ইবনে সিনার শরীর থেকে আত্মা কতটা আলাদা

যুক্তিবিদ্যার পথপ্রদর্শন ও প্রকৃতিবিজ্ঞান তথা ন্যাচারাল ফিলোসফিতে অবদান রাখার জন্য শুধু নিজের সমকাল নয় আজও এরিস্টটল স্মরণীয়। মধ্যযুগের দার্শনিকদের মাঝে তার অবদান অন্য যে কারোর চেয়ে বেশি। একই সময়ে ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম এই তিন সেমেটিক ধর্মের অগ্রগণ্য চিন্তাশীলদের চিন্তায় প্রভাব বিস্তার করেছে তার দর্শন। যদিও তার চিন্তা কোনো কোনো অর্থে ধর্মীয় দিক অস্বস্তিকরই বটে।

এরিস্টটল (৩৮৪ – ৩২২ খ্রিস্টপূর্ব)

মহাবিশ্বের কোনো একটা সময় সূচনা হয়েছে এমন ধারণা অস্বীকার করেন এরিস্টটল। খোদাকে তিনি ব্যক্তি আকারে না দেখে চিরন্তন গতির অচালিত চালক বা কারণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। যে কোনো অর্থে আত্মার অমরত্বকে অস্বীকার করেছেন। অবশ্য শরীরি মৃত্যুর পর ক্রমাগত পুনর্জন্ম থাকতে পারে। আত্মার একটি অংশ বুদ্ধি বা লোগোস টিকে থাকে!

তার শরীর ও আত্মার সম্পর্ক মূলত রূপ ও বস্তু সম্পর্কিত। সেখানে আত্মা সম্পর্কে তার বিখ্যাত সংজ্ঞা হলো, যেখানে একে ‘ফর্ম অব দ্য বডি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এবং এই ফর্ম বা আকার আবার শরীরের বাইরে অবস্থান করে না। আমি যদি একটি টেবিল পুড়িয়ে ফেলি, টেবিলের আকার বা আকৃতি বা গঠন টিকে থাকবে না। এবং কাঠের তৈরি কাঠামোর বাইরে বেশি কিছু হয়ে এটি থাকে না।

স্বভাবত আত্মা সম্পর্কে এরিস্টটলের ধারণা প্লেটোর বিপরীত। জৈবিক কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্ক থেকে এর সংজ্ঞা নির্ধারিত করেন এরিস্টটল। শুধু মানুষ নয় পশু ও বৃক্ষের আত্মা আছে, যাদের আছে অন্তর্নিহিত রীতি।

আত্মা বলতে এরিস্টটলের মতো, একটি শরীরের বাস্তবতা হলো তার জীবন আছে। এখানে জীবন মানে নিজেকে টিকিয়ে রাখা, বৃদ্ধি ও প্রজননের ক্ষমতা। যদি কেউ জীবিত সত্তাকে বস্তু ও রূপের (ম্যাটার অ্যান্ড ফর্ম) সংমিশ্রণ হিসেবে বিবেচনা করেন, তবে আত্মা হলো প্রাকৃতিক বা এরিস্টটলের মতে, জৈব- শরীরের রূপ। এখানে জৈব শরীর হলো এমন একটি শরীর যার অঙ্গ রয়েছে, যাদের নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে। যেমন; স্তন্যপায়ীর ক্ষেত্রে মুখ ও বৃক্ষের ক্ষেত্রে শিকড়।

জীবন্ত সত্তার আত্মাকে এরিস্টটল ক্রমবিন্যাস করেছেন। বৃক্ষের আছে উদ্ভিজ্জ বা পুষ্টিসাধক আত্মা, যার আছে বৃদ্ধি, পৃষ্টিসাধন ও পুনরুৎপাদন ক্ষমতা। এ সবের সঙ্গে প্রাণীর আছে প্রত্যক্ষণ ক্ষমতা ও চলৎশক্তি— তারা সংবেদনশীল আত্মার অধিকারী। প্রত্যেকে প্রাণীর কমপক্ষে একটি ইন্দ্রিয়বৃত্তি আছে। যার মধ্যে স্পর্শ হচ্ছে সবচেয়ে সর্বজনীন। এ ছাড়া যাদের ইন্দ্রিয় আছে তাদের মধ্যে বাসনাও আছে। এর সঙ্গে মানুষের রয়েছে যুক্তি ও চিন্তা করার ক্ষমতা, যাকে বলা যায় বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মা। এই বুদ্ধিবৃত্তিক এলাকা থেকে আত্মার সঙ্গে শরীরের সম্পর্কের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। এরিস্টটলের আত্মা ও তার বৃত্তি সম্পর্কিত এ কাঠামো শুধু দর্শন নয়, পরবর্তী প্রায় দুই হাজার বছর বিজ্ঞানকেও প্রভাবিত করে।

কিন্তু দ্বিতীয় শতকের দিকে এরিস্টটলের কিছু ব্যাখ্যামূলক আলোচনা অন্য ধরনের জটিলতা তৈরি করে। সে অনুসারে, চিন্তার জন্য শরীর ব্যবহারের দরকার নাও হতে পারে। তবে যদি আমাদের আত্মার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশকে মন বলি, তার শরীরের দরকার না হলে, তাহলে শরীরে তার অধিস্থান ঘটে কেন? এটা কি আত্মার জন্য কোনো ধরনের শাস্তি? প্লেটো ও তার অনুসারীরা যেভাবে বলে থাকেন, এটা একটি নৈমিত্তিক ব্যবস্থা, অশরীরী অস্তিত্ব হিসেবে আত্মা যদি শরীরের আগে থেকে থাকে, তবে শরীরের সঙ্গে এর সংযোগ সাময়িক? অনেক প্লাটোনিস্ট এর সঙ্গে প্রাচীন পিথাগোরাসের পুনর্জন্ম বিশ্বাসের সমর্থনে ব্যবহার করেন, এমনকি মানবাত্মা প্রাণীর দেহের পুনরুত্থিত হতে পারে।

ইবনে সিনা (৯৮০ – ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ)

তবে এ বিষয়টিকে ইবনে সিনা ভিন্নভাবে দেখানে। তার বিশ্বাস, একটি আত্মা অন্য আত্মার সঙ্গে পৃথক হওয়ার কারণে প্রতিটি আত্মার নিজস্ব শরীর দরকার। একটি আত্মা যদি অন্যটির মতো একই হয়ে থাকে। এভাবে কারো মধ্যে যদি পার্থক্য না থাকে, তাহলে তারা আলাদা বস্তু নয়। এখানে স্বতন্ত্র্য হওয়ার কিছু নীতি আছে, যা প্রত্যেকটি আত্মাকে অন্যটির চেয়ে বিশেষ করে তোলে। এবার একই রকম দেখতে দুটি টেবিলের কথা ভাবুন। তাদের দুটি রূপের কারণ হলো দুটো টেবিলের কাঠের আকৃতি।

ইবনে সিনার চিন্তায় এরিস্টটল এ দিক থেকে ঠিক যে, আমাদের আত্মা হলো আমাদের শরীরের রূপ। এর মাধ্যমে যদি শুধু এটা বুঝায় যে, আমাদের শরীরের জৈবিক শক্তির এবং আমাদের শরীরকে প্রাণবন্ত রাখার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের উৎস। শরীরের সঙ্গে এ সংযোগ থেকে বোঝা যাবে, কেন আমার আত্মা আপনার চেয়ে আলাদা। এখানে এসে প্লাটোনিস্টদের ধারণার সঙ্গে পার্থক্য স্পষ্ট যে, তারা মনে করেন আত্মা আকস্মাৎ দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত, কোনো জটিলতা ছাড়াই তারা একটির সঙ্গে অপরটি যুক্ত হতে পারে।

ইবনে সিনাকে অনুসরণ করলে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের এক ধরনের সম্বন্বয়ের দেখা মেলে। যেখানে মানুষের (যৌক্তিক) আত্মা ও জ্ঞানীয় প্রক্রিয়াগুলো যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে জ্ঞান উৎপাদন করে। তাই আলোচনাটি যথেষ্ট আকর্ষণীয়। তার মতে, একটি আত্মা একটি বিশেষ শরীরের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বন্ধনের মাধ্যমে একটি বিশেষ আত্মায় পরিণত হয়। সুতরাং এটা ভাবা যায় না যে, আমাদের শরীরে পৌঁছার আগে আমাদের আত্মা নিজের অধিকারের বলে অস্তিত্বশীল। 

এ জায়গায় এসে মনে হতে পারে ধর্মীয় কারণে এরিস্টটলের নির্দেশিত পখ থেকে সরে গেছেন ইবনে সিনা (!)। যদি অস্তিত্বের জন্য আত্মার শরীরের দরকার পড়ে, তবে আমাদের মৃত্যুর পর শরীর ছাড়া আত্মা কীভাবে বেঁচে থাকবো?

আত্মার বেশির ভাগ কাজ, এই যেমন; সংবেদন, মৃত্যুর পর রহিত হবে; কারণ আপনি চোখ ছাড়া দেখতে পাবেন না। ইবনে সিনার মতে, শরীরের মৃত্যুর পর মানুষ নয় এমন প্রাণীর অস্তিত্বই রহিত হবে। কিন্তু যুক্তি ও বুদ্ধির মতো উঁচুদরের ক্ষমতা মানুষকে বিশেষত্ব দিয়েছে। যাইহোক, চিন্তা নির্ভর করে সংবেদন ও স্মৃতির ওপর, এ দুটি ছাড়া আমরা চিন্তা করতেই পারি না। এ দিক থেকে ভাবলে চিন্তার শুরুর জন্য হলেও আমাদের শরীর থাকা দরকার। কিন্তু একবার প্রাথমিক পর্যায়ে ইন্দ্রিয়বৃত্তি ব্যবহার করে আমার চারপাশের জগত সম্পর্কে জানা শুরু করি, তবে আমরা স্বভাবতই বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাাপড়ার সঙ্গে জড়িত হতে পারি। এর জন্য আর কোনো অঙ্গের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব, এটা কি বির্মূত চিন্তা?

ইবনে সিনার আরেকটি যুক্তি আছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, আমাদের আত্মার জন্য শরীরের দরকার নেই। কল্পনা করুন, মাঝ আকাশে কোনো ব্যক্তি সৃষ্টি করেছেন খোদা। সে কোনো কিছু দেখে নাই, স্পর্শ করে নাই বা শুনে নাই এবং অতীতের কোনো অভিজ্ঞতা তার নাই। এই ‘উড়ন্ত মানবের’ নিজের শরীর বা চারপাশের জগত নিয়ে সচেতন হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও ইবনে সিনা বলছে, তিনি যে আছেন এটা জানতে পারবেন; তার মধ্যে আত্ম-সচেতনতা যা তাকে সত্য ও নিজের অশরীরী অহং-এর সঙ্গে যুক্ত রাখে।

এখানেই আসে চূড়ান্ত সমস্যা। তিনি একদিকে বলছেন চিন্তা ও আত্ম-সচেতনতার জন্য শরীরের দরকার নেই আত্মার, কিন্তু স্বতন্ত্র আত্মা হতে হলে শরীরের দরকার আছে। তাহলে স্বতন্ত্র হওয়ার শুরুর জন্য যদি শরীরের দরকার, তবে মৃত্যুর সঙ্গে শরীর হারালেও স্বতন্ত্রতা কেন হারাবে না? ইবনে সিনার উত্তর এমন যে, আমরা যখন মারা যাই ততদিনে আত্মা এমন সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, তার থাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও চিন্তা, যা তাদের ‘স্বতন্ত্র’ করে তোলে।

তাহলে বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, শরীর অনেকটা আত্মার জন্য সিড়ির মতো। একটা লক্ষ্য হাসিলের পর ছুড়ে ফেলা যায়। আপনি নিজের সত্তাকে জানতে এর প্রয়োজন হবে, কিন্তু যখন নিজেকে জানবেন, তখন নিজের সত্তাকে ধরে রাখার জন্য শরীরের দরকার পড়ে না। আত্মা যখন নিজের সঙ্গে সচেতন হয়, মৃত্যুর পরও সে চিন্তা চালিয়ে নিতে পারে। মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে এমন দৃষ্টিভঙ্গি বা খাঁটি চিন্তার জীবন একজন দার্শনিকই লালন করতে পারেন।

দর্শনের শুরুর দিক থেকে অন্যতম মৌলিক সমস্যাগুলোর একটি দেহ ও মন সম্পর্কিত। যা আসলে জড় ও প্রাণের সম্পর্ককে প্রশ্ন করার একটা জনপ্রিয় তরিকা বটে। তাদের আলাদা সত্তা আকারে চিন্তা করে আবার জোড়া দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা কম নয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা একই মুদ্রার দুই পিঠ হবে। কিন্তু বিশুদ্ধ বা বিমূর্ত চিন্তার জায়গা থেকে দেহকে নাকচ করার একটা ধারা বিদ্যমান আছে, যেখানে দেহকে জ্যান্তব আকারে ধারণা করা হয়। এ নাকচের ধারণাটা ইবনে সিনার আলোচনার মধ্যেও রয়েছে। কিন্তু আত্ম-সচেতনতার এমন একটা স্তর দরকার যেখানে বিশুদ্ধ চিন্তার আবার কোনো বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে হয়। চিন্তা যদি আত্ম-সচেতন না হয়, তাহলে তার মূল্য কী? সেক্ষেত্রে বিশেষ দেশ-কালে শরীরের দরকার পড়ে। এরপর অনন্ত জগতে অনন্ত আত্মার ভেতর সমর্পিত হওয়ার বন্দনা আছে বৈকি। কিন্তু এ জগতে মানুষ যা করে তার যা মূল্যায়ন তা কী শুধু আত্মার, শরীরের নয় কী!

এমনও নয় কি, শরীর আত্মাকে ব্যাখ্যা করে বলে বা শরীর দ্বারা আত্মা ভাষা পায় বলে তাকে অন্য জগতেও দরকার, যাকে আমরা দেখিনি! কেন দরকার? এ জগতকে শরীরি ধরলে আত্মার অর্থময়তার জন্য শরীরি দরকার, তার সামনে একটা আয়না ধরলে প্রতিবিম্ব তার উল্টোও হতে পারে! কী জানি? অন্য একটা আশঙ্কা হতে পারে— শরীরি বৃত্তিগুলোকে এক ধরনের স্খলন আকারে আমরা দেখি সাধারণ, যা অনেক ধর্মীয় ব্যাখ্যাও বিদ্যমন। দার্শনিকরা এর বাইরে বিশুদ্ধ একটা জীবন খোঁজে, যেখানে আত্মার বৃহত্তর কিছু খোঁজে, যা এ দুনিয়ায় শরীরের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। হ্যাঁ, একজন দার্শনিক হিসেবে বিশুদ্ধ চিন্তায় অবগাহনের চেয়ে আনন্দ আর কী থাকতে পারে! আছে কি তেমন কিছু?

/একাধিক সূত্র থেকে তথ্য সংগৃহীত

Comments

comments