‘এত সুখ সইবো কেমন করে
বুঝি কান্নাই লেখা ছিল ভাগ্যে আমার
সুখেও কান্না পায় দুচোখ ভরে’।
এ ঠিক কেমন সুখ! আর কেমন কান্না! নীলুফারের শ্রোতারা হয়তো টের পেতেন। এখনো পান। কিন্তু যেই অনুভূতিকে কোনো বাইনারি মনে- হয় সুখ নয় দুখ এই দ্বিভাজনের বাইরে- আমরা কি আজ আঁচ করতে পারবো? এই যেন না রাত-না দিন সেই অদ্ভুত মুহুর্ত। গোধূলি বেলা। যেখানটায় মানুষের অনুভূতিগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন ধরন আর সীমানায় আলাদা করা যায় না। অনুভূতির এই গোধুলিকালের জড়াজড়ি বাংলাভাষার শ্রুতির জগতে তুলে এনেছেন, ধরে রেখেছেন নীলুফার ইয়াসমীন, পুরো সত্তর আশি ও নব্বই- তিনটি দশক জুড়ে। নীলুফারের কন্ঠে আঁচ করা যায়; তিনি এই না সুখ না দুখ না হাসি না কান্না’র জড়াজড়ি অনুভূতিদের নিবিড়তম পথে নিজেকে সপে দিয়ে বুঝতে পারতেন- কিভাবে এই মুহুর্তগুলোকে কন্ঠে তুলে আনতে হয়।
সময়টি ছিলো ১৯৮৬ সাল। চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম শরৎচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করবেন চলচ্চিত্র শুভদা। চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখা হলো। ‘এতো কান্নাই লেখা থাকে ভাগ্যে আমার’। সাবিনা ইয়াসমীনকে গাইতে অনুরোধ করলেন চাষী। গানের কথা এবং বিস্তৃত মাত্রার দিকে খেয়াল করে সাবিনা রাজি হলেন না। চাষীকে সাবিনা জানালেন, গানটির কথা ও চলচ্চিত্রের আবহের সাথে সবচে ভাল গাইতে পারেন নীলুফার। এই গানটি নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চাষী বলেছিলেন, ‘নীলা ভাবী গানের সুর ক্যাসেটে রেকর্ড করে নিয়ে গেলেন। ৪ দিন বাসায় গানটি চর্চার পর তিনি গানটি রেকর্ড করার জন্য সময় দিলেন। গানের জন্য এতটা নিরলস শ্রম ক’জন শিল্পীই বা দেয়! যেটি নীলা ভাবী দিতেন।’
https://www.youtube.com/watch?feature=player_embedded&v=fPqu4wd9XPc
গানটির কথা মো. রফিকউজ্জামান ও সুর করেছেন খন্দকার নুরুল আলম। মুক্তি পাওয়ার পর নীলুফারের কন্ঠে গানটি’র সুবাদেই অনেকানেক ছড়িয়ে পড়ে চলচ্চিত্র শুভদা’। চাষী বলেছিলেন, ‘তার মতো শুদ্ধ সঙ্গীতশিল্পী আমাদের দেশে ক’জন আছে আমি জানি না। আমি এটা অন্তত বুঝি যে, নীলা ভাবী শুদ্ধ সঙ্গীতের যে চর্চা করতেন সেটি বর্তমানকালের শিল্পীদের মধ্যে বিরল।’ নীলুফারের সক্রিয় গায়কীর তিন দশকে অন্য কোনো শিল্পীই তার মতো করে- কীর্তন-নজরুল-আধুনিক গানের নিজস্ব চর্চার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের প্লে ব্যাকে- বাংলা গানের নানা শাখায় ধরনে- শ্রোতাদের কন্ঠে গুনগুন তুলে দিতে পারেন নাই। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো ‘বিরল’ বলছেন চাষী নজরুল ইসলাম। আবার বর্তমান শিল্পীদের মধ্যে ‘বিরল’ হওয়া হয়ত বর্তমান শিল্পীদের কাছে চাষীর না পৌছাতে পারার কারণেও হতে পারে।
চাষীর মত, চাষীর পূর্বসুরি ও সমসাময়িক অনেক প্রভাবশালী ও বরেণ্য পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন নীলুফার। সঙ্গীত পরিচালকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন খান আতাউর রহমান, খন্দকার নুরুল আলম, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলম খান। যেমন শুধু খান আতাউর রহমানের সুজন-সুখী, অরুণ বরুণ কিরণ মালা, জোয়ার ভাটা, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী, যে আগুনে পুড়ি, জীবন-তৃষ্ণা, জলছবি; এই চলচ্চিত্রগুলোতে প্লে-ব্যাক করেই নীলুফার গ্রাম-বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন।
রবীন্দ্র-নজরুল পার হয়ে পঞ্চ কবির গানের পর বাংলা গান যখন আর ছড়াতে পারছিল না, আগের বৃত্তের মধ্যে আটকেছিল, তখন যে হাতেগোনা কজনের কন্ঠে ভর করে বিকাশ ঘটেছিল গানের, নীলুফার তাদের একজন। তার পথ চলার সাথী ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কীর্তিমান পরিচালক খান আতাউর রহমান। ১৯৬৯ সালে প্রখ্যাত তিনি খান আতাকে বিয়ে করেন। ১৯৭০ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয়া তাদের একমাত্র ছেলে আগুন এখন প্রতিষ্ঠিত কন্ঠশিল্পী। নীলুফারদের পারিবারিক ঐতিহ্য তাকে অনেক এগিয়ে রেখেছিল আগেই। ফলে খান আতার পক্ষে কাজটা অবশ্য খুব কঠিন ছিল না।
১৯৪৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ১৩০/অ পার্ক স্ট্রিটে যে মায়ের মেয়ে হয়ে তিনি জন্মেছিলেন, সেই মা মৌলুদা খাতুন শিল্পী ছিলেন। গান শিখেছিলেন সেইকালে বিখ্যাত ওস্তাদ কাদের বকসের কাছে। নীলুফার ইয়াসমিনদের ৫ বোনের মধ্যে তার বড় বোন ফরিদা ইয়াসমীন ও ফওজিয়া খান এবং ছোট বোন সাবিদা ইয়াসমীন কন্ঠশিল্পী। নিজের দরদ ও প্রতিভা, সংগীতে পারিবারিক ঐতিহ্য এবং জীবনসঙ্গী খান আতার সহযোগিতায় বাকি পথে নীলুফারের তেমন কোনো কষ্ট হয়নি।
তার আধুনিক গানগুলো কথা, সুর ও গয়কীতে অনন্য। ‘প্রতিদিন সন্ধ্যায় হারাবে যে আলো’, ‘তোমাকে পাবার আগে জ্বলে জ্বলে বলতাম মিলনেই প্রেম হবে সত্য জ্বলে জ্বলে বুঝলাম বিরহেই প্রেম ছিল সত্য’, ‘নীল পাখিরে তুই মরুভূমির তৃষ্ণায়’, ‘এখন কেন কাঁদিস ও পাখিরে কেন ধরা দিতে গেলি পিঞ্জরে’, ‘যে মায়েরে মা বলে কেউ ডাকে না সে মায়ের বুকেরে কি আগুন কেউ তো জানে না রে মানিক কেউ তো জানে না’, ‘ফুলে মধু থাকবেই বিষ থাকবে না’, ‘দিওনা দিওনা ফেলে দিওনা’, ‘এক বরষা বৃষ্টিতে ভিজে দুটি মন কাছে আসলো’, ‘জীবন সে তো পদ্মপাতায় শিশির বিন্দু’, ‘যদি আপনার লয়ে এ মাধুরী’, ‘পথেরও শেষে অবশেষে বন্ধু তুমি এলে’সহ অসংখ্য আধুনিক গান।
ইয়াসমিন এমনকি নব্বইয়ের শেষদিকে একবার বিটিভিতে ঈদ অনুষ্ঠানে বাংলা পপ গানের দল রেনেসা’র একটি গান-‘হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়’ গানটি দক্ষ ও নিপুন গলায় তুলেছিলেন। উচ্চাঙ্গ থেকে শুরু করে অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, টপ্পা, ঠুমরি, কীর্তন, রাগসহ গানের প্রায় সবগুলো শাখাতেই তার কাজ আছে। প্রচুর গেয়েছেন।
বিশেষত রাগ প্রধান গান করেছেন অনেক। ১৯৬৪ সাল থেকে ওস্তাদ পি সি গোমেজ এর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখা শুরু করেছিলেন তিনি। পরে ১৯৮৪ সাল থেকে উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ-র সুযোগ্যা ছাত্রী মীরা ব্যানার্জীর কাছ তালিম নিতে থাকেন। এরপর প্রখ্যাত সারেঙ্গী বাদক ওস্তাদ সগীরউদ্দীন খাঁ ও মুরশিদাবাদের ওস্তাদ এ দাউদ সাহেব ও প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দীর্ঘকাল তালিম গ্রহণ করছিলেন তিনি।
অবশ্য শহুরে মধ্যবিত্তের মাঝে তিনি নজরুল সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেই বেশি পরিচিত। নজরুল সংগীত চর্চাকে তিনি সংগঠনিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি একজন শিক্ষকও বটে। ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের নজরুল সংগীত বিষয়ের প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। ২০০৩ সালে ১০ মার্চ বারডেম হাসপাতালে ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন।
*লেখাটি রাজনৈতিক.কমে পূর্ব প্রকাশিত।