ইতিহাসে কবে কি ঘটে, কে কিভাবে ঘটায় তাকে বস্তুনিষ্ট আকার দেয়ার বাসনা কঠিন বটে। ইতিহাস যাকে বলি তাকে সময় নামক ধারণার ভেতর কিভাবে পুঁতে দিই— সেটাও প্রশ্ন। সময় একাধারে বীজ, আবার মহীরুহ। মহূর্তেই সে কোন না কোন সম্ভবনা গজিয়ে তুলছে। তাই একে রহস্যময় বলা গেলে দারুণ হত। কিন্তু রহস্য দিয়ে আমরা কি করব!
সময়কে কিভাবে ধরা যায়— এই দ্বিধা আমার মনে। কিন্তু এটা তো সত্য, আমরা নিজেদের এক প্রবাহমানতার ভেতর আবিষ্কার করি। আবিষ্কার এই অর্থে যে আমরা অনন্তের দিকে বেঁকে যাওয়া সময়ের প্রবাহমানতা ধরতে পারি না। এমনকি কোন ঘটনা আকারেও আমরা কি বেছে নেব আর নেব না তার মধ্যেও ব্যাপক ফারাক রেখে চলে। তাই প্রবাহমানতার মধ্যে আমরা যা বলি হয়তো অর্ধেকের চেয়ে কম অথবা কিছুই বলি না। কিন্তু আমার বলাবলির মধ্যে যদি স্বাক্ষী(গোপাল) থাকে তখন কি হয়!
ইতিহাস আর সময় নিঃসন্দেহে একই বিষয় না। কিন্তু চুল আর মাথার সম্পর্ক কে না জানে। হুমায়ুনের যখন সময় ধরার বাসনা জেগেছে তিনি উপন্যাস লেখার জন্য ঐতিহাসিক বিষয়কে বেছে নিয়েছেন। দেয়াল ফিকশন নাকি সময় ধরা— তা ক’টি অধ্যায় প্রকাশের পর পরই দেখা গেছে। অবশ্য সময় ধরেও মহত্তম ফিকশন লেখার নজির ইতিহাসে ভুরি ভুরি। এটা শুদ্ধতা বা অশুদ্ধতার চেয়ে রাজনৈতিক আকারে আমাদের নিজেদের প্রশ্নের মুখোমুখি করতে না পারার বা সক্ষম না হয়ে ওঠার লক্ষণ।
কিন্তু মোটাদাগে উপন্যাস বা যেকোন শিল্পের ক্ষেত্রে সত্যাসত্যের প্রশ্নটা কি? প্রশ্ন যদি আসে, তবে হুমায়ুনের ‘মধ্যাহ্ন’ নিয়ে দারুণ সব প্রশ্ন উঠত। তার বারো পৃষ্ঠার উকিল মুন্সীর সাথে ঐতিহাসিক উকিল মুন্সীর কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু চরিত্র আকারে তার সম্ভাবনা ছিল অপার। যা ঘটেছে তাও দারুণ। কিন্তু সে বিচার করা হয় নাই। যদি করা হত শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা দারুণ সব আলোচনা তুলতে পারতাম। যেহেতু এক ক্ষেত্রে হয়, আরেকক্ষেত্রে হয় না— এটা কি শুধুমাত্র রাজনৈতিক পঠনের ফল? এক অর্থে। বিচার না করার সমস্যা আমাদের সাহিত্য চর্চার মধ্যে রয়ে গেছে। বিচার নঞর্থক কোন শব্দ নয়, পুরোমাত্রায় সদর্থক।
মোটাদাগে, তা যদি উপন্যাস বা যেকোন ফিকশন ফর্মে হয় তখন তো তাকে ইতিহাসের বস্তনিষ্ঠতার বিচারে দেখাও চলে না। এই চলাচলির বাইরেও তা থাকে, তা কোন নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনা লেখকের অনুভূতি বা বিচার বিবেচনায় ছাপ ফেলে। ফলে সৃজনীশীলতার ফর্মে বিচার করা গেলেও তর্ক আটক থাকে কোন ঐতিহাসিক মহূর্তের জাজমেন্ট কি আকারে দাঁড়ায়।
এছাড়া উপন্যাস যে ধরনের নৈতিক বা অনুভূতিজাত ভিত্তির উপর নির্মিত হয়— তার বিচার গোলমেলেও বটে। তবে এইটুকু তো বিচার করা যায়— উপন্যাস বা ফিকশনের অভিমুখ কোন দিকে। সেদিক থেকে শিল্পমাধ্যম ও ঐতিহাসিকতার একটা গোলমেলে সম্পর্ক দাঁড়ায়।
হুমায়ুন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসটি তার জীবদ্দশায় ও প্রকাশের আগে নানা বিতর্কের জম্ম দিয়েছে। উপন্যাসটির কয়েকটি কিস্তি ২০১২ সালে পত্রিকায় প্রকাশ হয়। বিতর্কটি শেষ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে গড়ায়। মূল আপত্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে তথ্য বিভ্রাট ঘটেছে। আদালত এই তথ্যগুলো সংশোধনের কথা বলে নির্দেশনা দেয়। আরো কিছু বিতর্ক উঠে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বড় করে দেখানো হয়েছে। তর্কটার প্রধান সমস্যা হলো হুমায়ুন আহমেদ স্বভাবসুলভ যে নিমোর্হভঙ্গি নিয়ে চরিত্র তৈরি করেছেন— সেদিকে।
সমস্যা আরো আছে— তিনি তাড়াহুড়ো করে কাহিনী বলে গেছেন ও মেজর জিয়াকে বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে দায়ী করেছেন। এইসব কিছু আমাদের জানা ছিল না। যদিও পত্রিকায় লিখিয়ে আপত্তিকারীরা এই বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে কথা তুলেন নাই। আবার এই আপত্তি না করাকেও আমরা সহজভাবে গ্রহণ করেছি। অর্থ্যাৎ, একটা স্পষ্ট দেয়াল আছে এই বিচারে।
মজার দিকটা হলো এটা যদি সমস্যা হয়ে থাকে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মধ্যে ভালোত্ব আবিষ্কার, তবে ধরতে হবে হুমায়ুনের নব্বই ভাগ উপন্যাসেরই সংশোধন দরকার। তার খারাপ লোকেরা মানবিক উৎকর্ষের বাইরে না। সংশোধন হওয়ার পর অবশ্য সে বির্তকের অবসর মিলবে না। আদালতের নির্দেশনায় কিছু তো বদলেছে। দেশের মানুষ মেজর ফারুক চরিত্রের যুদ্ধ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে।
একইভাবে দেখি সংশোধিত বইয়েও একটা চরিত্র প্রশ্ন তুলছে। সেখানে হুমায়ুন তথ্যসূত্র বাতলে দিয়েছে। এমনকি মেজর জিয়া ও জেনারেল ওসমানী (যাদের সাপে-নেউলে সম্পর্ক) তারা শেখ মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্র করছে— সেখানেও গোয়েন্দাগিরির তথ্য জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু এই তথ্য দিয়ে আমাদের কি হয়। সন্তুষ্ট হওয়া যায় না— সেটা মিলবে আনিসুজ্জামানের ভূমিকায়। তাহলে জনপ্রিয়তা বা জনের চাহিদা মেটানোর বিষয় থাকে। সেক্ষেত্রে অনুমান করা যায় বেশি সম্পাদনা করলে বইটির আর কিছুই থাকে না। আরো প্রশ্ন থাকে এটা দিয়ে কি হয় উপন্যাস জিয়াতে এসে শেষ হওয়া। যা কখনো মূল অভিমুখ মনে হয় নাই। কিছুতেই কিছু হয় না। এরচেয়ে সম্পাদিত উপন্যাসটি নিয়ে আরো দুই এক ঘা দেয়া যাক।
কাহিনী কিছুটা জানান দেয়া যাক। এই উপন্যাসের কাহিনী এগিয়েছে শফিক ও অবন্তি-কে ঘিরে। অবন্তি দাদার সাথে থাকে। বাবা-মা স্পেনে। অবন্তির একটা ট্রাজিক অতীত আছে। যুদ্ধের সময় গ্রামে আশ্রয় নিলে পাকিস্থানী মিলিটারির চোখে পড়ে। রাতারাতি এক পীরের ছেলের সাথে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। অবন্তি বা তার দাদা কেউ মানতে পারে না। অবন্তির মাঝে কিছু পাগলামী থাকে। সে দাদাকে শায়েস্তা করার জন্য পীরের সাথে সখ্যতা দেখায়। শফিক অবন্তির গৃহশিক্ষক। যে কিনা একমাত্র ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়।
অবশ্য অন্যকেউ প্রতিবাদ জানান নাই এমন তথ্য হুমায়ুন নিজেও বিশ্বাস করেন নাই বলে জানান। তাদের ঘিরে আছে দেশের রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত একগুচ্ছ চরিত্র। যারা জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছেন। যে বাংলাদেশে হুমায়ুন দেয়াল দেখতে পেয়েছেন।
এই দেয়াল আসলে কিসের দেয়াল? বলতে হয় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠেনি। সমাজের নানা স্তর-বিভাজন রয়েছে। অথচ সাম্য, ন্যায় ও ইনসাফের জন্য এই দেশের মানুষ পাকিস্তানী জালেমের বিরুদ্ধে লড়েছিল। একটি রাষ্ট্র হয়ে ওঠার যে শর্ত, সামনের বাধার দেয়াল টপকে যাওয়া। একে খুবই সহজ বা গরল করে দেখা যায়। তার জন্য হুমায়ুনের সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ক্ষমতার অলিগলিতে ঘুরেছেন। ক্ষমতা নিজেকে কি করে নিজের নায্যতাকে হাজির করে তাকে সরলরৈখিক গতি দিয়ে দেখলে হয় না। অন্তনির্হিত দিকটি বুঝতে হয়। সন্দেহকে উহ্য রেখেই বলি, একই সাথে ক্ষমতা ব্যক্তির নিয়তিকে কিভাবে নির্ধারণ করে তা হুমায়ুনের উপন্যাসে দেখা গেলেও একের পর এক খুনের ভেতর কি করে নায্যতা উৎপাদনের ক্ষমতাকে হারায় তা তিনি রাজনৈতিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ। বরং প্রচলিত ন্যারেশনের দরবারে তার বিস্ময়কর আত্মসমর্পণ। তারপর শেষ রক্ষা হয় না। যেটুকু অমিল তার জন্য মৃত হুমায়ুনের উপর খেদ প্রকাশের সুযোগ ভূমিকায় আনিসুজ্জামান ছাড়েন নাই। মোটের উপর তিনি হুমায়ুনের গুণপণা হিসেবে কিছু আপ্তবাক্যকে উপস্থিত করেছেন।
অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে ফর্মের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অ্যাখ্যান। খন্দকার মোশতাকের কৌতুকপ্রদ উপস্থাপনে হুমায়ুনের গভীরতর দৃষ্টির টের পাওয়া যায়। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ক্লাসিক আদলটা এমন করে এই সময়ের বাংলা উপন্যাসে পাওয়া যায় না। এটি শেকসপিয়রের চরিত্রের নিয়তিকে মনে করিয়ে দেয়। এই বর্ণনার মধ্যে হুমায়ুনের স্বভাবী সৌকর্য ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে অনেক গুরুত্ব পাওয়া কর্ণেল তাহের চরিত্রটি তার রাজনৈতিক চিন্তার বৈপ্লবিক দিক থেকে আসে নাই। এর মধ্যে তাহের দেশপ্রেমিক ছিলেন এমন ধরনের টোন পাওয়া যায়। সাম্যবাদের বৈশ্বিকরূপের সাথে দেশপ্রেমের এই অভিধা বাহুল্য ও খণ্ডিত। যা এখনো তার সঙ্গীদের অনেকে বুঝতে ব্যর্থ। ফলে বৈপ্লবিক ক্ষমতার রূপান্তরে যে বিধান পাল্টাতে চেয়েছেন সে বিধান তাকে দেশপ্রেমিক বলে নায্যতা দেয়। এরচেয়ে দুঃখজনক কি হতে পারে। ফলে আমাদের সমাজে তাহেরের মিথিক সম্ভাবনাও উহ্য রয়েছে। তিনি প্রচলিত বদ্ধ দেশপ্রেমের ময়দানে গড়াগড়ির বদলে কিছুই দিতে পারেন না।
উপন্যাসে লেখককে আবিষ্কার করাটাই হুমায়ুন পাঠকদের জন্য স্বস্তিদায়ক। যে আবিষ্কার আমরা এক আগেও দেখেছি জোছনা ও জননীর গল্প এবং মাতাল হাওয়ার মতো উপন্যাসে। বাস্তব আর কল্পনার মিশেল উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে। একই সাথে সময়ের মধ্যে তার হাজিরানা ও ব্যাপ্তিকে আরো গভীরতর করে। ব্যক্তিতে সময়ের ছাপ ও তার একান্ত কথা মিশেল হয়ে হাজির হয়। সে দিক থেকে অনেক অসন্তুষ্টির ভেতরও হুমায়ুন আমাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আপনার লোক বলে হাজির হন। সেটা উপন্যাসে অনেকবিস্তারের ভেতর দিয়ে দেখতে তাকে নিজের জীবনের দ্ইু এক ঘা দিয়ে দারুণভাবে তুলে ধরেন।
আরো অনেক কথা ছিল। এর চেয়ে বরং আপনারা উপন্যাসটি পড়ে নিন। হুমায়ুন না থাকার আক্ষেপটা আরেকবার অনুভব করুন। অথবা একটা অসম্পূর্ণ (অনুমান) কাজ কতটা কষ্ট দিতে পারে সেটা অনুভব করুন। কষ্ট মহৎ অনুভূতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
:আরটিএনএন.নেট-এ পূর্ব প্রকাশিত।