পূর্ণাঙ্গ অনুবাদে ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’, এ ভীষণ চমক

জুলভার্নের বই প্রথম পড়ছিলাম ক্লাস এইটে থাকতে। নাকি নাইনে?

নতুন বছরে নিজেরে উপহার দিছিলাম!

তখন যা হইতো যেখানে যাইতাম, গল্পের বই আছে কিনা খুঁজতাম। এক কাকার বাসায়, মূলত সিনেমার ম্যাগাজিন, পত্রিকা এই সব থাকতো। একদিন অনেক কাগজপত্রের মধ্যে সেলাই খোলা একটা বই পেলাম। প্রচ্ছদ, সম্ভবত দুই-তিনটা পৃষ্ঠা ছিল না। তবে প্রতি পেজের নিচে নাম দেখে বুঝলাম ‘রহস্যের দ্বীপ’ (ইংরেজি টাইটেল ‘মিস্ট্রিরিয়াস আইল্যান্ড’)।

আমেরিকার সিভিল ওয়ারের সময় বেলুনে করে পালিয়ে যাওয়া কিছু লোকের কাহিনি। যারা নির্জন এক দ্বীপে হাজির হয়। যেখানে চাহিদা মাত্র অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এক সময় বুঝতে পারে তাদের গোপনে কেউ লক্ষ্য করছে। সে লোকটা হলো ক্যাপ্টেন নিমো। এক ইন্ডিয়ান বিদ্রোহী রাজপুত্র।

যাই হোক, ক্যাপ্টেন নিমো আর তার আজব ডুবোজাহাজ নটিলাস আবেশিত করে রাখে অনেক অনেক দিন। কতবার যে পড়েছিলাম! মনে আছে, ওই কাকার বাসায় আরেকদিন বই খুঁজতে গিয়া দেখি ‘বড়দের একটা ম্যাগাজিন’। দু-একটা উল্টে ছবি দেখে এমন শকড হইছি, সে ভীষণ দৌড়!

… লাইনে আসি, পরে ‘মিস্ট্রিরিয়াস আইল্যান্ড’ নিয়ে একটা সিরিজ দেখায় বিটিভিতে। তবে টেলিভিশনের জন্য কাহিনির বেশ বদল ঘটে। বিস্তারিত আর মনে নাই। বই পড়ে নিমোর জন্য খুবই খারাপ লাগছিল। আর আমরা মানে আমাদের মতো অনেকেই মনে মনে এমনই হতে চাইতো!

পরে কলেজে পড়ার সময় ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ পড়ছিলাম। দারুণ মজা পাইছিলাম। তবে ‘রহস্যের দ্বীপের’ মতো না। দেখেছিলাম সাহিত্যের অদ্ভুত অদ্ভুত ক্যারেক্টার নিয়ে ছবি ‘দ্য লিগ অব এক্সট্রাঅর্ডিনারি জেন্টেলম্যান’। যেখানে নিমোর সঙ্গে ছিল অ্যালান কোয়াটারম্যান, ড. জেকিল বা ইনভিজিবল ম্যানের মতো চরিত্রগুলো। নিমো হইছিল নাসিরুদ্দীন শাহ, আর অ্যালান কোয়াটারম্যান ছিল শন কনারি। ছবিটি ভালো লাগে নাই।

গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে তারিক মাহমুদ ভাইয়ের একটা রিভিউ পড়ছিলাম। ‘টুয়েন্টি থাইজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’র। পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। খালেদ নকীব করছেন। উনার সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নাই। প্রায় অর্ধেক দাম ছাড় থাকার কারণে একটু সন্দেহ হইতেছিল, অনুবাদ কেমন! তারপরও, ব্যাপারটা চেখে দেখতে চাইলাম। তাই পেপার ভয়েজারের পেজে অর্ডার করে দিলাম।

দুইদিনের মাথায় চলে আসলো, বছরের প্রথম দিন। ডাউস বই, ডিটেইলস বর্ণনা। তা সত্ত্বেও এই কয়দিনে (মূলত গাড়িতে) প্রায় ১০০ পৃষ্টা মানে ছয় ভাগের একভাগ পড়লাম। গতি হিসেবে খারাপ না। ভালো ব্যাপার হলো, আগ্রহ মরে নাই। এত ধীরস্থিরভাবে জুলভার্ন লিখছিলেন। আর আমরা এর তিনভাগের এক ভাগে দৈর্ঘ্যের অনুবাদ পড়ছি চিরকাল। হায়! যাই হোক, এ বইটা আমার পছন্দ হইছে।

জানুয়ারি ৩, ২০২২

‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ শেষ করছি জানুয়ারির মাঝামাঝিতে। ৬৪৬ পৃষ্টার বইয়ের বেশির ভাগ অংশ সাগরের নানা প্রজাতির প্রাণীর পরিচিতি, আর অবশ্যই পানির তলের জগত। কোনোটাই অবাস্তব মনে হবে না। (আগে পড়া সেবা প্রকাশনীর বইয়ে) এ সব অংশ বাদ দেওয়ার কারণে সম্ভবত আগে পড়া সংক্ষিপ্ত অনুবাদে মনে হয়নি কিছু বাদ পড়েছে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো জলজ প্রাণী ও পরিবেশের বর্ণনা একটুও বিরক্ত লাগে নাই। সম্ভবত শেষ দিকে একটা পৃষ্টা বাদ দিছি মাত্র। এ ঘটনা নিশ্চয় কল্প-বিজ্ঞান হিসেবে একটা বিশেষত্ব, কোনো ভবিষ্যৎ আমরা কল্পনা করি, তার পূর্ণাঙ্গ ধারণা সবই দরকার। (এখন যদিও বাসি)। ওই ভবিষ্যত যা (মূলত অচেনা, ওই জগতটা এখনো) পাঠককে আটকে রাখছে। আর অবশ্য ধন্যবাদ অনুবাদককে, তিনিও বিরক্ত হয়ে হাল ছাড়েন নাই। সব মিলিয়ে অনুবাদটি আমাদের মুগ্ধ করেছে।

আসলে বইটার মূল্যায়নের জন্য তেমন কিছু আলাদাভাবে বলার নাই। বইটা যদি কেউ বলে, পছন্দ হইছে; তাইলেই সই। জাস্ট একটু ধৈর্য ও বড় বই পড়ার জন্য সাহস দরকার।

এবার একটু নিন্দা করি, তা হলো দেড়শ’ বছর আগে সাগর তলের প্রাণী ও পরিবেশ বর্ণনা করতে নিশ্চয় তখনকার বইপত্র, গবেষণা ও (নিজ) কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন, যেহেতু মূল ‘নটিলাস’ই জুলভার্নের কল্পনা। এখন জুলভার্নের বর্ণনা পড়ে মনে হতে পারে, উনি যা যা বলেছেন তার সবই প্রামাণ্য। তা বিশেষত বর্ণনার গুণে। তাইলে সত্য আর কল্পনার পার্থক্য কতটা? সেটা হয়তো জুলভার্নের সময় দরকার মনে নাই, যেমন; এখনকার কল্প-বিজ্ঞান পড়লে আমাদের জানার দরকার পড়ে না। তারপরও দেখা যায় ‘ইন্টারস্টেলার’ জাতীয় সিনেমার ব্যাখ্যার জন্য সত্যিকারের থিওরি নির্ভর নানান লেখাজোখা পাওয়া যায়। ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’র ক্ষেত্রেও তা দরকার।  

খালেদ নকীব বলেছিলেন, অনুবাদের জন্য ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টন ও অক্সফোর্ড ক্লাসিকের দুটি সংস্করণ অনুসরণ করেছেন। এর মধ্যে অক্সফোর্ড সংস্করণে থাকা কয়েকশো পৃষ্ঠার ফুটনোট ‘সাধারণ পাঠকের’ বিরক্তির কারণ হতে পারে মনে করে বাদ দিয়েছেন। সেই বাদ দেওয়া কতটা বিবেচনাসম্মত প্রশ্ন থেকে যায়! তা না হয়, বাদ দেওয়া গেল; একটা ভূমিকা আমরা আশা করতে পারি, যেখানে বিজ্ঞান ও কল্প-বিজ্ঞান হিসেবে ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। আশা করছি, পরবর্তী সংস্করণে এর একটা সুরাহা তিনি করবেন।

সাগরের জগতের পাশাপাশি এই বই একটা পলিটিক্যাল ভিউ’র ওপর দাঁড়ানো। পিয়েরে অ্যারোন্যাক্সের বর্ণনা ক্যাপ্টেন নিমোকে একজন সাম্রাজ্যবিরোধী মানুষ আকারে পাই, আবার শত্রুর প্রতি নৃশংসতায় তিনি নিমোকে ঘৃণাও করেন। সব মিলিয়ে এই বইয়ের একটা রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। সেটাও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে।

… আশা করি, বইটি আরও অনেক পাঠকের মন কাড়বে। এবং বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা সবগুলো বই প্রকাশ করবে পেপার ভয়েজার।

ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২২

Comments

comments