্রেসিং করাতে চাইতাম। অন্য সময় নার্সরা করে দিতো। তারাও পরিচিত হয়ে গেছে। দুই ডাক্তারের একজন খুব দ্রুত ক্ষত সারার বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন, তিনি বললেন, জায়গায় যাতে দ্রুত মাংস এসে ভরাট হয়, তেমন ওধুধ দেবেন। আমি মানা করলাম। বললাম, দ্রুত শুকানো দরকার আপাতত। কিন্তু অন্য ডাক্তার দ্রুত ক্ষত শুকানো নিয়ে সন্দেহ করলেন। তার মতে, ভেতরে কোনো একটা লিকেজ আছে। ক্ষত শুকালেও ভেতরে পুজ থেকে যাচ্ছে। কথাটা সত্য। ঘা অনেকটা শুকিয়ে আসার পর একদিন বিকেলের দিকে কম্পিউটারের অফিসের কাজ করছি— খেয়াল করলাম গেঞ্জি অনেকটা ভেজা। কিন্তু ড্রেসিংয়ে কোনো লিক নাই। এরপর ছাদে হাঁটতে যাওয়ার পর দেখলাম ভেজা অংশ বেড়ে গেছে। হাত দিয়ে ছুলে আটালো কিছু লেগে থাকে। হালকা হলুদ বা কাছাকাছি শেডের একটা রং। এমনও হলো দুদিন পর যাওয়ার কথা থাকলেও পরদিন আর্ক হাসপাতালে চলে গেলাম।

একদিন নার্স ড্রেসিং করতে করতে বলছিলেন ক্ষতের মুখ ছোট হয়ে আসলেও ভেতরে অনেক পুজ রয়ে গেছে। বের করতে বেশ সময় লাগছে। এমন সময় সিনিয়র একজন ডাক্তার আসলেন। অবস্থা দেখে বললেন, লোকাল এনেস্থেসিয়া দিয়ে ক্ষত বড় করতে হবে। নইলে দুদিনেই মুখ বুজে যাবে। তখন আবার জায়গাটা তাজা হয়ে যাবে। এনেস্থেসিয়ার কথা শুনে ভয় পেলাম। বললাম, ব্যথা পাবো। নার্স বললেন, না। হালকা সুইয়ের ব্যথা পেলাম। এরপর ব্লেড দিয়ে ক্ষতের মুখ বড় করা হলো।

এই সময় অলি-গলিতেও কড়া লকডাউন শুরু হয়ে গেছে। দুপুরের পর মনে হয় সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় আর্মি নেমেছে। আমার বাসা থেকে হাসপাতালে যাওয়ার ভাড়া ১২০ থেকে কমতে কমতে স্বাভাবিকের ৫০ টাকায় এসে ঠেকেছে। এখন নতুন ঝামেলা হলো রিকশা দেখলেই পুলিশ বা আর্মি থামায়। তাদের চ্যালা হিসেবে যোগ হইছে পিচ্চি পোলাপান। এরা তো সূর্যের চেয়ে বালি গরম টাইপ নতুন প্রজন্মের ‘লীগ’। একদিন মনে আছে, তাদের তাড়া খেয়ে রিকশা বিপজ্জনকভাবে উল্টো দিকে ঘুরে গেল। চালককে আশ্বস্ত করতে পারছিলাম না। এক ছেলে এসে অটোর চাবি নিয়ে নিল। পরে আর্মিকে বলতে ফেরত দিল। এ অত্যাচার নিত্যই চলতে লাগলো। হাসপাতালের কোনা জবাবদিহি করতে হয়। অলিগলি দিয়ে গিয়েও শান্তি নাই। কোথাও কোথাও করোনা রোগী আসে, তাই অবরুদ্ধ। আর কোথায় ছোট ছোট ছেলেরা অলির প্রবেশ মুখে বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে।

এর মধ্যে যা হলো— একদম প্রধান সড়কে বাঁশ! এ কারণে দুবার রিকশা নিতে হবো। আর ঠা ঠা গরমের মাঝে এক-দেড় কিলোমিটার হাঁটতে হতো। যেখানে কোথাও কোথাও কাদা বা পানি জমে থাকতো। গরমে ঘামতে ঘামতে হাঁটছি, আর ক্ষতের জায়গায় শক্ত করে ধরে আছি। এখন ভাবলে অবাস্তব মনে হয়।

ওই সময়টা ভ্যাপসা গরম ও কখনো কখনো ভীষণ হাওয়ার। এপ্রিলের শুরুতে সবাই বাসায় ঢুকে যায়। আমি শুধু হাসপাতালে যাওয়া ও কম্পিউটারে বসে অফিস কাজ। বাকি সবার ছুটি। আর দুলাভাই দুই-তিনদিন পর বাজারে যান। কাজের লোককে বলে দেওয়া হয়েছে আপাতত না আসতে। বাইরে কেউ আসা নিষেধ। সকালে উঠে কাজে বসে পড়তাম। মাঝে দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে আর্ক হাসপাতালে যেতাম, এক-দেড় সপ্তাহ পর ডা. আকবর আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া। বিকেলে সবাই মিলে ছাদে গিয়ে চা খাওয়া। এভাবেই চলছিল।

আমার ঘুম আসতো না। এর মাঝে ফ্যান স্লো হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ভীষণ হাওয়ার রাত। তখনও বেশির ভাগ দিনই আমার ঘুম আসতো না। অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে থাকতাম। নিচের কচুবনে ভীষণ হাওয়া খেলত। বাসার সামনে অনেকদূর পর্যন্ত খোলা হওয়ায় বাতাস সরাসরি ধাক্কা দিত। শুধু গায়ে না, মনেও! ড্রেসিংয়ের যে টেপ ইউজ করা হতো, তার চারপাশে চুলকাতো। গায়ে ঘাম হলে আর রাত যত বাড়ত চুলকানি বাড়ত। চুলকাতে চুলকাতে এক ধরনের আটা আটা রস বের হয়ে পড়তো! অচিরেই পেটে খোলা অংশগুলো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে।

এর মাঝে একদিন ডা. ইমরানকে ফোন করলাম। ভাবলাম, সবসময় শুধু অসুখ-বিসুখের গল্প বলি, আজ নাহয় উনার খবরাখবর নিই। কিন্তু যাই হওয়ার তা হলো, ঢুকে পড়লাম ক্ষত ভালো না হওয়ার সমস্যা নিয়ে। উনি বললেন, ক্ষত থেকে যে পুঁজ বের হচ্ছে, তার একটা টেস্ট করান। তা থেকে বোঝা যাবে কী ধরনে এন্টিবায়োপিক ব্যবহার করা উচিত। তবে এ কথা ডা. আকবরকে বলা হয় নাই। পরেরবারও উনি আশ্বস্ত করলেন। প্রথম থেকে বলছিলেন এভাবে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি না করে নিজেই পারি ড্রেসিং করতে।

তখন রোজার মাস। এত দৌড়াদৌড়ির ভেতরও রোজা রেখে চলছিলাম। যদিও আর্ক হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা মান করছিলেন না। কিন্তু আমার সমস্যা হচ্ছিল না, পরের দুই বছর রোজা রাখতে পারি নাই। সাহস করে রোজার শেষ দিকে একদিন আল হামরা থেকে ফেরার পথে গজ, টেপ ও জীবাণুনাশক নিয়ে আসি। প্রথম দিকে নিপুণ করে দিতো, পরে আমি নিজেই করতাম। সপ্তাহ দেড়েক মাথায় দেখি মোটামুটি শুকিয়ে আসছে, ঈদুল ফিতরের দিনও ড্রেসিং করতে হলো। এর তিন কী চার দিন দেখি পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। তারপর ডা. আকবরের কাছে গেলাম। দেখে খুশি হলেন। বললাম, ক্ষত শুকিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো ঠিকঠাক খেতে পারছি না, নানান জায়গায় ব্যথা করছে। উনি বললেন, একটা ক্ষত ত্বকের ওপরে বলেও সহজে মেলায় না। এটা তো ভেতরের ব্যাপার। আরও কিছু দিন ব্যথা-বেদনা সহ্য করতে হবে। তবে আর কোনো সমস্যা হবে।

এরপর বললেন, ঠিক আছে টেনশনমুক্ত হওয়ার জন্য একটা ইউএসজি করেন। তখন বাসার সবাই শাওয়ালের ছয় রোজা রাখছিলাম, ফলে ইউএসজির জন্য উপযুক্তই ছিলাম, পেট খালি ছিল। প্রস্রাবের বেগ দরকার ছিল, তাও ছিল!

টেনশনমুক্ত হবো কী নতুন টেনশনের দিন সেটা! ইউএসজির জন্য সিরিয়াল আসতে রুমে প্রবেশ করলাম। কম বয়সী কয়েক জন নারী কাজ করছিলেন। একজন আমার ওপর মেশিন দিকে কাজ করতে গিয়ে অবাক। বললেন, আপনার তি অপারেশন হয়েছে (পেটে লম্বালম্বি দাগ দেখা সত্ত্বেও বলছেন)? হ্যাঁ, কেন? উনি বললেন, আপনার পিত্তথলি ও পাথর তো রয়ে গেছে। আমি পুরোপুরি থ, কী বলেন? তারা বললেন, আপনি অপেক্ষা করুন। আপনার প্রথম ইউএসজিটা আমাদের হেড ম্যাডাম করেছেন। তিনি ঘণ্টাখানেক পর আসবেন। তার কাছেই ইউএসজি করার। আমি ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসলাম। তাহলে কি আমাকে আবার অপারেশন করাতে হবে? খুবই দুর্বল, রিক্ত ও অসহায় হয়ে চেয়ার বসলাম। তারপর? এ বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল নিপুণ। ও পরে বলেছিল, এমন ভয়ংকর কথা শোনার পর তোমার কেমন লেগেছিল মামা। বললাম, প্রথমে প্রচণ্ড অসহায়তা ঘিরে ধরলেও পরে তেমন কিছুই লাগছিল না। শুধু বলছিলাম, যা হওয়ার তা-ই হবে। যা-ই হোক পরোয়া করি না।

মোটামুটি ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর ম্যাডাম এলেন। রিসেপশনের তরুণী আমাকে ডাকলেন। ইউএসজি রুমে ঢুকতে ঢুকতে শুনছি নারী চিকিৎসক বলছেন, ‘এত কম বয়সে এ সমস্যা? খুবই খারাপ লাগছে।’ ঢুকতেই দেখতে পেলাম উনার হাতে আমার ফাইল খোলা। চেক করতে করতে সহকর্মীদের মতো একই কথা বললেন, ‘আপনার তো অপারেশন হয়েছে মনে হচ্ছে না। সব তো রয়ে গেছে ভেতরে।’ ডা. আকবর আহমেদকে ফোন করলেন তিনি। একটু পর তিনি হাজির হলেন ইউএসজি রুমে।

চলবে …

Comments

comments