সিরাজ সাঁই টু পাঞ্জু শাহ

এক.

জীবন থাকিতে যদি, নাহি পাই প্রাণপতি.
তবে তারে পাব কোন্ দিনে।

পৌষের শুরুতে চট্টগ্রামে বাতিঘরে দেখা স্বরূপ সুপান্থের সঙ্গে। অনেকদিন পর। জানালেন, মেলায় প্রথমবার হার্ড কাভারে তার কবিতার বই বেরুবে। এক যুগ আগে যৌথভাবে প্রকাশিত কার্ড কবিতায় ওর লেখা দেখেছিলাম! আরও নানান কথার পেছনে পেছনে ছুটছিলাম আমরা। হাত হাঁটছিল বইয়ে বইয়ে। ঢাউস সাইজের একটা বই উল্টাতে উল্টাতে একটা পৃষ্ঠায় থামে স্বরূপ। উদম গায়ে লুঙ্গি পরা সাধু মতন একজন মানুষ বসে আছেন। হাতে ধরা আছে তসবি। যদিও মানুষটা ‘বাউল’ নন, তবুও বইটার নাম ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’। অনেক অনেক সাধুর ভিড়ে তার ঠাঁই। লেখক অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। স্বরূপ বলল, ‘দেখ, পাঞ্জু শাহ!’ ঝিনাইদহের হরিশপুরের পাঞ্জু শাহ। পশ্চিম-পূর্বমুখী কবরের বাসিন্দা তিনি এখন। এখন!

তার উত্তর দিয়েছিলেন নায়েব আলী কাকা। কার্তিকের তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে। বিকেল আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি সময়ে। তিনিই আমাদের সিরাজ সাঁইয়ের মাজার থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান পাঞ্জু শাহর মাজারে। একই গ্রামে শুয়ে আছেন এ সাধক-গীতিকবির গুরু হিরাজতুল্লাহ খোন্দকার। গানের ভণিতায় যাকে পাঞ্জু ডেকেছেন ‘হিরুচাঁদ’। গুরু তো চাঁদই! ইশক আলোকিত ব্যাপার। তার লগে চাঁদ-তারার সম্পর্কই মানায়।

আছে সত্য নবি বর্ত চিনে কর রূপ নিহার।
হিরুচাঁদের চরণ ভুলে পাঞ্জু হলো ছারেখার।

উত্তর-দক্ষিণে কবর হলে গুরুর দিকে পা পড়বে— তাই এই মুসাবিদা। অন্য কথাও থাকে। কবর ঠিকই দেওয়া হয় প্রচলিত রীতি উত্তর-দক্ষিণে। কিন্তু নিজে নিজে কবরের দিক পাল্টে যায়। প্রাণবান কবর! কবরেও খবর হয়। এমন খবরে আমরা অবাক হই না। মানে আমরা যে চারজনের দল। আমার দেখার ধরন দিয়েই তো দুনিয়ার সকল কার্য-কারণ জোড় বাঁধে না। সেটা যতটা উপলব্ধির, কল্পনার, ভাবনার, ততটা তো ঘটনারও। ভাব-ভক্তির এমন তাৎপর্য আছে বলেই না আমরা ছুটে যাই। পর্যটন করি!

গাছপালা ছড়ানো ছায়া ছায়া পথঘাট মাড়িয়ে অবশেষে হাজির হই সে বাড়িতে। হরিণাকুণ্ড উপজেলার হরিশপুরে পাঞ্জু শাহর ডেরায়। বাড়িতে ঢোকার পরপরই হাতের ডানে একটা পুরনো দালান চোখে পড়বে। বামে কয়েকটা কবর। আর দালানটা— যার দেওয়ালে বাসা বেঁধেছে শ্যাওলা, ওইখানকার এক কক্ষে পাঞ্জু শাহর কবর। কার্তিকের ঝিম ধরা সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে আমরা কেউ ওই দালানের বারান্দায় বসে থাকি, কেউ অকারণ ঘুরাঘুরি করে, ছবি তোলাতুলি আর কেউ ঠাণ্ডা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ভক্তি দেয়।

উত্তর-দক্ষিণ লম্বা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ওই দালানটা আগে কেমন ছিল জানার উপায় নাই। সংস্কার হয়েছে বেশ আগে। যার মাথার উপ্রে লেখা আছে ‌‘মরহুম খোঃ পাঞ্জু শাহের মাজার। সংস্কারক কনিষ্ট পুত্রবধূ খাতেমান নেছা। সন ১৩৯১, ২৪ শে ফাল্গুন।’ মূল কক্ষে তিনটি কবর। মাঝে পাঞ্জু শাহ। দুইপাশে স্ত্রী চন্দন নেছা ও পাঁচি নেছা।

বরাবরের মতো এটা ভ্রমণ বৃত্তান্ত। তারপরও এ অছিলায় পাঞ্জু শাহর পরিচয় নিয়া দুই-এক ছত্র না বললে চলে কি!

পাঞ্জু শাহর ছবি, সূত্র : অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’ । পাঞ্জু শাহর হাতের লেখা, সূত্র : খোন্দকার রিয়াজুল হক ‌‘মরমী কবি পাঞ্জু শাহ : জীবন ও কাব্য’।

পাঞ্জু শাহর ছবি, সূত্র : অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’ । পাঞ্জু শাহর হাতের লেখা, সূত্র : খোন্দকার রিয়াজুল হক ‌‘মরমী কবি পাঞ্জু শাহ : জীবন ও কাব্য’।

ফরহাদ মজহারের সূত্রে জানি, নদিয়ার ভাবের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছে লালন’সহ পাঁচ ঘরকে কেন্দ্র করে। লালন ছাড়া বাকি চার ঘর সতী মা, পাঞ্জু শাহ, চৌধুরী ও দেলবার শাহ। উনাদের সিলসিলাকে গদি মান্য ধরা হয়। তবে ভাব ও প্রকাশের শক্তির দিক থেকে ফকির লালন শাহ যে পরিমাণ দৃশ্যমান, অন্যরা অতোটা নন। এখান থেকে পাঞ্জু শাহর গুরুত্ব সম্পর্কে একটা আলগা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আর লালন শাহের সঙ্গে বৈঠকে পাঞ্জু শাহর গান গাওয়ার গল্পও প্রচলিত আছে।

এই ঘুরাঘুরির কিছুদিন পরের কথা আগেই বলি। ঝিনাইদহ জেলা ওয়েবসাইটে একটা বিলের ছবি পাওয়া গেল। যার ক্যাপশনে লেখা আছে ‘লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ ও সিরাজ সাঁইয়ের বিল’। ওই বিলে না-কি এই তিন মহারথী (তিন পাগল নন) গোসল করেছিলেন! তবে নিশ্চয় একই সময়ে নয়। তাইলে যে বড়ই গোলমাল। এ এলাকায় থাকা কবরের ফলক অনুযায়ী সিরাজ সাঁইয়ের মৃত্যু আর পাঞ্জু শাহর জন্মের ব্যবধান ৫৩ বছর। অবশ্য ভাবের বিল হইলে অন্য কথা!

আবার খোন্দকার রিয়াজুল হক ‌‘মরমী কবি পাঞ্জু শাহ : জীবন ও কাব্য’ বইয়ে জানান, ‘লালন যখন ছেউড়িয়া থেকে তদীয় শিষ্য দুদ্দু শাহের আখড়াবাড়ি বেলতলা গ্রামে বেড়াতে যেতেন, তখন হিরুচাঁদের সঙ্গে তার বৈঠক হতো।’ আর ভাবের বাড়িতে বেড়া দিয়ে তারা বাস করতেন আলাদা ঘরে। সে সূত্রে হরিশপুর একটা গ্রাম থেকে পারে, ভাব বিচারে কত বিচিত্র-কত রঙের মাখামাখি।

সুধীর চক্রবর্তী তার ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’ বইয়ে (পৃ. ৯৪) পাঞ্জু শাহ সম্পর্কে কী লিখেছেন তা এ অছিলায় উল্লেখ করি। তিনি লিখেছেন, “যশোহরের মারফতি সাধক ও বিখ্যাত গীতিকার পাঞ্জু শাহ (১৮৫১-১৯১৪) প্রথমে লালন-স্রোতের অনুগামী ছিলেন। কিন্তু শোনা যায়, লালনপন্থার জন্মরোধের সাধনা থেকে স্খলিত হন তিনি। সন্তানজন্ম ঘটার ফলে নাকি পাঞ্জু শাহকে লালনস্রোত থেকে বহিস্কৃত হতে হয় এবং তিনি যশোহরের আলমপুরে নিজের সাধনার এক স্বতন্ত্র ঘরানা তৈরি করে নেন। আজও এই দুই সাধনার স্রোতে মিলন ঘটেনি। বাংলাদেশের লোকায়ত ধর্মসাধনার প্রবহমান ধারায় লালনশাহী ঘর ও পাঞ্জুশাহী ঘর এখন দ্বিধাবিভক্ত দুটি তরঙ্গ। একটি ছেঁউড়িয়ায়, একটি আলমপুরে। উভয় সম্প্রদায়েই হিন্দু-মুসলমান শিষ্যসেবক আছেন। সুলতানা আফরোজের সরেজমিন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাঞ্জুঘরের ভিত্তিতে আছে সুফিবাদ, লালনঘরের ভিত্তিতে বাউলতত্ত্ব। ‘পাঞ্জুশাহী এবং লালনশাহী ঘরের মধ্যে বিবাহ সাদী হয় না।… গোঁড়া মুসলমানরা তাদেরকে মুসলিমসমাজ বহির্ভূত বলে ভাবেন।’ তবে একথাও উল্লেখ্য যে, ১লা কার্তিক (লালনের মৃত্যুবার্ষিক) এবং ফাল্গুনমেলায় ছেঁউড়িয়াতে বহু ধরনের বাউল ফকির সমবেত হতেন। তখন পাঞ্জুশাহী ঘর ও লালনশাহী ঘর বর্ষার বন্যার মতো কূপজল ও নদীর জলকে মিলিয়ে নিত ভাবস্রোতে।” এ আলোচনায় পাঞ্জু শাহর বহিস্কৃত হওয়ার তথ্য জানিয়ে তারকা চিহ্ন দিয়ে সুধীর জানাচ্ছেন, ‘এই তথ্য সম্পর্কে দ্বিমত আছে। একদল এই তথ্য সমর্থন করেন। অন্য দল মনে করেন পাঞ্জু শাহ কোনোদিন লালনপন্থী ছিলেন না।’ এ দুই দল কারা উল্লেখ নাই অবশ্য। এরপর দুটি গান দিয়ে উদাহরণ দেন লালন ও পাঞ্জুর ভাবের মিল।

এবার আসা যাক, হিরুচাঁদ প্রসঙ্গে। তাকে কীভাবে পেলেন পাঞ্জু শাহ? এ প্রসঙ্গে পাঞ্জু শাহর ছেলে খোন্দকার রফিউদ্দিনের বরাত দিয়ে রিয়াজুল জানান, ‘গুরুর সন্ধানে কবি নানা স্থান গমন করেন। বাংলাদেশের সর্বত্র, আসাম, মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব-সিন্ধু, এমনকি সুদূর খোরাসান পর্যন্ত একজন পূর্ণ-মানবরূপী (আল-কামালিয়াত) দীক্ষাগুরুর (মুরশিদের) অন্বেষণে এ সময় তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন বলে জানা যায়। কিন্তু তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হয় না। অবশেষে তিনি ঘরে ফিরে আসেন। এমন সময় হিরাজতুল্লাহ খোন্দকারের সাথে তাঁর আলাপ হয়। ইনি ছিলেন একজন তত্ত্বজ্ঞ কামিল দরবেশ। হরিশপুরের দক্ষিণ প্রান্তে ছিল তাঁর দরবার শরিফ।’ চিন্তা করে দেখেন, কতো কতো জায়গায় তালাশ করে ঘরের কাছেই গুরু মিলল।

যার বই থেকে তথ্য দিচ্ছি, তার সম্পর্কে বলে নিই। পাঞ্জু শাহ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পিএইচডি গবেষণা করেছেন খোন্দকার রিয়াজুল হক। তিনি পাঞ্জু শাহর ভাইয়ের দিকের নাতি। বাংলা একাডেমি থেকে বই আকারে প্রকাশ হওয়া ওই গবেষণাপত্রে পাঞ্জুর কোনো ছবি নাই। বরং পারিবারিক ছবির শুরুতেই আছে খানিকটা চিমসে যাওয়া রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে লালনের সেই ছবি! সেখানে তাকে পাঞ্জু শাহর পূর্বসূরি বলে উল্লেখ করা হয়।

আগের একটি লেখায় জানিয়েছি, হরিশপুরে আমরা মুখোমুখি হই ‘লালনের বংশধরদের’! এতো ‘বড় বিষয়ে’ এ বইয়ে কিছু নাই। অথচ বলা হচ্ছে, এ গ্রামে লালনের যাতায়াত ছিল। তবে লালনের জন্ম হরিশপুর— রিয়াজুলকেও এমন তথ্যের জন্য দায়ী করেন সুধীর।

দুই.

ফকির হয়েছি আল্লার রাহেতে।
সাধু-গুরুর চরণ ধূলি দাও গো আমার মাথাতে।

পাঞ্জু শাহর জন্ম ১২৫৮ বঙ্গাব্দের ২৮ শ্রাবণ শৈলকূপায়। তার বাবার নাম খাদেম আলী খন্দকার। তিনি জমিদার ছিলেন। এক সময় জমিদারি হারিয়ে ছেলে পাঞ্জু ও ওছিমউদ্দীনসহ পরিবার নিয়ে হরিশপুরে চলে আসেন। তাদের অবস্থা তখন গরীবী হালতেই ছিল। এরপর বাবা মারা গেলে পরিবারের ভার পাঞ্জুর কাঁধেই পড়ে।

তিনি পারিবারিক রেওয়াজ মতে বাল্যকালে আরবি, ফারসি ও উর্দু শেখেন। পাশাপাশি নিজ চেষ্টায় বাংলা শেখেন। জীবনের শেষদিকে খেরকা গ্রহণ করে ফকিরি জীবনযাপন শুরু করেন, কিন্তু সংসারত্যাগী হননি। এ জন্য তাকে আবার ‘গৃহী বাউল’ বলবেন না। ভাব সাধনা নির্বিশেষে ‘বাউল’ বলার আধুনিক চলের কারণে এ সাবধান করে দেওয়া। এ ব্যাপারে পাঞ্জু নিজেও সচেতন ছিলেন। ভেদ বিচার তো সাধনার বড় কাজ। তাই গানের কোথাও নিজেকে ‘বাউল’ বলেন নাই।

তার বেড়ে উঠা এ অঞ্চলে ভাব-রসে টইটুম্বর নানা গীতধারার ভেতর দিয়ে। তাও আবার হিন্দু-ইসলাম ধর্মের আধ্যাত্ম রসে জারিত। নদিয়ার যে ধারা আরকি! তাই পাঞ্জুর মেটাফোরগুলো আপনার কাছে অতি পরিচিত ঠেকবে। তাতে সম্ভবত সুফিধারার ভাষা চিহ্নই বেশি দেখা যায়। গুরু হিরাজতুল্লাহর দিক থেকে তাকে চিশতিয়া ও নিজামিয়া ধারায় যোগ করা হয়। ১৮৯০ সালে ‌‘ছহি ইস্কি ছাদেকী গওহোর’ নামে তার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‌‘ইস্কি ছাদেকী’ মানে হলো ‘সত্যিকারের প্রেম’। কার প্রতি? বুঝাই যাচ্ছে। বইটির তিনটি সংস্করণ প্রকাশ হয়। এতে সুফিতত্ত্বের মর্মকথা ও নৈতিক উপদেশ বর্ণিত হয়েছে। বইটি সম্পর্কে তিনি লেখেন, ‌‌‘এ কিতাব ইমানেতে যে জন পড়িবে! আল্লার যে ভেদ সেই অবশ্য পাইবে।’ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের ‌‘হারামণি’ (সপ্তম খণ্ড) ও খোন্দকার রিয়াজুল হক’সহ আরও কয়েকজনের বইয়ে তার গান সংকলিত হয়েছে। অতঃপর ১৩২১ (১৯১৪) বঙ্গাব্দের ২৮ শ্রাবণ হরিশপুরে পাঞ্জু শাহ্ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

উত্তর-দক্ষিণ লম্বা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ওই দালানটা আগে কেমন ছিল জানার উপায় নাই। সংস্কার হয়েছে বেশ আগে। যার মাথার উপ্রে লেখা আছে ‌‘মরহুম খোঃ পাঞ্জু শাহের মাজার। সংস্কারক কনিষ্ট পুত্রবধূ খাতেমান নেছা। সন ১৩৯১, ২৪ শে ফাল্গুন।’ মূল কক্ষে তিনটি কবর। মাঝে পাঞ্জু শাহ। দুইপাশে স্ত্রী চন্দন নেছা ও পাঁচি নেছা।

উত্তর-দক্ষিণ লম্বা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ওই দালানটা আগে কেমন ছিল জানার উপায় নাই। সংস্কার হয়েছে বেশ আগে। যার মাথার উপ্রে লেখা আছে ‌‘মরহুম খোঃ পাঞ্জু শাহের মাজার। সংস্কারক কনিষ্ট পুত্রবধূ খাতেমান নেছা। সন ১৩৯১, ২৪ শে ফাল্গুন।’ মূল কক্ষে তিনটি কবর। মাঝে পাঞ্জু শাহ। দুইপাশে স্ত্রী চন্দন নেছা ও পাঁচি নেছা।

রিয়াজুল হকের বরাতে তার গানের শ্রেণীকরণ এমন— আল্লাহতত্ত্ব, রাছুলতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মুরশিদতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, পারাপারতত্ত্ব, সংসার ও সমাজতত্ত্ব, খেরকাতত্ত্ব, গোষ্ঠ ও অষ্টতত্ত্ব। এর থেকে পাঞ্জুর কালাম সম্পর্কে আলগা ধারণা আমরা পেলাম।

দেলে যার দয়া হবে, আল্লা তারে দোস্ত কবে,
দলিলেতে এই কথা বলে।

এ সবের সঙ্গে অবশ্য বাড়িটি দেখাদেখির কোনো সম্পর্ক নাই। সেখানে আরও কয়েকটি কবর আছে। বছরে দুটি মচ্ছব হয়। এর মধ্যে একটি ফাল্গুন মাসে। জলসা বসে, ওরস হয়। সফরসঙ্গী দাউদ জানালো, পাঞ্জু শাহর ঘরের সিলসিলা শক্তভাবে জারি আছে। তবে শহরের মানুষের ফোকাসে থাকেন লালন। অবশ্য আমরা যখন গেলাম বাড়িটি কেমন ঘুম ঘুম! সারাদিনের ক্লান্তির ভেতর একটা শান্তি শান্তি ভাব পাওয়া যাচ্ছিল। ভেতর বাড়িতে গেলাম। পাকা দোতলা বাড়ি। পাঞ্জু শাহর বংশধরদের কেউ সেখানে থাকেন না। উনারা শহরবাসী। বাসিন্দা এক ভদ্রলোক জানালেন, তার বাড়ি অন্য জেলায়। গুরুর (পাঞ্জু শাহর বংশধর) কথা মতো বাড়িটি পাহারা দেন। পরিবারসহ থাকেন।

বের হতে না হতে আকাশে ঝুলে পড়া সন্ধ্যা আরও কাছাকাছি নেমে এলো। নায়েব আলী কাকা বললেন, ‘বাজারে ফিরে কাজ নেই। তাহলে আজ আর ঝিনাইদহ ফেরা যাবে না।’ চট জলদি গন্তব্যের গাড়ি ধরতে অন্য একটা মাটির পথ ধরে চলা শুরু হলো। পথটা দেখে বোঝা যায় বৃষ্টি হয়েছে বেশিদিন হয়নি। আমরা পাঁচজনের দল চলছি। খালের পাড় ধরে একটা রাস্তা দিয়ে। ওই পাড়ে সমান্তরালে আরেকটা রাস্তা। হঠাৎ চোখে পড়ল আমাদের সমান্তরাল রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে একসারি রাজহাঁস। মোবাইলে ছবি তুলতে গেলাম। কাঁপা কাঁপা হাত আর হাঁটা হাঁটা হাঁসে একটা অবাস্তব দৃশ্যের জন্ম নিল। স্থির চোখে গতি অবাস্তব হতে পারে। কিন্তু এ জগতে গতি ভিন্ন আর কি আছে!

আমার অনুমান ছিল একসময় খালের মাঝখানে ব্রিজ পাবো। তারপর ওই পাড়ে যাবো। কিন্তু ব্রিজ পেলাম ঠিকই— পার হলাম না। নায়েব আলী আরেকজনকে ওই পার থেকে ডাকলেন। তার হাতে একটা গাছের চারা। তারা ‘দোস্ত’ সম্বোধন করে নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করলেন। আমাদের পরিচয় পেয়ে নতুন সঙ্গী মোবাইলে কী যে একটা ভাবের গান চালালেন। এরপর আমরা হাজির হলাম ত্রিমোহনীতে। এ রাস্তা ফাঁকি দিয়ে কোনো আলমসাধু, পাখি অথবা নসিমন হরিণাকুণ্ড থেকে আসতে বা যেতে পারবে না।

হঠাৎ চোখে পড়ল আমাদের সমান্তরাল রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে একসারি রাজহাঁস। মোবাইলে ছবি তুলতে গেলাম। কাঁপা কাঁপা হাত আর হাঁটা হাঁটা হাঁসে একটা অবাস্তব দৃশ্যের জন্ম নিল। স্থির চোখে গতি অবাস্তব হতে পারে। কিন্তু এ জগতে গতি ভিন্ন আর কি আছে!

হঠাৎ চোখে পড়ল আমাদের সমান্তরাল রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে একসারি রাজহাঁস। মোবাইলে ছবি তুলতে গেলাম। কাঁপা কাঁপা হাত আর হাঁটা হাঁটা হাঁসে একটা অবাস্তব দৃশ্যের জন্ম নিল। স্থির চোখে গতি অবাস্তব হতে পারে। কিন্তু এ জগতে গতি ভিন্ন আর কি আছে!

অপেক্ষার পালা আর শেষ হয় না। এই ফাঁকে মোডের একমাত্র দোকানে চানাচুর-মুড়ি পেলাম। সঙ্গে সুমিষ্ট পানি পান করে মন জুড়ালো। খাওয়ার শেষে তো মুড়ির দাম নেবে না। কারণ মুড়ি ঘর থেকে আনা। তার ওপর আমরা মেহমান। অতঃপর একটা গাড়ি মিলে গেল। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে দ্রুত উঠে গেলাম। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বাস ধরতে হবে। তখন বেশ অন্ধকার। একসময় গান গাইতে শুরু করল রাফসান গালিব ‌‘আমায় ভাসাইলি রে আমায় ডুবাইলি রে’। মাঝে মাঝে চাটগাঁইয়া উচ্চারণ চলে আসে। তাও ফারিহা পারভেজের সঙ্গে আলমগীরের গাওয়া উর্দু ভার্সন। কী অদ্ভুত! ভাসানো-ডুবানোর উৎস একই। ক্যায়া বাত!

অবশেষে পৌঁছলাম হরিণাকুণ্ড বাস স্টেশনে। শেষ বাসটা যেন আমাদের অপেক্ষায় ছিল। সিটে বসতেই ঝিনাইদহের দিকে ভোঁ দৌড়।

তথ্যঋণ : পাঞ্জু শাহ প্রসঙ্গে উল্লেখিত গান ও তথ্যের বেশির ভাগ খোন্দকার রিয়াজুল হকের বই থেকে নেওয়া।

*লেখাটি পরিবর্তন ডটকমে পূর্ব প্রকাশিত।

Comments

comments