সিদ্ধার্থের আপন ভূবন

সিদ্ধার্থ নামে আমি নিজেকে চিনি অথবা ভাবি। আমার এই ছোট্ট জীবনে নানা অতৃপ্তি আছে। অথবা আমাদের এই জীবনে। আছে নানা কাঙ্খা। কোনটাকে ভালো আর কোনটা মন্দ নামে ডাকি। আবার কখনো কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ তা-ই বুঝতে পারি না। তারপরও সব মিলিয়ে চাই এই হাটুক আর হামাগুড়ি দিয়ে যাক সে যেন জীবন ছক বাধা থাকে। আমাদের নির্মিত বাসনার বাইরে না যায়।

মধ্যবিত্তীয় বাসনা। কিন্তু এই যে জীবন- আসলে কি প্রতিদিন একই ছকে হাটে। যখনই একই পথ হাটি দেখি একই ভুল। এই সবকিছু ছাড়িয়ে এই আমি অবোধ্য অধরা কিছুর প্রতি টান অনুভব করি। সেই অনুভব বৃহত্তর কিছুর সাথে মিশে যাবার। অথবা সেখানে বৃহত্তর ভাবাভাবির কোন মূল্য সেখানে নেই। যেখানে ভেদ-অভেদে কিছুই আছে যায় না। কোন দুর্বিনীত আকাঙ্খা অবিরত খুচিয়ে চলে না। যেখানে ইচ্ছেগুলি পাওয়া-না পাওয়া, ভুল-শুদ্ধের জেহাদে ত্যক্ত-বিরক্ত করে না। তেমন কিছুতে লোভ আমার অথবা অন্য অন্য আরো অনেকের। একদিন মুখোমুখি হয়েছিলাম ছোট্ট এক চড়ুই পাখির অথবা অনেক কিছুর। কারণ, শুধুমাত্র দেখা জগতকে সত্য মেনে নিলে আমার এই বাসনার কোন মূল্য থাকে না। আমি এক বিপনী বিতানে একটা পণ্যের নাম জেনেছিলাম, নির্বাণ। পূর্বে আমি যাকে নিবার্ণ নামে জেনেছি তাকে অলৌকিক বলে জেনেছিলাম। যখন পণ্যরূপে থাকে দেখি, ভাবতে থাকি…। তুল্যমূল্য ছাড়া ভাবনা কোন পথ খুজে পায় না।

সেই যে চড়ুই পাখির কথা বলছিলাম। সে আমায় বলে গেছে আমার ভেতরকার কথা। অথচ সে আমার অপর। আপন-অপর নিজেকে নিয়ে সিদ্ধার্থের আপন ভূবন। সিদ্ধার্থ আর কেউ নয়। স্বচ্ছ জলে যার ছায়া দেখি। অথচ আসল মানুষটাই আমি।

ছোট একটি পাখি একদিন বলেছিল, প্রকৃতই জন্ম তার- যার পুর্নজন্ম ঘটে। তাই প্রতিটি মানুষকে নানারূপে আসতে হয়। তেমন মানুষ বড়ই দুর্লভ, যার পুর্নজন্ম ঘটে না। যার ঘটে না, সে তো মহাপুরুষ। জম্মই তাকে নিশ্চিতি দেয়। কিন্তু প্রকৃতই পুর্নজন্ম কয়জনের ঘটে। বেশির ভাগই আধ-খেচড়া বোধ নিয়ে সন্তুষ্ট।

মানুষ হলো এমন সত্ত্বা সে চাইলে প্রতিমুহুর্তে নিজেকে নানারূপে অনুধাবন করতে পারে। আবার সে নাও চাইতে পারে। চাইতে হয় সেটা অনুধাবন নাও করতে পারে। কিন্তু আমরা জানি মানুষ কিছু না কিছূ চায়। ভুল করে হলেও চায়। তার ভুল আসলে প্রকৃত ভুল নয়। এর ভেতর কিছু না কিছু সত্য থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সে ভুল কাটিয়ে উঠতে চায় কিনা।

পুর্নজন্ম ভুল করার সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু সেই সম্পর্কই জোরালো যখন সে ভুলটা শুধরাতে চায়। নিজেকে অতীত গ্লানি থেকে মুক্তি দিতে চায়।

তাহলে পুর্নজন্মের এই জম্মটা আসলে কি? যদি প্রতিদিন নতুন জীবন চাই- তাহলে ভুলের চক্র কি নির্দেশ করে। কি?

সেই পাখিটা বলেছিলো, পূর্ব জম্মের স্মৃতি ভুলতে না পারলে পুর্নজন্ম ঘটে না। পুর্নজন্ম হলো বিপ্লবের নাম। পুর্নজন্ম মানুষের নিত্য বাসনা।

দেহে এবং দ্রোহে। পুর্নজন্ম কি?

শাস্ত্র হতে ধার নিয়ে বলি, দেহ কিছু না, আত্মাই আসল।

এবার আমার অবাক হবার পালা। পাখিটি বলে, দেহের ক্ষয়-বৃদ্ধি আছে, সে ধ্বংস হয়। আত্মা অক্ষয়, অমর। এই মানব দেহ ভূ-বিশ্বে পড়ে থাকে। আত্মা উড়ে যায় অন্যকোথাও। বাসা বাধে অন্য দেহে। দেহ কি এতই তুচ্ছ।

সে আমার পরান পাখি। সে আমার গুরু হয়ে উঠে। সে বলে, দেহ মোটেই তুচ্ছ নয়। এই ভূ-বিশ্বে অ-দরকার বলে কিছু নাই। নিমিত্ত বুঝতে শেখো। নিমিত্তের রহস্য জানলে সব পরিষ্কার হবে।

তখন তাকে শুধালাম, আত্মা কি?

সে আরো বলল, আত্মা হলো আপনাকে অনুসরণের একটা নিমিত্ত। তাই আত্মা নিজে বিষয়, আবার একই সাথে অনুসরণের পথ বটে। তাকে অনুসরণ করেই তার স্বরূপ জানতে হয়।

আমি ভাবছিলাম সী মোরগের কাহিনী।

সে বলে চলে, আত্মার ক্ষয়-বৃদ্ধি নাই। এটি সর্বাংশে সত্য নয়। দেহের আছে ক্ষয়-বৃদ্ধি-পতন-পচন, এর চেয়ে বড় বিপদ ঘটে আত্মায়। আত্মার অধঃপতন আছে। আত্মার অধঃপতন ঘটলে, তার অন্বেষণের পথ বড়ই কঠিন আর দুর্গম। এমন নয় যে তাকে শরীরিকভাবে স্থানের দুরত্ব পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু দেহকেও এর চেয়ে বড়ো দখল সামলাতে হয়। আত্মার নিয়ন্ত্রণ তো কায়িক সাধনাও বটে। আত্মাকে পুনরুদ্ধার করতে না পারলে মানুষ চক্রে পড়ে। শাস্ত্রে যাকে পুর্নজন্ম বলে।

আমি বলি, তা কি করে সম্ভব? তাহলে পুর্নজন্মের ধারণায় থাকে না।

সে বলে, যদি শাস্ত্রের ভাষায় বলি মানুষের পাপের কারণে তার অধঃপতন ঘটে। আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে। সে যদি না-ই জানে তার আত্মার হাল তবে তার আত্মার উর্ধগমন হবে কি করে। আর দেহে ভর করে যে আত্মা সেতোই প্রকাশমান। এই উর্ধগতি-অর্ধগতি তো দেহের জগতেই ঘটে।

আমি বলি, তুমি যে বলো আগের জন্ম ভুলতে না পারলে পুর্নজম্ম ঘটে না।

ওরে অবুঝ, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না। পুর্নজন্ম সমগ্র ভাবনার অংশ মাত্র। এর বিশেষ রূপ বিশেষ সময়ে মানুষের জীবনে ধরা পড়ে। হতে পারে একই মানুষের জীবনের নানা অংশ। কিন্তু এরমধ্যে ধারাবাহিকতা আছে। এখানে মৃত্যু মানে ব্যক্তির দৈহিক মৃত্যু না। বরং, নিজের জ্ঞানজ ভ্রমন, যা একই সাথে কর্মও। তার অনুসন্ধান।

তোমার মাঝে দেহকে তুচ্ছ ভাবার পূর্বানুমান আছে। এই ভাবনার কোন কারণ নাই। এই মানুষ যদি সেই মানুষ না থাকে- তবে অদেখা অপরের পাপের ঘানি টানবে কেন?

সে এইভাবে কতকিছু বলে……।

আমি যেন অবুঝ বালক। চুপচাপ চেয়ে থাকি নিষিদ্ধ খিরকি পানে।

এই ছিল আমার স্বপ্ন। আমার আপন ভূবনে আসা-যাওয়া। ভোরের আলো ফোটার আগেই পাখিটি উড়াল দেয়। কোমল আলো জানালা পেরিয়ে আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আমার হৃদয় আলোর হলকা অনুভব করে। এই অনুভূতি বলে দেয় দেহ ও মনের সম্পর্ক বুঝা দূরবর্তী কিছু নয়।

আমার আত্মা কাকে গুরু মেনেছে জানি না। কিন্তু মানুষের গুরু থাকতে হয়। হয়ত দৃশ্যমান কিছু থাকে না। নিজের মাঝে অচিন কেউ বসত করে। সেই আপনার বেশ ধরে নিজের সাথে সওয়াল-জবাব করে।

> পোষ্টে ব্যবহৃত ছবি নেয়া হয়েছে  হেন্ডারসন আর্ট সাইট থেকে।

Comments

comments