সুধীর চক্রবর্তীর ‘বাউল ফকির কথা’ বইটায় বৈষ্ণবদের নিয়ে যে পার্ট; ওইটা আমি পড়তেছিলাম। থেমে থেকে পড়তে হইতেছিল। সেটা বোধহয় লেখার জনরার কারণে। কিন্তু মজাদার, কৌতুককর ও বিয়োগান্তক। বর্ণনামূলক বাস্তব জীবনটা এভাবে আলাদা করা যায় আরকি। মানুষের জীবনে কেন এমন ঘটে; মানুষের সাধনা কেন এমন জটিল ও দুঃখ জাগায়; সেটা নিয়ে ততটা আসলে ভাবি নাই। ওই লেখাটার কথা এমনভাবে মনে পড়ে, যখন আমি তারাশঙ্করের ‘রাইকমল’ প্রসঙ্গে আসছি। সুধীরের লেখাটা পড়তে আমার সময় লাগছে, কিন্তু ‘রাইকমল’ তরতর করে পড়ছি। ঘটনা শেষে যেটা মনে হইছে— ফিকশনের ভেতর দিয়া আমার মতো পাঠকরে সন্তুষ্ট করা সহজ। তার স্মরণশক্তি ও কল্পনাশক্তি আগাইয়া দিত হয়তো ফিকশনের জায়গাটা কিছুটা হইলেও ইস্তেমাল করতে পারে। এ ধরনের পাঠকের স্থান নিশ্চয় উঁচা কোনো জায়গা না, বাট আমার মতো আরো আরো আমপাঠক থাকার কথা।
এত লম্বা ভূমিকা বা মূল কথার পর মনে হচ্ছে, বাকি কথা আর থাকলো কই। সেথায় যাওয়ার প্রসঙ্গ আসলে রক মনুর গল্পের বই ‘বাশনার ফিকির’ নিয়া আমি যখন ভাবতেছিলাম; এই রকম একটা উদাহরণ মাথায় আসলো, যা আমি ‘রাইকমল’ পড়তে পড়তে গত বছর ভাবতেছিলাম। মানে ফিকশন আর নন-ফিকশনের সম্পর্কটা বোঝার একটা চেষ্টা করতেছিলাম।
অন্য অনেকের চেয়ে রক মনুর বিষয়টা আলাদা ও এক এ জন্য যে— উনার সঙ্গে আমার চেনা-পরিচয় আছে। আমরা ক্যালেন্ডারের হিসাবে একই সময়ের মানুষ। বছর দু-একে দেখার হওয়ার চান্স থাকে। ইভেন উনাকে চাইলে একটা চিমটি বা খামচি দেয়া সম্ভব। ফ্রেন্ডলি অর্থে, যখন ব্যক্তি রক মনু প্রসঙ্গে বলি তখন। রূপকার্থেও, যেভাবে আমরা নিপীড়িত বাংলাদেশে কমন স্পেস ভাগাভাগি করে থাকি; যখন গল্প ও তার ভাব বা ভাষা নিয়ে বলি তখন নতুন একটা ভাব বা গল্পের বিষয়বস্তুর সঙ্গে এখনকার অগ্রসর মানুষদের সম্পর্কের দিক থেকে থাকি। এখানে ‘অগ্রসর’ একটা কোটেশন চিহ্নের ভেতর আসতে পারে। যাই হোক সুধীর চক্রবর্তী ও রাইকমলের আর উল্লেখ না করে সেই প্রসঙ্গ টানার বিষয়টা বলি। রক মনুর লেখা আমি আগে পড়ছি, যেটা প্রচলিত কেতা অনুসারে প্রবন্ধ টাইপ বা রাজনৈতিক ভাষ্য। অনেক ক্ষেত্রেই আমি দাঁত দিয়ে বেশি কাটতে সক্ষম হই নাই। যেটা তার গল্পের ক্ষেত্রে সম্ভব হইছে। দুই লেখা ঠিক একই না, বাট আইডিয়ার দিক থেকে রক মনু যে পলিটিকসটা দেখেন এই বাংলায়; যেটা গল্পগুলোর মধ্যে অনেকটা আনা গেছে মনে হইতে পারে, যদি আমার মতো এমন কল্পনা আর কারো মাঝে হাজির হয়।
তাইলে এটা আমার জন্য খানিকটা ভাবার বিষয় যে, এ ভাষায় ভাষ্যকার হিসেবে যখন হাজির তখন মনোযোগ দিয়ে ধরা কঠিন। আবার গল্পের মধ্য দিয়ে সহজ হইতেছে। এখানে চিমটি বা খামচি মারারে স্মরণ করা যাইতে পারে। সেটা হলো, আমাদের চারপাশে যে দুনিয়া সেটা ঘা মেরে দেখানোর তরিকাটা রক মনু ভাষার মধ্যে আছে, যে ভাষায় আমরা আলাপ করতেছি। প্রবন্ধে মনোযোগ কঠিন হলেও গল্পের পাঠকের জন্য গল্পে ব্যাপারটা সহজ। যেখানে প্রচুর ঘটনা হয়তো তত্ত্ব আকারে ঘটতেছে না, আমরা তাকে কানেক্ট করতে পারছি। যেহেতু বিষয়গুলো রক্ত-মানুষের চরিত্র আকারে হাজির। যা গাছটা গাছ আকারে, মাছটা মাছ আকারে। এরপর আমরা একটা বিমূর্ত অবস্থায় পতিত হতে পারি, আবার নাও পারি। এখানে রক মনু নন-ফিকশন নিয়ে আসলে অভিযোগ না, তারে বরং আরো আরো ফিকশন লেখার জন্য উসকাইতেছি। আমি এও দেখছি, অন-ফিকশনে তার পাঠক ও ভক্ত অনেক।
এখানে যে ব্যাপারটা আরো দরকারি, এবং এটা হয়তো আরো অনেকবার নানাভাবে বলা হইছে। ফলত আমি নতুন কিছু আবিষ্কার ছাড়া (কোথায় বলা হইছে জানি না) বলতে পারি যে, রক মনু যে গল্পটা বলছেন, সেটা উনার যে ভাষায় বলছেন, তা ছাড়া আসলে বলা সম্ভব না। কিন্তু এই গল্প তো আসলে বলে ফেলে দরকার বা কেউ কেউ দায়িত্ব মনে করতে পারেন। বাংলার মানুষের মধ্যে এত বদল যে ঘটে গেছে সেটা তো বলতে হবে।
একটা ভাষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া সম্ভব হইছে বলে এটা গল্প আকারে হাজির হওয়া সম্ভব হইছে। আমাদের ‘প্রমিত ভাষা-ভঙ্গি’ ও এর ‘পবিত্রতার’ ভেতর মান ইতিহাস (যেটা প্রমিতের খালাত বা জ্যাঠাত ভাই)-রে এভাবে প্রশ্ন করাটা কেমন যেন অসম্ভব। কারণ এর সঙ্গে যে ক্ষমতা কাঠামো সে কখনো তার মুক্তিযুদ্ধ, তার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, কখনো আলোকায়নের কুসংস্কার, তার নারীরে দেখা বা সম্পর্কগুলোরে এভাবে প্রশ্ন করতে দেয় না। না, দেয় না এমন না বরং আমরা এমন প্র্যাকটিসের ভেতর দাঁড়ায়া আছি; যেখানে এগুলো বলতে কেমন যেন লাগে। এ ভাষার সঙ্গে যায়ও না যেন। এভাবে না বলতে না বলতে তা প্রকাশের যোগ্যতা বা আমাদের চিন্তারে ধারণ করার যোগ্যতা হারায়া ফেলছে।
এখানে এমনও ব্যাপার থাকে, আমরা যে ভাষা লিখি সে ভাষায় বলি বা বর্ণনা করি না। এই ফারাকটুকুর কারণে যে সেন্সর বা মানের ভেতর দিয়া যাইতে হয় যে বেড়া ভাঙছে ‘বাশনার ফিকির’। উদাহরণ হিসেবে; ওই ভাষায় ‘গু’ শব্দটা আপনারে ‘শ্লীল-অশ্লীণ’ বিতর্কে ফেলে দিতে পারে। অথবা ‘নেই’ আর ‘নাই’-এর ব্যবহার। অর্থাৎ, মুখের ভাষাটা বা তার ক্রম বদল দেখানো যাইবে না। এমনকি কখনো কখনো বাড়াবাড়ি মনে হইলেও গল্পরে এভাবে দিক-বেদিক আগাইতে দেয়ার সম্ভাবনাটা তো বোধহয় ওই ভাষার ভেতর এবং তাকে কেন্দ্র করে যে চিন্তা বা যে চিন্তারে কেন্দ্র করে ওই ভাষার বলা হয়ে থাকে, তাতে সম্ভব নয়।
তবু মনে হয়, কখনো কখনো মনু নিজের লেখারে শাসন করতে চাইছেন। যেমন; হিন্দু-মুসলমানের বিয়ার সমস্যাটারে যেভাবে সমাধান করছেন। ওই জায়গায় আমার শাবনূর-রিয়াজের ‘প্রেমের তাজমহল’ সিনেমার কথা মনে পড়ছে। কারণ, হিন্দু-মুসলমানের বিয়া প্রমিতের মধ্যে যেভাবে বাস্তবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেভাবে দেখানো হয়, কোনো না কোনোভাবে তাদের একই গ্রোত্রভুক্ত হইতে হয়। যেমন; বেদের মেয়ে জোসনাও আসলে রাজার মেয়ে। যাই হোক, এই সব ঘটনা তো ঘটে। অল্প বা বিস্তর। সেটা অন্যের বাশনা মোতাবেক নাও হইতে পারে! এবং গুরুতরভাবে রক মনুর নারীরা যেভাবে হাজির, সেটাও বোধহয় গল্প রান্নার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
পুরো বইয়ে পাঁচটা গল্প আছে। আমার অভিজ্ঞতা বলে; কখন যে পড়ে শেষ করে ফেলতেছি ততটা বুঝতে পারি নাই। এর মধ্যে সম্ভবত ‘ডিরোজিও’ গল্পটা সবাইরে মজা দেবে। ওইটা হয়তো ওই গল্পের দুর্বল পয়েন্ট হইতে পারে। তবে এতে একটা ব্যবস্থার ক্রিটিক থাকার সম্ভাবনা আছে। এই রকম প্রায় গল্পে। যেখানে আলাদা আলাদা টাইম লাইন অনুসরণ করা হইছে। বাস্তব ক্যারেক্টার আসছে কল্পিত ক্যারেক্টারগুলারে বাঁচায়া দিতে। সচরাচর বাস্তব ক্যারেক্টারগুলো কল্পিত ডিলেমা বা রহস্যের ওপর আছর করে ভক্তবৃন্দের কোলে বসে থাকে (আমের কোলে- উঠার সম্পর্কিত কোনো লেখা আছে রক মনুর), এখানে তা নাই। তারা আসছে তাদের মতো, একটা ভূমিকা রেখে চলে গেছে। তো, এই পবিত্র দুনিয়ারে উল্টায়া দেখার যে বিপ্লব, সেটা বিপ্লব বিপ্লব বইলা না যে সম্ভব; সেটা হলো ‘বাশনার ফিকির’। যে তার জন্য ইতিহাসরে নিজের ভাব-ভাষার মধ্যে উঠায়া আনতে চায়। তাতে দুনিয়ার বদলটা আরো আন্তরিক হইলো। আর ‘ফিকির’ বিষয়টা জুতসই হয়ে উঠে।