‘খুশির ঈদ’ বলতে কী বুঝব

‘খুশির ঈদ’ বলতে কী বুঝব? আমি যখন ধর্মবেত্তা নই, তখন ঈদ নিয়ে কী লিখব। শুধু ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক শরিকানার কারণে এ নিয়ে বলার যোগ্যতা রাখি কি? বলতে পারি কি? যেহেতু দাবিটা লিভিং ট্রাডিশনের মধ্যে, তাই কিছু তো বলা যায়।

আমরা যখন এমন প্রশ্ন দিয়ে আলাপ শুরু করি— তখন প্রথম কাজ হল প্রশ্নের উৎপত্তি শনাক্তকরণ। বা কোথায় দাঁড়িয়ে এ কথা তুলছি। এর পরের কাজ হলো যা যা পেলাম— তা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। তার ভেতর থেকে প্রশ্নটাকে সাফ করা। সন্দেহ নেই এভাবে এগুলে কাজটি গুরুতর হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাহলে যখন ‘ঈদ’ মানে ‘এলো খুশির ঈদ’, উদযাপনের লিমিটেশন নাই— তখন তরল ভাবকে গরলে নেওয়ার সুযোগও থাকে।

Eid-Mubarak_WS-thereport24আমরা যে সময়ে ঈদ নিয়ে অক্ষরের ভাষায় কথা চালাচালি করছি, তখন ঈদ মানে ধর্মীয় উৎসব— এ অর্থ পপুলার যোগাযোগ মাধ্যমে একদম গায়েব। আবার এর নতুন অর্থই বা কী আমি নিশ্চিত নই। ধর্মবেত্তার কথা আসছে কেন? কোনো কিছু নিয়ে বলার বিপত্তি মোটাদাগে কর্তৃপক্ষীয়। তারপরও সে রিস্ক নেওয়া যায়। যেহেতু বাংলাদেশে হরে দরে সেকুলার স্পেস থেকে ধর্মের সংজ্ঞা ঠিক করে দেওয়ার বিপদজনক চল আছে। এমন কিছু ভেবে-চিন্তে একটা সাধারণ জায়গায় হয়ত দাঁড়ানো যায়। ভরসা তো তা-ই! ঈদ বলে কিছু একটা হাজির আছে আপনার-আমার সামনে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলি ‘ঈদ মুবারক’।

এটা সত্য ‘ঈদ’ মানে ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। এ গানের আরও আরও লাইন আছে। ওইগুলো কি আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনি বা শোনার চেষ্টা করি। সম্ভবত না। মূলত ‘খুশির ঈদ’ই এখানে প্রধান হয়ে রয়— স্থায়ী শোনেন আর পুরো গান শুনেন। কিন্তু দুটো ‘খুশি’র মাত্রা তো আলাদাই— অর্থাৎ কোনো বিষয় নিয়ে যত দীর্ঘ কথা বলি, তার অর্থবোধকতা বাড়ে। এখানে ভাবা যেতে পারে ‘ঈদ’ নিয়ে এতো কথাই বা কিসের। কথা নেই— এমন ভাবাভাবির কারণ হতে পারে আপনি ‘ঈদ’ পালন করে আসছেন, আপনার আগেও হয়েছে— পরেও হবে। মানে শুরুতেই যাকে ট্রাডিশন বলা হলো।

ইসলামের ইতিহাস ও ভাব-ভাষা-চর্চার জায়গায় ঈদের নিশ্চয় অনন্য অর্থ আছে। তার গুরুতর ভাব-ব্যাখ্যাও আছে। তা নিশ্চয় গড়পরতা খুশি বা আনন্দ অর্থে নয়। সে অর্থবোধকতাকে হাজির করতে হয় মাহে রমজানের মতো বৃহৎ প্রেক্ষাপটে। যা নিছক না খেয়ে থাকার ‘অভ্যাস’ও নয়। ধর্মীয় অর্থে এর অর্থ আলাদা করে উৎপাদন করার জরুরত থাকে সব সময়। আবার ধরেন নাইও বলা যায়। নাই এ অর্থে যে, আমরা গড়পরতা ধর্ম নিয়ে কথা বলা যাবে না— এমন একটা আবহে বসবাস করি। আপনি যা ধর্ম হিসেবে সাব্যস্ত করছেন— তা শুধু আপনার আমলের বিষয় নয়, এর সামাজিক প্রেক্ষিত আছে।

আবার যারা রোজাদার ও রোজার হক্ব বলে কিছু একটা মানেন তাদের দিক থেকে কিছু কথা থাকে। ঈদুল ফিতরের সঙ্গে এ যোগ গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ রমজানকে আমি কীভাবে বিচার করি (নিতান্ত শিক্ষামূলক হলেও) তার সঙ্গে ঈদের গুরুত্ব বিদ্যমান।

যেহেতু ‌‘এলো খুশির ঈদ’, তাই আলোচনাকে গুরুগম্ভীর না করে দেখাই বোধহয় ভাল! উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক রেডিও-টেলিভিশন বা অপরাপর সংবাদমাধ্যমের রমজান বিষয়ক করিৎকর্ম। সেখানে সারা রমজান মাসে ধর্ম শেখানোর বহর দেখা যায়। ওই সময়ের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো মূলত প্রশ্ন-উত্তরমূলক। ধরা যাক, মাটিতে ট্যাবলেট পড়ে গেছে— এটা তুলে খাওয়া জায়েজ কিনা! এর মাধ্যমে ধর্ম কী ও কেন তার অর্থ উৎপাদন হয়। শয়তানকে বেধে রাখার সময়ের মনস্তত্বে এই তো ধর্মকর্ম। ওই সব অনুষ্ঠানের সিরিয়াস প্রশ্ন হলো মুহাম্মদ (স.) মাটি না নূরের তৈরি টাইপ। কোনোটাই নীতিগত অর্থে ইসলাম যে মৌলিক পরিবর্তনের কথা বলে তার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আর রান্না-বান্নার অনুষ্ঠানের কথা তো বাদই দিলাম।

এটা একটা ভাল চিত্র হতেও পারে! রমজান যে অর্থে নিজেকে নতুনতর বিশ্লেষণে দাঁড় করানোর কথা— সে তাৎপর্য কতটা আছে এ থেকে বুঝা যায়। এটা আসলে সে ধারাবাহিকতা আপনি যেমন নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করাতে চান না। এটা সারা বছরই ঘটে। তাহলে রমজানে খানিক ব্যতিক্রম কেন? ধরেন কোনো কিছু আপনার সামনে হাজির হলো—তারে টপাটপ আমলে করলেন। মানে উপলক্ষ্যের বিচার। ঘটনা হয়ত এমন!

ধর্ম অর্থ যদি এই উৎপাদন হয়— নৈতিক কর্তব্যধর্মী কৃৎকৌশলে নিজেকে হাজির করা। এটা হয়ত বেশ স্বাস্থ্যকর। কারণ পরবর্তীতে এ ধরনের কাজের মাধ্যমে আপনার কোনো আত্মোপলব্ধি তৈরি হবে না। যা ইচ্ছায় আছে আমলে নাই। কারণ আমাদের পাহারাদারির নিয়মকে নিয়ম আকারে দেখার মধ্যে জারি থাকে। তার পেছনে যে বিশ্বাস ও ব্যাখ্যা তা গড়হাজির। এখানে ব্যাখ্যা মানে যুক্তির কথা আসছে না। যা কথা, কাজ ও আস্থার ভেতর পরিষ্কারের হয়— তা। সেটা কেমন হবে? স্বীকার করতে হবে— পুরো লেখায় যে অনুমান তা দিয়ে তো সেটার আক্ষরিক ভাব উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এবং সঙ্গত কারণে সারা বছর পালায় পালায় জীবনযাপন করে, রমজানে কিছু আচার-বিচার শিখে ধর্মের মৌলিক প্রশ্নকে পাশ কাটানো যায়।

অবস্থা বিচারে মনে হতে পারে ঈদের দিনে মাশলা-মাশায়েল টাইপ নৈতিক প্রণোদনা আর চালু থাকে না। ওইসব চর্চার জরুরত অস্বীকারের ইচ্ছাও এখানে বিদ্যমান নাই। তারপরও মনে হয়, ঈদের দিনে ‘ঈদ’ পাবেন না, মানে যে ঈদে ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, পাবেন ‘এলো খুশির ঈদ’। ‘ঈদ মানে আনন্দ’ যথার্থই তো! আবার ঈদ মানে সেটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যা আপনি করছেন না। আবার যা করছেন তাও কি নয়! তাও অবশ্যই— কারণ কোনো চর্চা তো আর ফেলনা নয়। তার একটা ইতিবাচক অভিমুখ অবশ্যই আছে। সে অভিমুখ দিক ঠিক রাখে প্রতিদিনের চিন্তা ও চর্চার মাধ্যমে। তাই সবকিছুর আগে ধর্মের মৌলিক প্রস্তাব বিচার করাই হয়ত স্বাস্থ্যকর। তাহলে ‘খুশির ঈদ’ এর প্রস্তুতি হিসেবে রমজান, রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে আমাদের জীবনের অনেক কিছুই হাজির থাকবে।

নিশ্চয় খেয়াল করেছেন এ সব কথার মধ্যে খানিক শ্লেষ আছে। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ এভাবে কথা বলা সহজ, এখানে কোনো কিছুকে প্রতিষ্ঠার দায় থাকে না। তাহলে এর বাইরে আমরা কী করতে পারি। যা করতে পারি ধর্মচর্চার এহেন প্যাটার্নে সমাজের অবস্থা বিচার করা যেতে পারে। সমাজ রূপান্তরে ধর্মের ঐতিহাসিক চর্চা, যা আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক তার মধ্যে কোথায় যেন গড়বড় হয়ে যাচ্ছে— তার পরিপ্রেক্ষিতে কথাগুলো তুলতে পারি।

আমরা তো ওই সময়ে বসবাস করি যখন আমরা সমাজ পরিবর্তনের কথা বলি না, ব্যক্তিকে পরিবর্তনের কথা বলছি। তাইলে কী এটাই হচ্ছে ধর্ম যার যার। যদিও ‘যার যার’ বললেও কোনো অর্থ হয় না। সে অর্থে কিছু নাই। যখন কোনো কিছুকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, সেই ব্যাপারটাই কাঁধের উপর সওয়ার করে থাকে।

এভাবে কিছু বিশৃঙ্খল কথা দিয়ে ঈদের আলোচনা হয়ত শেষ করা যায়। মনে হচ্ছে শুরুর প্রশ্নের কাটাকুটি ততটা ফেলনা নয়। আমরা সম্ভবত এ নিয়ে আরও কথা বলতে পারি। সেটা আপাতত তোলা থাক। এ ছাড়া যারা ধর্মবেত্তা তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত শোনার আছে, বোঝার আছে। সবাইকে ঈদ মুবারক।

অলংকরণ : সাদিক আহমেদ।

*লেখাটি দ্য রিপোর্ট২৪.কম ও দখিনায় প্রকাশিত।

Comments

comments