নদী পথে পাপেট শো

‘কমলা রকেট’ সিনেমায় মোশাররফ করিম ও জয়রাজ

এক.

সিনেমার নাম ‘কমলা রকেট’। স্টিমারের প্রথম ও সাধারণ শ্রেণীর সব যাত্রী একই লাইনে খাবারের জন্য দাঁড়িয়েছে। বৈষয়িক হিশেব-নিকেশে তাদের মাঝে মেলা পার্থক্য। আবার প্রথম শ্রেণীতে থাকা যাত্রীদের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য, একই পার্থক্য সাধারণ শ্রেণীতে গিজগিজ করা যাত্রীতেও। কিন্তু টিকে থাকা আর জীবন সম্পর্কে অনিশ্চয়তা তাদের মধ্যে এজমালি। দর্শক তো সর্বদ্রষ্টা এখানে। পর্দার বাইরে থেকে ভাবা যেতে পারে, একই লাইনে দাঁড়িয়ে তারা পরস্পরের মনের কথা, সাদৃশ্যতার কথা ধরতে পারবে কি? এই প্রশ্ন না করলেও একটু বলা যায়, এই লাইনে দাঁড় করিয়েছেন নির্মাতা— কম কী সে!

এতটুকুতে সন্তুষ্ট হলে হয়তো গল্পটা এখানে শেষ হতে পারত। কিন্তু না। এরপরের দৃশ্যে পাশাপাশি বসে আছেন তৌকীর আহমেদ ও জয়রাজ। নিজের অজান্তে স্ত্রীর খুনীকে কাঁচা মরিচ বাড়িয়ে দিয়ে তাদের একজন অপরজনকে বলছেন, ‘এটা দিয়ে ডলে খান। জিহ্বায় স্বাদ আসবে।’ এখানেও কি শেষ হতে পারত না?

বাতাস ধীরে ধীরে ভারি হয়ে ওঠে পচতে থাকা মৃতদেহের গন্ধে। খাবারের জন্য ভিড় করা উঁচু-নিচুতলার যাত্রীরা মৌচাকে ঢিল পড়ার মতো ছুটতে থাকে। বমি করতে থাকে খুনি, লাশের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে স্বামী। কুয়াশার ভেতর সরতে থাকে সিনেমার ক্যামেরা। দূর থেকে এই দৃশ্য আমরা দেখি।

স্পয়লার হলেও গল্পটা বলে দেওয়ার লোভ সামলানো যায় নাই। মনে হলো গল্প আসলে এখানেই শুরু। সূত্রধরের কাজ করল সিনেমাটি। অর্থাৎ, পরস্পরের আয়না হলে ওঠার জন্য মানুষকে কতদূর যেতে হবে? এই প্রশ্ন আমার মনে।

সবশেষ দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে, নিজের বমিতে ভেসে যাওয়ার আগে কি মানুষ মানুষকে উদ্ধার করতে পারে না? সেটা হয়তো বৃহত্তর আখ্যানের সম্ভাবনা। যার উসিলা মজুদ আছে এই স্টিমারে, কমলা রকেটে। গল্প, সিনেমা, নির্মাণ, অভিনয় ও দেখাদেখিতে।

দুই.

শাহাদুজ্জামানের ‘মৌলিক’ গল্পটা কয়েকবছর আগে পড়েছিলাম। ওই গল্পের কিছু দৃশ্য চোখে লেগে আছে। কখনো ভাবি নাই তেমন দৃশ্য সিনেমা পর্দায় দেখতে পাবো। যদিও এর সঙ্গে জুড়ে গেছে ‘সাইপ্রাস’ নামের আরেকটি অপঠিত গল্প। ‘কমলা রকেট’ সিনেমায় এ কাণ্ডের সাক্ষি হলাম।

পরিচালক নূর ইমরান মিঠুর বরাতে সংবাদমাধ্যমে ‘কমলা রকেট’ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘এ যেন ছোট এক বাংলাদেশ।’ সে সূত্রে দেখার আগ্রহ আরো পোক্ত হয়।

কেমন বাংলাদেশ দেখলাম? যদিও হিশেব এখানে রকেট স্টিমারের প্রথম শ্রেণী ও সাধারণ শ্রেণীর যাত্রীর। বিত্ত-বৈভবের হিশেবে বেশি উচ্চতায় টানা যায় না গল্পের পাত্র-পাত্রীদের। তারা অনেকটাই ধরা-ছোঁয়ায় মাঝেই আছেন। কিন্তু এই ‘বাংলাদেশ’-এর হাল-ভবিষ্যত কারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা কি এ গল্পে আছে? নাকি সমাজের বড় অংশের উচ্চকিত উপস্থিতিই বাংলাদেশের গল্প বলে নিশ্চিত করে।

গল্পটা দেখেন, যারা এর চরিত্র— তাদের মাঝে রাষ্ট্র ধারণা আকারে বাংলাদেশটা কোথায় আছে? বরং রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের ভিকটিম হিসেবেই আবিষ্কার করলে আরাম লাগে। তারা নিজ নিজ খোপের মধ্যে একেকটা চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছেন। সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে কোন ভাবনা কি চোখে পড়ে? এমন ভাবনা নিশ্চয় আমাদের সমাজ-সংসারে বিস্তুর আছে। সিনেমার চরিত্রগুলোর ‘না বলা’র মধ্যেও আছে। তো, বৃহত্তর অর্থে ‘এ যেন ছোট এক বাংলাদেশ’ বলতে আপত্তি আছে। তবে হ্যাঁ, আমরা যদি সমসাময়িক জন আকাঙ্ক্ষার কিছু অংশ আবিষ্কার করতে চাই তবে বিদ্যমান ‘বাংলাদেশের’ কিছু চরিত্র এখানে পাই। আর ভাসমান স্টিমারের সঙ্গে বাংলাদেশের রূপক তৈরিই করতে পারেন! এ রাষ্ট্রের টালমাটাল একটা দিক তো আছে! চরে আটকে যাওয়ার ভয়, কুয়াশায় পথ হারানোর ভয়!

তৌকীর আহমেদ ও ডমিনিক গোমেজ

তিন.

সম্প্রতি কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব’ এর ৮টি সিনেমার একটি বাদে সবই ইমপ্রেস টেলিফিল্মের, যে প্রতিষ্ঠানটির ব্যানারে নির্মিত হয়েছে ‘কমলা রকেট’। ইমপ্রেস নিয়ে আমাদের অনেক সমালোচনা। কিন্তু খেয়াল করুন দেশের প্রতিনিধিত্বশীল সিনেমাগুলো বলতে গেলে ইমপ্রেস থেকে হচ্ছে।

আর ‘কমলা রকেট’ দেখে মনে হলো ইমপ্রেসের গরীবিয়ানাকে অনেকটা ঝাপসা করে দিয়েছে সিনেমাটি। এটা শুধুমাত্র বাজেট কম-বেশির ব্যাপার না। বরং সীমাবদ্ধতার ভেতর একটা কাজ কতটা গুছিয়ে করা যায়— সেই বিচারে। কী চমৎকার নির্মাণ! নানান ধরনের মুহূর্তের মধ্যে আমাদের চোখ-কান-মন আটকে থাকে।

স্টিমারের সীমিত পরিসরের মধ্যে নির্মাণ কোথাও চরে আটকে যায়নি বা কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যায়নি। বরং দৃশ্যান্তরের চর ও কুয়াশা খুলে দেয় অনেক গল্পের জবান। তেমনি আছে সীমাবদ্ধতার গল্প। অনুমান হয় এক লটে পুরো দৃশ্যায়ন শেষ হয়নি। তাই তো মোশাররফ করিমকে হঠাৎ কোট খুলে বলতে হয়, ‘এই বছর শীতের মধ্যে গরম পড়ছে’ টাইপ কিছু। কুয়াশার দৃশ্যটা যত ডিটেইলস ছিল, ছিল না চরে আটকে পড়ার দৃশ্য। এ সব ছোটখাট বিষয় কোনোভাবে সিনেমাটিতে ম্লান করে না।

সকল সীমাবদ্ধতাকে নিপুণভাবে পাশ কাটিয়েছেন মিঠু। লোকেশনে বৈচিত্র নাই, গল্প অনুসারে থাকার কথাও না। কিন্তু দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে অপ্রচলিত টেনশন ছিল। গল্প ঠিকঠাক একটা নিজস্ব গতি ধরে রাখছিল। কোথাও মনে হয় নাই গল্প ঝুলে গেল বা নড়েচড়ে না টাইপ কিছু। তবে স্বপ্ন দৃশ্য ভালো লাগে নাই। আইডিয়াটা দারুণ। ঠিকঠাক মতো ধারণে সমস্যা ছিল। আর তৌকীর পানির তলে যেখানে শুয়ে ছিল, সেখানে নানান আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের লোগো খুবই আরোপিত লাগছে। এর সঙ্গে পোশাক কারখানার অনিয়মজনিত সমস্যার সম্পর্কটা ঠিক কোথায়? যদি থাকেও এমন রেফারেন্স সিনেমার ছন্দ বিঘ্নিত করছে। আর এ সব অনিয়মের মধ্যে রাষ্ট্র কোথায় হাজির— তা কিন্তু উহ্য রাখা হয়েছে।

এছাড়া তৌকীর আর মোশাররফ চরিত্র দুইটার মধ্যে সম্পর্কের হিসেব-নিকেশ পুরোপুরি ধরে নাই। তৌকীরের সঙ্গে মোশাররফের সম্প্রীতিমূলক আচরণের উৎস কী? মনে হয়েছে এটা ‘মৌলিক’ আর ‘সাইপ্রাস’ গল্প দুটার গ্রে লাইন। যেখানে মিশতে মিশতে গিয়াও সুক্ষ একটা ফাঁক রয়ে গেছে। যেহেতু পরের গল্পটা পড়ি নাই— এটা অনুমান মাত্র।

সিনেমার চরিত্রগুলো সুনির্মিত। প্রায় সকলেই চরিত্র অনুযায়ী চমৎকার অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে তৌকীর ও মোশাররফ। তৌকীরের চরিত্রে ঘটনা বিচারে কোন অন্তর্দ্বন্দ্ব নাই। কিন্তু ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ার বিন্যাস মনে কেড়ে নেয়।

সামিয়া সাঈদ

চার.

ভালো সিনেমা, মন্দ সিনেমা নিয়া অনেক তর্ক আছে। থাকাই যথার্থ। তার মাঝে ‘কমলা রকেট’ নিশ্চয় সুবিধাজনক জায়গাতেই থাকবে।

তারে পাশ কাটায়া প্রশ্ন জাগে, ‘কমলা রকেট’ এর সাথে দর্শকের সম্পর্ক কী? দর্শক যদিও একাট্টা ধারণা না। নানান দর্শকের মনের গহীন সিধা-বাঁকা-তেরজা প্রশ্ন-উত্তর ঘাঁই মারতে পারে। তার একটা এজমালি পাঠাতন কল্পনা করলে দেখতে পাই যেন— এ সিনেমায় আমরা নানান জন নানান জায়গায় প্লে করতেছি, যেমনে উত্তর হতে পারে আলাদা।

আমাদের অভিনয় প্রতিদিন চলছে নাগরিক হিসেবে বিবিধ বিধি-বিধান আরোপের ভেতর, বাট আমরা যেন একটা ঐক্যের জায়গা, মানবিকতার জায়গায় উত্তরণের পথ অসম্ভব বা অনেকটা দৈবিক ব্যাপার করে তুলছি। নইলে এক কাঁতারে দাঁড়াইতে পারি না কেন! আবার খাবারের মতো মৌলিক চাহিদার জন্য লাইনে আসলেও এর মধ্য দিয়ে মনোজাগতিক কোনো রূপান্তর ঘটছে না। কারণ মানুষ জৈবিক প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও যান্ত্রিক নয়।

শুরুতেই যা বলছিলাম, সেই রজ্জু ধরে বলা যায়, বুঝতে পারি না এ গল্পের শেষ কোথায়? নাকি শেষ নাই। ‘কমলা রকেট’ এর মতো চরে আটকাইয়া গল্পের গতি রুদ্ধ হয়ে আছে। বাংলাদেশের অন্য অনেক গল্পের মতো! এবং ভাবছি কথক কি সেই চরের বাইরে যেতে পারছেন? নাকি স্টিমারের মধ্যে আটকা পড়ছেন?

পরিচালক নূর ইমরান মিঠু।

পাঁচ.

সিনেমার বাইরে এসে উস্কে দেওয়া গল্পগুলো ধরতে চাইছিলাম। কিন্তু সেই গল্পের সম্ভাবনাগুলো কোথায়? গল্পের চরিত্রগুলো দেখেন— বৈষয়িকভাবে আরেকটু উঁচু অবস্থানে ওঠা, নিশ্চিত খাওয়া-পরার বাইরে কোনো গল্প কিন্তু এখানে ধরা পড়ে না। এটা আজকের বাংলাদেশের চিত্র! সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক বা ধর্মীয় বোঝাপড়ার কোনো লেশ এসে নাই কিন্তু। পোশাক কারখানায় আগুন, বিদেশে সেটল হওয়া, বিশেষ ক্লাবের সদস্য হওয়া বা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে কিছু পরিস্থিতি ওঠে আসে মাত্র।

একমাত্র সুনীল কর্মকারের কণ্ঠে মহর্ষি মনমোহনের গানে ওস্তাদ সেজে থাকা মানুষটার মধ্যে সক্রিয় চিন্তার একটা ধারা দেথতে পাই। যা অবশ্য সিনেমায় খানিকটা এন্টিক ভ্যালু আকারে হাজির। এর বেশি কিছু না। একইভাবে মোশাররফ করিমের কথিত ‘শাস্ত্র’ কীভাবে নিস্ক্রিয় চিন্তায় পরিণত হয়, তাও দেখতে পাই। এ বিবেচনায় ‘কমলা রকেট’কে কখনো কখনো দারুণ একটা পাপেট শোও মনে হতে পারে। স্টিমারে সার্কাস দলের উপস্থিতি তার যুতসই ইঙ্গিত দেয়। ‘কমলা রকেট’ নিয়ে এই তবে কথা!

লেখাটি উঠান ডটকমে প্রকাশিত।

Comments

comments

2 thoughts on “নদী পথে পাপেট শো

    • আশা করি, দেখে আনন্দ পাবেন। দুঃখের কথা হলো এ মুহূর্তে কোথাও প্রদর্শিত হচ্ছে না। ভবিষ্যতে নিশ্চয় হবে।

Comments are closed.