বিচ্ছিন্ন হৃদয় কোথায় থামে?

আমাদের ভেতরকার শূন্যতা, যা নিয়ে আমরা ভাবি এবং ক্রমশ গ্রাস থাকি। তার অন্তর্গত সত্য উন্মোচন না হলেও আমাদের মুক্তি কোথায়? ভেতরকার ও অন্তর্গত এ ধরনের শব্দের মাধ্যমে বৃত্তের মাঝে আরও বৃত্ত, অদেখার মাঝে আরও অদেখার তালাশ আছে।

হারুকি মুরাকামি

আমাদের মুক্তি কি বাসনার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে? এ ভাবনা কারণ কী হতে পারে! মানুষের বোঝাপড়ার ভেতর এমন কিছু আছে একটা দেয়ালের উল্টো দিকে যেখানে আমাদের হতাশা, ক্রোধ, নিস্পৃহতা, অর্থহীনতারা নতুন অর্থ লাভ করে। কিন্তু সে জগত তো আমাদের নয়। মানে আমাদের এ শূন্যতার ফলাফল নয়, নিদানও নয়। দুটো আলাদা জীবন, আলাদা প্রবাহ! তাদের কী কখনো দেখা হয়! আমার বিশ্বাস দেখা হয়। সেটা কতটা আমাদের আকুতি দিয়ে? নাকি সত্যের অন্তর্গত রূপ এমনই, যাকে ছোঁয়া বলেই সে এসে ধরা দিতে হয়। এখানে আত্মা পরিপূর্ণ হয়, মুক্ত হয়। মুক্তি একটা সাপেক্ষ বিষয় তো বটে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন মানুষের মুক্তি কোথঅয়?

সোজা কথায়, হারুকি মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ পড়ার প্রাথমিক উপলব্ধি এমন। ওয়াতানাবে, তার দুই প্রেমিকা ও আশপাশের মানুষের এ গল্প। ওয়াতানাবের ১৯৬০ এর দশকের শেষ দিকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অদ্ভুত এক মাঠের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো। যার সম্বন্ধে প্রেমিকা নাওকো বলছে, এর কোথাও একটা কূপ আছে। মানুষ যার অস্তিত্ব জানে, যেখানে টুপ করে হারিয়ে যায়, কিন্তু তারা জানে না, কূপটা কোথায়। যদি জানত দেয়াল বাধিয়ে দিতো অথবা কেউ হারিয়ে গেলে সেখানে তার খোঁজ করতো। সেই কূপ থেকে বাঁচার উপায় কী? পরস্পরের হাত ধরে হাঁটা।

এ গল্প এমন এক সময়ের এবং এমন এমন মানুষের, যারা প্রেম করে, একাধিক যৌন সম্পর্কে লিপ্ত, কিন্তু তারা প্রত্যেকেই আলাদা। কোনো সম্পর্কই আত্মা ছুঁতে পারে না। যাকে তারা খুঁজতে থাকে, পুড়তে থাকে। মনে হতে পারে প্রত্যেকের মন একেকটা কূপ। তারা যদি নিজ নিজের কূপের ভেতর পড়ে যায়, কেউ কখনো কাউকে দেখতে পাবে না।

বইটা পড়তে পড়তে এটা ভাবছিলাম, এই বিচ্ছিন্নতা ও নিজেকে হাতড়ে বেড়ানোর অর্থটা আসলে কোথায়? আমরা যেখানে খুঁজছি মানে এর উপন্যাসের চরিত্রগুলো যেখানে খুঁজছে, তার আশপাশে কোথাও? পুরো উপন্যাস জুড়ে তার কোনো তালাশ পাই না। যে সমাজ বা সামাজিক আবহ এক-আধটু দেখি, যা আমাদের থেকে একদম আলাদা, মনে হয় না পুরোনো দিনের গল্প পড়ছি। জাপানের পুঁজিগত রূপান্তরের একটা সময়ে স্বাধীন মানুষের গল্প। যে স্বাধীনতা আমরা ছুঁতে পারিনি (পাওয়া-না পাওয়া অর্থে না বা কোনো আদর্শও নয়)। কিন্তু এই অর্থে যে, জাপানে এটা নস্টালজিয়া হতে পারে, আমাদের কাছে অচেনা জাপান সেখানে স্থির থাকতে পারে। যাই হোক… সবাই যেহেতু দুঃখী। দুঃখটা হয়তো স্পর্শ করে, কিন্তু তার ভার যৌথ নয়, কেউ কাউকে বলছে না আমি তোমার দুঃখ ভুলিয়ে দেবো। বরং সবাই অপরের কাছে ঠিকঠাক হয়ে ফিরতে চায়। কেন?

বাংলা অনুবাদে ‘নরওয়েজিয়ান উড’

এটা ১৯৬০ এর শেষে দিকের জাপান। যখন বিশ্বব্যাপী চলমান সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার আঁচ জাপানেও লেগেছে। মুরাকামির বেড়ে উঠার সময়ও এটা, তিনি ওই সময় ওয়ানাতাবের বয়সী। যার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের কথা জানি। জ্বালাও-পোড়াও, ক্যাম্পাস বন্ধ। ওয়ানাতাবে এর সঙ্গে যুক্ত নয়, কিন্তু অচিরে টের পায় এ সব আন্দোলনের অসারতা ও প্রতারণা। (তখন মুরাকামি কি এভাবে ভাবতেন?) একইভাবে তার বান্ধবী মিদোরি বর্ণনা করে মার্কসবাদী থিয়েটারের গল্প। এর বাইরে সমাজের বৃহত্তম কোনো দিক বা আধ্যাত্মিকতা নামে ডাক দিয়ে যার কথা বলা যায়, তার কোনো চিহ্ন নাই। যুথবদ্ধতা অদৃশ্য। তেমন একটা সমাজ বা সময়ে ব্যক্তির মুক্তি একাকীত্বের মধ্যে আটকে থাকে।

নাওকোর আত্মহত্যার পর টোকিও ছেড়ে পালায় ওয়ানাতাবে, এক মাস সমুদ্র তীরে ঘোরে একা একা। কিন্তু টোকিও শহরের একাকীত্ব আর সমুদ্র তীরে একা একা ঘোরায় তেমন পার্থক্য আসলে দেখি নাই। সে শুধু বোঝে তার আরও সময় দরকার। এ দুনিয়াটা তো এক গোলকধাঁধা। ওয়ানাতাবে যখন ভাবে, এখন পুরোনো সব স্মৃতি থেকে মুক্ত ঠিক তখনই বুঝতে পারেন না, তখন কোথায় আছে?

মুরাকামি বলছিলেন, সুরিয়্যালাস্টিক টোন বাদ দিয়ে রিয়্যালাস্টিক জায়গা থেকে উপন্যাসটি লিখেছেন। তা ঠিক। অল্প মুরাকামি পাঠকও বিষয়টা ধরতে পারবেন। কিন্তু ধরেন, চিন্তা করতে করতে আমরা একটা জায়গায় তো পৌঁছেও যাইতে পারি, যেখানে বাস্তব অবস্থার ভেদজ্ঞান লোপ পাই! এটা অবশ্য ধূসর কোনো জায়গা না, যেটা আমরা দেখি না। আসলে আমরা তো সেখানেই আছিই তো! এটা তখনই উপলব্ধি করি, আসলে জীবনের পাজলগুলোর সমাধানের কোনো অর্থ হয় না। হা হা হা!

মজার বিষয় হইলো, বইটা পড়ার পর মানে এ পর্যন্ত লেখার পর যখন ভাবতেছিলাম, মুরাকামিকে আরেকটু জানা দরকার। তখন ইমরুল হাসানের অনুবাদ করা সাক্ষাৎকার উল্টাইতে উল্টাইতে এমন কিছু লাইন পাইলাম—

আমার প্রোটাগনিস্টরা প্রায় সবসময়ই বাস্তব দুনিয়া এবং আধ্যাত্মিক দুনিয়ার মাঝখানে আটকায়া থাকে। আধ্যাত্মিক দুনিয়াতে, নারী বা পুরুষরা শান্ত, বুদ্ধিমান, নম্র, জ্ঞানী। বাস্তব দুনিয়াতে, যেমনটা আপনি বললেন, নারীরা খুবই অ্যাক্টিভ, কমিক, পজিটিভ। তাদের একটা সেন্স অফ হিউমার আছে। প্রোটাগনিস্টের মন এই সম্পূর্ণ ভিন্ন দুনিয়ার মধ্যে ভাগ হয়া আছে সে বাছতে পারে না কোনটা নিবে। আমি মনে করি আমার কাজের এইটা একটা মেইন ঘটনা। হার্ডবয়েলড ওয়ান্ডারল্যান্ডে এইটা খুবই দেখা যায়, যেইখানে তার মন শারীরিকভাবে বিভক্ত। নরওয়েজিয়ান উডয়েও দুইজন মেয়ে আছে আর সে তাদের মধ্যে থেকে কার কাছে যাবে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

আসলে তত কিছু কইতে চাই না আর!

শুধু এটুকু বলি ‘নরওয়েজিয়ান উড’ আলভী আহমেদের অনুবাদ পড়ছি। অদ্ভুত রকম সাবলীল ও পরিশ্রমী একটা কাজ। বাতিঘর বইটা প্রকাশ করছে ২০২০ সালে।

Comments

comments