করোনার বাড়াবাড়ি, আচানক থমকে গেল সবকিছু। শুধু মানুষের বয়স বাড়ছিল যেন। লকডাউনের শুরুর দিকে একটা শ্রেণীর মাঝে অবসর, উদযাপন বা পিকনিক পিকনিক ভাব চলে আসে। কেউ কেউ ফূর্তির মেজাজে বলছিলেন, নিত্য রুটিনের চাপে ফিকে হওয়া ‘নিজেকে’ ফিরে পেলাম। একটু অবসর না পাওয়ায় হা-পিত্যেশ তো আমরা প্রায়ই করি!
মুশকিল হলো, মানুষ নিজেকে যা মনে করে, তা চর্চার বিষয়। হুট করে তাকে ধরা যায় না। পরিবর্তনকে অস্বীকার করলেও পরিবর্তনের ভেতর আসল মানুষটাই হাজির হয়। অতীত বিচারে এর চেয়ে যুতসই তরিকা কমই আছে। জীবনকে ‘নদীর মতো বয়ে চলা’ কিছু ধরলেও জীবনকে অর্থময় করা কিছু সময় তো চিরকালই স্থির থাকে, হয়তো অর্থ পাল্টায়। সেখানে কোনো নির্লিপ্ততা বা অন্যমনস্কতা খাটে না।
তো, সহজভাবে করোনার ভেতরে আর যা যা হতে পারে, পুরোনো দিন, পুরোনো সম্পর্কের বিচার। নিদেনপক্ষে পুরোনো দিনের জাবর কাটা। জাবর কাটা এ অর্থে হয়তো যদি নতুন অর্থ না মেলে বা অতীত স্রেফ তার ঘোরে আটকে থাকা। সেটা আলোচ্য না এখানে। বরং সেইসব ঘটনাকে আমরা বরাবরই স্মরণ করি, যা সমান্তরালে বর্তমান হয়ে থাকে। অবচেতনেও। তার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে বর্তমানে তুলনা-প্রতিতুলনা হতে পারে। অথবা অতীত এক আয়না, মুখটা দেখি মাঝে মাঝে! চমকে উঠি!
করোনার দুঃসহ এই ঘরবন্দী সময়ে ফুয়াদের স্মৃতিতে ফিরে আসে বিশ্ববিদ্যালয় দিনের বান্ধবীর স্মৃতি। তার হাত ধরে পরিপার্শ্ব। শুরুতে ফুয়াদকে আমরা এমনভাবে জানছিলাম, গ্রাম থেকে আসা ও কোনো মতে একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে নেওয়া মানুষ। পরে ধীরে ধীরে দেখা যায়, বেশ পারিবারিক সুবিধার মধ্যে বেড়ে ওঠা তরুণ, পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্যক্তিগত কিছু বিপর্যয় ছাড়া আশপাশের বিপদের কোনো আঁচ তার গায়ে লাগে না! কিন্তু সেই উচ্ছল সময় থেকে নিজেকে সে গুটিয়ে নিয়েছে। দায়হীন সম্পর্ক ও সমাজকে ভুলতে চায় কি সে?
সালাহ উদ্দিন শুভ্রর উপন্যাস ‘অন্যমনস্ক দিনগুলি’র নায়ক ফুয়াদ। স্ত্রী, শিশু সন্তান ও কিশোরী শ্যালিকা আছে তার সংসারে। খুবই সাদামাটাভাবে নিজের বয়ান দিতে দিতে হাজির হয় আমাদের সামনে। উত্তম পুরুষে লেখা বর্ণনায় জীবনের গভীরে যেতে যেতে পাঠককেই নিজস্ব উপলব্ধির মুখোমুখি করে ফুয়াদ। উপন্যাসের জন্য ভালো একটা বৈশিষ্ট্য। সময় বিচারেও কানেক্ট করা যায় সহজে।
করোনাকালে ফুয়াদের প্রধান কাজ হলো স্ত্রীর (সম্ভাব্য) পরকীয়া ঠেকাতে নিত্য নতুন ফন্দি খোঁজা। একদিন শরীরে করোনার লক্ষণ আবিষ্কারের পর নিভৃতবাসে থাকার সময় শাদা একটি ডায়েরি আবিষ্কার করে বিয়ের উপহার হিসেবে পাওয়া ড্রেসিং টেবিলে। করোনা আর অতীত একাকার! শাদা পাতায় যেন স্মৃতিতে থাকা চিহ্নগুলো ফুটে ওঠা বাকি। সেই খাতায় ফুটে উঠতে থাকে একদম ‘নীরস’ ফুয়াদের রঙিন দিনগুলো। সেখানেই আছে ফুয়াদ অরাজনৈতিক, নির্বোধ, সমাজবিমুখ জীবনের গল্প। ফুয়াদ বাংলাদেশের তেমনই মানুষ, যারা এমন এক রাজনীতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে, যেখানে সক্রিয়ভাবে যুক্ত না হলেও একটা ডগমা দিয়ে যুগের পর যুগ চলা যায়, যতক্ষণ না গুরুতর কোনো ধাক্কা সে খায়। ফুয়াদ সেখানে ধাক্কা খায় না— ফলত চলমান বাকশালের ভেতরই যাবতীয় মুশকিলের আসান খোঁজে! হোক স্ত্রীর পরকীয়া ঠেকানোর ফর্মুলা বা পরিবর্তনকে আমলে না নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু অন্যমনস্কতা মানুষকে কোনো দায় থেকে মুক্তি দেয় না। তাকে পেছন থেকে সাফ হয়ে আসতে হয়। তাই অমীমাংসিত অতীত হাজির! যেমন; বাংলাদেশের জটিলতায় এখন এক-এগারো বা শাহবাগ ঘুরে ঘুরে হাজির হয়।
এ উপন্যাস দুটি সময়ের বর্ণনা। সাম্প্রতিক করোনাকাল ও এক এগারোর সরকারের সময়কার ঘটনা। নানান অর্থে দুটি ইভেন্টের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। করোনা তো বৈশ্বিক মহামারি। পৃথিবী হয়তো সামনে করোনার আগে-পরে দ্বারা বর্ণিত হবে। তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসও এক-এগারোর আগে-পরে বলে নির্ণিত হয় আজকাল, এবং আমরা ফিরছি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির দিকে।
দুই সময়কে ধরার দিক থেকে শুভ্রর এ উপন্যাস অবশ্যই অভিনব। এবং একজন লেখক নিজের সময়কে ধরার মধ্যে কীভাবে প্রাসঙ্গিক হন তার উদাহরণ হতেও পারেন! বিশেষ করে, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা তুলে ধরার ক্ষেত্রে আমাদের যেকোনো শিল্পমাধ্যমই মারাত্মক রকমের নির্লিপ্ত, দায়হীন এবং অবুঝ!
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই স্বপ্নভঙ্গ ও নানান টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যার সমসাময়িক বড় ধাক্কা এক-এগারোর সেনা সমর্থিত সরকার। যাদের হাত ধরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বাকি থাকা রেশও আস্তে আস্তে অস্তমিত হবে। একসময় শাহবাগ নামক দানব হাজির হবে, যা সকল বিরোধিতাকে গিলে খাবে। তেমন প্রেক্ষাপটেই ফুয়াদের বিরাজনীতিক একটি সময় আমরা দেখি। যেখানে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় না থাকা অর্থে সে মূলত আওয়ামী লীগ হিসেবে হাজির। সমাজে এখনও বিশাল অংশই এমন। শুভ্র এমন একটি চরিত্র নির্মাণ করে গুরু কোনো অর্থ দিতে চেয়েছেন সম্ভবত।
শুভ্রর আগের যেকোনো লেখা বিবেচনায় তাকে রাজনীতি সচেতন হিসেবে আমরা পাই। এ উপন্যাসের পটভূমিও সেটাই নির্দেশ করে। কিন্তু নির্লিপ্ত একটি চরিত্রকে প্রধান করেই তিনি যেন এ নিষ্ক্রিয় সময়কে বোঝাতে চেয়েছেন। এ সময়ের ক্রিটিক এসেছে ফুয়াদের বন্ধুদের তরফে। কিন্তু ফুয়াদের কোনো মনজাগতিক পরিবর্তন আমরা দেখি না। এ জায়গায় শুভ্র কিছুটা দায় অনুভব করেন হয়তো। তাই আশপাশের চরিত্র দিয়ে বিপরীত বক্তব্যগুলো আমরা শুনি, যা সমসাময়িক একহারা বয়ানের বাংলাদেশে বিরল।
উপন্যাসের চরিত্রগুলোর বর্ণনা স্পষ্ট। প্রেমের মাঝেই শুভ্র যাবতীয় রহস্য খুঁজে পেয়েছেন। তার বাইরে দেশ ও রাজনীতি নিয়ে চরিত্রগুলোর চিন্তার স্পষ্ট-অস্পষ্ট চিন্তা, দ্বিধা বা দোদুল্যমান অবস্থান পরিষ্কার। অবশ্য এ বর্ণনাগুলো কখনো কখনো বক্তব্য নির্ভর হয়ে যাচ্ছিল, যেটা উপন্যাসের কাজ বলে মনে হয় না। ঠিক যেন পরে সাজানোর জন্য দরকারি নোকতাগুলো তুলে রাখা।
শুভ্র প্রেম-বিরহ দিয়েই মূল আখ্যান সাজিয়েছেন। যেখানে রাজনীতির একটা চোরা টান আমরা দেখে আপাত দূরবর্তী হলেও প্রভাবিত করে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকে। রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পর্ক এবং কর্তৃত্বের প্রশ্নগুলো আবহে বারবার হাজির হয়। যেখান থেকে পরিবারকে আমরা আলাদা ভাবি। কিন্তু নিজের টালমাটাল অবস্থাগুলো বিবেচনা করুন। একটার সঙ্গে অপরটি বাধা।
এক-এগারো পরবর্তী সময় করোনাকালেও হাজির হয়। এটা কি এমনভাবে ভাবা যায় যে, যে পরিস্থিতির মুখোমুখি এক দশক আগে ফুয়াদ হতে পারিনি, তা তাকে ছেড়ে যায়নি। আবার হাজির হয়েছে। কেন? এর নির্দেশ সরাসরি উপন্যাসের কথক ফুয়াদ বা লেখক বলে যাননি। কিন্তু জীবনকে হয়তো আমরা এমন একটা চোরা গলির মধ্য দিয়ে দেখবো, কিছু কিছু ঘূর্ণি ছাড়িয়ে পিছু ছাড়ে না। এ জীবন আপনাকে ‘অন্যমনস্ক’ হওয়ার ফুরসত দেবে না। পুরোনো হিসেব চুকাতে হয়।
কোনো লেখা এক টানে পড়া যায় বা যায় না— এ হিসাব দিয়ে তার সাহিত্য মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। ‘অন্যমনস্ক দিনগুলি’র মূল্যায়নও নিশ্চয় এখানে আটকে থাকবে না। শুধু তথ্য আকারে বলা যায়, তিন-চার বসায় টানা পড়ে শেষ করা গেছে উপন্যাসটি। চমকে দেওয়া উপলব্ধি ও চোখা সংলাপ আছে পাতায় পাতায়। তবে এ চমক ফেনায়িত নয়, নিচে ঠিকঠাক গভীর তরল আবিষ্কার করা যায়। কিছু বর্ণনার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করা যায়। একটানা সংলাপ দিয়ে সময়কে তুলে ধরা খানিকটা বিরক্তির উদ্রেক করে। শুভ্র আরেকটু সময় নিতে পারবেন। মনে হয় সম্পাদনায় পাঠ অনেক সহজ ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠত। এর বাইরে ফুয়াদের প্রেম নিশ্চয় অনেককে নস্টালজিক করে তুলবে। উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশও বটে। আর যৌনতা? থাক না সেই কথা!