মাসরুরের ‘আড়িয়াল খাঁ’ ঘুরে দেখার পর

প্রথম আলোতে ব্যবহৃত অলংকরণের সঙ্গে বইটার প্রচ্ছদ

কিছুদিন আগে মঈনুল আহসান সাবেরের ‘আমাদের খঞ্জনপুর’ পড়ে মুগ্ধ হইছিলাম। সঙ্গে এটাও ভাবছিলাম, এই সময়ে এসে এমন একটা উপন্যাস যদি কেউ লেখে, অসম্ভব ও সেকেলে ঠেকবে। স্থান-কালের সম্পর্করে ভূত-ভবিষ্যত দিয়ে যেভাবে ভাবি আমরা। তাই কেউ উল্টোটা দেখলেও; ‘আড়িয়াল খাঁ’, মাসরুর আরেফিনের উপন্যাসটা পড়ে দু-একবার এটা মনে হইছিল। রেফারেন্স হিসেবে নিকট অতীতই ভালো, মানে সাবেরের উপন্যাস। আশির দশকের শুরু হইতেছে এমন একটা সময়ের বর্ণনা কেমন হইতে পারে এ সময়ের উপন্যাস! ম্যাজিক ম্যাজিক উপন্যাস। ভাষার ভীষণ জাদু, দার্শনিকতার জাদু। আমরা যতদূর দেখি, বাকিটুকু তার থেকে কল্পনা করি হেতু, এ হেতু থেকে মনে হলো, হ্যাঁ হয়তো এমন কিছু খুঁজতেছিলাম। এভাবে কাকতাল হয় বা আমরা তুলনা-প্রতিতুলনা করে একটা স্বস্তিকর অবস্থায় থাকতে চাই। মোটের ওপর যে দুনিয়াটা হাজির তারে বুঝতে চাই, ব্যাখ্যা করতে চাই। উপন্যাসটা ভালো লাগতেছে হেতু; একদম শুরু থেকে। গল্প, ভাষা ও তার বাস্তব-পরাবাস্তব বর্ণনারীতি ধরে আগাইতেছিলাম, দ্রুত শেষ করার তাড়ার মধ্যে ছিলাম।

জাহেদ নামের এক বাচ্চা ছেলের চিন্তার জগৎ ও চারপাশ নিয়ে এ উপন্যাস। যেহেতু জাহেদ একটা বাচ্চা ছেলে, তাই তার ভাবনার মধ্যে কোনো বেড়া দেওয়া নাই। মানে, আমরা বড় হইতে হইতে কোনটা ভাবা যাইবে আর কোনটা যাইবে না এমন বেড়ার মধ্যে আটকে পড়ি, বা জগতের একটা কাঠামো তৈয়ার হয়ে যায়; তার বাইরে এ গল্প। ফলে, একটা বাচ্চা ছেলে যখন বলে সে একটা মাছরে উড়তে দেখছে, মানে সে কোনোভাবে দেখছে (উদাহরণটা আড়িয়াল খাঁ থেকে নয়)। আমি দেখলে কিন্তু তা বলব না, বরং ভ্রম হিসেবে লুকায়া ফেলবো, বা কেউ পাগল বলুক এটা চাইবো না। জাহেদের বা যেকোনো বাচ্চার ভাবনা তো সেটা না। এ ব্যাপারটা উপন্যাসটার মধ্যে আসছে। যে পড়তেছে সে তার অতীতের পৃষ্টাও উল্টাইতে থাকে। সঙ্গে এটাও মাথায় রাখতে হবে, এটা বাচ্চাদের উপন্যাস না। সুকুমার রায়ের সুকুমার কোনো কেচ্ছা নয়। একইসঙ্গে দুনিয়াটা যখন আমাদের সামনে একটা শেপের মধ্যে হাজির হয়, কত বৈপরীত্য, অদ্ভুত সব বিষয়ের মধ্যে মিলমিশ করতে চায়, সেটার একটা বর্ণনা এখানে পাইলাম। যা একটা সুন্দর-নিষ্ঠুর একটা উদার জগত দেখায় আমাদের। যদিও জাহেদ কবি বা লেখক হইবে এমন একটা ইশারার মধ্যে উপন্যাস সমাপ্ত। জাহেদ কেন লিডার হইবে না!

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড এ উপন্যাসের একটা প্রেক্ষাপট বটে! যেটা মূল উপন্যাসের গতিপথে খানিকটা অন্তত শেষ ক্লাইমেক্সে ভালো ভূমিকা রাখলেও মোটামুটি এটা ভালো একটা বিজ্ঞাপন শেষ পর্যন্ত। যদিও উপন্যাসটা হাতে নেওয়ার সময় বিষয়টা ততটা মাথায় ছিল না। এই দিক থেকে পলিটিক্যাল জায়গায় মাসরুরের একটা অ্যাম্বিশন নিশ্চয় আছে। যেটা একটা রাজনৈতিকভাবে নিস্তরঙ্গ একটা শহরে অনুমানের কিছু ঢিল মারে। মূল সংকট বলে যদি কিছু থাকে ওই জগতে সেটারে এড়ায়া যায়। যেহেতু উপন্যাসের প্রচ্ছদে একজন জোকার আছে, এবং দুনিয়ার সবকিছুরে মেনে নেওয়া যাচ্ছে, সে হিসেবে এতো সিরিয়াস হওয়ার কিছু নাই। জোকার; মূলত সার্কাসের জোকার আপনারে যে সত্য দেখাবে, এটা একটা হাস্যকর একটা দুনিয়ায় দেখাবে। তো সে দুনিয়ার যতটা সত্য, তার চেয়ে বেশি মিথ্যা ভাবলেও সমস্যা হয় না। আবার বাস্তবে যদি কেউ জোকারে পরিণত হয়, সে মূলত মানুষ হিসেবে দেউলিয়া ঘোষণা করে। এভাবে ভাবার অর্থ না থাকতে পারে। বাট, এভাবে ভাবা হয়ে যাচ্ছে এ উপন্যাসটা পড়ার পর। এবং আশির দশক হইলেও উপন্যাসটা লেখা হইছে চার দশক পর এসে, এ সময়ের অভিঘাত উল্টো দিক থেকে সেখানে লাগা অস্বাভাবিক নয়।

শেখ মুজিবের খুন হওয়া নিয়েও ‘আগস্ট আবছায়া’ নামের একটা উপন্যাস আছে মাসরুরের, পড়া হয় নাই। যাই হোক, এখানে জিয়া বলতে মোটাদাগে ‘হিন্দুর শত্রু’ হিসেবে আমরা পাইতেছি। মানে উপন্যাসটা হিন্দুর বয়ান থেকে এটা মুখস্ত করায়া ছাড়ে আরকি। মুসলমানরাও মোটাদাগে এভাবে দেখছে। এটার তাৎপর্য কী মাসরুর জানেন। এ দেখাটা মাসরুরের লেখার ম্যাজিক দিয়ে পুরোপুরি চাপা পড়ে না, অস্বস্তি জাগায়। না না, চাপা পড়তে হবে কেন? হয়তো হাল দুনিয়ার একরৈখিক ইতিহাস বা হিসাব থেকে ওঠা মানুষ বলে এটা আমার চোখে বেশি বেশি পড়ছে। কিন্তু শিল্পের যে স্বাধীনতা সেখানে জিয়াউর রহমানকে লাকুরিয়া খালে দেখতে আমাদের অস্বস্তি নাই!

‘আড়িয়াল খাঁ’র পর আমি কী করবো? মাসরুরের দুই উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ ও ‘আলথুসার’ হাতের কাছে থাকলেও পড়া হয় নাই। এবার বোধহয় আমি পড়বো!

Comments

comments