শিবাজী মহারাষ্ট্রের বীর । শিবাজীর নাম নিতেই একজন বলে উঠল, সে তো ডাকাত সর্দার। এই কথা ঠিক-বেঠিক যাই হোক, মানুষের দুনিয়ায় কোন কিছু আইকন হয়ে উঠার আলাদা আলাদা মাজেজা আছে। কাওরে ডাকাত সর্দার বলে ঝেড়ে মুছে ফেলা যায় না। তাই ডাকাত সর্দারও সেখানকার মানুষের পরিচয়, ধর্ম, মুক্তিচেতনার ও ইতিহাসের অন্যতম প্রধান পুরুষ। এই মোটাদাগের কথা দিয়া বলি, শিবাজী এখনো ফুরাইয়া যায় নাই। যদিও যার কথা বলব, সে অন্য জায়গার বীর পুরুষ- কিন্তু নামে নামে যমে টানে।
এই শিবাজী তামিলনাডুর বীর। আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত সফটওয়্যার এনালিষ্ট। ২৫০ কোটি রুপি কামাই করে দেশে ফিরে। উদ্দেশ্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও গরীব পোলাপানদের পড়ালেখার সুযোগ করে দেয়া। প্রকল্পের নাম শিবাজী ফাউন্ডেশন। যে কথা সেই কাজ। কাজ প্রায় মাঝামাঝি, তখন দেখা দেয় সমস্যা। স্থানীয় এমপিকে দিতে হবে ঘুষ, ৫০ কোটি রুপিয়া । কিন্তু ন্যায়বান শিবাজী তার হালাল রুজির এমন নয়ছয় হতে দিবে না। তাই ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে। এরপর সরকারী খাতায় কি কি সব অমিল দেখিয়ে প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। এরমধ্যে তার সাথে বিয়ে ঠিক হয়…। কিন্তু কন্যা রাজী না। কারণ বিবাহ হলে স্বামীর মৃত্যু যোগ আছে কপালে। সে শিবাজীর মতো ভালো মানুষরে অকালে মারতে চায় না। শিবাজী তারে নানা কষ্টে রাজী করানো চেষ্টা করে। আধ-বুড়া শিবাজীর রসবোধ কম না … মূল কাহিনীতে যাই, শিবাজী এবার সহায় সম্পত্তি ব্যাংকে মটগেজ রেখে ২০০ কোটি রুপিয়া যোগাড় করে। কাজ চলতে থাকে। তখন আবার একই সমস্যা। এমপি’র ও সাথে যোগ হয় বিজনেসম্যান আদি। শিবাজীর প্রকল্প তার বিজনেসে তা বড় প্রতিদ্বন্ধী হয়ে উঠবে। সে কল কাঠি নাড়ে। … নানা কারসাজিতে শিবাজী সর্বহারা। আদি দয়াপরবশ হয়ে তারে এক রুপিয়ার একখান কয়েন দিয়া বলে, যাও নতুন করে শুরু করো।
এবার দেখেন শিবাজির একশান। এই এক রুপিয়ার কয়েন দিয়া সে আদিরে একখান ফোন লাগায়। কি থেকে কি হয়। আদি ভয় পাইয়া তার সকল ডকুমেন্টস লুকিয়ে ফেলে। শিবাজী এতো হাতিয়ে নিয়া দেখে আদি প্রায় ২০০ কোটি অবৈধ রুপিয়ার [কালো টাকা] মালিক। ব্লাকমেইল করে শিবাজী কিছু টাকা খসাইয়া আবার কাজ শুরু করে। মাঝখানে সিনেমার লোকদের ধোকা দেয়। খাস লোক ছাড়া সবাই জানে শিবাজী পুলিশ কাস্টডিতে মারা গেছে। এই কেচ্ছা খুব চমৎকার। শিবাজী নতুন পরিচয়ে এসে …
বাকীটা দেখে নিয়েন। চমকে চমকে ঠাসা। শিবাজী- দি বস মুভির সমাপ্তিতে দেখা যায় শিবাজীর হাতে তামিলনাডু দুর্নীতিমুক্ত হয়। এই মুভির পরিচালক শংকর। যিনি অতি স¤প্রতি রবোট নামে একখান সাই-ফাই মুভি বানাইছেন।
গত কয়েকমাসে বেশ কটি তামিল মুভি দেখেছি। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি কি চমৎকার প্যাকেজ। একশান, ড্রামা, কমেডির অসামান্য মিশেল। এই ধরনের কাজ অন্য অঞ্চলে মুভি বোধ করি কম দেখা যায়। সুশীল ভাষায় বললে ভাড়ামীর অদ্ভুত মিশেল। কিন্তু কেন এই মুভিগুলান মানুষ গিলে? তার নিশ্চয় যৌক্তিক কারণ আছে।
এশিয়ার মধ্যে রজনীকান্ত জ্যাকিচ্যানের পরে সব’ চে পারিশ্রমিক নেয়া অভিনেতা। শুধু তাই নয় ৬০ কোটি রুপী বাজেটের এই ছবিটা আয় করেছিল ১২৮ কোটি রুপি। লম্বায় ৩ ঘন্টা ৫ মিনিট। মূল মুভিতে নাচ-গান থাকলেও টিভিতে কেন জানি দেখায় না। তামিল মুভির নাচগুলো সেই রকম। ঢাক গুড়গুড় কোন ব্যাপার নাই। আল্লাহ জানে কি মিস করলাম।
মিথের দুনিয়া ছিলো কথপোকথনে। এখন সেলুলয়েডের তার কীর্তি। সিনেমার নায়ক’রা রবিনহুড না হলে চলে না। আদ্যিকাল থেকে এই যুগ পর্যন্ত। তারা বড়লোকের কালো টাকাকে গরীবদের বিলিয়ে দিয়ে। কালো টাকার দোষ তারা কর দেয়া হয় নাই, চুরি চামারী করে এই টাকা কামানো। কিন্তু বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এমন কি আছে তাতে কর দিলেই জনকল্যান হবে। বরং এইসব চুরিচামারীতে সাহায্য করে গরীবেরর আয় রোজগার ভালো হয়। তাই কালো টাকারে দোষ দিয়া কি লাভ। কালো টাকা তো এই সমাজেরই ফসল। সমাজ না বদলানোর চিন্তা করে এইসব শ্লোগান আর নাটক করার কোন বেইল নাই।
মধ্যবিত্তরা মূল চরিত্র হয় মূলত আর্ট ফিল্মে। কারণ তাদের মনোস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাত বেশী। জ্ঞানী গুনী বুদ্ধিজীবি দের পয়দাও এখান থেকে হয়। আর জনগণের ত্রাতা সবসময় আসে গরীবদের ভেতর থেকে। আবার কেউ কেউ খানদানী সিলসিলার গরীব মানুষ। শিবাজী এসেছেন বড়লোকের দল থেকে। তার কালো টাকা নাই। সে ভালো মানুষ। কারণ সে অসৎ না। তাই কালো টাকা আর অসৎ রাজনীতির দাপটের কাছে সে টিকতে পারে না। তাকেও গরীব হতে হয়। নাইলে গরীব এই সিনেমা দেখবে না, ভাষা বুঝবে না। বাইরের বাস্তবতার সাথে তার স্বপ্নের ফারাক করতে পারবে না। তাইলে কি তারা বড়লোকরে বিশ্বাস করে না?
শিবাজী যেহেতু সোজা আঙ্গুলে ঘি তুলতে পারে না আঙ্গুল বাকাইয়া তুলছে। এই জিনিসটা বাংলাদেশের মুভিতেও দেখা যায়। পথের ফকির থেকে কোটিপতি। সম্ভবত গরীবের কিছু হারানোর নাই বা শ্রেণীচ্যুতি নাই বইলা সিনেমার গরীব মানুষের সাহস বেশী। বাস্তবে সেটা কি শুধু গরীব মানুষরে ভরপুর বিনোদনে, কামনা-বাসনায় আমোদিত করে চিত্তে শান্তি দেয়া। নাকি এর চেয়ে বেশী আর কিছু?
আমার এক কবি বন্ধু। ব্লগীয় জগতে তার হিট ব্যাপক। সে আবার পচা রাজনীতিরে বিশ্বাস করে না। যখন দেশে দুর্নীতিবাজদের ধরা শুরু হইছিলো অপর দুর্নীতিবাজ কর্তৃক। সে বেজায় খুশি হইছে। সে আমারে তখন মহৎ সব মুভির কথা বলত। এখন জিগায় একশান কোন মুভি আছে কিনা। অন্য কোন মুভিতে আগ্রহ নাই। কেন? ঘটনা মনে হইছে, এখনো লোকে ডাইরেক্ট একশানে বিশ্বাস করে। কিন্তু দুনিয়ার ইতিহাসে এমন কিছু ঘটছে কিনা জানা নাই। সে গণতন্ত্র, হোক সমাজতন্ত্র, হোক ইসলাম- সবাই রাজনীতির নাড়ি নক্ষত্র ইস্তেমাল কইরা দুনিয়া পাল্টাইছে। তাই দেখা যাইবো শিবাজী মুভিখানের যদি কোন পরবর্তী পর্ব থাকে- শিবাজী আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে। কারণ, অতপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগিল। দুনিয়ার সুখ মাই ডিজুস। ইহা চিত্তকে ক্ষনিক শান্তি দেয় এর বেশী কিছু না। শান্তি নাইরে শান্তি নাই। ভিলেন রাজিবের একখানা ডায়লগ।
আমি কি শিবাজী মুভি নিন্দা করছি। না, এই মুভি দেখে আমি আমোদিত হইছি। কষ্ট হইছে এই ভাইবা এই ধরণের মুভি করনের মতো একজন মাত্র সুপারস্টার আছিলো বাংলা মুলুকে। যিনি পুতুপুতু প্রেমের বদলে সমাজরে উল্টাইয়া দিতেন। তিনি হলেন মান্না। এই মুভি দেখতে দেখতে তারে বেশ মনে পড়তে ছিলো। বাংলার মুভির নতুন ঝলকানী আমাদের ফ্ল্যাট বাড়িকে মাঝে মাঝে আলোকিত করে, তা শুধু নতনি নতুন কামনা-বাসনা তৈরী করে। আর কিছু নয়। আড়াল থাকে সমাজ কাঠামো পাল্টানোর বাসনা।