কাংরি বন্ধন হলো না গুরু

(আমাদের রোমেল ভাই গিয়েছিলেন হারমোনিয়ামের দীক্ষা নিতে। সেই ২০১৩ সালে। তা এক বিরাট কাহিনী। তখন প্রথম শুনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনমোহন সাধুর নাম। কিন্তু লজ্জার বিষয়– ভেবেছিলাম মনোরম। এতোবছর  পর রোমেল ভাই জানালেন, তখন ভুল লিখেছিলাম। লেখাটা ছাপা হয়েছিল আরটিএনএনে। এবার নামটা ঠিক করে কনফেশন হলো আরকি!)

সোনারগাঁও হোটেল পেরিয়ে হাতিরঝিল প্রকল্পের গাড়িশূন্য রাস্তা। মাঝে মাঝে দুই একটা সাইকেল হুশ করে ঢুকে পড়ে। বিকেল হলেই ছেলেরা ক্রিকেট খেলায় নেমে পড়ে। আজও (৭ মার্চ ২০১৩) তার ব্যতিক্রম হল না। স্বাস্থ্য-শিকারী মানুষও আছে। আছে পুলিশ। দেশে যে কিছু একটা চলছে তার সিম্বল পুলিশ।

কিছু দূর অগ্রসর হলে একটা মসজিদ। মসজিদ পেরিয়ে সরু গলি দিয়ে বস্তিতে যেতে হয়। বেশ অলিগলি পেরিয়ে কানু শাহের সেই প্রত্যাশিত ঘরটা।

kanu-shah-and-cat

কানু শাহ ও তার বেড়াল

কানু শাহ একসময় চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতেন। রসের বাইদানী, একই রাস্তা ও প্রেম পূজারী নামের তিনটা সিনেমার প্রযোজক তিনি। প্রথম দুইটা সিনেমা সাদা কালো। পরেরটা রঙিন। প্রেম পূজারীর নায়ক ছিলেন জাফর ইকবাল। জাফর ইকবালের মৃত্যুর কারণে চলচ্চিত্র অসমাপ্ত রয়ে গেছে। সে অনেক বছর আগের কথা। বর্তমানে আরেকটি চলচ্চিত্রের পরিকল্পনা করছেন। নাম প্রেমের স্বাদ। কাহিনী তার। তার সাথে আমার সাক্ষাত চলচ্চিত্র বিষয়ে নয়। গান নিয়ে। আজ তার কাছে একজনের হারমোনিয়ামের রেওয়াজ শুরু হবে। সে উপলক্ষে ছাত্রকে কাংরি পরিয়ে দেয়া হবে। এই কাংরি এক সপ্তাহ শরীরে ধারণ করতে হবে। তার কাছে গানও শেখা যায়। আপনি যাই শিখতে আসেন না কেন এটাই নিয়ম। নিয়মের ব্যতিক্রম হবে না।

মোহাম্মদ রোমেলের দীক্ষা হবে আজ। যার সাথে আমার আগে থেকেই পরিচয়। আমাদের ছিলেন রিংকু। সবাই একসাথে বলে উঠলাম কাংরি কি? কাংরি জটিল কিছু না। কাংরি হলো রাখি। বিয়েতে জরিওয়ালা যে রাখিগুলো পড়া হয়। এটাকে অবশ্যই সোনালী হতে হবে। সাদা হলে হবে না। এক সপ্তাহ হাতে রাখার পর পুকুরে ফেলে দিতে হবে। কানুশাহের কনিষ্ট শিষ্যদের একজন লিজা (১০) জানালো কাংরি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এর উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। যেমন— পুকুরে কাংরি ভাসানোর পর যতদূর যাবে শিক্ষা তত পোক্ত হবে। দীক্ষা নিলে উপস্থিত সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে হয়। একজনকে দায়িত্ব দেয়া হলো কাংরি আর মিষ্টি কেনার জন্য। মিষ্টি আসতে বেশি সময় লাগল না। ফ্রিজে ঠাঁই পেল। কাংরি কেনা হয় নাই। ধারে কাছেই পাওয়া যায়। পরানো হবে সন্ধ্যার পর। মেলা সময় বাকি।

কানুশাহের পুরো নাম শাহ আলম কানু। তিনি একজন গায়কও বটে। তিনি গান শিখেছেন ইন্ডিয়ার এলাহী বক্সের কাছে। গুরুর কথা বলতে তার মাঝে সমীহের ছাপ পড়ল স্পষ্ট। তিনি এই বস্তিতে গঠন করেছেন কানু শাহ শিল্পী কল্যাণ সংস্থা। তিনি এই বস্তির একটা বড় অংশের মালিক। যেখানে নাভানা কোম্পানি এপার্টমেন্ট করবে। এই সংস্থার অধীনে তিনি বস্তির শিশুদের গান শেখান। আসর বসে সন্ধ্যায়। তার মতে, এই শিশুরা অনেক অপ্রাপ্তি ভুলে গানের মাঝেই সান্ত্বনা খুজে পায়। এছাড়া নানান ধরণের লোক তার কাছে বাদ্য বাজানো শিখতে আসে। কানু শাহ বললেন— যেহেতু হাতে বেশ খানিকটা সময় আছে। আমরা চাইলে উনার সাথে ঘুরে আসতে পারি। বস্তির শেষ মাথায় ছোট একটা দরোজা। সেই দরোজা দিয়ে পাচার হলাম হাতির ঝিলের রাস্তায়।

আমাদের সাথে এসে হাজির হলো লিজা, হ্যাপীসহ আরো কজন। হ্যাপীর কোলে ছোটবোন পাপিয়া। পাপিয়াকে সবাই মধুর মা ডাকে। প্রথমে বুঝতে পারি নাই। পরে মনে পড়ল কোন একটা ওয়েস্ট বেঙ্গলের চলচ্চিত্রে নায়ক দেব নায়িকা কোয়েল মল্লিককে মধুর মা ডাকত। এই বাচ্চা দুটো একটু পর পরই নতুন নতুন কলি গুনগুন করছিল। হ্যাপীর মতে মধুর মাও নাকি গান গাইতে আকুল। কথা বলতে না পারলেও আ আ আ আ শব্দ দিয়ে নিজের কণ্ঠ জানান দেয়। কানু শাহের প্রতি মনটা আর্দ্র হয়ে উঠল। এই বাচ্চাদের ভেতর সুন্দর একটা শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।

কানু শাহ বলছিলেন গুরু ভক্তি গুরুত্বপূর্ণ। এটা ছাড়া শিক্ষা পূর্ণ হয় না। শিষ্য অনেক বড় কিছু হতে পারে। কিন্তু গুরু তো গুরুই। এই কথাগুলো হচ্ছিল আমরা যখন ফিরে এলাম। একটা বিড়াল আসল। তিনি বলেন, বিরক্ত করিস না। দূরে গিয়ে বস। নাছোড় বান্দা বিড়াল দূরে গেল না। তার কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। আনন্দে চোখ মুদল। কানু শাহ বলে যান, মমতাজের ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক। বেশ ক’বছর আগে তিনি মারা গেছেন। মমতাজ তখন স্টার হয়ে উঠেছে। গুরু বাড়িতে উৎসবে গেছেন শিষ্যা। তিনদিন ছিলেন। মমতাজের গান শোনার লোভে রাজ্যের লোক আসল। মমতাজ গান গাইলেন না। ওস্তাদও কিছু বলে না। মমতাজ যাবার কালে ওস্তাদ বলে, তুমি লোভ সামলাইতে পারছ। আমি অনুমতি দেই নাই বইলা তুমি গান গাও নাই। তুমি জীবনে অনেক বড় হইবা।

রোমেলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হওয়ায় গুরুভক্তি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গড়ালো। শিষ্যা মালেকাকে বললেন দুইটা বই নিয়ে আসতে। দুই খণ্ডের বইয়ের নাম মলয়া*। তিনজন লোকের নামের আদ্যাক্ষরে নামকরণ করা এই বইয়ের গানগুলো লিখেছেন মনমোহন। ম-তে মনমোহন, ল-তে লেবু এবং য়-তে আফতাব। তিনজনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিখ্যাত গীতিকবি। কাছাকাছি বাড়ি ছিল। মনমোহন বিখ্যাত হলে অন্যরা তাকে ঈর্ষা করে। এক আসরে লবু তাকে বিষ মেশানো চা খাইতে দেয়। খাওয়ার পর মনমোহন বুঝতে পারেন চায়ে বিষ ছিল। এরপর লেবু ও আফতাবের জন্য চা আসলে তিনি বিষ আছে মনে করে ফেলে দেন। আফতাব বুঝতে পারেন প্রকৃত শিল্পী হতে হলে এমনই হতে হয়। নিজের জীবনই সব নয়। অন্যদিকে মনমোহন গুরু নাম স্মরণ করলে মৃত গুরু তাকে পথ্য বাতলে দেয়। গুরু ভক্তি প্রসঙ্গে কানু স্মরণ করলেন সিরাজ সাই আর লালনকে।

আমরা যাওয়ার আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন হুমায়ুন কবির। তিনি একজন কবি। তার কবিতার বই দেখালেন। আগের রাতে বাড়ি যাবার পথে কানু শাহের শিল্পী কল্যাণ সংস্থার সাইনবোর্ড দেখে এসেছিলেন। আজও আসলেন। লালন ও হাছন ভক্তির কথা জানা হলো। সন্ধ্যায় আরো অনেকে এসে উপস্থিত হলো। বিড়ালটি ঘুরে ঘুরে অনেকের কোলে গিয়ে বসছে। বসে থাকবে কিন্তু স্পর্শ করা যাবে না। স্পর্শ করলেই কামড়। দুইজন কামড় খেলো।

আমরা হারমোনিয়ামের সামনে বসে আছি। একজন তবলচি এসেছেন। সবাই রেডি। কিন্তু যিনি কাংরি কিনতে গিয়েছিলাম তিনি দুঃসংবাদটা জানালেন। আজ মঙ্গলবার। এই এলাকার সব দোকানপাট বন্ধ। এছাড়া হরতালের দিন। কাংরি পরা ছাড়া হারমোনিয়ামে দীক্ষা হবে না। ফলে দৃশ্যটি দেখা হলো না। তার বদলে লিজা আর হ্যাপীর গলায় লালন ও বিচ্ছেদের দুটো গান শোনা হলো। একই সাথে হয়ত সবকিছু হয় না- হয়ত অন্যদিন এসে আরো কিছু শোনা হবে, দেখা হবে। কাংরি পরানো দেখব। সেই পযন্ত বিদায় জানিয়ে নিজের পথ ধরি।

………………………….

*তিনজনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। কিন্তু তিনজন গীতিকবি নন। মনমোহন দত্ত মুখে মুখে গান বানাতেন। লেবু লিখে রাখতেন বা নোট নিতেন। আর আফতাব উদ্দিন সুর করতেন ও গাইতেন। এই আফতাব উদ্দিন হচ্ছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বড় ভাই ।)

 

Comments

comments