জ্ঞান সম্পর্কীয় আলোচনায় বলা হয়ে থাকে: যা কিছু জ্ঞান তা কিছু না কিছুতে নিশ্চিত। জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে জ্ঞান এবং নিশ্চিয়তা সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। তবে আমরা কোন কিছু সম্পূর্ণ জানি বা সম্পূর্ণ নিশ্চিত এই ধরণের দাবী করতে পারি না। তাই জ্ঞানতত্ত্বের দাবী , যখন আমরা বলি আমরা কিছু জানি তখন আমরা কিছ না কিছুতে নিশ্চিত হই। তাহলে জ্ঞান এবং নিশ্চিতার সম্পর্ক বিচারে যেটাকে আমরা পরম জ্ঞান বলব সেটা পরমভাবে কোন কিছুতে নিশ্চিত হওয়া, যেখানে কোন কিছু সম্ভাব্য থাকে না। সে জ্ঞান কি আমাদের পক্ষে বিচার করা সম্ভব কিনা বা এটা নিশ্চিত করতে কি কি শর্ত দরকার তা নিয়ে জ্ঞানতত্ত্বে নানা পর্যালোচনা আছে। কিন্তু সেই সমস্যার আপাত কোন সমাধানের নজির হাজির নাই। তবে, মূল ভিত্তি জায়গাটা প্রস্তুত আছে। যেমন- অভিধানিক অর্থে, নিশ্চিয়তা (Certainty) একটা অর্থ, কোন বিষয় বস্তু বা ঘটনায় প্রশ্নহীন, অপরীক্ষিত বিশ্বাস।
লুই সাফি তার ফাউন্ডেশান অব নলেজ: এ কম্পারেটিভ স্টাডি ইন ইসলামিক এন্ড ওয়েস্টান মেথডস অব ইনকুয়ারী বইয়ের লজিক্যাল এনালাইসিস: রুলস অব সিস্টেটিক ইনফারেন্স শিরোনামের তৃতীয় অধ্যায়ে জ্ঞান ও নিশ্চিয়তা সম্ভাব্যতা নিয়ে সংপ্তি ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সেই সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় দেখাচ্ছেন নিশ্চিয়তা এবং জ্ঞানের সম্পর্ক বিচারে মুসলিম দর্শনে একটা বিবর্তন ঘটেছে। সেটা গ্রীকদর্শনের প্রভাব থেকে এর বাইরে যাওয়ার ইতিহাস বটে। যেটা মাত্রাগতগতভাবে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জ্ঞান সম্পর্কীয় সংজ্ঞায়ন এবং তার সন্দেহগুলোকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে।
মুসলিম দর্শনে কালাম শাস্ত্রের উদ্ভব হয় মুতাজিলাদের হাতে। এটি পদ্ধতি হিসেবে ছিল নতুন এবং কার্যকরী। দর্শনের পরিসরে যে প্রশ্নগুলো উদ্ভব ঘটেছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর খোজার জন্য কালাম শাস্ত্রের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটে। অপর চিন্তাগোষ্ঠী আশারিয়ারাও কালাম শাস্ত্রের ব্যবহার করেন। কিন্তু চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। তাদের সামনে একটি মৌলিক প্রশ্ন ছিল বিজ্ঞান (ইলম্) কি?
মুতাকাল্লিমুন’রা বিজ্ঞানের এই সংজ্ঞায় একমত ছিলেন: বস্তুর জ্ঞান হলো এটি নিজে কিভাবে অস্তিত্বশীল তা জানা।(এই জ্ঞান সুত্রে জ্ঞানতত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা) এই সংজ্ঞা কালাম শাস্ত্রের উদগাতা মুতাজিলাদের কাছে গ্রহনযোগ্য ছিলো। আশারিয়া স্কুলের (প্রতিষ্ঠাতা আবু আল-হাসান আল-আশারী) আল-বাকিল্লানী এই সংজ্ঞায় কিছু পরিমার্জন আনেন।
বস্তু বা thing সম্পর্কে উভয়ই বলেন, একটি অস্তিত্বমানতা বা বাস্তবতা। এটি বস্তু, দ্রব্য, আকার বা সারবস্তু হতে পারে। তারা বিশ্বাস করতেন বস্তু নিজে যা বলতে তারা বুঝেন সেখানে বস্তুর সকল অংশ বিদ্যমান, একে মানব মন দ্বারা জানা যায়। কিন্তু আমরা জানি ইমানুয়েল কান্ট বলেন, আমরা বস্তু নিজে যা সেভাবে জানতে পারি না। আমাদের মনের সীমাবদ্ধতা আছে। এখানে পরিদৃশ্যমান জগত এবং দৃষ্টির আড়ালের যে জগত তার পার্থক্য চলে আসে। কিন্তু বিজ্ঞান কি তার তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা আর ব্যবহারিক দিক একই নয়। তাদের বিজ্ঞান বিষয় আলোচনা থেকে আরো জানা যায়-
জ্ঞানের নিশ্চিয়তার উপর ভিত্তি করে মুতাকাল্লিমুনরা দুটি ভাগ করেন। একটি হলো বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। প্রাথমিকভাবেই ভাবা হতো বৈজ্ঞানিক জ্ঞান মানে বস্তু নিজে আসলে সেটা কি (knowledge of the whatness of the thing) তাকে জানা। অপরটি হলো অজ্ঞতা। এটি বস্তুও প্রকৃতির বিপরীত কিছু নির্দেশ করে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও অজ্ঞতাকে অনুসরণ করে জ্ঞানের আরো দুটি ভাগ পাওয়া। প্রথমটি হলো সংশয়বাদ। সংশয়বাদে কোনকিছুকে বুঝতে গেলে দেখা যায় বিপরীত দিক থেকে দুটি সমান সম্ভাব্যতা থাকে। অন্যটি হলো সম্ভাব্য জ্ঞান। সম্ভাব্য জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন কিছুর দুটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা থাকলেও সেখানে যেকোন একটি বেশী সম্ভাব্য থাকে। নিশ্চিয়তা বিচারে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নিশ্চিত অথবা সম্ভাব্য। আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব বলে, যা কিছু সম্ভাব্য তা কিছু না কিছুতে নিশ্চিত। অন্যদিকে সংশয়বাদ ও অজ্ঞতা বিজ্ঞান নয়। যেহেতু এটি বস্তু নিজে কি তা প্রকাশ করে না।
কিন্তু আল-গাজালী বলছেন, নিশ্চিয়তা বৈজ্ঞানিক হবে এমন ভাবার প্রয়োজন নাই। এটি এক ধরণের প্রত্যয় বা দৃঢ় বিশ্বাস। আমরা কোনকিছুর নিশ্চিয়তা সম্পর্কে সর্বোচ্চ বিশ্বাস দেখাতে পারি, কিন্তু বিষয়টি ভুল হতে পারে। আল-গাজালী বলছেন, একজন ব্যক্তি বিপরীত সম্ভাবনার কোনরূপ বিচার না করে কোন বিষয়ের সত্যতা নিয়ে দৃঢ় বিশ্বাস করতে পারে। সুতারাং, দৃঢ় বিশ্বাস হলো অপরীতি বিশ্বাস। এটি বিজ্ঞান নয়। আল-গাজালী বিজ্ঞান ও দৃঢ় বিশ্বাস বা প্রত্যয়ের পার্থক্য করতে গিয়ে বলছেন- এই ধরণের প্রশ্ন বিদ্যমান আছে, মহাবিশ্ব সৃষ্ট না চিরন্তন। সংশয়বাদের কাছে এর দুটি সম্ভাবনাই জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে সমান। একজন কোন বিচার বিবেচনায় ছাড়া গ্রহন করতে পারে বিশ্ব সৃষ্ট। অথবা বিশ্ব চিরন্তন তার সৃষ্টি প্রক্রিয়া অনন্তকাল ধরে চলছে। দেখা গেলো অজ্ঞতাবাদীর বলা বিশ্ব চিরন্তন-এটা মিথ্যা। অন্যদিকে দৃঢ় বিশ্বাসকারী বললেন, বিশ্ব সৃষ্ট-এটা সত্য। কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাসকারী বা যিনি নিশ্চিত তার দাবী সত্য হলেও জ্ঞান নয়। এখানে দুজনেরই কোন পার্থক্য নাই। কেন না, দুজনই নির্বিচারবাদী। অন্যদিকে বিজ্ঞান হলো বস্তর অপরিবর্তনশীলতার চেয়ে এই পরিবর্তনে গুরুত্ব দেয়া। নিশ্চিয়তা বিষয়ক দাবীর গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বস্তুজগত সদা পরিবর্তনশীল। এই বিষয়কে সে যথাযথ ধরতে পারে না। ঠিক তেমনি আমাদের জ্ঞানগত উপলব্দিকে নিশ্চিত বলতে পারি না। কারণ একই ধরণের বোঝাপড়া অবস্থা ভিন্ন হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো মুসলিম দর্শনে জ্ঞানগত নিশ্চিয়তা মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেনি। বরং, কোন প্রক্রিয়ায় জ্ঞানের উম্মেষ ঘটে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রনোদনা থাকে প্রত্যাদেশ। এই যে নিশ্চিয়তা ধারণা তা কোন অর্থে গায়েবী বিশ্বাস দ্বারা পরিপুষ্ট নয়। একই আলোচনার সুত্র ধরে সনাতনী যুক্তিবিদ্যাকে খন্ডন করেছেন আল-গাজালী। তিনি এরিস্টটলের সনাতনী যুক্তি বিদ্যার বাইনারী পদ্ধতি চ্যালেঞ্জ করে দেখান এই ভিত্তিগত দিক দুর্বল। এটাও ছিল কোন কোন অর্থে কোন বচনের সত্য বা মিথ্যা প্রতিপাদনের মাধ্যমে নিশ্চয় জ্ঞান অজর্নের ভিত্তি। এই আলোচনার শাধ্যমে লুই সাফি পশ্চিমা জ্ঞনকান্ডের পদ্ধতি সাথে ইসলামী জ্ঞানকান্ডের পদ্ধতি তুলনা করেছেন।
নিশ্চিয়তা সম্পর্কীয় তুলনামূলক বিচার পদ্ধতিতে সময়ের ক্ষেত্রে মুসলিম দার্শনিকরা এগিয়ে আছেন। কিন্তু সেই ধারা শেষ পয্যন্ত বহাল থাকেনি। অন্যদিকে পশ্চিমা দর্শন প্রশ্ন তোলার জায়গা টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আল-গাজালীর হাতে নিশ্চিয়তা বিষয়ক সমস্যার যে পর্যালোচনা ঘটেছে, তা সেখানে ঘটেনি। তবে, ইমানুয়েল কান্টের দর্শনে এর ছাপ আছে। ফলে, জ্ঞান হওয়া না হওয়া, এর সীমানা, বৈধতা নিয়ে প্রচলিত জ্ঞানতত্ত্ব এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে।
লুই সাফির আলোচনার বিষয় ব্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তুলনামূলকভাবে পশ্চিমা ইসলামী জ্ঞানকান্ডের পদ্ধতি আলোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন প্রত্যাদেশ কিভাবে সঠিক প্রশ্ন তোলা ও অনুসন্ধান পদ্ধতির উৎস হতে পারে। কিন্তু তিনি ভিত্তিগত আলোচনা করতে গিয়ে সমকালে যেসব চর্চা হচ্ছে সেগুলোর প্রতি জোর দেননি। কারণ, ভিত্তিমূল এক হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা কান্ডের পর্যালোচনা আরো ব্যাপকতা দাবী করে। কিন্তু, পাঠকের এই দাবীর নায্যতা কোন অর্থেই বইটির গুরুত্ব কমাতে পারে না।
The Foundation of Knowledge: A comparative study in Islamic and Western methods of Inquiry। By: Louay Safi। Publisher: International Institute of Islamic Thought and International Islamic University of Malaysia। 1996। P. 204.
সুন্দর আলোচনা করেছেন। অনেক ভালো লাগল। শুভেচ্ছা সুজন ভাই 🙂
ধন্যবাদ,
শেখ আমিনুল ইসলাম।
আপনার ব্লগে আসা-যাওয়া হয়। সেটা এই ব্লগের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।