সুলেমানি দাওয়াই

দীপ্ত টিভিতে ‘সুলতান সুলেমান’ প্রচার নিয়ে দেশে বেশ কথা চালাচালি হচ্ছে। একই সময় এনটিভিতে প্রচার হচ্ছে দেশি সিরিয়াল ‘তরুণ তুর্কি’। দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চাওয়া কয়েকজন তরুণ-তরুণীর গল্পে এ নাটক।

টিভি শো ‘সুলতান সুলেমান’-এর জনপ্রিয়তার নানা কারণ থাকতে পারে। ধর্মীয় কারণ তো বটে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত খিলাফত আন্দোলনকেও শরণ নেওয়া যেতে পারে। তুর্কি জাতীয়তাবাদী বয়ানের বাইরেও রাখা যায় না একে।

সুলতান সুলেমান, হুররেম সুলতান ও ইব্রাহিম পাশা

‘সুলতান সুলেমান’ বিশ্বের নানা দেশে জনপ্রিয় একটি সিরিজ। সুলেমান যিনি সুদক্ষ শাসনের জন্য ‘সুলেমান দ্য ম্যাগফিসেন্ট’ নামে পরিচিত। খোদ তুরস্কে অভিযোগ উঠেছে নাটকীয় উপস্থাপনায় ঐতিহাসিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তির সম্মানহানি হয়েছে। দেশটির রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশন সুপ্রিম কাউন্সিলে সিরিয়ালটির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আসে। প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানের মতে, ‘সুলতান সুলেমান’ তরুণ প্রজন্মের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলবে। পূর্বপুরুষকে তারা ভুলভাবে জানছে। বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর কেউ কেউ ভুলভাবে তুর্কি খিলাফত দেখানোর অভিযোগে সিরিজটি বন্ধের দাবি জানান।

বাকি আলাপের আগে জেনে নিই ‘সুলতান সুলেমান’-এর জনপ্রিয়তায় অন্য চ্যানেলগুলোতে কী কী আমদানি হয়েছে। তার কয়েকটি হলো ভারতে নির্মিত ‘হাতিম তাই’, ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’, ‘আলিফ লায়লা’, তুরস্কের ‘সীমান্তের সুলতান’, ‘সুলতান কাসিম’ ও ইরানের ‘ইউসুফ জুলেখা’। সব কটিই মুসলিম শাসক বা মিথ বা ঐতিহ্যিক গল্পের অনুসরণে তৈরি। ব্যতিক্রমী উদাহরণ তুরস্কের শো ‘লুকানো ভালোবাসা’ ও কোরিয়ার ‘সিন্দ্রেলার বোন’।

মুসলমান ঐতিহ্যগন্ধী সিরিয়াল প্রচারে চ্যানেলের বক্তব্যও মজাদার। বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে দীপ্তর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী উরফী আহমদ বলেন, ‘আমরা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে একটি বিদেশি সিরিজ নির্বাচিত করেছিলাম চ্যানেল সম্প্রচারের আগেই। প্রচারের পর যা এ দেশের মানুষের কাছে  জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যদি ভেবে দেখেন, তাহলে বোঝা যাবে এটাকে আসলে সেই অর্থে বিদেশি বলা যায় না। এখানে আমাদের মুসলিম সংস্কৃতি ও সাম্রাজ্যের গল্প উঠে এসেছে।’

সুলতান সুলেমানের অভিনেতারা

অন্যদিকে ডাব সিরিয়াল ও বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপবিরোধী ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশনের (এফটিপিও) সদস্য সচিব ও ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি গাজী রাকায়েত বলেন, ‘টিভি চ্যানেল যদি নিজস্ব ঐতিহ্য-সংস্কৃতি থেকে সরে যায়, তবে পুরো জাতি ধ্বংস হয়ে যায়। পাঁচ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধÑসবাই টেলিভিশনের দর্শক। তাঁদের রুচি ও দেশীয় সংস্কৃতির কথা বিবেচনা করে টিভি অনুষ্ঠান প্রচার হওয়া উচিত। এখন টিভিতে অ্যাডাল্ট অনুষ্ঠান দেখালে দর্শক ভিউয়ার বাড়বে। সব সময় কি তা করা হবে? জনপ্রিয় হলেই কি সব অনুষ্ঠান দেখাতে হবে? বাণিজ্যের পাশাপাশি নিজেদের সংস্কৃতির প্রতিও দায়বদ্ধ থাকতে হবে।’

তাঁদের কথামতে, বিদেশি সিরিয়ালের মাধ্যমে ভিনদেশি সংস্কৃতির আমদানি হচ্ছে। যার কারণে দেশীয় সংস্কৃতির দুর্দশা তৈরি হচ্ছে। শিল্পীদের আয়-রোজগারে ভাটা পড়ছে। যদিও ঠাট্টা করে কেউ কেউ বলছেন স্টার জলসা থেকে মুখ ফেরানো দর্শকদের স্টার জলসায় ফেরাতেই এ উদ্যোগ!

‘সুলতান সুলেমান’ নিয়ে নানা আঙ্গিকের আলোচনা লক্ষণীয়। খুব একটা আমলে আনা হচ্ছে না ঐতিহ্য-সংস্কৃতি নিয়ে বিপরীতমুখী বক্তব্য। এক পক্ষ বলছে অনুষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের দর্শকদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। যুক্তি হলো, এসব নাটকের পাত্রপাত্রীর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় আকুতির প্রকাশ ঘটছে। তারা টেলিভিশনেও দৈনন্দিন ভাব-ভাষার প্রয়োগ দেখতে যায়। ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক আচারের মাধ্যমে বৃহৎ একটি সমাজের সঙ্গে মানুষ যুক্ত হয়। এমনও হতে পারে মুসলিম পরিচয়ে সারা বিশ্বে কোণঠাসা হয়ে থাকার বিপরীতে সাম্রাজ্য, বীরত্বের গল্প সান্ত¡না পুরস্কার হিসেবে দেখা হয়! যদিও দেশে নির্মিত নাটকে এসব বিষয়কে বেমালুম গায়েব করে দেওয়া হচ্ছে।

সুলতান সুলেমানের অন্যতম চরিত্র হুররেম সুলতান

এ দেশের মানুষ ধর্ম প্রশ্নে কতটা সহনশীল, তা স্পষ্ট ভারতীয় সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা থেকে। ভারতীয় সিরিয়ালের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ধর্ম। ওই সিরিয়ালে ভালো-মন্দের বিচারও ধর্মীয়। পৌরাণিক কাহিনি, মিথ ও দেব-দেবীর নামভিত্তিক সিরিয়াল বা কার্টুন প্রতিটি চ্যানেলে দেখা যায়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশি দর্শক গ্রহণ করেছে। প্রশ্নহীনভাবে মেনে নেওয়া হয় হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি আলাদা নয়। এমনকি রাজনৈতিক প্রশ্নটিও।

উল্টো ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে। ধর্মীয় গল্প বা বীর তো দূরে থাক, নাটকের কোনো চরিত্রকে জুমার নামাজ পড়তে দেখা বিরল কোনো ব্যাপার হয়ে আছে। অথচ এ দেশেই আপনি রাস্তার মোড়ে মোড়ে মসজিদ পাবেন। সে শূন্যস্থান পূরণে যদি তারা ‘সুলতান সুলেমান’ বা ‘আলিফ লায়লা’ বেছে নেন, এমন অনুমান কতটা ভুল হবে!

শুটিংয়ের অবসরে সিরিয়ালটির তারকারা

বাঙালি মুসলমান বিষয়টি বাংলাদেশে এখনো স্পর্শকাতর। বাঙালি আর মুসলমান আলাদা বিষয়ই যেন! কিছুদিন আগে ‘আয়নাবাজি’ নির্মাতা অমিতাভ রেজা নিজেকে বাঙালি মুসলমানের নির্মাতা দাবি করে ফাঁপরে পড়েছিলেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের গোত্রবাদী সংস্কৃতিতে কী বলা যাবে কী বলা যাবে না, তা স্পষ্ট। তাই হয়তো লালনকে যৌনগন্ধী সাধক বানানেওয়ালা নির্মাতারা যখন ‘সুলতান সুলেমান’-এর হেরেম নিয়ে মনঃকষ্টে ভোগেন, তা নিয়ে সামাজিক পরিসরে বিতর্ক থেকেই যায়। একই কারণে আমরা দেখবো, সুলতানী সংস্কৃতি নিয়ে যখন ‘সাংস্কৃতিক বিতর্ক’ ওঠে— ভারতীয় সিরিয়ালের নায়কদের পরকীয়া বা বহুবিবাহ তখনও স্রেফ ঠাট্টার বিষয় হয়ে থাকে, সমসাময়িক সমাজের অবক্ষয়ের চিত্র হিসেবে সিরিয়াসভাবে নেওয়া হয় না সেটা। এমনকি জঙ্গি বাণিজ্যের রমরমা যুগে সহি ইসলামের বয়ান দুনিয়ার সব জায়গায় কালচারাল উৎপাদন হিসেবে যখন জনপ্রিয় তখনো সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের নির্মাতারা চুপ।

*লেখাটি সাম্প্রতিক দেশকালে পূর্ব প্রকাশিত। মূলত ‘সুলতান সুলেমান’ ও বিদেশি ডাব সিরিয়ালবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ২০১৬ সালের শেষ দিকে লিখিত।

Comments

comments