সাদাত হোসাইনের ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’ পড়ার পর…

সাদাত হোসাইন বেশ আয়োজন করে লেখেন। তা-ই মনে হলো সর্বশেষ উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’ পড়তে পড়তে। মোটামুটি সময় নিয়ে একটা গল্প বলতে চান তিনি।

টুকরো টুকরো ঘটনা নয়, বরং মুহূর্তগুলোকে জোড়া দেন চুপচাপ, হঠাৎ উল্লফন খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু সময় তো বয়ে চলে। এ চলাচলের মধ্যেই ঘটনা চলমান বটে। এ ভাবটা বজায় রাখা দারুণ ঘটনা। গল্পের একরৈখিকতা, সরল বয়ান ও ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা ‘চমক’ এ আভাস দেয়।

নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের প্রচ্ছদ

যখন এভাবে রয়ে-সয়ে গল্পটা বলা হয়, প্রশ্ন থাকে পাঠক কতটা ধৈর্যশীল বা ধৈর্যশীল কি-না? এর উত্তর বইয়ের পাতাতে যেন থাকে। লেখক আন্তরিকভাবে সময় নিয়ে যখন বলছেন, পাঠক কেন তা ধৈর্যের পরীক্ষা দেবে না। এ আত্মবিশ্বাস নিশ্চয় তার আছে!

সাদাতের ঢাউস সাইজের উপন্যাস (আগেরগুলো থেকে এটা সম্ভবত ছোটই) দেখে দ্বিধা তৈরি হলেও যাদের সঙ্গে যায়, সে পাঠকের মগ্ন হতে সময় লাগে না বোধহয়। হালে তার বইয়ের বিক্রিবাট্টার কথা যেমনটা শোনা যায়— এতে এমন হওয়া স্বাভাবিক।

আগেই বলেছি তিনি গল্প বলেন আন্তরিক ভঙ্গিতে। চরিত্র ধরে ধরে কথা বলেন, তার চাল-চলনে রহস্য নয়, পরিচিত চরিত্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা— ভালো লাগে। হ্যাঁ, চরিত্রগুলোর ভবিষ্যত জানার তাড়া থাকে। এসব মুগ্ধকর ঘটনার সাথে স্বাভাবিক কিছু চমকের সাথে সাথে জানা যায় প্রতিটি চরিত্রের জগত কেমন, তারা কী ভাবছে, কেন ভাবছে।

পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছার সরল একটি প্রক্রিয়া (এটা রপ্ত করা নিশ্চয় সরল ঘটনা না) চরিত্রগুলোকে তাদের চেনা-জানার চৌহদ্দিতে আটকে ফেলা। কিছু চরিত্র বা মূল চরিত্রের অনুভূতিকে পাঠক নিজেকে সেভাবে ভাবেন বা ভাবতে চান— তার সঙ্গে মিলিয়ে পড়াতে পারা, একটুখানি চমকে দেওয়া (তার মধ্যে অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতা)। ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’-এ সে ব্যাপারটা আছে বোধহয়।

এছাড়া এ উপন্যাসে মূল স্রোত ‘দুঃখবোধ’। পাঠককে দুঃখে ভাসাতে ভাসাতে একে লেখক বিলাসিতার স্তরে তুলে এনেছেন। এ কাতর যাপনের ভেতর হয়তো পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করেন। অথবা, এ ধরনের আলাপ তারা অন্যের জন্য তুলে রাখেন- সেটা দেখতে দেখতে ছদ্ম দুঃখে ঝাঁপ দেন।

তাও আবার সমসাময়িকতার চিহ্ন ধরে। এটা মনে রাখার মতো ব্যাপার। বর্ণনার ক্ষেত্রে আমাদের পরিচিত ঘর, বাইর, রাজনীতি, ধর্ম স্পষ্ট। যেমন; এই গল্পের বাঁক বদলে দেয় গুলশান ট্র্যাজেডি। এটা আমাদের সময়ের গুরুত্বপূর্ণ একটা চিহ্ন। অবশ্য এ নিয়ে বেশি কথা নাই। আছে জীবন নিয়ে উপলব্ধি, দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার— এর সবই একটা মোলায়েম ভঙ্গিতে আসে। খুব বেশি চিন্তার উপকরণ যোগায় না। গুমোট একটা পরিবেশে আটকে থাকে সবই— আমাদের সময়টা যেমন। হয়তো আমাদের কোনো আশা নেই বা তার লক্ষণ নেই বলে এতেই আটকে থাকেন লেখক।

সাদাতের গদ্য মিষ্টি। গল্প বা চরিত্রকে যেভাবে তুলে ধরেন তা বেশ চেনা চেনা লাগে। মানে এর মধ্যে একটা এজমালি ভঙ্গি আছে। এ ভঙ্গি পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছতে তাকে সাহায্য করেছে নিশ্চয়। একটু অন্যভাবে ভাবলে মনে হয়— এ স্বরকে সাদাতের একক স্বর বলে চিহ্নিত করা যায় না। যার এত ক্ষমতা, তার স্বরকে আগ্রহীরা শুনতে চাইবেন নিশ্চয়। এছাড়া সময়ের নিরিখে ভাষা বিচার না করলে পিছিয়ে থাকতে হয় নিশ্চয়। লেখকরা যখন পিছিয়ে থাকেন, কোনো কোনো পাঠকও নিশ্চয় পিছিয়ে যান।

এ উপন্যাস মূলত এক নারী ও তার পরিবারকে কেন্দ্র করে। তাদের নানামুখী সংগ্রাম এর মূখ্য বিষয়। আমরা আবিষ্কার করি নিম্ন-মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের সংকট, যার আবার প্রধান অবলম্বন বড় মেয়ে। একের পর এক ট্র্যাজেডিতে কাহিনি শেষ হয়। পড়া শেষে প্রশ্ন জাগে— এই উপন্যাসের আবিষ্কারটা কী? বা মানবজীবনের কোন রহস্যকে উদঘাটন করে? অথবা ঘটনা পরম্পরা বর্ণনায় লেখক কোন ধরনের ঝুঁকি নিলেন— যা উপন্যাসটিকে অনন্য করে তোলে।

হয়তো এর কোনোটাই অবশ্যম্ভাবী নয় এ উপন্যাসের জন্য। অথবা কোনো উপন্যাসের জন্যও। তারপর মিষ্টি এই লেখাটাকে আলাদা করে ভাবতে ইচ্ছে করে। সেই পাঠাতন খুঁজে না পেলেও কী যেন আছে লেখাজুড়ে— সদ্য ছড়ানো পারফিউমের মতো মিলিয়ে যেতে যেতে রেশ রেখে যায়।

নিঃসঙ্গ নক্ষত্র । সাদাত হোসাইন । প্রকাশক : ভাষাচিত্র । ফেব্রুয়ারি ২০১৮ । প্রচ্ছদ : খন্দকার সোহেল । মূল : ৪৭০ টাকা

Comments

comments

One thought on “সাদাত হোসাইনের ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’ পড়ার পর…

  1. এত কষ্টের আমি এম্নিতেই অল্পতেই দুখী। বই পড়ে মন হাল্কা করতে যেয়ে প্রবল বিষাদে দুই দিন ডুবে ছিলাম।এটা কি হল??শেষে এমন হওয়াটা কি খুব দরকার ছিল.??

    আসলে কিছু মানুষের জীবনে সুখ সয় না।সুখ আস্লেও পরবর্তীকাল টা হয় ভয়াবহ দু:সময়!!তেমন একটা নারীর গল্প।জীবন জুড়ে যার শোক,জরা,ক্লান্তি, ক্লেদ, বিষাদ।
    তবে শেষ এমন টা না হলেও পারত।

Comments are closed.