বাঙলার মুসলমানের স্বরাজ বাসনা

এমন কথা প্রচলিত আছে, পলাশি যুদ্ধে যখন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা হারছিলেন, তখন পাশের জমিতে কৃষকেরা নিরুদ্বেগ চাষাবাদে ব্যস্ত ছিলেন। এমনও বলা হয়, যখন ইংরেজ বাহিনী মুর্শিদাবাদে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করে, শহরবাসী একটা করে ঢিল ছুড়লেও তারা পালাতে বাধ্য হতো।

ড. মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল ১৯২৬ – ২৮ মার্চ ২০২১)

সাধারণত এই সব কথাকে যেভাবে মূল্যায়ন আকারে ধরা হয়- সে দিকে না-ই যাই। বরং এ কথা স্মরণ করা যেতে পারে সামাজিকভাবে রাজনৈতিক সচেতন হওয়া বা কর্তব্য নির্ধারণের ধারণাটা তুলনামূলকভাবে আরেকটু জটিল ও বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপস্থিতিও দাবি করে। বিশেষ শ্রেণি সচেতনতা দরকার পড়তে পারে বৈকি! বাঙলা ও এই অঞ্চলের সাধারণ মুসলমানদের রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়ে সচেতনতা তেমনই ব্যাপার।

বিষয়টিকে নির্বিশেষ নয়, বরং বিশেষ আকারে ধরে নিয়েছি ড. মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের ‘মুসলিম স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম ইন বেঙল’ বইটি পড়ার সময়। যার প্রথম প্রকাশ ১৯৬০ সালে। পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ হয় ১৯৮২ সালে। মূল বইটি ইংরেজিতে লিখিত। নাতি দৈর্ঘ্যের বইটির বাংলা সংস্করণ প্রকাশ হয়েছে ২০১৯ সালে, অনুবাদ করেছেন খালিদ ইবনে মুনীর ও মিনহাজ আমান।

১০১ পৃষ্ঠার বইটায় দশটা অধ্যায়। শিরোনাম যথাক্রমে- বাংলার মুসলিমদের আর্থসামাজিক অবস্থা (১৮৫৭-১৯১৩), ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন (১৮১৮-১৮৭০), ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ, শাসনতান্ত্রিক সংগ্রাম: মুসলিম আধুনিকতা এবং আনুগত্য, বাংলা ভাগ এবং মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা (১৯০৫-), খিলাফত আন্দোলন, পাকিস্তান চিন্তা, ঐক্যের বিষয়, পাকিস্তান এবং (সবশেষ অধ্যায়) পরবর্তী সাংবিধানিক পরিস্থিতি ও পাকিস্তানের অভ্যুদয়।

অল্প পরিসরে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের বর্ণনা ওঠে এসেছে। যদিও ‘বেঙ্গল’ বলা হচ্ছে, তা সত্ত্বেও এক বিশাল সাম্রাজ্যের স্মৃতিকাতর প্রজা হিসেবে এখানে কেউ আলাদা নন, সব অঞ্চল ও ধর্ম-মত নির্বিশেষে একটা শরীকানা আছে। সেখান থেকে বাংলার মুসলমানদের আলাদা করার এই কিতাবে মূলত রাজনীতি সচেতনতাহীন একটি জনগোষ্ঠীর রাজনীতিমুখর হয়ে ওঠা এবং শেষ পর্যন্ত পৃথক রাষ্ট্রের মুসাবিদায় পৌঁছার ইতিহাস যথাসম্ভব (অতি) সরল ও সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সরলীকরণ আছে কিনা- সেই প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু বইয়ের কলেবর ও উদ্দেশ্যের ভেতরই তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায়, নির্যাস আকারে এটুকুই হয়তো যথেষ্ট।

এই বইতে দেখা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আগে মুসলিম সমাজ মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল- উঁচু ও নিম্ন শ্রেণি। যাদের সম্পর্ক সার্বভৌম ও কর্তৃত্বের। কিন্তু ‘আধুনিক’ অর্থে রাজনীতির বিকাশের জন্য মধ্যবিত্তের উদ্ভব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। তত দিন অভিজাত শ্রেণিটি ইংরেজদের শাসন প্রণালি ও হিন্দু সমাজের অভিযোজনের অসাধারণত ক্ষমতার কারণে শৌর্যবীর্যহীন হয়ে পড়ে।

বলা হচ্ছে, “পলাশি যুদ্ধের পর, বাংলার সরকারি প্রশাসনে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একটি বিরাট পরিবর্তন চোখে পড়ে যা প্রথমে ধীরে ধীরে শুরু হলেও পরবর্তীতে দ্রুতই ত্বরান্বিত হয়। এর ফলে উচ্চবিত্ত শ্রেণির মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার নেতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়। আঠারো শতকের শেষার্ধ মূলত বাংলার উচ্চবিত্ত শ্রেণির মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিলুপ্ত হয়ে যাবার এক করুণ অধ্যায়।” (পৃ: ১৩)

স্বভাবতই নতুন শাসনকাঠামোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া বা বিরোধের প্রশ্নে আত্মবিশ্লেষণের দরকার পড়ে। সুলতানি আমল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে শাসন কাঠামোর সঙ্গে ভিন্নভাবে জড়িয়ে ছিল হিন্দুদের একটি অংশ। সহজ হিসেবে, ব্রিটিশরা তাদের কাছে শাসকের পরিবর্তনের বৈ কিছু নয়। পাশাপাশি মুসলিম উচ্চশ্রেণির বিলুপ্ত হওয়ায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের আরও বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ দেয়। সে সুবিধা এখনো বহমান!

রাতারাতি শাসক সংশ্লিষ্ট আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে ছিটকে পড়া এই গোষ্ঠী দেখল ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার এর কারণ। সে দিকে প্রথম দিকের আন্দোলনগুলো মূলত ধর্মীয় সংস্কারমূলক, পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে বিরোধ তৈরি হয় হিন্দু জমিদার ও ইংরেজদের সঙ্গে। এটা ঠিক যে, ইতিহাসের অন্যান্য অংশগুলোর মতো মুসলমানরা রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রশ্নে ইসলামকে ততটা আলাদা করতে পারেনি, যতটা এখনো ভাবা হয়। হাজী শরীতুল্লাহ ও দুদু মিয়া বা ফরায়েজি আন্দোলনকে আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে পাই। যাকে লেখক ভূমিকায় বলছেন, ‘জনসম্পৃক্ততা ও সঠিক কৌশলের অভাবে তা ফলদায়ক হতে পারেনি।’ ফরায়েজি আন্দোলন নিয়ে ড. মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের আলাদা একটি বইও রয়েছে। এই বইয়েও তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলনগুলোও এসেছে গুরুত্বের সঙ্গে। বিশেষ করে যখন প্রথমবারের মতো এই অঞ্চলের নিম্ন কোটির মানুষ রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়, পরে আমরা দেখি মূলধারার রাজনীতির উদ্ভব ঘটে নতুন মধ্যবিত্তের মধ্যে (যার মধ্যে পুরোনো অভিজাতদের ছায়াও দেখা যায়)। শুরুর দিকে আন্দোলনের মূল প্রবণতা হলো ‘বিদ্রোহ’ (সিপাহি বিদ্রোহসহ), আর মধ্যবিত্তের রাজনীতির প্রথম ধাপ হলো ‘আনুগত্য’। মূলত ইংরেজি শিক্ষিত হয়ে একটা দর-কষাকষির পর্যায়ে যাওয়া। পাশাপাশি ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মের মেলামেশাকে নতুনভাবে দেখা।

এই আনুগত্যের নানা পর্যায় আছে। এই গোষ্ঠীগত ব্যক্তিদের মধ্যে নানান ধরনের মত পার্থক্য দেখা যায়। যেমন; ধর্ম ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে সৈয়দ আমীর আলী ও আবদুল লতিফের মত পার্থক্য। গণতন্ত্রের প্রশ্নেও নানান নিরীক্ষামূলক দেখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিন্দু ও মুসলিম এক পাটাতনে হাজির হতে পারেনি। ড. খানের মতে, ‘বেনিয়া স্বার্থ’ ক্ষুণ্ন হওয়ার কারণে বঙ্গভঙ্গ রদে হিন্দুদের প্রতিক্রিয়ার কারণে মুসলিম মধ্যবিত্তরা উদারনৈতিক অবস্থান ছেড়ে পৃথক রাজনীতিক পাটাতনে হাজির হয়। তবে ঐক্যের প্রশ্নটি এরপরও বিলীন হয়নি। ওঠা-নামা, টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। যার ফলশ্রুতিতে পাই ভারত ও পাকিস্তান নামের দুই রাষ্ট্র। এখানে বলা হয়, “মুসলিম জাতীয়তাবাদ বা দ্বিজাতি তত্ত্বের চিন্তাটি সে অর্থে নতুন কোন আবিষ্কার না, এটি কেবলই পরিবর্তিত রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে সম্পর্কিত মুসলিম ক্বওমের গভীরতম আকাঙ্ক্ষার পুনঃআবিষ্কার।” (পৃ: ৯২)

মুসলিম স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম ইন বেঙল। মুঈন উদ-দীন আহমদ খান। অনুবাদ: খালিদ ইবনে মুনীর ও মিনহাজ আমান। প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৯। প্রকাশক: বাংলা পাবলিশার্স। প্রচ্ছদ: মোহাম্মদ জুয়েল মিয়া। মূল্য: ২২০ টাকা।

যদিও ‘পাকিস্তান’ শব্দটা ভেতর কখনো বাংলা অঞ্চল যুক্ত ছিল না। সেই পাকিস্তান গঠন পর্বে এসে বইটি শেষ হয়। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে বইটি পুনর্প্রকাশ হলেও এই বিষয়ে কোনো সংযুক্তি চোখে পড়ে না।

তবে মূল সময়কাল ধরলে কিছু জিনিসের গরহাজির চোখে পড়ে। মূলধারার মুসলিম রাজনীতিতে ‘পাকিস্তান’ অবশ্যম্ভাবী একটি ঘটনা আকারে হাজির হয়, যার সঙ্গে কলকাতার অভিজাতদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে হালে। যার মধ্যে জয়া চ্যাটার্জির গবেষণা বেশ আলোচিত। ততটুকুও নয়, বরং ‘মুসলিম স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম ইন বেঙল’-এ এমন কোনো পক্ষের উপস্থিতি নাই- যারা বাংলা বিভাগ চায়নি। এটা একটি অসম্পূর্ণতা বটে। বিশেষ করে বইটি যখন প্রকাশ হয় সেই ১৯৬০ সালেও বিষয়টি নানা কারণেই প্রাসঙ্গিক ছিল। এ ছাড়া কিছু কিছু বয়ান অস্বস্তি জাগাতে পারে- যদিও বইয়ের ফ্যাক্টস আকারেই এসেছে। ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতিশীল’তার মতো ধারণাগুলোকে পর্যালোচনা করা হয়নি।

বই থেকে খানিকটা পড়া যাক এভাবে, “১৮৫৭-৫৮ সালের বিদ্রোহের পর, (তখনো বিক্ষিপ্তভাবে মুসলিম জনসাধারণের মাঝে জিহাদি আন্দোলনের ভাবনা ঘুরে ফিরছিল) একটি আলোকিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলায় ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, যারা বিদেশি শাসকদের সাথে মুসলিম প্রজাদের সামঞ্জস্যবিধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি তারা এটাও অনুধাবন করে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মুসলিম সমাজকে নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দেয় প্রগতির পথ রচনা করতে জানতে হবে, যেই কাজটি হিন্দুরা অর্ধশতাব্দী আগেই করে ফেলেছে। এই নতুন অভিযাত্রার সাথে বাংলার মুসলিমদের মাঝে আধুনিকতা জন্ম নেয়।“ (পৃ: ৩৫)

এবার প্রকাশনার মান নিয়ে খানিকটা বলা যাক। অজস্র ভুল নিয়ে ছাপানোর (বানানের পাশাপাশি সাল বিভ্রাট আছে) এই বইয়ের ‘অনুবাদের উদ্দেশ’ ঊহ্যই থেকে গেল। যদিও অনুবাদের নামমাত্র ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ড. খানকে খুবই প্রাসঙ্গিক হিসেবে পাবেন পাঠকেরা’। কী অর্থে প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা করা হয়নি। এটা বড় ধরনের খামতি। বাংলাদেশে প্রচুর বই পুনর্প্রকাশ ও অনুবাদ হয় ফি বছরের। কিন্তু এর উদ্দেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্পষ্ট করা হয় না। সে দিক প্রসঙ্গ খুঁজতে গেলে ‘মুসলিম স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম ইন বেঙল’-এর পাঠককে বেশ খাটুনি করতে হয়। হ্যাঁ, হালে ইসলাম ও ধর্ম প্রশ্নে আমরা একদল তরুণের উপস্থিতি পাচ্ছি চিন্তা জগতে। তারপরও পাঠকের মনে নিশ্চিত হতে চায়- অনুবাদকেরা ‘প্রাসঙ্গিকতা’ অর্থে কী বোঝাতে চেয়েছেন।

Comments

comments