মন খারাপ শুনে এক সাধু কফি খাওয়াতে চাইলেন। সঙ্গে জিগাসা করলেন, কেন মন খারাপ? বিষয়টার আসলে তেমন কোনো সার নাই। সেই অর্থে বললাম, ঠিকঠাক জানি না। কিছু ভাল্লাগছে না! উনি বললেন, এই রকম সবারই হয়! বললাম, আপনি কই যাবেন? বেঙ্গলে। সুলতানের ছবি নিয়া একটা এক্সজিবিশন হচ্ছে। না না বইলাও উনার লগে চলে গেলাম। ভালোই হলো!
এসএম সুলতানের আঁকা ছবি খোয়া যাওয়ার ঘটনা, অন্তত তার জীবদ্দশায় অনেকবার ঘটছে। ঢাকায় তো প্রচুর! সে তুলনায় এ প্রদর্শনীতে কম ছবিই ছিল। ডজন দু-একের কম হয়তো! যাই হোক, আমরা কাশ্মীরের একখান ছবি দেখলাম। এটা নিশ্চয় পড়ে স্মৃতি থেকে আঁকা। আমরা যারা অল্প-স্বল্প উনার ছবি দেখছি, নিশ্চয় এ ধরনের ল্যান্ডস্কেপের কথা মনে রাখি নাই। মানে উনার সিগনেচার কাজ না মনে করি। এ ছবি উনার দীর্ঘ যাযাবর জীবনকে মনে করায়া দেয় বটে!
সাধু বন্ধু ছবি দেখতে দেখতে মাংসল ফিগারগুলা নিয়া বিদ্বগ্ধ সমাজে কী কী বয়ান চালু আছে সেগুলা বলতেছিলেন। অবশ্য, সুলতানের নিজের বয়ানেও এর হদিস মেলে। আমি ভাবতেছিলাম, শহুরে জীবন আঁকলে কী রোগা-পটকা (অন্তর্গতভাবে) বা খোদার খাসি টাইপ মানুষরে তিনি কেমনে দেখতেন। হয়তো এখানেও মসিহার রূপে উনারে পাইতাম। এই সব বিচ্ছিরি জায়গা থেকে যেখানে উদ্ধার পাইতে চাই বলে আবার থাকতেও চাই, সেখান থেকে আমাদের উদ্ধার করতেন। বাইরে জিনিস দিয়া তো উনার ততটা কাজ নাই, বিমূর্ত হয়েও ততটা না। যতটা আমার ভেতরে ভেতরে কী বা কী বইতে পারি। মানব সত্তার একটা আদর্শ ও সত্যিকার রূপ। সবল শরীরের আত্নার দুনিয়া। দেহ ও মনের দোটানায় না গিয়ে একরূপে তার যত্মআত্তি!
সাধু বন্ধু বলতেছিলেন, সুলতানের ফিগারগুলো দেখেন। কাপড়চোপড় ছাড়া। এ যে নারী। এটা কিছু কোনো ধরনের উত্তেজনা তৈয়ার করার ব্যাপার না। এটা প্রাকৃতিক একটা ঘটনা (স্মরণ থেকে আমার মূল্যায়ন)। হ্যাঁ, হাশরের ময়দানে সবাই কাপড় ছাড়া উঠলেও কারো তো কারো দিকে তাকানোর ফুসরত থাকবে না।
অবশ্য সাধু কী ভাবছেন এ সব ছবি নিয়ে, সেটা নিজের মাঝেই রেখে দিছেন (নারীর ব্যাপারটা ছাড়া)। সম্ভবত আপাতত আমাদের দেখায়া দিতে চান, দুনিয়াটা কোন হালে আছে, দুনিয়া কী ভাবে। বাকি কথা পরে হবে?
ছবিগুলো দেখতে দেখতে মনে হইলো, শিকার যুগ বা কৃষি যুগ, এই বল্লম নিয়ে মানুষ আগাচ্ছে বা চাষবাস করছে। তাদের অবয়বের কোনো চেঞ্জ নাই। ওই যে গাছে গাছে মানুষ ঝুলছে। এই রকম কিছু। মানে মানুষের একটা হদিস আছে। অপুষ্টি বা কুশিক্ষা যা-ই ঘটুক তারে আমরা তালাশ করছি। যেমন; ভারতবর্ষ বা ইউরোপে উনি ঘুরছেন। মেবি ইংল্যান্ডে এক বাচ্চা উনাকে যিশু ভাইবা ভুল করছে। এখানে ভুল না ঠিক! যিশু ইতিহাসের বাইরে একটা কল্পনা বা আদিকল্পনা, যা যুগে যুগে নির্মিত। সুলতান সেখান থেকে হাজির। অসংখ্য পূর্বশর্ত মিলা তৈরি জগতে নিজেদের সাফ করে একটা সার পদার্থে হাজির হওয়া। যাই হোক, এগুলা বিশেষায়িত কথা না। গরগর করে মনে হাজির হওয়া।
বেঙ্গলের সেই প্রদর্শনীতে ছবি ছাড়াও অডিও-ভিজ্যুয়াল উপাদান ছিল। কানে হেডফোন দিয়ে সুলতানের কথা শোনা যাচ্ছিল বা দেখা যাইছিল তারেক মাসুদের ‘সুলতান’। এটা বেশ সুন্দর একটা ছবি। সব সবল-সুন্দর এক মানুষ। যিনি জগতে কী ঘটছে বা ঘটমানকে এড়ায়া বিমূর্ত হওয়ার বদলে আমরা কী ও কী চাই নিয়ে কাজ করছেন। যেহেতু আমি শিল্পের লোক না, যেহেতু সেগুলো সেভাবে ব্যক্ত হবে না বলা বাহুল্য।
আরও পড়ুন: ‘সুলতান’ হয়ে উঠা
সুলতানের ইন্টারভিউ পড়ছিলাম একটা। যেখানে মোহাম্মদ ইকবালের দর্শন ও কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা বা বিবিধ বিষয় নিয়ে উনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। কেন জানি, মনে হইছিল এটা সাক্ষাৎকারগ্রাহিতাকে অনেকটা বিরক্ত করছিল বলে একপ্রকার প্রসঙ্গান্তরে যায় প্রশ্ন। সত্তাগত প্রশ্নে ইকবালের যে দর্শন সেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটা মূল্যায়ন আছে। মুসলমান দার্শনিকদের মধ্যে এ জিনিস নিয়ে অনেক কাজ হইছে মেবি। আবার নজরুলের বিদ্রোহী ব্যাপারটা নিয়েই তো আমরা বেশি কথা বলি। অবশ্য ভালো হইতো সুলতান থেকে কোট করা গেলে। আপাতত এটা সম্ভব না।
প্রদর্শনীতে ছিল নাসির আল মামুনের তোলা গোটা কয়েক ছবি। দুইটা ছবিতে আমার তাকানো ছিল অন্যমনস্ক। প্রথমে কোনো মানুষ দেখতে পাইতেছিলাম না। পরে দেখি, ওমা! ওই তো সুলতান। লগে লগে ছবির অর্থ পাল্টায়া গেল। দেখা গেল, ছবির জগতটা এখন সুলতানকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
… এরপর আমরা কফি খাইলাম বেঙ্গলের দোতলায়। সিঙ্গারা খাইতেও চাইতেছি। বাট, নিচ তলার খাবার একটু দামি কফি শপে নেওয়া যায় না। অগত্যা, তুলনামূলক কম দামের সিঙ্গারা ও চপের লোভে আমরা কফি নিয়ে নিচে নেমে আসলাম। সচরাচর আমাদের নেমেই আসতে হয়, যেখানে আমরা থাকি! সুলতান যেখানটায় নামাইতে বা মনে করাইতে চাইছেন, সেখানে আমরা নামি না বা ব্যাপারটা ভুলে গেছি। হয়তো নামলে ভালোই হইতো। বাট, মাঝে মাঝে দেখি আর ভাবি … আহা!