বিরহে উকিল মুন্সীর খবরদারি

উকিল মুন্সী ও ‘বিরহ’ প্রায় সমার্থক। তার সম্পর্কিত আলোচনায় কোনো না কোনোভাবে বিচ্ছেদী ভাব প্রধান হয়ে উঠে বা আমরা এড়াতে পারি না। আবার অনেক ক্ষেত্রে এই বিরহ উকিলকে ভিন্ন অর্থ ও সম্ভাবনার জায়গা থেকে দেখার সুযোগ ব্যর্থ করে দেয়। নির্বিশেষ কারণ হলো, এ সাধকের বেশির ভাগ গান বা জনপ্রিয় অর্থেই আমরা যা পাই তার সবই প্রায় এই আঙ্গিকের। (অন্যের বিরহেরও গান তার নামে চালু আছে)। আবার জন্ম-বেড়ে উঠার মাঝে যে ট্রাজেডি, তার সঙ্গে আলাদা করেও ভাবা মুশকিল। গানের পাশাপাশি উকিলের বেদনাবিদুর জীবন হয়ে উঠেছে লোকগাথার অংশ।

অলংকরণ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

গানের সঙ্গে বিরহ-বিচ্ছেদের সম্পর্ক গানের আবির্ভাবের মতোই পুরোনো। উকিল গানে গানে তার এই আর্তিকে মসজিদ বা মাহফিল-মোনাজাত পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন, এটা এখনো বাংলায় গুরুতর একটি ঘটনা।

‘কান্না’ বা ‘বিচ্ছেদ’ যে ধরনের অনুপস্থিতির ধারণা ভাগাভাগি করে, তা কী মানুষের নিয়তি বা চূড়ান্ত গন্তব্য হতে পারে? মূলত এ ধরনের একটা প্রশ্ন বরাবরই আমাকে চালিত করেছে। কান্নার নিদানে যেতে না পেরে কি উকিল ব্যর্থ? আষাঢ় মাসের ভাসা পানির আনন্দে কি তার অবগাহন হয় নাই?

বাংলা বা এই অঞ্চলের দর্শন চিন্তায় উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ‘দুঃখ’কে জয় করা। বিরহ-বিচ্ছেদে দুঃখ থাকলেও তা একই বিষয় নয়। সাধারণ জাগতিক দুঃখের সঙ্গে উকিলের বিরহের পার্থক্য রয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় চোখে দেখা কোনো কর্মকাণ্ডে তিনি লিপ্তও হন নাই। শুধু ভক্তি-প্রার্থনায় সমর্পন করেছেন। মানে ভিন্ন অর্থে সেখানে যা বলা যায়; দুঃখকে জয় করতে হবে, তা হয়তো সুরাহা করা যায়। কিন্তু দুঃখের চেয়ে আলাদা বিচ্ছেদের স্থানটি কি কখনো সুরাহা হয়। যাই হোক, আমি প্রায় নিশ্চিত যে, সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার এই লেখায় নেই। কিন্তু প্রশ্নটা জারি রাখাটাই উদ্দেশ্য।

বইয়ে প্রকাশিত কিছু লেখার হদিস: উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে

এক.

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান বলতেন, ‘সংগীত একটা বিশাল সমুদ্রের মতন, যার কোনো সীমা নেই। যখন কারো সংগীত শুনে লোকে হাততালি দেবে বা চেঁচাবে সেটা প্রকৃত সংগীত নয়, প্রকৃত সংগীত হবে সেটা যেটা শুনে লোকে সব ভুলে গিয়ে শুধু কাঁদবে।’ (আপনাদের সেবায়, সুরসম্রাট আলি আকবর খান-এর আত্মজীবনী, অনিন্দ্য বন্দোপাধ্যায় গ্রস্থিত, গীমা, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৯৬) গান মানুষকে কী ভুলিয়ে দেবে? এই ‘সব’ কি তার দেখা-শোনা-অনুমানের অর্জিত বিষয়াষয়, সংগীত তাকে তুচ্ছ করে তোলে? হ্যাঁ, সংগীতের সেই ক্ষমতা আছে, সকল স্থানিকতা ও তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে মানুষকে তুলে ধরতে।

উকিলের গানের সঙ্গে ওস্তাদ আলাউদ্দিনের আলোচনা হয়তো এক পাল্লায় মাপা যাবে না। তবে সংগীত নিয়ে আলোচনায় এমন নির্বিশেষ অবস্থার আরোপ করা সম্ভব। সংগীতের ভাষা; যাকে শুধু শব্দ কাঠামো দিয়ে ধরা যায় না। বরং তার সারবস্তু সব ভাব-ভাষার ঊর্ধ্বে গিয়ে সংযোগ তৈরি করে। আমরা অনুভব করি এবং সেই অনুভবকে আত্মার মাঝে ধারণ করি বলে মনে হয়। এ ভাবাটা আসলে। এভাবে চিন্তা করলে উকিল মুন্সীর যে বিচ্ছেদ তার সঙ্গে সম্পর্কটা তৈরি আসলে সম্ভব।

উকিলের যে বিচ্ছেদ তা অধরা এক সত্তার কথা বলে। যাকে ধরতে গেলেই হারিয়ে যায়। উকিলের গানের মধ্যে যখন আমরা যাই, তখন তা আসলে নির্দিষ্ট নয়, কে আসলে এই অধরা? যাকে সুনির্দিষ্ট স্থান-কাল, ধর্ম বা ইতিহাসের বিচারে ধরতে হয়। যেমন; ‘কোকিল রে কোন দেশে উড়িয়া যাও বলো, তুমিনি বলিতে পারো আমার বন্ধু কোথায় রইল’ বা ‘শ্যাম বিচ্ছেদে প্রাণ বাঁচে না, মইল গো রাই কাঞ্চাসোনা’। এখানে দুটি গানের আলাদা দ্যোতনা লক্ষ্য করা যায়। এ গান যখন ভাষার সীমানা ভেদ করে সকলের হয়ে উঠে তখন আলাদা অর্থ তৈরি হয়, যার সঙ্গে ‘মূলের’ সম্পর্ক থাকে না বাহ্যিকভাবে।

উকিল মুন্সীর প্রকাশ বাংলার প্রথাগত সংগীত অনুশীলনের ভেতর উঠে এসেছে। শ্যাম বা কোকিল বৈষ্ণবীয় ধারার ভাব-অনুষঙ্গ। কিন্তু উকিলের ক্ষেত্রে এই অর্থ ভিন্ন, তবে একদম আলাদা নয়। ভাটি অঞ্চলের অনেক মহাজনের গান এই ধরনের ভাবের সন্ধান আমরা পাবো। বরং আশেক-মাশুকের যে ভাবচর্চা তা প্রচলিত কথার ভেতর দিয়ে পীর-ভক্ত উকিল তুলে এনেছে। কিন্তু এ ভেদ যদি আমরা ভুলে যায়; উকিলের ভূগোল ভেদ করে শ্যাম বলতে বৈঞ্চবীয় ধারায় আসতে পারি না? আসতে পারি। আবার স্রেফ মানবীয় জায়গা থেকেও ধরতে পারি। এভাবে নানাভাবে ধরা গেলেও কনটেক্সের বাইরে সংজ্ঞায়িত করতে পারছি না, তার বিরহটা আসলে কীসের। আবার কোনো একটা অর্থ ধরলে, মানেও পাল্টে যাচ্ছে। তাকে না পাওয়ার, নাকি সে হাজির আছে জানি, কিন্তু ধরতে পারছি না, সংজ্ঞায়িত করতে পারছি না। এমনকি মানবীয় কোনো শর্তের মাঝে না থাকলেও মানবীয় রূপে তাকে ধরছি আমরা।

উকিল মুন্সীর বাড়িতে নির্মাণাধীন কাঠামো। অক্টোবর ২০২১। বর্তমানে নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে

দুই.

সুমনকুমার দাশ তার ‘বাউল-ফকির পদাবলি: উকিল মুনশি’ বইয়ের ভূমিকায় বলছেন, ‘বাউলশাস্ত্রের নিগূঢ়তত্ত্বধর্মী গানের চেয়ে উকিলের বিচ্ছেদ গানের পরিমাণই বেশি। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে বোঝায়— তার প্রায় নিরানব্বই ভাগ গানই বিচ্ছেদ পর্যায়ভুক্ত। এসব গানে প্রচ্ছন্নভাবে বাউল-দর্শন যে একেবারেই পরিস্ফুট হয়নি, তাও কিন্তু বলা যাবে না। তবে সেসব ছাপিয়ে তার গানের বিরহী-সত্তাই জ্বলজ্বল করে দাপিয়ে বেড়ায় পাঠক/শ্রোতাদের মনে।’

এখানে বাউল-দর্শন আর উকিল মুন্সীর বিরহী-সত্তার একটা ফাঁক লক্ষ্য যাচ্ছে। সেটা কেন? উকিল মুন্সী আখড়াবাসী না হওয়ার কারণে কি তার গানের ভূগোলে এই পার্থক্য, যাকে দর্শনটা ছাপিয়ে হচ্ছে। মানে প্রত্যাহিক জীবন-যাপনের কাছাকাছি ছিলেন বলেই। সে দিকে যেখানে যা খোঁজার নয়, তেমন শাস্ত্রবিরোধী জিজ্ঞাসা আছে?

আমাদের জীবন হলো অভিজ্ঞতার সমষ্টি। যেকোনো ভাবের নাড়ি পোঁতা থাকে সুখ-দুঃখময় এই পৃথিবীতে। যার সূত্র আমরা এভাবে পাই। সুমনকুমার বলছেন, ‘উকিল মুনশির বেড়ে ওঠা যেমন শোক-দুঃখের মধ্য দিয়ে তেমনি জীবনভর নানা ঘাত-প্রতিঘাত-প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে পথ চলতে হয়েছে। দশ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু, মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে, প্রেমের বিয়ের কারণে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি, ছোটো ভাই ও প্রিয়তমা স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যু থেকে শুরু করে তাঁর শেষ বয়সে ছেলে আবদুস সাত্তারের মৃত্যু—তাঁর পুরো জীবনটাই যেন বিষাদগাথা। সম্ভবত এসব কারণেই উকিলের পুরো সত্তায় বিরহ ভর করেছিল ব্যাপকভাবে। তাই তিনি বাউল-মতবাদে বিশ্বাসী হয়েও তত্ত্বগানের চেয়ে বিচ্ছেদ গান রচনাতেই বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন।’

অর্থাৎ, উকিলের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে ঠেলে দিয়েছে ‘বাউল-মতবাদ বিশ্বাসী হয়েও’ তার বাইরে যাওয়ার একটা পথে। যদিও এই মতবাদজনিত কোনো তথ্য আমরা পাই না। বরং ভাটি অঞ্চলের ভাবুকদের বাউল হিসেবে দেখানোর একটা জোরাজুরি আমরা টের পাই। ধর্মীয় ঐতিহ্য ব্রাত্য করে রাখায় হয় আলোচনায়। অথচ সুফি তরিকার সঙ্গে উকিল মুন্সীর সুস্পষ্ট যোগ আছে। এমনকি ইমামতির সঙ্গে তার সঙ্গে বাউলিয়ানার সম্পর্ক তো নাই। তারপরও সংস্কার বশে তার বিরহকে স্পষ্ট করার সাহস নিতে পারি না। মারেফতের যোগটি আমরা স্পষ্টভাবে এড়িয়ে চলতে চাই।

ময়মনসিংহ অঞ্চলের বৃহত্তর ভাব ঐতিহ্যের সঙ্গে মাহবুব কবির তার ‘উকিল মুন্সির গান’ বইয়ে মেলাচ্ছেন এভাবে, ‘উকিল মুন্সি মৈমনসিংহ গীতিকার পালাকার কবি দ্বিজ কানাই, মনসুর বয়াতি, কঙ্ক, দমোদর, রঘুসুতের উত্তরসূরি। সেইসব পালাগানের কাহিনির উৎসভূমি এবং ধনু নদীর সন্তান উকিল মুন্সি। সেই মানবীয় প্রেম, বিরহ ও প্রকৃতি এই মরমি সাধকের গানে নতুন ব্যঞ্জনায় মাত্রা পেয়েছে যেন। উকিলের গানে বিশেষ করে বিরহী ভাব আলাদা একটি ইমেজ সৃষ্টি করেছে। এই ভাব ও প্রেম অধ্যাত্মসাধনকে ঘিরে।’ অর্থাৎ, জীবনের সাদামাটা ইমেজেরগুলোর বাইরে আত্মার জগতে বিরাজ করছে এই বিরহের ভার।

বছর কয়েক আগে এক আলাপে পালাকার আবুল সরকার বলছিলেন, ‘বাউলের ভাব তো অঞ্চল ভেদে আলাদা। করিমের বাউল গান আছে কিন্তু চোখের পানি আনার মতো গান নাই। মানিকগঞ্জের সুরে কথায় চোখের পানি আসে। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনার সুর উড়ে উড়ে যায় আর মানিকগঞ্জে ঢাবা ঢাবা। অন্তরের গভীর থেকে আসে। কুষ্টিয়ার সুর এরকম কান্নার মধ্যে না, বুঝের মধ্যে আছে। বাঞ্চারামপুর, হোমনা, দাউদকান্দি এসব এলাকার মধ্যে কান্না আছে। সিলেট চিটাগাং নোয়াখালিতে তো নাই-ই। বরিশাল খুলনায় কিছু পাবেন। আবার বিজয় সরকার আর উকিল মুন্সীর ভাব একই না।’

এই একই না হওয়া কি এমন কিছু যা কুষ্টিয়া ঘটে কিন্তু ময়মনসিংহে ঘটে না। আবার বরিশালে যা ঘটে তার চেয়ে নোয়াখালীতে আলাদা কিছু ঘটে। কিন্তু সব মানুষই তো আলাদা আলাদা স্থানিক পরিসরে অন্যের ভাবে মিথস্ক্রিয়া করে।

অর্থাৎ, এই বিরহী যে ইমেজের মাধ্যমে আমাদের সামনে প্রকাশ ঘটে, তা একক কোনো ঘটনা থেকে উৎসারিত না। কিন্তু এর কোনোটাই চূড়ান্ত অর্থে বিরহের নিদান ঘটায় না। এটা কি উকিলের ব্যর্থতা। না। কেন না, সেই প্রসঙ্গে সামনে আসছি।

উকিল মুন্সীর বাড়ির কাছে কংস নদী। মোহনগঞ্জ

তিন.

আবুল সরকার বলছিলেন, ‘ভাবের গান গাইলে কান্না চলে আসে। এটাই তো এই দেশের ভাব। গ্রাম আর শহরের পার্থক্য হলো গ্রামের মানুষ সহজ-সরল। শহরের মানুষ আধুনিক। সে এমএ পড়বে ইঞ্জিনিয়ার হবে। তার চিন্তা এই দিকে থাকে। গ্রামের মানুষ ক্ষেত-খামারে কাজ করে। তারা ভাবে আমি মরে যাবো। আল্লাহ তুমি আমাকে রক্ষা করো, দয়াল আমাকে রক্ষা করো। গ্রামের মানুষের মধ্যে যে প্রেমভাব আছে তা শহরে নাই। শহরে হাততালি পেতে পারি কিন্তু প্রাণটা নাই। গ্রামে কান্নার ভাব প্রবল। প্রাণটা বেশি পাওয়া যায়।’

ভাবের এই স্বতস্ফূর্ততা অঞ্চল ভেদে আলাদা হবে কেন? প্রধানত কোথায় কোন প্রশ্ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার ওপর নির্ভর করতে পারে। আবার ভৌগলিকভাবে বিচ্ছেদ স্রেফ বস্তুগত অর্থ নয়, মানুষে মানুষে দুরত্ব আমরা যেভাবে অনুভব করি। এখন ‘আল্লাহ’ স্রেফ ‘আমাকে রক্ষা করো’র ভেতর মুশকিলের আসান খোঁজে না। আল্লাহকে আমরা কীভাবে ভাবি, কোন নামে ডাকি তার উপরও নির্ভর করে। আল্লাহকে তো আমরা নিরানব্বই নামে পাই। তার সবটা কি আমার আয়াশসাধ্য অনুভূতিতে ধরতে পারি। উকিল এ ক্ষেত্রে শুধু অঞ্চলগত ভাব নন, তার পীরের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, কারণ উকিল গানে গানে যে অর্থ তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তা ‘স্রেফ গান’ বা ‘স্রেফ বিচ্ছেদ’ নয় এবং এই বিরহ একপ্রকার অনুশীলন। এখানে খোদা প্রেমময়। এই প্রেম দিয়েই জগৎ সংসারকে ধরতে হবে। এর একটা সিলসিলা আছে, সেই পথ ধরে এগিয়েছে। সেখানে অন্যদের সঙ্গে আলাদা হয়ে গেছেন উকিল মুন্সী।

চার.

প্রকৃতির উপমায় ভরপুর উকিলের বিরহী আর্তি। হোক নদীর জল বা ডালে ডালে উড়ে বেড়ানো পাখি। সবাই-ই তো তার বিরহকে নিরাবণ করে। তার পূর্ণতা পায়, যার জন্য বিরহ তাকে পায়। কিন্তু উকিলের কি পূর্ণতা মেলে? সেখানে এই প্রশ্নও তোলা যায়, পূর্ণতাকে কি অপূর্ণ ভাষা ব্যবস্থার ভেতর প্রকাশ করা সম্ভব! ধারণা থাকলেও চোখে দেখায় কোনো পূর্ণতার সন্ধান কি আমরা পাই? ইসলামের বাতেনি দিক খেয়াল করলে, আল্লাহর সঙ্গে বান্দার বিচ্ছেদ যত সহজে প্রকাশ সম্ভব, ততটা সত্তার পরিপূর্ণতা ধরা সম্ভব নয়। সেই স্থিতি অবস্থা প্রকাশযোগ্য নয় বলেই আমরা অনুমান করতে পারি বাহ্যিক অর্থে।

যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে মনসুর হাল্লাজ ‘আনাল হক্ব’ উচ্চারণ করেন, তা কী এক প্রকার বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত হয় না? আমরা যখন ‘আনাল হক্ক’ বাক্যটি উচ্চারণ করি, ধন্ধে পড়ে যাই না? সাধনার তুরীয় কোনো স্থানে না গিয়েও এই বাক্যটির ওজন অনেক ভারি হয়ে বুকের ওপর চেপে ধরে না! এ ধরনের বাক্য আসলে শেষ পর্যন্ত কখন বলা সম্ভব। মনসুর হাল্লাজের ঘটনাটি শুধু এই উচ্চারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর মৃত্যুর রাজনৈতিক কিছু তাৎপর্যও রয়েছে, সেটা প্রসঙ্গের মধ্যে না গিয়ে এ সব কথা বলা যায়। মানে এখানে উপমার জগত শেষ হয়ে আসে। উকিল কি উপমার এই জগৎ অতিক্রম করতে পেরেছেন? যদি পারেনও, পরিস্থিতিগত কারণে তাকে প্রকাশ্যে না আনা অস্বাভাবিক নয়। ইসলামে সমাজ কাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মসজিদের ইমাম হিসেবে শরিয়তি যে ধারার মধ্যে তিনি বিরাজ করেছেন, তা হয়তো অতিক্রম করতে চাননি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার তুরীয় অবস্থা প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

উকিল মুন্সী ও পুত্র আবদুর সাত্তারের কবর। জৈনপুর, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা। ফেব্রুয়ারি ২০১২।

পাঁচ.

‘সেই দেশের লোক এই দেশে কত আসে যায়, কার কুঞ্জে ভুলিয়া রইলো আসতে নাহি চায়।’

শিল্প একাকী তৈরি হলেও তার প্রকাশ সামগ্রিকতার ভেতর। এবং সেই শিল্পই মানুষকে ততটা আকর্ষণ করে যতটা তাদের আকুতি-আর্তি বা প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসতে পারে। নিজেদের না বলা কথাকে পরিষ্কার করে হাজির করতে পারে। বিচ্ছিন্ন হাওর অঞ্চলের মানুষের ভাষ্যকে স্পষ্ট করে হাজির করেছেন। যেখানে শিল্পের সঙ্গে তার স্থান ও কালের সম্পর্ক। কিন্তু প্রশ্ন তো চিরন্তন, অস্তিত্বের বিপন্নতা তো চিরন্তন, এর থেকে তার নিদান নেই। এটা শুধু খাওয়া-পরার অভাব নয়।

উকিল মুন্সী সেই কান্নাকে দেখেছে তার চর্চার মধ্যে। তার গানে কান্না, তার মোনাজাতে কান্না। এটা একাকী কোনো কান্না নয়, এ যেন মানুষের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা হয়ে উকিলের কণ্ঠে ফুটে উঠেছে। তার সাধনা একাকী হতে পারে, কিন্তু সামাজিক পরিসরে তার অর্থ আলাদা। যেখানে নানা শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষ মুক্তি চাইছে। পবিত্র হতে চাইছে। এ কারণে মানুষ তার কান্নার শিল্পিত প্রকাশ বা যে ভাষা তারা দিতে পারেন না, তার জন্য সাধারণ মানুষ উকিলের মোনাজাত বা গানে আকুল হয়। অধরা, অব্যক্তকে আরো স্বচ্ছ করে হাজির করে সবার সামনে। মাহবুব কবির বলছিলেন, ‘অধরাকে ধরার জন্য, মিলনের জন্য, এতটুকু শান্তির জন্য করুণ আকুতি ও হাহাকার উকিলের গানের তুরীয় ভাব।’

দুঃখের আলাদা বিস্তৃতি রয়েছে। দুঃখ নিজেকে কোনো স্থানিক পরিসরে না রেখে আরো বৃহত্তর কোনো আর্তির সঙ্গে যোগ করতে চায়। সেটা মানুষের অস্তিত্বের যোগ। সেটা সম্ভবত মানুষের সবচেয়ে মৌলিক অন্বেষণ। যেমন; আমরা কোথা থেকে এলাম, কেন এলাম। কেন এলাম, এই প্রশ্নের উত্তর অনেকেই সারাজীবন অন্বেষণ করে যান। এই জীবনের অন্তরালে কী আছে, তার জবাব আমরা নানাভাবে পায়। নানা শাস্ত্রে নানা উত্তর আছে। অভিজ্ঞতার জগতে তার খামতি থেকে যায়।

ছয়.

‘বন্ধু তুই আমারে এত দুঃখ দিলে রে, বন্ধু রে, তোর রাজত্ব জগৎ জুড়ি। আমার নাই রে ঘরবাড়ি, দিবানিশি থাকি পরার ঘরে।’

উকিলের বিরহী ভাব কেন আধুনিক মানুষের মধ্যে অধরা থাকবে? এর একটা কারণ হতে পারে, দুঃখকে ‘বিলাস’ হিসেবে যাপনের একটা খায়েশ আছে আধুনিক মানুষের মাঝে। কিন্তু হাওর অঞ্চল বা দৈনন্দিন খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে দুঃখ কোনো বিলাসিতা নয়, বরং কঠিন বাস্তবতা। কায়িক শ্রম, ক্ষুধা, রোগ-শোকের মধ্য দিয়ে তারা একে অর্জন করে। কিন্তু এটাই যখন নিজের সাধারণ রূপ হয়ে দাঁড়ায়; দুঃখ তখন আরো বড় কিছুর সন্ধান করে। তাই এখানে দুঃখকে অতিক্রমের যে বাসনা, তাকে শেষ পর্যন্ত কায়িক জীবনের দিক থেকে দেখলে চলে না। কারণ যুগের পর যুগ সে জিনিসটা আপনি দেখে আসছেন, তাকে মেনে নেয়ার একটা অনিবার্যতা যেমন যোগ হয়, তাকে অতিক্রমের ক্ষেত্রে অর্থহীনতা তাকে আবার একই বাস্তবতায় নিয়ে যায়। ক্ষণিক সুখের স্মৃতি এক অর্থে দুঃখই। তাই স্থানিক দুঃখকে অতিক্রম করতে পারে বৃহত্তর কোনো দুঃখ, যা তাকে মিলিত করতে পারে এই অনুভবের নির্গুণ কোনো স্থরে। যেকোনো বিলোপ ঘটে সকল অস্থায়ীত্বের। যা আমাদের ধারণার স্থরে থাকে, কিন্তু ধরতে পারি না। তখন উকিলের বা আরো কারো ভাবুকতা আমাদের একাত্ম করে। যদিও তা আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতির পরিপূরক নয়। কিন্তু আমরা অন্বেষণকে উসকে তো দেয়।

এখানে ভাব-ভাষা দিয়ে যাকে ধরা যাচ্ছে না, সেই বিরহ ও তার স্বরূপ আজাবের মতো লাগে। মানুষ পুড়ে পুড়ে খাটিঁ হয়। সেখানে কাব্য অজানা ভাষাকে খুলে দেয়, বলতে না পারা কথা নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করে।

Comments

comments