আফগানিস্তানে যুদ্ধ ও সন্ত্রাস আবিষ্কার কাহিনীর ভেতরবাড়ী

পশ্চিমের আপন আর অপর

এখনকার দিনে আফগানিস্তান, ইরাক বা পাকিস্তানে আত্মঘাতী বোমা হামলার অনেক ঘটনা ঘটছে। একসময় আত্মঘাতী হামলার ইসলামি বয়ান নিয়ে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমগুলো নানা তর্ক-বিতর্কে ব্যস্ত থাকত। মানবাধিকার, নীতি-নৈতিকতার ফেনা তোলা আলোচনার সে দিন আর নাই। তালাল আসাদের ভাষায়, ‘এসব নিয়ে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম এখন কম আবেগ খরচ করে। একইভাবে আফগান বা ইরাক যুদ্ধে দখলদার সৈন্যদের হাতে কোন বেসামরিক নাগরিক নিহত হলে দায় সারা গোছের খবর ছাপে। এখন এইসব নিয়ে বাতচিত না করার কারণ এইসব হামলার শিকার ইওরোপীয়ান- আমেরিকান বা ইজরাইলিরা না। পশ্চিমা মিডিয়া প্রচণ্ড বর্ণবাদী হওয়া সত্ত্বেও মানবিকতা, মানবতা ইত্যাদিকে যুদ্ধের সপক্ষে প্রচার কৌশল হিশাবে সব সময় ব্যবহার করে। তাই তারা দখলদারি যুদ্ধের সামনে ন্যায় তকমা লাগিয়ে সেটাকে জায়েজ করে নিয়েছে। তারা আপন স্বার্থ রক্ষার অজুহাত দিচ্ছেন বিশ্বের নিরাপত্তা রক্ষার মহান দায়িত্বের নামে।

নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ

নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ

ন্যায় যুদ্ধের কার্য-কারণ
আমেরিকার এই যুদ্ধ বরাবরই নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। তারা এখানে ভালমন্দ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জায়গায় মন্দের ভাল রূপে ন্যায় যুদ্ধের কথা বলছে। সে যুদ্ধকে আবার অনিবার্য হয়ে উঠতে হয়। কারণ, ন্যায় যুদ্ধের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি হল, এই যুদ্ধ আত্মরক্ষামূলক এবং শান্তি পূর্ণভাবে যদি না এড়ানো যায় তবে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। আফগান যুদ্ধের ক্ষেত্রে এই যুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। বরাবরের মত বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দুনিয়াব্যাপী যুদ্ধ’র পক্ষে অনিবার্যতা এবং মানবিকতার কারণ দেখিয়েছেন। আরও অনেকের মত বারাক ওবামাও বুশের তত্ত্ব কবুল করেছেন। এই ন্যায় যুদ্ধের অনির্বাযতা নিয়ে তালালের প্রশ্ন, আফগান যুদ্ধ ১১ সেপ্টেম্বরের সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া বটে, কিন্তু এই যুদ্ধ কেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল? এটা কি শুধু আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ? এবং অনিবার্যতা আরোপ করা হলেই কি তা ন্যায় যুদ্ধ শুরু করার জন্য যথার্থ? কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি এই যুদ্ধ অনেক অন্যায়কেই বৈধতা দেয়ার নজির তৈরি করেছে।

এই যুদ্ধে আরোপিত অনিবার্যতা আত্মরক্ষামূলক না বরং এর অন্য কারণ আছে। সেই কারণগুলো তথাকথিত ন্যায় যুদ্ধ থেকে আলাদা থাকে নাই। বরং, ন্যায় শব্দটি দিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ন্যায় যুদ্ধ বলতে যে মন্দের ভাল এমন কোন লক্ষণও এই যুদ্ধে দেখা যায় নাই। যুদ্ধ ও শান্তি এবং যে পার্থক্যের ওপর ন্যায় যুদ্ধের তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে, খোদ সেটাই প্রমাণ করল এই পার্থক্য কোন কাজের জিনিসই না। এই যুদ্ধের শুরুতে আমেরিকা যুদ্ধ ও শান্তির পার্থক্য দেখাতে কোনরকম আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আগায় নাই। শুধু শান্তির দোহাই দিয়ে এবং আত্মরক্ষার অসিলায় এই যুদ্ধে মরিয়া হয়ে ওঠে। তালালের ভাষায় আমেরিকা যা করে নাই প্র মত: সন্ত্রাসী হামলার দায়-দায়িত্বের প্রমাণ কখনই আইনগতভাবে দাখিল করে নাই এবং দ্বিতীয়ত: ষড়যন্ত্রকারীদের পাকড়াও ও শাস্তি দেয়ার চেষ্টা বে-সামরিক উপায়ে করে নাই। বরং ভবিষ্যত হুমকি মোকাবেলার নামে শুরু করা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ হয়ে ওঠে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ (প্রিভেনটিভ ওয়ার)’। মোটকথা সব উপায় যুক্তি-তর্ক আর অজুহাতকে তারা সামরিক যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধই তাদের সব যুক্তি তর্কের সারকথা।

২০০১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে বিন লাদেন বলেছিলেন, এই হামলা কিছু লোকের ব্যক্তিগত পরিকল্পনা। তার আরও দাবি ছিল, তিনি আফগানিস্তানের আইন-কানুন মেনেই সেখানে বসবাস করছেন। সেখানকার শাসকশ্রেণী এই ধরনের কাজ অনুমোদন করে না। কিন্তু অক্টোবরের শেষ দিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই হামলার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেন। এই স্ববিরোধী কথায় আমেরিকান শাসকগোষ্টী তাদের যুক্তি আর প্রমাণ খুঁজে পায়। তাদের আর কোন প্রমাণ এবং অনুসন্ধানের দরকার পড়ে না। তারা তাদের হাতে বিন লাদেনকে তুলে দিতে বলে। তালেবান সরকার প্রমাণ দাবি করে এবং তারা স্পষ্ট বলে যে, যদি বিন লাদেন অপরাধী হয়, তবে নিরপেক্ষ ইসলামি আদালতে তার বিচার করা হবে। কিন্তু আমেরিকা সেটা মানে নাই। এটাকে অসিলা ধরে যুদ্ধ শুরু করার পর অন্যান্য ন্যায্য কারণগুলাও আর ধোপে টেকে নাই।

শুধু তাই না, আল কায়েদার হুমকির কারণে আফগানিস্তানে সৈন্য-সামন্ত বাড়ানোর সমালোচনা করে বিভিন্ন জনের বলা কিছু বিষয় মনোযোগ দাবি করে। তালাল বলেন, কেউ আছে কি নাই সেটা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ আছে বটে, কিন্তু গত আট বছরে আমেরিকা কোন সন্ত্রাসী হামলার মুখে পড়ে নাই। এটা হল বড় কথা। এর পেছনে এক কারণ হতে পারে- আফগানিস্তানের আল-কায়েদা কখনও এত শক্তিশালী ছিল না। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট এর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্ট সহ অনেকে বলছেন, সন্ত্রাসীরা আমেরিকার অনেক কাছে থেকে হামলা চালাতে পারে, যেমন, ৯/১১ এর পরিকল্পনা আফগানিস্তান নয় জর্মানিতে হয়েছিল। কাউন্সিল অন ফরেন রিলিশান্স এর প্রধান রিচার্ড হাস এক উপ-সম্পাদকীয়তে লিখেছেন, আফগানিস্তান থেকে কোন হামলা চালানোকে কঠিন করে তোলাও তাদের এই যুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত। আবার, যে আল কায়েদা নিয়ে আমেরিকা প্রশাসনে এত কথাবার্তা, সে আল কায়েদা এখনও একটা নামই মাত্র, এই সংগঠনের প্রধানঘাঁটিও তারা বের করেছে এমন দাবি করতে পারে নাই। কারও কারও মতে, এইসব সন্ত্রাসীরা বিভিন্নদেশে কিছু কাল্পনিকভাবে আর কিছু বাস্তবেই ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এই পার্থক্য কে করবে? যদি কোনটা বাস্তব আর কোনটা কাল্পনিক সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তবে কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় সে পার্থক্য খাড়া হবে কেমন করে? কেউ কেউ বলেন, এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে। আল কায়েদা সদস্যরা সবাই নেতার নির্দেশ মেনে চলে এমন না। তাহলে ন্যায় যুদ্ধের ভিত্তিমূলে অনেক অনেক ফাঁক ফোকরই বিদ্যমান আছে।

ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদকে এক করে ইওরোপ-আমেরিকার প্রচার মাধ্যমগুলার বাগাড়ম্বরপূর্ণ তথ্য-প্রপাগান্ডা ইসলাম ও মুসলমানদের অপরাপর দল-মত, ধর্মের মানুষের কাছে একটা প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। যেটা অনেক বিষয়কে বিবেচনারই বাইরে রাখে। শুধু আবেগ আর মোহ দিয়ে সবকিছু যাচাই করেছে। সা¤প্রতিক গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ বিতর্কে সেই নজির আবার দেখা গেছে। বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও নিষ্ঠুরতার প্রচারও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। একটি সামষ্টিক অভিজ্ঞতাকে প্রচার মাধ্যমগুলাতে বার বার প্রচার এবং নতুন নতুন বর্ণনার আবিষ্কার ৯/১১কে একটা উপযুক্ত বাগধারায় পরিণত করেছে। তালাল আসাদ তার লেখাতে ২০০১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে স্প্যানিশ হারলেমে একটা ভ্যানের ওপর থাকা প্ল্যাকার্ডের কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানে লেখা ছিল জনাব প্রেসিডেন্ট আমরা ন্যায় বিচার চাই না, আমরা যুদ্ধ চাই’। এই যে যুদ্ধ উন্মাদনা তা যেকোন ন্যায় নীতি ভাল মন্দেরও ধার ধারে না তা তো একদমই পরিষ্কার।

বিন লাদেন বলেছিলেন, এই হামলা কিছু লোকের ব্যক্তিগত পরিকল্পনা। তার আরও দাবি ছিল, তিনি আফগানিস্তানের আইন-কানুন মেনেই সেখানে বসবাস করছেন। সেখানকার শাসকশ্রেণী এই ধরনের কাজ অনুমোদন করে না।

পবিত্র সীমানা’র লঙ্ঘন

এই যে যুদ্ধের উন্মাদনা এটা বলে দেয় যে, আমেরিকার জনগণের মনে ৯/১১ এর ক্ষত অনেক গভীর। এর সাথে রাজনীতি, মিডিয়া প্রচারণা তো ছিল, তার সাথে সাথে আমেরিকার জনগণের মনোস্তত্ত্বে কি ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়েছে তাও গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা তার ইতিহাসে বাইরের কোন শক্তি দ্বারা আক্রমণের শিকার হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। সেই ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মূল ভূখণ্ডের বাইরে আমেরিকার নিয়ন্ত্রিত হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে জাপান আক্রমণ চালিয়েছিল। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে আমেরিকা তার চরম জবাব দিয়েছিল। ভৌগলিক অবস্থানও আমেরিকার এই সুরক্ষার জন্য খুবই সুবিধাজনক। সেদিক থেকে আমেরিকার সুরক্ষা একটা ট্যাবু অর্থাৎ ধর্মসিদ্ধ ঐশ্বরিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তাদের সীমানা পবিত্র সীমানা। যা বাইরের কোন শক্তি দ্বারা লঙ্ঘিত হবার নয়। এর ঐশ্বরিক তাৎপর্য আছে। কিন্তু ৯/১১ এর ঘটনায় আমেরিকার সেই ঐশ্বরিক প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে গেছে। যে বিষয়টি এতদিন অপর ছিল, তা এখন আমেরিকার ইতিহাসের অংশ। এই ঘটনা তাদের সর্বগ্রাসী ভয়ে নিমজ্জিত করেছে। এটা তাদের জীবনে এনে দিয়েছে স্থায়ী দুঃস্বপ্ন। এর একমাত্র সুরাহা হল সীমাহীন শাস্তি, এই যেন ঐশ্বরিক ক্রোধ। এ প্রসঙ্গে তালালের বক্তব্যের সারকথা হল, যখন এমন শাস্তি দেয়াটাই সমগ্র চিন্তা শক্তিকে আচ্ছনড়ব করে, তখন কোন কিছু নিরাময় করার যে ঐশ্বরিক বাণী তাকেও ত্যাগ করতে হয়। হামলার বদলে হামলা। ভয়ের বদলে ভয়। বিভিন্ন ভাষ্যকাররা মধ্য এশিয়ার শক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং ভূরাজনৈতিক কৌশলের যে কথা বলেন তা নিঃসন্দেহে এতে হাজির। এটাকে আক্রমণের একটা কারণ ধরা ছাড়াও আসলেই এর বেশি শাস্তির বিষয়টাও একটা নতুন ট্যাবু হয়ে উঠেছে। অবাক হবার কিছু নাই এই যুদ্ধ নতুন নতুন যুদ্ধ, অস্ত্র এবং কৌশলের ব্যবহার ও কার্যকারিতা পরীক্ষার ক্ষেত্রও বটে। আবার আফগানিস্তান হামলার দেড় বছরের মাথায় ইরাকে যা শুরু হল, সেখানেও একই ট্যাবু মাত্রাতিরিক্ত শাস্তির ধারণা কাজ করেছে। আঘাত কর আর আতঙ্কিতকর। আতঙ্কের বদলা আতঙ্ক।

আইনের নমনীয় পাঠ
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের এমিরেটাস অধ্যাপক রিচার্ড ফালক অক্টোবর ২০০১ এ ন্যায় যুদ্ধের আইনগত দিক খণ্ডন করেছেন। তার মতে, ৯/১১ এর হামলা ও দুনিয়াব্যাপী সন্ত্রাসে লাদেনকে নিরপেক্ষ বিচারের মুখোমুখি করার প্রমাণ ছিল অপর্যাপ্ত। কিন্তু অচিরেই ফালকসহ অন্যদের এই যুক্তি পাল্টে যায়। ন্যায় যুদ্ধের নামে অসংখ্য নিরীহ আফগান নিহত এবং নিযার্তনের শিকার হতে থাকে ক্রমাগত আনুপাতিক হারে। টুইন টাওয়ারের নিহত হয়েছে প্রায় তিন হাজার মানুষ আর আফগানিস্তানে গত বছরে নিহত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ লাখ আর উদ্বাস্তু হয়েছে ত্রিশ লাখের বেশি মানুষ। এই অনুপাতকে কোনভাবেই তুলনা করা চলে না। অথচ এক ন্যায় যুদ্ধের নামে প্রশ্নহীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সেকুলারদের যুক্তির দিক থেকে আফগানিস্তানে হামলা আন্তর্জাতিক আইনে সিদ্ধ হলেও ইরাক যুদ্ধ সেদিক থেকে সিদ্ধ নয়; কিন্তু এটি একটি পরিষ্কার যুক্তি। রিচার্ড ফালক কিছুটা পরিবর্তন করে বলেন, এটা হল আন্তর্জাতিক আইনের নমনীয় পঠন। এই নমনীয় পঠন অভিযুক্ত আর সন্দেহভাজনের ফারাক রাখে নাই। আইন, সার্বভৌমত্বের প্রচলিত ধারণাকে পাল্টে নতুন কাঠামোতে ফেলেছে।

সন্দেহভাজনদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করার আইনি পথ ঠিক করা হল
এই ন্যায় যুদ্ধে কে সন্ত্রাসী আর কে নয় তা নিশ্চিত করে বলার কোন উপায় নাই। সে অর্থে যে কেউ সন্দেহভাজন হতে পারে। এই যুদ্ধ সেই অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজনকে নির্যাতন করার পথও বাতলে দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে পল ডব্লিউ কান এর ২০০৮ সালে প্রকাশিত বই ‘সাকরেড ভায়লেন্স: টর্চার, টেরর, অ্যান্ড সবর্জিনিটি’ এর সাহায্য নেয়া যায়। নির্যাতন বিষয়ে ইজরাইলি সর্বোচ্চ আদালতের রায় হল, কোন নাগরিককে বেআইনিভাবে নির্যাতন করা যাবে না। যদি এমন ঘটনা ঘটে তবে নির্যাতিত ব্যক্তি আইনের কাছে এর প্রতিকার চাইতে পারে। কিন্তু প্রতিরক্ষার দোহাই দিয়ে নির্যাতিত ব্যক্তির অভিযোগ খণ্ডন করা যায়। কারণ হল এইসব সন্ত্রাসীরা তো রাষ্ট্রই স্বীকার করে না, সেইখানে তাদের নাগরিক হবার বিষয়টি আসে কিভাবে। যদি এই হয়, তবে যুদ্ধকালীন সেনাবাহিনী বা অন্যদের নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইনি প্রশ্নের বিষয়টি আসে কেন। কান বলছেন, এর কারণ হল সন্ত্রাস চেনায় ভুল হতে পারে কিন্তু সন্ত্রাস তো আইনি জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না। সে আমাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘনের দিকে নিয়ে যায়। যেটাকে লঙ্ঘন করা যায় না। কিন্তু তা-ই বাস্তবে উল্টা ঘটেছে। তারা আমাদের সার্বভৌম মানে না। তার মানে, যে কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বই স্বীকার করে না, তার জন্য আইনি সুরক্ষাই খোলা থাকে না। তাই যদি কারও বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রশ্ন জাগে, সে নির্যাতনের দিকে পা বাড়াতে পারে। এটাও তখন সার্বভৌমত্বের মত পবিত্র জিনিস। উদাহরণ হিশাবে বলা যায়, আমেরিকার আইনি ভূগোলের বাইরে স্থাপিত গুয়ান্তানামো কারাগার। এই আইনি নায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই একসময় অবাস্তব ছিল। তালাল জানাচ্ছেন, তাহলে সন্ত্রাস হল অ-রাষ্ট্রীয় তরফের বিষয় আর অন্য দিকে এর সাথে নির্যাতন হল সার্বভৌমত্বের বিষয়। তিনি এটাকে সাম্রাজ্যবাদের নিজের চরিত্রের ভেতরকার বিষয়ই বলেন, তা শুধুমাত্র অপরের বিষয় নয়, বরং নিজেদের পুলিশী কাজও বটে।

সন্ত্রাস ও সার্বভৌম একে অপরকে জড়াজড়ি করে আছে

৯/১১ এর ঘটনায় আমেরিকার সেই ঐশ্বরিক প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে গেছে। যে বিষয়টি এতদিন অপর ছিল, তা এখন আমেরিকার ইতিহাসের অংশ। এই ঘটনা তাদের সর্বগ্রাসী ভয়ে নিমজ্জিত করেছে। এটা তাদের জীবনে এনে দিয়েছে স্থায়ী দুঃস্বপ্ন। এর একমাত্র সুরাহা হল সীমাহীন শাস্তি, এই যেন ঐশ্বরিক ক্রোধ।

সন্ত্রাস ইতিমধ্যে এবং সবসময় সার্বভৌমের বিষয়। তার সাথে আইন জড়িত। আইন নিজে অতীন্দ্রিয় এবং ‘অপর’র বরাতের বিষয়। সেটা এই আইন প্রয়োগকারীরা ধারণ করেন মাত্র। এবং এই আইনের মধ্য দিয়েই সেই সন্ত্রাসের ভয় কাজে লাগায় তারা; যা তাদেরকে এবং খোদ আইনকে ন্যায় যুদ্ধে নায্যতা দেয়। আর ক্রমেই তখন আইনের এই প্রক্রিয়া সহিংসতাকেও নৈতিক আর আইনি ভিত্তি দেয়। যেকোন ধরনের শক্তি প্রয়োগ, জবরদখলের বাসনা আর জুলুম-নির্যাতনের খায়েশকে পূর্ণতা দেয়। রিচার্ড ফালক একেই আইনের নমনীয় পঠন বলেছেন। অর্থাৎ, প্রয়োগকারীদের নিয়তের ওপরই নির্ভর করে, আইনটা কিভাবে প্রয়োগ হবে। সে কারণে আমেরিকার আফগানিস্তান আক্রমণে আন্তর্জাতিক আইন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। এর নমনীয় সাধারণ ভাষ্যই পশ্চিমের জন্য কাজের জিনিস হয়ে উঠছে। আবার এর সাথে আরও চমৎকার উপাদান হিশাবে মানবিক ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতাও যুক্ত আছে। যা আরও ব্যাপক অর্থে সন্ত্রাসের ভয় জয় করার ভিত্তি দিচ্ছে। খেয়াল করার বিষয় এর সাথে আধুনিক রাষ্ট্রের সেই অলঙ্ঘনীয় অতীন্দ্রিয় সত্ত্বা ‘সার্বভৌমত্ব’র সাথে আফগানিস্তানের কোন যোগসূত্র নাই যেন। শুধুমাত্র সন্ত্রাসী হামলার ভয়ই এর পোশাকি ভিত্তি। এই ভিত্তি শুধু পশ্চিমের জন্যই একমাত্র পবিত্র এবং স্বতসিদ্ধ। কিন্তু রাষ্ট্রের এই টিকে থাকার আইনি ও সার্বভৌম ক্ষমতা অপরের বেলায় পুরাপুরিই তার সুবিধামত নাকচ করে দেয় পশ্চিম। ফলে সেখানে আফগান রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তো কোন জিনিসই না।

২০০২ সালের জানুয়ারি ৯ তারিখে আমেরিকার বিচার বিভাগ একটা স্মারক খাড়া করে, সে হিশাবে তাদের মতে আফগানিস্তান একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ায় দেশটির বন্দিদের ক্ষেত্রে জেনেভা কনভেনশনের নীতি খাটবে না। এই আইনি যুক্তি কথিত নৈতিকতাকে পানসে করে দেয়, তার চেয়ে বেশি কিছু না। কিন্তু ব্যর্থ রাষ্ট্র এটা কি জিনিস? কোন পক্ষ ব্যর্থ রাষ্ট্রের ঘোষণা দিতে পারে? সাধারণত ব্যর্থ রাষ্ট্র বলতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটা তত্ত্বের দিকে জোর দেয়া হয়। যেটা সচরাচর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলার দিকে ইশারা করে। এটা কোনভাবেই আইন-আদালতের বিষয় না। কিন্তু এই যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমেরিকা এই তত্ত্বকে ছদ্ম-আইনি বয়ানে খাড়া করে এর একটি নতুন ক্যাটগরি বানিয়েছে। ফলে আইনি রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে গুয়ান্তানামো কারাগার তৈরিও বৈধতা লাভ করে। তাহলে ঘটনা যা দাঁড়ায় তাতে ন্যায় যুদ্ধের বয়ানের পে যেকোন তত্ত্ব যেমন খুশি প্রয়োগ করা যায়। শুধু তাই নয়, তাদের পছন্দের এই যুক্তি মতে কোন রাষ্ট্র ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হলে তার বিরুদ্ধে আগ্রাসনও জায়েয। কিন্তু কোন বিদ্যমান কাঠামোতে আফগান রাষ্ট্র নিজেকে দাঁড় করিয়েছে এবং তার নাগরিকদের তরফে এর কোন প্রতিক্রিয়া ছিল কি না চোখে পড়ে নাই। এই ব্যর্থ রাষ্ট্রে আμমণের আইনি বৈধতার ভিত্তি হলÑ অসংখ্য মৃত্যু, কারজাই সরকারের দুর্নীতি, প্রশাসনিক কাঠামোর অদক্ষতা, অবকাঠামো উনড়বয়নে অব্যবস্থাপনা, বিশাল সেনা বাহিনী পোষার ব্যয়ভার, সরকার-সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা ও পশ্চাদপদ শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। তালালের মতে, এটা হলÑ স্বার্থক রাষ্ট্র আমেরিকার জনগণের নৈতিক ও রাজনৈতিক অপচয়ের জন্য ব্যর্থ রাষ্ট্র আফগানিস্তানের জনগণের মহান আত্মত্যাগ। এই আইনি সুরক্ষা যেমন আমেরিকার যুদ্ধকে যৌক্তিক করে তুলেছে, তেমনি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিশাবে আমেরিকার নাগরিকদের বিরোধিতা ছিল অপর্যাপ্ত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাথে তুলনা করলে আমেরিকান সৈন্যের তুলনায় ঢের বেশি আফগান সাধারণ নাগরিক মারা যাচ্ছে। কিন্তু আমেরিকানদের জন্য যুদ্ধে গিয়ে বেসামরিক নাগরিক মারাটা মোটেও যথেষ্ট না। আমেরিকা সন্ত্রাসের যে তত্ত্বকথা আওড়িয়ে এই যুদ্ধে নেমেছে সেদিক থেকে এ যুদ্ধ আমেরিকারই স্ববিরোধী। কিন্তু এর পেছনের বড় একটা তোড়জোড় হল, ৯/১১ এর ঘটনায় ঐশ্বরিকতার লঙ্ঘন। এই লঙ্ঘন হল আমেরিকার পবিত্রতার লঙ্ঘন। তাছাড়া অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, বেকারত্বের উচ্চহার যুদ্ধের পক্ষে জনমত টানার জন্যও অনুকূল। সাম্প্রতিক কংগ্রেসনাল রিপোর্ট তাই তো বলছে। যদিও পাখতুনদের ওপর হামলা-হতাহতের কারণে কিছু উদার বুদ্ধিজীবি এখন নরম সুরে এই যুদ্ধের বিরোধিতা করছেন।

মানবাধিকারের ধোয়া-সর্ষের মধ্যে ভূত
আগেই বলা হয়েছে, এই যুদ্ধ উপলক্ষে আফগান জনগণ শরিয়া আইনে অমানবিক জীবননাশ করছে যা তাদের বার বার আলোচনার বিষয় হয়েছে। বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের শরিয়া আইনে নারীর স্বাধীনতা নাই। শুধু তাই নয়, তাদের অনৈতিক শাসন ব্যবস্থা আফগানিস্তানকে পাকিস্তান ছাড়া অপরাপর দেশ থেকেও বিচ্ছিনড়ব করে দিয়েছে। এছাড়া আফিম চাষের ঘটনাকে জোরসোরে আলোচনায় আনা হয়েছে। আফগানিস্তানের সবচেয়ে সাহসী নারী হিশাবে পরিচিত সংসদ সদস্য মালালাই জয়া বলেন, ২০০১ সালে আমেরিকার হামলার পরও নারীর অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নাই। বরং, যুদ্ধবাজ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। আর মাদক চাষের বিরোধিতা বলতে আসলে কি বুঝায় সেটাও পরিষ্কার না। সেই সোভিয়েত দখল আমলে আফগানিস্তানে আফিম চাষের পত্তন ঘটে আমেরিকার গোয়েন্দা বাহিনী সি আই এ’র সরাসরি সহায়তায়। বিগত বছরগুলাতে সেটা বেড়েই চলছে। সেখানেও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার হাত আছে। ২০০১ এর হামলার পর তা বেড়েছে ৪,৪০০%। জয়া ইউ এস ও ন্যাটো বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি করে বলেন, এইসব বাহিনী তাদের জন্য ভয়, মৃত্যু ও দুর্নীতি ছাড়া কিছুই বয়ে আনে নাই। কিন্তু বাস্তব ঘটনা কি? তা নারী নিপীড়নের ঘটনা হোক অথবা মাদক উৎপাদন হোক কোন কিছুই থেমে থাকে না, কোন কিছুই একটা ন্যায় যুদ্ধ জায়েয করে না।

আমেরিকার বিদেশনীতির পরিবর্তন
এই ন্যায় যুদ্ধের আরেক বাস্তবতা হল এর মাধ্যমে আমেরিকান নয়া রক্ষণশীল (নিওকনজারভেটিভ) বিদেশ নীতির পরিবর্তন হচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধকালের সে সময় আর নাই। তাই শত্র“-মিত্রের ধারণাও এখন পাল্টাতে হয়েছে। যা আগে ছিল ইওরোপে এখন তা মধ্যপ্রাচ্যে। সে দিক থেকে এই হামলা তাদের নিজেদের পরিকল্পনামাফিক পথে গেছে। শুধু তাই নয়, ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে হোয়াইট হাউসে আফগানিস্তানে হামলার পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ হামলার আগেই ৯/১১এর ঘটনা আমেরিকাকে সর্বগ্রাসী ভয়ে আক্রন্ত করেছে। তখন জনমত আর বাধা হয়ে দাঁড়ায় নাই। জনমতের সমস্যা আর থাকে নাই তার সামনে। খোদ জনগণই এখন এই যুদ্ধের অংশীদার। তাহলে ৯/১১ এর অনিবার্য পরিণতি তাদের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাস্তব অবস্থাকে অন্য পথে নিয়ে যায় নাই। অর্থাৎ এই পরিবর্তন আর এক মাত্রিক থাকে নাই। এর গজিয়েছে নতুন নতুন ডাল-পালা। যা সমগ্র বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতিতে এনেছে গুণগত রূপান্তর। এতে দুনিয়া পরিষ্কার দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে। হয় আমেরিকার ‘বন্ধু নয়তো শত্র’ অংশে ভাগ হয়ে গেছে। মোটকথা ৯/১১ দুনিয়াকে বিলকুল বদলে দিয়েছে। যার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের তত্ত্বের ভিত্তিতে আমেরিকা তার পররাষ্ট্রনীতি সাজিয়ে চলছে।

সন্ত্রাসবাদের অর্থও বদলে গেছে
আমেরিকার স্বরাষ্ট্র বিভাগের সা¤প্রতিক সংজ্ঞা মতে সন্ত্রাসবাদ হল, রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে কোন উপ-জাতীয়তাবাদী বা গুপ্ত সংগঠন যখন কোন নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর ওপর পূর্বপরিকল্পিতভাবে সহিংস আক্রমণ চালায়। আমেরিকার টেররিজম এ্যাক্ট ২০০০ এ হুমকি (থ্রেট) শব্দটি অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু তা সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞায় ব্যবহার করা হয় নাই। এর আবার অন্য কারবার। হুমকি বলতে কি বুঝায়? যখন কারও হাতে অস্ত্র থাকে তা অনিবার্যভাবে কারও জন্য হুমকি হিশাবে গণ্য হয়। এটা অনেক সময় বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। তালাল বলছেন, আমেরিকার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। সেটাও তো অন্যদের কাছে হুমকি হিশাবে গণ্য হবে। তাহলে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ঘটলে, সেটাও তো কোন আন্ত র্জাতিক আইনেই পড়বে না। তাহলে কাউকে হুমকি গণ্য করার সাথে কি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে সেটা নয়, বরং সে কি অস্ত্র ব্যবহারের সক্ষমতা রাখে সেটাই বড় কথা। হুমকি আমলে নিয়ে প্রতিরক্ষার ধারণা টেররিজম অ্যাক্টের আগের বিষয়। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে ১৯৯৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস একটা পরামর্শ দেয়। সেই মতে কোন রাষ্ট্র আত্মরক্ষার চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এই চূড়ান্ত পরিস্থিতি শব্দ দুটির দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, এটি শুধু শরীরী বিষয় আকারেই নয় বরং সাংবিধানিকভাবে যে রাজনৈতিক অস্তিত্বের কথা আছে তার সাথে জড়িত। আমেরিকা, দুনিয়াব্যাপী তার সাম্রাজ্য। সে যদি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেয় বা ব্যবহার করে সেটা তার জন্য বে-আইনি নয়। সেটা বে-ইনসাফী কিনা অন্য তর্ক বটে।

এবার খেয়াল করা যাক আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে কি করবে না, সেই তর্ক কি বলে। ২০০৭ সালে সিনেটর থাকা কালে বর্তমান রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা বলেছিলেন, আফগানিস্তানের জনগণের ওপর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। সেই সময়কার সিনেটর, রাষ্ট্রপতি প্রার্থীতায় প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বর্তমানে ওবামা সরকারের সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন স্নায়ু যুদ্ধ আমলের রাষ্ট্রপতিদের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তার মতে, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার হলেও তা হবে শান্তির জন্য। হিলারি এটা বিশ্বাস করেন না, একজন রাষ্ট্রপতি প্রকাশ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হবে কি হবে না, এই নিয়ে কথা বলতে পারেন। এবং এরপর ওবামা জায়গা মত ফিরেও আসেন। যুদ্ধের প্র ম পদক্ষেপে ব্যাপক বিধ্বংসের হুমকি বা অস্ত্র ব্যবহার এটাই আমেরিকার যুদ্ধ নীতি। যে পথে ওবামাও হাঁটছেন। তাহলে যুক্তিসঙ্গতভাবেই হিলারির সাথে গলা মিলিয়ে বলা যায়, ন্যায় যুদ্ধ যদি অনিবার্য হয় তবে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার কেন নয়? ফলে এটাই হল সেই আমেরিকা, যেখানে তার শান্তির জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন হয়।

শান্তির জন্য যুদ্ধ
পরাশক্তি হিশাবে আমেরিকা সবসময় কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। সেটাকে নৈতিকতা ও ভাল-মন্দের জায়গায় দাঁড় করানো কোন কাজের জিনিস হতে পারে না। বরং আমরা আবার জোর দিতে পারি সনাতনী ধারণানুযায়ী ন্যায় যুদ্ধ কি জিনিস? নীতি বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে, রাজনৈতিক বাস্তববাদ ও শান্তিবাদ নামক দুইটা চরম তত্ত্বের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে ন্যায় যুদ্ধ। এটা নির্ভর করে শান্তি ও যুদ্ধের পার্থক্যের ওপর। এই পার্থক্য চিহ্নিত করতে না পারলে ন্যায় যুদ্ধের শুরু বা শেষ করা যায় না। আমেরিকা তাদের চলমান যুদ্ধে ন্যায় যুদ্ধ তত্ত্বের যে দাবি ‘শাস্তির জন্য যুদ্ধ’ তার কথায় বার বার বলেছে। এমনকি যদি পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারও হয়, তারও নিমিত্ত শান্তি। কিন্তু এখন বাড়তে থাকা অস্ত্রের ঝনঝনানি তা ঘরে-বাইরে আর দেশে-বিদেশে হোক, এখানে শান্তি থেকে অস্ত্র আলাদা করা কঠিন। মূলত এই শান্তি কোন সংজ্ঞায় ঠিক হয় না। দুনিয়াব্যাপী চলমান যে সহিংসতা সবকিছু গ্রাস করছে, তাকে হঠিয়ে যে শান্তির এই কল্পনা করা যায়- তা শুধু বইয়ে লেখা বুলির মত বলা যায় ন্যায়যুদ্ধের যথাযথ উপসংহার হল চারিদিকে শান্তি আর শান্তি। কিন্তু সেই শান্তি নিশ্চিত থাকতে পারার মত কোন ঘটনা এখনও ঘটে নাই। ফলে এটা একটা বড় প্রশ্ন ন্যায় যুদ্ধ বলে দুনিয়াতে আসলে কিছু ছিল কি?

ন্যায় যুদ্ধ ভবিষ্যতে তার স্বভাব পাল্টাবে
বছরখানেক আগে রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাকে উদ্দেশ্য করে দি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় সম্পাদকীয় ছাপা হয়। লেখাটির শিরোনাম, আ মিলিটারি ফর ডেনজারাস ওয়ার্ল্ড। এখানে বৃহৎ সেনাবাহিনীর প্রয়োজনের কথা বলা হয়। বলা হয়েছে, আমেরিকা ও ন্যাটো জোট আফগানিস্তানকে অবশ্য পরাজিত করবে। তারা দুনিয়ার যে কোন জায়গা থেকে আল কায়েদার সদস্যদের পাকড়াও করবে। সেই সাথে আশা পোষণ করেছে বেয়াড়া ইরান, উত্তর কোরিয়া, চীনের উদয়মান শক্তি, রাশিয়া, সোমালিয়া ও পাকিস্তান পুরাপুরি আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে। এইগুলাকে প্রচলিত যুদ্ধের কাতারে ফেলা হয়েছে। এই মোকাবেলায় আমেরিকার সক্ষমতায় অটুট বিশ্বাস আছে সেই লেখকের। কিন্তু মুশকিল হল, ভবিষ্যত আর প্রচলিত যুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকবে, তার সম্প্রসারণ ঘটবে গেরিলা যুদ্ধে। যা এখনও চলছে, কিন্তু দি নিউ ইয়র্ক টাইমস এর এই সম্পাদকীয় মতে ভবিষ্যতে সে অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। আমেরিকাকে ভিনদেশের মাটিতে মারাত্মক সব সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে যুদ্ধনীতি কি হবে, কি অস্ত্রের ব্যবহার হবে, এই আইনি বয়ান কি হবে তা বর্তমান ন্যায় যুদ্ধ থেকে খানিকটা অনুমান করে নেয়া যায়। পাঠকদের জন্য দি নিউইয়র্ক টাইম এর বক্তব্য হল, যদি বর্তমান পরিস্থিতি জারি থাকে এই জগত সংসার শত শত বছর বিপদজনকই থাকবে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হল, শান্তির জন্য যুদ্ধ। মানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ। সবমিলিয়ে কথা হল, সেই বিপদের খাড়া ঝুলিয়ে হয় ‘বন্ধু-নয় শত্র’ তত্ত্বের মাধ্যমে দুনিয়াকেই ভাগ করা হল।

ন্যায় হল শক্তিমানের স্বার্থ
ইওরোপ-আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতি হিশাবে গত শতকের শেষ দিকে দুনিয়ার মানুষ দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে: একদিকে শান্তিবাদী দেশ (পশ্চিমা দেশসমূহ) এবং অন্যান্য যুদ্ধ অঞ্চল (অ-পশ্চিমা দুর্বল দেশসমূহ)। অথবা আইনের শাসন এবং অরাজকতার শাসন। পশ্চিম এবং অপর। আফগানিস্তানের যুদ্ধকালে শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের কথা ভেবে বুশ বলেছিলেন, আমি আপনাদের জানাতে চাই, যখন আমরা যুদ্ধের কথা বলি, আসলেই শান্তিরই কথা বলি। কারও কারও মর্মে এটা দ্বিমুখি কথা। ওবামাও সেই সুরে সুর মিলিয়েছেন। তিনি তালেবানদের অন্তহীন সহিংসতার কথা উল্লেখ করে বলেন, এদের ধ্বংস করার যে দায়িত্ব তা শুধু আমেরিকার নিজের জন্য নয়। কিন্তু আমেরিকার সুখ-শান্তি নির্ভর করছে তালেবানদের নিশ্চিহ্ন করার মধ্যেই। তালেবান মানে দুনিয়ার আশাহীন, সম্ভাবনাহীন, সুখ-শান্তিহীন ভবিষ্যত। তাহলে অনন্ত শান্তির জন্য প্রয়োজন অনন্ত যুদ্ধ। এই সুখ-শান্তি নিশ্চিত করতে আমেরিকাকে ইতিহাসই ডেকে এনেছে। শুধু তাই নয় পশ্চিম ও অপর ভাগাভাগি সত্ত্বেও আমেরিকা তাদের এই যুদ্ধে অন্যদের সাহায্য আশা করছে। যেহেতু এই শান্তি আমেরিকার একার শান্তি নয়, সারা দুনিয়ার খাতিরে এই যুদ্ধ। সুতরাং, এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে আমেরিকা অন্যদের শরীরী সাহায্য কামনা করছে।

তালালের মতে, নয়া-উদারনৈতিকতাবাদী এই সংঘাত চলছে নানাভাবে। যুদ্ধ, আত্মঘাতী হামলা, বিশ্বাসঘাতকতামূলক হত্যা ও ইজরাইল-আমেরিকার নিরাপত্তার স্বার্থে নিরীহ গ্রামবাসী হত্যা সহ নানা নামে। নিরাপত্তার নামে নানান প্রযুক্তি আমাদের চারদিক ঘিরে ধরছে। কোন কিছুই আর গোপন নাই। ক্যামেরা আপনার চারদিকে ঘুরঘুর করছে। জাতীয় পরিচয় পত্রসহ নানা ধরনের আইডি আছে যার জালে আপনি জড়িয়ে পড়ছেন। অদৃশ্য বিমান প্রহরা, স্যাটেলাইট প্রতিমুহূর্তে আপনার ওপর নজরদারি করছে। যেকোন মুহূর্তে আপনি একজন বিপদজনক সন্ত্রাসীরূপে সন্দেহের শিকার হতে পারেন। হতে পারেন অভিযুক্ত। সেটা আর আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান, আফ্রিকার বিষয়ই নাই। আপনি দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকেন না কেন ঘরে-বাইরে নিরাপত্তার মহা কারবার। তালাল এইসবের সাথে সাথে পুঁজিবাদী বিশ্বের সংকট যুক্ত করেন। যেমন ধনী গরিবের অসাম্য। এইসবের সাথে যুদ্ধ ও শান্তির সম্পর্কটা কি? শুধুমাত্র ন্যায় যুদ্ধই কি এই দুনিয়াতে শান্তি নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট। এইসবের সমাধান শুধু শান্তির প্রশড়ব না বরং, যার হাতে ক্ষমতা আছে সে আসলে একে কিভাবে দেখে কি নিয়তে ব্যবহার করবে তার ওপর নির্ভর করে। আপন-পরের যে ভেদ শান্তি ও যুদ্ধের নামে ছড়িয়ে পড়েছে তা কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তার বীজ আকারেই অন্য কোন ভবিষ্যতকে নির্দেশ করছে। এটা স্পষ্ট করে বলা যায়, অনিবার্য ন্যায় যুদ্ধের যে যুক্তি তাতে কোনভাবেই পৃথিবীর শান্তি লুকানো নাই।

………………………………………………………………………………………………………………

নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ পেশায় শিক্ষক, আমেরিকার নিউ ইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন। ঔপনিবেশিক উৎস ও প্রকরণজাত শাস্ত্র হিসেবে সাম্রাজ্যিক প্রকল্প থেকে পরিচালিত অ-পশ্চিমী জগতকে ‘বিষয় বানিয়ে বিদ্যা উৎপাদন ব্যবসা তার হাতে পড়ে বড়সড় একটা ঝাকুনি খায়। তিনি একেবারে আরম্ভেই মোকাবেলার সূচনা করেন, এই শাস্ত্রের অনুমান, পাটাতন আর উদ্দেশ্যকে। এরই আদি নিদর্শন তার সম্পাদিত অ্যানথ্রপলজি অ্যান্ড কলোনিয়াল এনকাউন্টার (১৯৭৩) বইটা। নৃবিজ্ঞানের অভ্যাসের আওতায় ফেলে পশ্চিমকে সাব্যস্ত করার কাজ শুরু করেন সেই থেকে। ঔপনিবেশিক কর্তাকে উপনিবেশি প্রজার অজ্ঞান উদ্ধারের জন্য বাছাই করে তিনি আধুনিকতার ইতি-আদি-আকার ও বিকার প্রদর্শনে রত হন। গোড়ায় গিয়ে গাথুনির তলা এবং মালমশলার স্বরূপ সংক্ষেপ করেছেন জিনিয়লজি অব রিলিজিয়ন (১৯৯৩) বইটাতে। ধর্ম মুক্ত নিখাদ ইহজাগতিকতা বা দুনিয়াদারিতে পিছিয়ে থাকায় প্রাচ্য বিশেষ, মুসলমানদের দুর্দশার যে অন্ত নাই সেই বয়ানের চাকচিক্যময় বাহিরানা আর অন্দরের ঐতিহাসিক বাসনার বসন খুলে তিনি আসল মুখখানা হাজির -নাজির দেখাতে কোশেশ করেছেন ফরমেশনস অব সেকুলার (২০০৩) বইটাতে। আধুনিকরাষ্ট্র ও রাজনীতির নিরন্তর দাওয়াইপত্রে ইসলামকে যেভাবে আদিভৌতিক বিভীষিকা বানানোর তালে মজেছে তার চলন ও চরিত বিশেষেণ তিনি তাদেরই ইতিহাসকে সাক্ষী মেনেছেন সর্বশেষ অন সুইসাইড বম্বিং (২০০৭) বইতে। এই লেখাটি বৃটেনের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত আগস্ট ২০১০ দেয়া তালাল আসাদের বক্তৃতা অবলম্বনে তৈরী।

>ব্যবহৃত ছবি গুগল সার্চের মাধ্যমে সংগৃহীত।

>লেখাটি পাক্ষিক চিন্তা ৩০ অক্টোবর ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত।

Comments

comments