মাহফুজা ও আতা গাছে তোতা পাখি
গাজীপুরের কালিগঞ্জের নাম শুনতেই মাহফুজার কথা মনে উঠল। ৭ বছর হল তারে দেখি না। ফোনেও কথা হয় নাই— বছর ৫। গতবছর একবার ফোন করছিলাম— ওর মা ধরে বলল, মাহফুজা এ নাম্বার ইউজ করে না। কারণ বন্ধুদের উপর তার প্রবল অভিমান। বিষয়টা আমি অরূপকে জানাই। কারণ, আমি কখনো মাহফুজার ভাল বন্ধু ছিলাম না। অরূপ, শফিক— আরও কেউ কেউ তার ভাল বন্ধু ছিল। অরুপ জানাল সে বিষয়টা জানে। মানে পরীক্ষিত ভাল বন্ধু।
কিন্তু আতাফল বিষয়ক একটা ঘটনা তাকে আমার স্মৃতিতে অনেককাল জাগ্রত রাখবে। আশা করা যায়।
মাহফুজা ক্লাশের বন্ধুদের প্রায়শ তাদের বাসায় যাওয়ার কথা বলত। তো, যাওয়া হয় না হয় না এমন করতে করতে আমরা কয়েকজন একদিন গেলাম। পুরানো শামসুন্নাহার হণেন পাশে তাদের কোয়াটার। আমি, শফিক ও অরূপ হইতে পারি অথবা অন্য কারো সঙ্গে। গিয়ে দেখি সব বাসা একই রকম। তো, একজন নারীকে জিগেস করি, আপা মাহফুজাদের বাসা কোনটা? তিনি হেসে বলেন, আমার সঙ্গে আসো। তার বদন্যতায় আমরা খুশি হই। এটা খুশি হওয়াই ঘটনা। পরে দেখা গেল এ আপা মাহফুজার আম্মা, যাকে পরে আমরা আন্টি বলতাম। যাইহোক ঘটনা মজার, তবে আতাফল বিষয়ক না।
কোন একদিন আমার এক প্রাণবন্ধু (এখনও নিশ্চয়) কথায় কথায় জানাল, সে আতাফল চিনে না। যেহেতু চিনে না, সেহেতু কখনো খায় নাই। বিষয়টা আমাকে আহত করে। কারণ দুনিয়ার যত সুখাদ্য ফলফলাদি আছে, তার মধ্যে আতাফল অন্যতম। ঘটনাচক্রে মাহফুজা তাদের বাসার আশেপাশের গাছের কথা বলতেছিল একদিন। আমি জানালাম আমার পছন্দের ফল আতা। সে জানালো তাদের বাসার পেছনে বেশ সরস আতাগাছ আছে। আমি বললাম, কিছু আতাফল দিস। আমার প্রাণবন্ধুকে খাওয়াবো।
হয়ত আতাফলের বিষয়টা ভুলে গিয়েছিলাম, অথবা খানিক ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। তেমন একদিন সকাল সকাল (৭টার দিকে হয়ত) মাহফুজা মোবাইল করল। হলের বাইরে গিয়ে দেখি বাজারের থলে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে থলেতে ৪-৫টা গাছ পাকা আতা। এমন আতা যারা খেয়েছেন তারাই মর্ম বুঝবেন। মাহফুজা খুব একটা সৌজন্য দেখানোর সুযোগ না দিয়ে চলে গেল।
সে আতাফল আমার সে প্রাণবন্ধুর (এখনও নিশ্চয়) জন্য নিয়ে গেলাম। সে বলল, আতাফল তো কত খেয়েছি। নতুন আরকি!
বিষয়টা তো এই আতাফল দুনিয়াতে নতুন কিছু না। তার না খাওয়ার বিষয়টা ভুল শুনতেও পারি। এরপর কিছু দিন-রজনী কাটল, হয়ত মাস গড়িয়ে বছর। তারপর কোন একদিন মাহফুজাকে আতাফলের জন্য ধন্যবাদ জানালাম। তখন সে বিস্মিত হয়ে বলে, কিসের আতাফল। আমি কখনো তোর হলের সামনে আতাফল নিয়ে যাই নাই।
আমি তখন বিস্মিত হয়েছিলাম, যেহেতু এমনই হওয়ার কথা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এখানে বিস্ময়ের কিছু নাই। কিছু আতাফল একটা থলে আর মাহফুজা হয়ে আমার কাছে আসতে পারে— যেমন বাতাস আমাদের নিঃশ্বাস নিয়ে থাকে— কোনো ধন্যবাদ ছাড়াই। আসলেই এতে বিস্মিত হওয়ারও কিছু নাই। তারপরও আতাফল বিষয়ক যে কোনো ঘটনা আমার কাছে শুধু ‘আতা গাছে তোতা পাখি’ই নয়, মাহফুজা বিষয়ক ঘটনা হয়ে যাবে।
মার্চ ১৬, ২০১৫
মিরপুর টু মাওয়া ও ডাইনোসর
গাড়ীর নাম স্বাধীন এক্সপ্রেস। মিরপুর ১২ থেকে মাওয়া যায়। এ গাড়ি করে শিমুলিয়া ঘাট থেকে ফিরতেছিলাম। নামলাম তালতলা। তারপর বাসার পথে রিকশা। পথে পড়ল বিজ্ঞান যাদুঘর। দেখলাম অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে ডাইনোসর। কত কত বছর হইল। কত কোটি বছর। পুরানা শিহরণ হানা দিল! ডাইনোসরের পিঠে সওয়ার হলাম।
প্রথমবার বিজ্ঞান যাদুঘরে আসছিলাম আমি আর জসিম ভাইয়া। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলাম। ছোটবেলার বন্ধুই বলা যায়। তারপর তুচ্ছ একটা কারণে কথা বলা বন্ধ। অনেক বছর পর এক বিয়েতে দেখা। তার বাসায় যাইতে বললেন। কখনো যাওয়া হয় নাই। তারপর গতবছর আরেক বিয়েতে দেখা। কিন্তু যাওয়া হয় না। কি যেন কেটে গেছে!
এরপর গেছিলাম টিপুর সঙ্গে। লতাপাতায় ভাগ্নে আরকি! আমার চেয়ে খানিক ছোট ছিল। এখন জেলে। যাবজ্জীবন সাজা খাটছে। শুনেছি তার বিশাল নেটওয়ার্ক। কখনো আমাকে দেখলে চিনবে না জানি। কিন্তু কল্যানপুরে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর দিনগুলো মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
একবার গেছিলাম আমি আর রাসেল। সম্ভবত বৃহস্পতির উপগ্রহ দেখতে দূরবীন দিয়ে। দেখছিলামও বোধহয়। রাসেলের সঙ্গে অনেকবছর দেখা নাই। ব্রিটেন থাকে। ফেসবুকের কল্পনা হঠাৎ কইরা পাইয়া গেলাম। কয়েকদিন বেশ কথা-টথা হলো। পরিকল্পনা হলো ও দেশে আসলে সেন্ট মার্টিন যাবো। এখন আর কথা হয় না!
বছর কয়েক আগে মিশু আসছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ভাইভা দিতে। তখন কলেজ বন্ধু সুজনের সঙ্গে যাদুঘরের সামনে চা খাইলাম। ওর সঙ্গেও অনেকবছর পর হঠাৎ করে দেখা। এখন আর কথা হয় না। ওইদিন আবার দেখা। বলল, ও দেখা করতে চাইলে না করি তাই ফোন-টোন করে না। পাত্তা দিই না বলে। বললাম, পাত্তা না দেয়ার কিছু নাই। আসলে বলার মতো কথা খুজে পাই না।
রহস্যপত্রিকার একটা কাভার ছিল ডাইনোসরের ছবি সমেত। ফিচারটা অনেকবার পড়েছি। তারপর ডিভিডি কিনে ‘জুরাসিক পার্ক’ সিরিজের সবগুলো সিনেমা দেখা। বার বার। কিছুদিন আগে নতুন পর্ব ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’ দেখছিলাম। ভালো লাগে নাই। খাপছাড়া লাগল। একই হিংস্রতা ও পশুকে বশ মানানো, স্বভাব পাল্টে ফেলানোর কসরত হলিউড কত দেখাবে। বিজ্ঞান, বিনোদন বা কল্যান— কোনো নামেও পারছে না। হয়ত তারা নিজেরা পাল্টে গেলে অনেক কিছু সম্ভব।
ডাইনোসর শব্দটাই আমাকে এখনো শিহরণ জাগায়। বিজ্ঞান, বিনোদন বা মানব কল্যাণ কিছুর কাছেই এ অনুভূতির ব্যাখ্যা চাই না। অন্ধকারের ঘাপটি মারা ডাইনোসর ভালো লাগে। স্মৃতির মতো, ভবিষ্যতের মতো অথবা সে সব কাল্পনিক মানুষের প্রতি ভালোবাসার মতো। যা দেখি না, দেখব না, আস্বাদ করি নাই— শব্দের ভেতর, কল্পনার ভেতর মূর্ত হয়ে উঠি। এর পর যা বলি বা করি, তাতে তার ছাপ থাইকা যায়। ভালবাসা। সবার জার্নি সুখের হোক।
অক্টোবর ৪, ২০১৫