চৈত্র সংক্রান্তিতে দাঁড়িয়ে

সময়ের ধারণা

বাংলা বছরের হিসাব চলে সূর্যের সাথে সাথে। আবার নানা কারণে আমবস্যা-পূর্ণিমা কেন্দ্রিক চাদেঁর হিসেবও গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলা সন মূলত সৌরবছর। এতে বাইনারিভাবে দেখার বিষয়টি অগ্রাহ্য করা হয়। এখানে সময়ের শেষ বা শুরু বলে কিছু নেই। বারো মাসের বছরের শেষ মাস চৈত্রে’ও বছরের ‘শেষ’ হয় না। চৈত্রে ‘সংক্রান্তি’ হয় আগামী বছরের সাথে। এ হলো চৈত্র সংক্রান্তি।

সংক্রান্তি মানে এক ক্রান্তি থেকে- এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় যাওয়া। ক্রান্তির সঞ্চার। সাঁতার। মহাকালের অনাদি ও অশেষের মাঝে ঋতুর বদল করতে করতে সূর্যের ও আরো অনেক গ্রহ-উপগ্রহ-গ্রহাণু-উল্কার সাথে সাথে সাঁতরে চলা। এ এক চক্রের মতো, চরকার মতো, সূর্য সাঁতরে চলে, ঋতুরা ফিরে ফিরে আসে। ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে সময়। নতুন নাই, পুরাতনও নাই। এখানে পুরাতনকে জরা-জীর্ন বলে বিদায় দেওয়ার কিছু নাই। বরং, এক ধরনের প্রবাহমানতা আছে। যেখানে সবকিছু প্রাণবান সম্পর্কের সূত্রে আবদ্ধ।

এ চিন্তার রেশ চৈত্র সংক্রান্তির মধ্যে প্রবল। তাই সময়ের মধ্যে প্রাণ ও প্রকৃতির অবিচ্ছিন্ন যাত্রায় যারা মগ্ন, সেই বাংলাদেশের গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তি এখনো বছরের প্রধান উপলক্ষ।

বিশেষত, উপমহাদেশের সনাতন প্রথা অনুসারী মানুষেরা এই দিনটিকে খুবই পুণ্যের দিন বলে মনে করেন। সনাতন পঞ্জিকা মতে, দিনটিকে গণ্য করা হয় মহাবিষুব সংক্রান্তি। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এই দিনটিকে নানা উৎসবের মাধ্যমে পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের বিজু ও বৈসাবি উৎসব।

সাধারণভাবে বঙ্গাব্দের শেষ দিনটি হয়ে থাকে ৩০ চৈত্র। বাংলা একাডেমির সংস্কারায়িত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বছরের প্রথম পাঁচ মাস গণনা করা হয় ৩১ দিনে, বাকী ৭ মাস ৩০ দিনে। সে হিসেবে ৩০ চৈত্রকে ধরা হয় সংক্রান্তি। অন্যদিকে ভারতীয় বাংলা পঞ্জিকাকারদের পুরানো হিসেব মতে দিনটির তারতম্য হতে পারে, আবার মিলেও যেতে পারে।

সাধারণত চৈত্রসংক্রান্তির আলোচনাতে মেলা, গাজন, পুজার কথা ঘুরে ফিরে আসে। এগুলো নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচারের সম্পর্কিত হয়ে গেছে এখন। কিন্তু এর বাইরে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে জড়িত আছে চৈত্র সংক্রান্তি। যা শুধু উৎসব নয়, এক ধরণের কথা চলাচলি। নিজের ও প্রকৃতির খোঁজ নেয়া। এই খোঁজ নেয়ার দায়িত্ব পড়ে নারীর ওপর। যেটা কৃষিজীবী মানুষের প্রজ্ঞার দারুণ প্রকাশ। এবং নারীর এ দিকটি দিন দিন চাপা পড়ে যাচ্ছে।

জীবনযাত্রার মানদণ্ড

শাক শাক বারো শাক, পাতে দিলে জামাই রাগ।
-(গ্রাম বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ)

জামাই এলে খাওয়াতে হয় ভালো ভালো খাবার। জামাইয়ের দাবিও থাকে বেশি। কিন্তু জামাই যদি আসে চৈত্র সংক্রান্তিতে? তাকে শাকই খেতে হবে। আচ্ছা, শাক কি ভালো খাবার না? ফাস্টফুড জেনারেশনের কাছে অবশ্যই না। কিন্তু, জামাই তো আর জেনে শুনে রাগ করতে পারে না। এর মধ্যেই আছে মজা।

ছড়ায় বারো শাক বলা হলে সাধারণত চেয়ে বেশি পরিমান শাকও রান্না হয়। যা চৌদ্দ বা আরো বেশি। শহুরে অভ্যস্ত কানে অদ্ভুত লাগতে পারে এতো শাক আছে কিনা। এইদিন নানা ধরণের তিতা সবজি (সাত তিতে) ও পাচন রান্না করা হয়। এর মূল কথা হলো, বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে প্রকৃতির উপস্থিতি।

qayyum chowdhury

গ্রামে এই দিনে ঘরদোর লেপা পোছা হয়, গোয়ালঘরও। সকালে গোয়াল থেকে গরুগুলোকে বের করে গোসল করানো হয়। আমিষ নিষিদ্ধ। অবশ্য কেউ করলে শুধু জিয়ল মাছ যেমন কই-শিং-মাগুরের ঝোল। নিরামিষ শাক সবজি’র সাথে সাত তিতে রান্না করা হয়। সবচেয়ে অনিবার্য হলো ব্রত পালন। সারা চৈত্র মাস নারীরা ব্রত পালন করত। কৃষিজীবনের নারীর নিজস্ব সংস্কৃতাচার এই ব্রত। আমিষ নিষিদ্ধ ব্রতকালীন সময়ে। স্বামী সংসারের কৃষির ব্যবসার শুভ কামনা করে ব্রত পালন। আলানে পালানে কুড়িয়ে পাওয়া শাক খাওয়া হইতে এই সময়। এই চাষ না করা, কুড়িয়ে পাওয়া শাক যদি আলানে পালানে ক্ষেতে বাগানে পাওয়া যায় তবে বুঝতে হবে সারা বছরের কৃষি ঠিক ছিল। সারা বছরের কৃষি মানুষসহ সব প্রাণের, চারপাশের প্রকৃতির আপন ছিলো। আমরা দরকারি-বেদরকারি বলে নানা কিছুর বাছ-বিচার করি। ফলে প্রকৃতিতে থাকা আপাত বেদরকারি গাছ-গাছালি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আদতে তা ঠিক নয়। এর তত্ত্ব-তালাশ হয় চৈত্র সংক্রান্তি। যদি আমার চারপাশের প্রাণ ঠিক থাকে তবে আগামী বর্ষে প্রবেশ শুভ, পহেলা বৈশাখ শুভ।

বুঝাই যাচ্ছে, কৃষি সংস্কৃতির মধ্যে কৃষির জীবনযাত্রার মধ্যে চৈত্র সংক্রান্তি হলো জীবনমানের মানদণ্ড। যেটা আমাদের জানান দেয় যে; জীবনমান ঠিক আছে। কেননা আপনি যখন নানান শাক বা পাতা তুলতে চান, তখন ধরা পড়ে এই প্রকৃতিতে গতবছর কী ছিল আর এই বছর কী আছে? এই থাকা এবং না থাকার মধ্যে দিয়ে টের পাওয়া যায় প্রকৃতির স্থিতি অবস্থা। পরিবেশ রক্ষার জন্য্ বাস্তুসংস্থানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। যেখানে একটি প্রাণ অপরটির সাথে যুথবদ্ধভাবে থাকে। এই যুথবদ্ধতা প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে লালন করে। অতি জনপ্রিয় নববর্ষের আয়োজনে জীর্ন বলে পুরানোকে দূর হতে বলার একটা রেওয়াজ আছে। কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তিতে এমন কিছু নাই। বরং প্রাণের বৈচিত্র্য, ঐক্য ও ধারাবাহিকতা কথা মনে করিয়ে দেয়।

‘হাইব্রিড’ সময়

কিন্তু এই সম্পর্ক বিচারের দিন কি আছে? সেই বিচার তো ব্যবহারিক কাজ। আমাদের জীবন যাপন ও অভ্যাসের মধ্য দিয়ে চর্চিত বিষয়। সেই চর্চা এমন যা সময়ের সাথে ফুরিয়ে যায়। প্রকৃতির স্বভাব ধরতে না পারার মধ্য দিয়ে আমরা চলে গেছি কৃত্রিম বনায়নে, কৃষিকে বানিয়ে ফেলেছি খাদ্য ‘কারখানা’। মেরে ফেলেছি দেশীয় শাক-সবজি, শস্য ও অন্যান্য প্রাণে বীজ। হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির স্বতস্ফূর্ততা, নষ্ট হচ্ছে বাস্তু সংস্থান।

পাল্টে গেছে প্রাণ ও প্রকৃতির সম্পর্ক। মানুষে মানুষে সম্পর্কও। দেশে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে ‘হাইব্রিড’। বোঝা হয়ে ওঠে না এর সাংস্কৃতিক অধিপত্য। যেমনভাবে নববর্ষ আসল, আসল সবুজ বিপ্লব আর সবশেষে জিএম বীজ-শস্য। ঋতুর কোনো বাছবিচার নাই। এমনকি ষড়ঋতু হারাতে বসেছে। সারাবছর টমেটো পাবেন। পাবেন কাঁচা মরিচও। কই মাছ পাবেন। পুঁটি মাছ পাবেন। আবার বলবেন আগের মতো স্বাদ পাওয়া যায় না। সেই আগেটা কী?

SM Sultanযখন যা ইচ্ছা সে বীজ দেয়া হচ্ছে জমিতে, সাথে প্রাণবিনাশী সার কীটনাশক। এমনকি আগন্তুক সব শস্য ফল ফসল জোর করে গছিয়ে দেয়া হচ্ছে। দ্রুত বনায়ন চাই। দ্রুত ফুল চাই, চাই দ্রুত ফল। এমনকি প্রাণও। হাই্রব্রিড পশু পাখি। নষ্ট হচ্ছে আমাদের চিরচেনা প্রকৃতি প্রাণ পরিবেশ। হারিয়ে ফেলতে নিজেদের প্রাণ ভাণ্ডার। অথচ খাদ্য নিরাপত্তার নামে এসব করছেন, করছেন আধুনিক কৃষির নামে। তারাই আবার পহেলা বৈশাখ পালনের ধূম করছেন। হৈ হুল্লোড়ের কনসার্ট করছেন। চাষাভূষোকে রবীন্দ্র সংগীত শুধোচ্ছেন।

এইসব না থাকার মধ্যেও সূর্য যখন আবার মহাবিষুবে পড়ে চৈত্র সংক্রান্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় পুরান দিনের কথা। ঘুরে ঘুরে আসার কথা। কিন্তু মনে যদি থাকে সরলরেখা, তবে কেমন করে দেখব চক্র। মন আর শরীর তাদের পার্থক্য ভুলে যাক। চৈত্র সংক্রান্তি ফিরে আসুক। সেই কৃষি ফিরে আসুক যে কৃষি মানুষ আর প্রকৃতিকে আলাদা করে না। যে কৃষি এই বাংলাদেশের চিরচেনা শস্য আর পশু পাখিকে সাথে নিয়ে বাঁচে, প্রাণ বাঁচায়। সেই কৃষি যদি বাঁচে তবে তার সাথে কৃষি জীবনের উৎসব চৈত্র সংক্রান্তিও বাঁচবে। শুভ চৈত্র সংক্রান্তি।

সাহায্য:
১. ভাবান্দোলন, ফরহাদ মজহার
২. চিরায়ত লোকউৎসব চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈসাবি, মিল্টন ঘোষ
৩. চৈত্র সংক্রান্তি বাঁচলেই কেবল শুভ হবে পহেলা বৈশাখ, মোহাম্মদ আরজু
৪. ব্যবহৃত চিত্রকর্ম  কাইয়ুম চৌধুরী ও এস এম সুলতান
৫. লেখাটি ২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল আরটিএনএন.নেটে প্রকাশিত।

Comments

comments