এক.
এনালাইটিক বা বিশ্লেষণী ধারা ও কন্টিনেন্টাল ধারার দর্শনের মধ্যে অসংখ্য পার্থক্য রয়েছে। ‘অপরের সঙ্গে সম্পর্ক’ বিষয়ক আলোচনায় তার একটা আকর্ষণীয় দিক পাওয়া যাবে। বিশ্লেষণী ধারায় এ সমস্যার বোঝাপড়া খুবই সাদামাটা। যদি জ্ঞানের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনাটা শুরু হয়, ‘অপরের মনের সমস্যা’ বা ‘দ্য প্রব্লেম অব আদার মাইন্ডস’ নিয়ে প্রশ্ন হলো— কীভাবে আমরা অপরের মনের অস্তিত্ব জানতে পারি? যেহেতু সরাসরি কোনো ইন্দ্রিয়জ দ্বারা আমরা জানতে পারি না, যেভাবে অনেককিছু আমরা দেখি বা স্পর্শ করি, কিন্তু মনকে দেখা বা স্পর্শ করা যায় না।
এনালাইটিক ধারায় অনেকেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। সেখান থেকে এ ধ্রপদী প্রশ্নের উত্তরে জন স্টুয়ার্ট মিল কী বলেছেন তা বিবেচনায় রেখে আগানো যায়।
মিল নিস্পত্তি করতে চান এভাবে, ‘আমার মতোই অনুভূতি রয়েছে অন্যান্য মানব সত্ত্বার, কারণ, প্রথমত তারা শরীরীভাবে আমার মতো, আমার নিজের ক্ষেত্রে জানি অনুভূতির পূর্ববর্তী দশা সম্পর্কে; এবং দ্বিতীয়ত তাদের সক্রিয়তা এবং বাহ্যিক অন্যান্য লক্ষণ প্রদর্শন করে, যা আমি নিজের অনুভূতি দ্বারা পাওয়া অভিজ্ঞতায় জানি।’ (এন এক্সামিনেশন অব স্যার উইলিয়াম হ্যামিলটনস ফিলোসফি, ১৮৬৫)
মিলের এই উপসংহার ব্যবচ্ছেদে হালে ব্যবহৃত হচ্ছে থট এক্সপেরিমেন্ট ‘ফিলোসফিক্যাল জোম্বি’, যেটি জনপ্রিয় করেছেন ডেভিড শালমার্স। যারা হরর সিনেমার মাংসভোজী পিশাচ নয় কিন্তু ধরে নেওয়া হয় যে, দেখতে ও কাজকর্মে মানুষের মতো কিন্তু তাদের কোনো সচেতন অভিজ্ঞতা নেই। শালমার্সের জিজ্ঞাসা, এমন একটি প্রাণী সম্ভব কিনা (হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নয়) এবং কোন প্রমাণ আছে কি, কোনো ব্যক্তি ফিলোসফিক্যাল জোম্বি নন।
জোম্বি ছেড়ে দিয়ে বাস্তব দুনিয়ায় ফেরা যাক। এটা স্পষ্ট যে, মিল যে পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত দেন তার সঙ্গে আমাদের চারপাশে থাকা মানুষের ‘মন’ আছে, এটা মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।
শিশুদের অবাস্তব পর্যবেক্ষণ থেকেও ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারি। তারা বড় হতে হতে এ জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। যেটা মিলের ধারণার বিপরীত। শুরুতে, তারা সবকিছুর মধ্যে মানসিক অবস্থার গুণ দেখতে পায়। তারা বিশ্বাস করে খেলনার মন ও অনুভূতি আছে, যেমনটা তাদের মা-বাবার আছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এ সব বস্তুতে মানসিক অবস্থার গুণারোপ কমিয়ে দেয়। প্রাণীরা এ ধরনের শ্রেণীতে অনেকদিন থাকে, এমনকি প্রাপ্তবয়স্করাও তাদের পোষা প্রাণীর মানসিক রাজ্য আছে এমন ধারণা পোষণ করে। আবার যেমন, বস্তুসমূহের মধ্যে ভাবতে পারি না তারা নিয়ম মানবে না। যেমন; দরজা খুলবে না।
এভাবে দেখা যায় দুনিয়ার সকল অস্তিত্বের মধ্যে মানসিক অবস্থা আমরা অনুমান করে নিই। একইভাবে আদিম ধর্মগুলোতে গাছ, নদী বা অন্যান্য প্রাকৃতিক বস্তুতে আত্মা আরোপ করা হতো। এর মাধ্যমে আমরা কীভাবে চিন্তা করি তার একটা সহজাত দিক বোঝা যায়। সে দিক থেকে কোনোকিছুর মন আছে মানে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভুত বা প্রমাণ থেকে আগত— মিলের এমন ভাবনার মতো নয়। বরং অনুমানগুলো আমাদের অভিজ্ঞতার আগে থাকে। এখানে হাজির করতে পারি নতুন একটি ক্যাটাগরি।
যেটাকে ইম্যানুয়েল কান্ট বলছেন ‘আ প্রায়োরি’ বা পূর্বতঃসিদ্ধ। চিন্তার এই ক্যাটাগরি অনুসারে দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতার আগে যা উপস্থিত। ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজন’ (১৭৮১) বইয়ে তিনি ধারণাটি ব্যাখ্যা করেন। তবে এই বইয়ে ‘অ্যান আদার পারসন’ বা ‘অপর’ আলোচনার বিষয় নয়। এখানে তার মনোযোগ ছিল বাহ্যিক পৃথিবীর অভিজ্ঞতার জন্য কোন ক্যাটাগরিগুলো দরকার। তার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আছে দ্রব্য বা সাবস্ট্যান্স ও কার্য-কারণ সম্পর্ক বা কজালিটি। কান্ট পরবর্তী বই ‘ক্রিটিক অব প্র্যাকটিক্যাল রিজন’-এ (১৭৮৮) অপরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় আনেন। তার ব্যাখ্যা অনুসারে নৈতিক আইন দ্বারাই অপর মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ও জড়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কের পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য নির্ণিত হয়। কান্টের দেওয়া একটি নৈতিক নিয়ম হলো ‘অন্যদেরকে সর্বদা এমনভাবে নাও যেন তারা নিজেই লক্ষ্য, কখনোই শুধু লক্ষ্য পুরণের হাতিয়ার/উপায় হিসেবে নয়।’ আর কান্টের মতে, এই নৈতিক আইন পিওর রিজন বা বিশুদ্ধ বুদ্ধি থেকে আগত। যা কিংডম অব এন্ডসের ধারণা দেয়, সেখানে স্বাধীন ব্যক্তিসত্ত্বার অস্তিত্ব আছে।
কান্টের উত্তরসূরীরা এ আলোচনায় আর আগায়া যান নাই। মানে ‘অপর’কে ‘অন্য এক ব্যক্তি’ ধরে প্রায়োরি ক্যাটাগরি আকারে দেখা। হালে কন্টিনেন্টাল ফিলোসফি এই ধারণা নিয়ে কাজ করছে, যা বিশ্লেষণী ধারার কম মনোযোগই পেয়েছে।
দুই.
এজমালি অভিজ্ঞতার দিক থেকে অপরের মন বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। এর ভালো উদাহরণ হাল আমলে জনপ্রিয়তা পাওয়া আমাজনের ‘আলেক্সা’। অনেকেই এই ভার্চুয়াল সহযোগীর সঙ্গে নিয়মিত বাতচিত করেন। তারা ঘরের সুবিধাজনক কোনো স্থানে অ্যালেক্সা স্থাপন করেন। দ্রুত টিভি, লাইট, কম্পিটার ও অন্যান্য ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এবার শুধু বললেই হলো, ‘অ্যালেক্সা, টিভি চালিয়ে দাও প্লিজ।’ দ্রুত হুকুম তামিল করে অ্যালেক্সা সন্তুষ্ট করবে আপনাকে। এমনকি মুদিখানায় অর্ডার, ইন্টারনেট সাবসক্রিপশন রিনিউসহ আধুনিক জীবনের নানান কাজ সহজ করে দিচ্ছে। আর তার কথা বলার ধরন মেয়েলি, নরম ও বিচক্ষণ। যদিও সবকিছুই আমাজন থেকে ধারণকৃত, তারপরও হাজারো মানুষ অ্যালেক্সার প্রতি ভালোবাসা দেখায়। আর ‘প্লিজ’ উচ্চারণ নিশ্চয় কাউকে অস্বস্তিতে ফেলে না।
যদিও অ্যালেক্সা একটা যান্ত্রিক বিন্যাস ছাড়া কিছুই না, তার প্রতি প্রেমেরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, নিছক একটা বস্তুর চেয়ে লোকজন দ্রুতই ‘অপর’ হিসেবে বিবেচনা করে তাকে। যদিও তারা জানে চেতনা, অভিপ্রায় ও বাসনাহীন একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস অ্যালেক্সা। শুধু আগে থেকে করা যান্ত্রিক নকশার কারণে একজন ব্যক্তি যেভাবে সাড়া দেয় অ্যালেক্সাও সেই আচরণ করেন। আর আমাদের মস্তিষ্কও সত্তা হিসেব ‘অপর’ ক্যাটাগরাইজ করে। এমন ক্যাটাগরাইজেশন বা বর্গীকরণ আমরা প্রত্যাখান করতে পারি। কিন্তু এভাবে ব্যাখ্যা করলেও আমাদের দৃষ্টিগত বিভ্রম ও সংবেদন অপরিবর্তিতই থাকবে। যেমন; আমরা জানি, পানির নিচে কাঠি বাঁকা দেখালেও সত্যিকারের ঘটনা এমন নয়। অ্যালেক্সাকে ব্যক্তি হিসেবে দেখা সেই ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ভ্রম।
অন্যান্য অস্তিত্বের চেয়ে মানুষকে আমরা ভিন্নভাবে ভাবি। আমাদের মস্তিষ্ক ‘ফেস’ বা ‘মুখ’কে অন্যান্য আকারের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখে। এ ধরনের পরিষ্কার ও অভ্রান্ত প্রমাণ রয়েছে অ্যালেক্সা কোনো ব্যক্তি নয়। তা সত্ত্বেও অ্যালেক্সাকে ব্যক্তি হিসেবে ভাবা হয়। যা দেখিয়ে দেয় ‘অপর মনের সমস্যা’য় অভিজ্ঞতাবাদী মিলের সীমাবদ্ধতা কোথায়। ‘অপর মন’কে আমরা দেখতে পাই যদি তার কোনো অস্তিস্ত্ব নাও থাকে। কারণ ‘অপর’ নিয়ে আমাদের ভাবনায় ‘পূর্বতসিদ্ধ’ বলে একটা ক্যাটাগরি আছে।
থট-এক্সপেরিমেন্ট ফিলোসফিক্যাল জোম্বি একটা ইন্টেলেকচুয়াল গেম, কিন্তু কিছু লোক এমন অভিজ্ঞতাকে ভয়ার্ত বাস্তবতা আকারে দেখেন। মানসিক রোগীদের অনেকেই তাদের চারপাশে থাকা মানুষদের বাস্তব হিসেবে ভাবেন না বা অনুভব করেন না। মনে করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত। আত্মীয়-বন্ধু-ডাক্তারকেও তারা এ তালিকায় রাখে। ড্যানিয়েল স্ক্যাবারের কেস হিস্ট্রিতে সিগমন্ড ফ্রয়েড এ ধরনের লক্ষণ আলোচনা করেছেন। ওই বিচারক নিজের মানসিক অসুস্থতা নিয়ে একটি বইও লিখেছেন।
তিন.
কান্টের পর জর্জ উইলহেম ফ্রেডরিক হেগেল হলেন প্রথম দার্শনিক যিনি এই ক্যাটাগরির সঙ্গে যুক্ত নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ‘ফেনোমেনোলজি অব স্পিরিট’-এর (১৮০৭) প্রথম অধ্যায়ে তিনি প্রত্যক্ষক ও প্রত্যক্ষণের বিষয়ের সম্পর্ক নিয়ে তিনি একই ধরনের প্রশ্ন তোলেন। যাকে বলছেন ‘চেতনার দ্বান্দ্বিকতা’ বা দ্য ডায়ালেক্টিক অব কনসাসনেস। বইটির দ্বিতীয় অংশে আরেকটি বিষয়ের মুখোমুখি হন, যেখানে তাদের দেখার বস্তুই হাজির হয় অন্য বিষয়/সাবজেক্ট, অন্য ব্যক্তি রূপে। হেগেল একে বলছেন, ‘আত্নচেতনার দ্বান্দ্বিকতা’ বা দ্য ডায়ালেক্টিক অব সেলফ-কনসাসনেস। কারণ মানুষ শুধুমাত্র সচেতনই নয়, আত্ম সচেতন। হেগেলের এই আত্মসচেতনার ধারণার সঙ্গে যুক্ত আছে অন্যদের প্রতি আমাদের সচেতনতা। যাকে হালের মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, ‘থিওরি অব মাইন্ড’, যার দ্বারা তারা বোঝান অন্য মানুষের মন আছে এটা ঠাহর করতে পারার ক্ষমতা এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, অন্য ব্যক্তিরাও চিন্তা করে। কিন্তু হেগেলের কাছে বিষয়টি হলো এটাও ঠাহর করতে পারা যে আমিও অন্যের চিন্তার বিষয়, আমার চিন্তা সম্পর্কে তারা অনুমান করতে পারে। ঘটনাটি এমন, দুটো অনুরূপ আয়নাকে পরস্পরের মুখোমুখি করলে যা দাঁড়ায়। যেখানে প্রতিটি আয়না একটি সুড়ঙ্গ পথ ধরে বারবার পরস্পরকে প্রতিফলিত করে, অসীমভাবে।
মানুষের আত্ম-চেতনের এই প্রতিফলনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আনুধ্যানিকভাবে যুক্ত হয়েছেন পরবর্তী সময়ের কন্টিনেন্টাল ধারার অনেকে। তবে তাদের ভাবনার ফারাক রয়েছে। হেগেল বিশ্বাস করতেন নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দুই সচেতনত্বের মোকাবিলায় একটি অন্যটিকে আয়ত্ব করতে চায়। যদি নাও হয়, এই প্রক্রিয়া নিজেই প্রথম সচেতনতার ধরনকে বদলে দেয়। যার মাধ্যম চেতনার বিভিন্ন রূপের সূত্রপাত হয় যা হেগেলের মতে মানুষের জীবন ও ইতিহাস গঠন করে। এটা শুধুমাত্র তখনই শুরু হয় যখন সচেতনতা অপরের অস্তিত্বকে কবুল করে নেয়।
এর বিপরীত মত পাওয়া যায় জাঁ পল সার্ত্রের ‘বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস’ (১৯৪৩) বইয়ে। সেখানে তিনি জানাচ্ছেন, আমরা বিষয়ী বা সাবজেক্ট (নিজেদের জন্য) ও অবজেক্ট বা বিষয় (অপরের জন্য) উভয়ই। কিন্তু একই সময়ে আমরা দুটো সম্পর্কে সচেতন হতে পারি না। আমাদের সচেতনতা দুটি খুঁটির মধ্যে দোল খায়, কখনোই দুটো অবস্থানে একই সময়ে থাকতে পারে না। এমন পরিস্থিতি থেকেই মানুষের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে উভয়সংকট পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই যে দোল খাওয়ার প্রস্তাবনা এতেই হেগেলের সঙ্গে সার্ত্রের পার্থক্য যার কোনো অগ্রসর পর্যায় সম্ভব নয়, সুতরাং হেগেলকে অনুসরণ করে সচেতনতার কোনো ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ সম্ভব নয়। এভাবে হেগেলিয়ান ধারার সঙ্গে সার্ত্রের সাবজেক্ট-অবজেক্টের সঙ্গে সম্পর্ক রচিত হয়, যা একইভাবে মার্কসবাদী চিন্তার সঙ্গে বোঝাপড়ায়ও ব্যর্থ হয়।
একই বিষয়ে বিকল্প প্রস্তাবনা পাওয়া যায় অ্যালেজান্দে কোজেব, মার্টিন বুবার, ইমান্যুয়েল লেভিনাস, মিশেল ফুঁকো ও অন্য অনেক কন্টিনেন্টাল দার্শনিকের চিন্তায়। আর বিষয়টি নিয়ে এত এত অনুসন্ধান বলে দেয় মানব মিথস্ক্রিয়ার মৌলিক বৈশিষ্টগুলোর এই ক্ষেত্রটি অনুসন্ধানের জন্য ফলপ্রদ। যা গভীর ও উদ্দীপনাময় চিন্তার জন্ম দেয়।
চার.
ফরাসি মনোবিজ্ঞানী জাক লাকাঁও আত্ন বা অহং ও অপরের দ্বান্দ্বিকতাকে ফ্রয়েডের অচেতন তত্ত্বের আলোকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও ফ্রয়েডের প্রকল্পটি দাঁড়িয়ে আছে জৈবিক আবেগের ওপর। থিওরি অব দ্য আদারে লাঁকার অবদান হলো বিগ আদার ও লিটল আদারে পার্থক্য দেখানো। বিগ আদারকে বুঝানো হয় বড় হাতের ‘এ’ দ্বারা, যা ফরাসি শব্দ আউত্রে নির্দেশ করে আর লিটল আদার হলো ছোট ‘এ’। লাঁকার প্রথমদিকের কাজে ছোট ‘এ’ নিয়ে বুঝানো হয় আমাদের কাউন্টার পার্ট বা অনুরূপ অংশকে, যা আমাদের আরশি, সংলাপে সমান অংশীদার; পক্ষান্তরে বড় ‘এ’ বা এবসুলিউট আদার আদারনেসের ধারণাকে পরিণত করে আলাদা অস্তিত্বে। তৈরি করে আদারনেস ইন ইটসেলফ। এটা বলে দেয় আদারের ধারণাকে বিশেষ কোনো ব্যক্তি ও এমনকি কোনো শরীরি অস্তিত্বের (যেমন; নদী, গাছ বা পাথর) বাইরে অনুধাবণ করার ক্ষমতা আমাদের আছে।
লাকাঁর পরবর্তী চিন্তা হলো আদারনেসের ধারণার বিমূর্তায়নের মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের ধারণায় উপনীত হতে পারি। তিনি ঘোষণা করেন, ‘এটা অসম্ভব যে ঈশ্বরে বিশ্বাস না করা’, এর মাধ্যমে তিনি নির্দেশ করেন আমাদের মনের কাঠামোর মধ্যে আদারের এমন অবতার অনিবার্যভাবে উদ্ভব হয়। একই পথে, ঐতিহাসিকভাবে আদিম এনিমিস্টিক ধর্মগুলোর অনেক স্পিরিট স্থানচ্যুত হয় একত্ববাদী ধর্মের ‘আদারনেস ইন ইটসেলফ’ দ্বারা। যেখানে পৃথিবীতেই আমরা আমাদের অতিক্রম করে যাওয়া কোনো কিছুর মোকাবিলা করি। এই ঈশ্বরকে আবার বিপজ্জনকভাবে পৃথিবীতে নামিয়ে আনা হয়, যেমন; কোনো একজন বিশেষ ব্যক্তিকে আদার হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে ঈশ্বরের স্থান দেওয়া হয়। যা প্রায়শ ঘটে টোটালিটারিয়ান বা কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের স্বৈরশাসকের ক্ষেত্রে।
কিন্তু সমাজ নিজেও আদার হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। মানে এর নিয়ম, অনুমান ও আইনে আমরা যেভাবে বশ্যতা স্বীকার করি। বিকল্পভাবে আদার আমাদের ভাষাকে নির্মাণ করে। আমি যদি কাউন্টারপার্ট (ছোট ‘এ’) আদারের সঙ্গে কথা বলি, তার শব্দ ও ব্যাকরণ আমরা উভয়ই ব্যবহার করি যা আবার স্বাতন্ত্র্য হিসেবে আমাদের নিজস্ব নয়। বাইরের কোনো উৎস থেকে আমরা ভাষা ধার করি, ব্যবহার করি। সেটা হলো বিগ আদার।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যে শব্দগুলো আমরা উচ্চারণ করি— কখনো সম্পূর্ণরূপে তার বহন করা অর্থ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমি যা-ই বলি না কেন তা যেভাবে বলি তার অভিপ্রায়কে অতিক্রম করে যায়। লাকাঁর তত্ত্ব মতে, এই বাহুল্য হলো অজ্ঞান বা অচেতন। তাহলে অচেতন হলো আমাদের ভাষার ব্যবহারের ফল, যার মূল বিষয় হলো আমরা কথা বলা সত্তা।
এখন আমরা দুটি ধারণার মুখোমুখি। ‘দ্য ডিসকোর্স অব দ্য আদার’ হিসেবে লাকাঁর অজ্ঞানতার তত্ত্ব ও ফ্রয়েডের সচেতন থেকে অবদমিত মনের তত্ত্ব। এর যে কোনোটি গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া একজন এভাবে দেখতে পারেন, মন নিজের কাছে স্বচ্ছ নয়। কোনো অন্তদর্শনই তাকে পুরোপুরি প্রকাশ করে না। কিন্তু বিশ্লেষণী ধারা কদাচিৎ এ ধরনের মত মেনে নেবে। কারণ সচেতনতা বা কনসাসনেসকে ধরে নেওয়া হচ্ছে পুরোপুরি স্বচ্ছ আত্ন-সচেতনতা বা সেলফ-অ্যাওয়ারনেস হিসেবে। উপরের ধারণাগুলো না মানলেও ধরেই নেওয়া যায় সেলফ-অ্যাওয়ারনেসের ধারণা সন্দেহজনক ও এর যাচাইকরণের দরকার আছে।
প্রকৃতপক্ষে বিশ্লেষণী ধারার দার্শনিকরা যদি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ের দিকে জোর দেন, তবে দেখতে পারেন প্রাথমিক অনুমানগুলোর বিকল্প রূপ আছে। আর হ্যাঁ, বিশ্লেষণী ও কন্টিনেন্টাল ধারার এই বিচ্ছেদে পশ্চিমা দর্শনের উপকার হচ্ছে না, এমনকি নিকট ভবিষ্যতে সেতুবন্ধনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অপরের ধারণার মাধ্যমে তার একটা রূপ দেখা গেল।
পিটার বেনসনের ‘দ্য কনসেপ্ট অব দ্য আদার ফ্রম কান্ট টু লাকাঁ’ অবলম্বনে।
Comments are closed.