“আমরা কয়েকজন একসঙ্গে শুরু করলাম— আমি, কবির আনোয়ার, পরে আলমগীর কবির; আলমগীর কবির ‘জীবন থেকে নেয়া’র সেটে প্রথম এল, বাইরে থেকে, তার সঙ্গে ১৬ মিমি ক্যামেরা ছিল, এরপর আস্তে আস্তে সবাই কিন্তু চলে গেছে। কবির আনোয়ারের ছবি মানুষ দেখে নাই। ঝরতে ঝরতে আমি একলাই একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে একলা একটা প্রদীপ হয়ে কোনো রকমে জ্বলছিলাম’— ফাহমিদুল হক ও অমিতাভ রেজার সঙ্গে আলাপচারিতায় আমজাদ হোসেন।
‘একলা প্রদীপ’ আমজাদ হোসেনের সব সিনেমা আমার দেখা হয় নাই। যতটুকু দেখেছি, তার থেকে অল্প অল্প বর্ণনা দিয়ে সদ্য প্রয়াত নির্মাতাকে স্মরণ করছি। বৃহৎ কোনো পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নোকতা আকারে থাকল এ লেখা।
এক.
আমজাদ হোসেনের উদ্ধৃতিটির সঙ্গে বাংলা সিনেমার সমাজ ভাবনার দিকটি গুরুত্বপূর্ণভাবে জড়িত। তাদের সিনিয়র খান আতাউর রহমানসহ ঢাকাই সিনেমার পৃষ্ঠা উল্টাতে গেলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিকটির কথা চলেই আসবে। খান আতাউর রহমান, জহির রায়হান, আলমগীর কবির ও আমজাদ হোসেন ছাড়াও নিশ্চয় অনেকে ছিলেন। কিন্তু তাদের নির্মাণের ধারাবাহিকতা ও গল্পের মর্মশাঁসের ঘনিষ্ঠতা অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে।
আঙ্গিক আলাদা হলেও নির্দিষ্ট সময়ের নিরিখে কিছু প্রশ্ন সামনে রেখে এগিয়েছেন এ নির্মাতারা। সেই প্রশ্নগুলো মানুষের একদম মৌলিক চাহিদাগুলোর সুরাহা করতে না পারাজনিত জটিলতা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট। ইহজগতে মানুষের মুক্তির প্রশ্নটি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সে কথাও আকার-ইঙ্গিতে বলা।
বরাবরই নিজের সিনেমার গল্প-গান নিজেই লিখতেন আমজাদ হোসেন। কোনো কোনোটির প্রযোজকও তিনি। শুরুর দিকে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’র চিত্রনাট্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একটা সংসারকে মেটাফোর করে শোষণের ধারণাকে দারুণভাবে স্টাবলিশ করেছেন তারা। যদিও জেল-জুলুম-আমার সোনার বাংলা গানটি বা একুশে ফেব্রুয়ারি সবই বিদ্যমান। (শুরুর দিকের কখনো আসেনি বা সূর্যস্নানের মতো সিনেমা মাথায় রেখেও) কিন্তু স্বাধীনতার পরে খান আতা, আলমগীর কবির, আমজাদ হোসেন আরো খোলাখুলি বয়ানে গেলেন। হয়তো ধরে নিয়েছিলেন স্বাধীন দেশে সবকিছু স্পষ্ট করে বলা উচিত। সে আলোচনা আজ আমজাদ হোসেনকে ঘিরে।
বাংলা সিনেমায় গরিব মানুষের হাজিরা নতুন কিছু নয়, শুরু থেকেই প্রবল। কিন্তু বৈশিষ্ট্যগতভাবে বেশির ভাগ চিত্রায়িত গল্প বাস্তবকে ছাপিয়ে গেছে। আমজাদ হোসেনের সিনেমায়ও নানা ধরনের সামাজিক সংকট এসেছে। উল্লেখযোগ্য নির্মাণে আলাদা করে চোখে পড়ে ‘ক্ষুধা’। মানে বেঁচে থাকার একদম শুরুর প্রশ্ন। এমনকি ২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কাল সকালে’র মতো অনুল্লেখযোগ্য সিনেমায়ও একই ধরনের সংকট বিদ্যমান।
প্রথাগত অর্থে রোমান্টিক সিনেমা খুব একটা বানাননি আমজাদ হোসেন। যতটুকু নির্মাণ করেছেন, তার সর্বোচ্চ প্রকাশ ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’। তার ছবির ধারা অনুযায়ী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত করুণ রসে ভরা (এত কষ্ট দর্শক কীভাবে নিতেন)। সে সংকটকে মানসিক টানাপড়েনের দিক থেকে দেখা যায় বটে, কিন্তু মূল প্রশ্ন সেই ‘ক্ষুধা’। লড়াই করে স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশে মানুষের সত্যিকারের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তি না আসা নিয়ে ক্ষোভ।
এ ছবির টাইটেল গানের দিকে নজর দিলে দারুণ কিছু লাইন কানে লাগে। ফুল-পাখি মার্কা সংস্কৃতি না থাকা জনগোষ্ঠীকে আমরা অসংস্কৃত বলতে কসুর করি না। এ ফুল-পাখির ধ্যান কোথা থেকে যে আসে? অথচ ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র নায়ক গাইছে, ‘আমার এ ব্যথা ভরা গান ফুল পাখি নিয়ে নয়।’ এখানেই সে আহাজারি না-ই হয়ে যায় না। গ্রামকেন্দ্রিক সিনেমায় বাউলিয়ানাকে হাজির করে ‘ফুল-পাখি’র বয়ানকে আঘাত করেছেন। এর আরো গল্প আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বুলবুল যদিও বলেন তার আকুতি ‘ফুল-পাখি’ নিয়ে নয়, শৈল্পিক প্রয়াসের মধ্যে আমরা কি সেই সংকটকে বয়ানের আগে উপস্থাপন করতে পারি? এটা কি মূল সমস্যাকে আড়াল করে না? সেই দ্বন্দ্ব্বও আমরা দেখি আমজাদ হোসেনকে ফরসা করতে গেলে।
এ সিনেমায় দেখা যায় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে আহত হন গণসংগীত শিল্পী বুলবুল আহমেদ। এরপর দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু বিজয় তার জীবনে নতুন কিছু যোগ করে না। হতাশা বাড়ায় শুধু। গানের মাস্টারি করতে গিয়ে দেখতে পান, যারা পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশপ্রেমের-স্বাধিকারের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তারাই এখন শোষকের ভূমিকায়। সদ্য স্বাধীন দেশকে লুটে নিচ্ছে।
তেমন এক নেতার সঙ্গে (নায়িকার বাবা) বুলবুলের দেখা হয়, যিনি এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। ফ্ল্যাশব্যাকে উঠে আসে অতীত। যুদ্ধের আগে তিনি কী কী নীতি-আদর্শের কথা অনুসারীদের বলছেন, তার ফিরিস্তি জানতে পারি। ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র শুরুর দিকের ওই দৃশ্য দেখলে আপনিও বুঝতে পারবেন এর বাস্তবতা। বিষয়টি ভিন্ন ভিন্ন বয়ানে আমজাদের কাছাকাছি সময়ে তুলে ধরেছেন খান আতা (আবার তোরা মানুষ হ, এখনো অনেক রাত) বা নারায়ণ ঘোষ মিতা (আলোর মিছিল), সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী (ঘুড্ডি) বা আরো অনেকে। সেই গল্প নিদারুণভাবে আজও বাস্তব। তাই স্বাধীনতার অর্ধশতক পরে এসে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের তালাশ করতে হয়, স্বাধীনতার স্মৃতি হাতড়াতে হয়। মুক্তি তো আসে না! ক্ষুধার মুক্তি দূর কি বাত!
আমজাদের গল্পে দেখা যায়, নতুন পুঁজিপতিদের ব্যবসার পুঁজি হলো পুরনো লড়াই। এটা ঠিক, বর্তমান অতীতকেই নয়, খোদ বর্তমানকেও চ্যালেঞ্জ করে, মূল্যায়ন করে। সেই চ্যালেঞ্জটুকু আমজাদের সিনেমায় আছে।
‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র নায়ক-নায়িকা বুলবুল-ববিতার দ্বন্দ্ব্ব অহমকেন্দ্রিক হলেও, যার সূত্রপাত স্বাধীনতার মাধ্যমে গণের অধিকার সুরক্ষিত না হওয়ার মধ্যে। এ ছবির করুণ রস খুবই ডিস্টার্বিং। এর মাঝে আরো বিরক্ত করে প্রবীর মিত্রের চরিত্রটি। যে কিনা বারবার গ্রাম থেকে বুলবুলের খোঁজ নিতে আসে। পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেয় সাংস্কৃতিকভাবে নির্ণিত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সংকট। যেখানে একই ‘ক্ষুধা’র ভিন্ন ভিন্ন পরত ধরা দেয়। মনে হতে পারে, একজনের সামনে সংকটের উৎস পরিষ্কার কিন্তু সে নিদানের জন্য সাহস পায় না, হারিয়ে গেছে বিশ্বাসভঙ্গের ভেতর। অন্যজনের কাছে পরিষ্কার নয়, কিন্তু তার কাছে ক্ষুধার জ্বালা-কাপড় না থাকার জ্বালাটুকু স্পষ্ট।
একটু দূরবর্তী হলেও মান্না ও কাজী হায়াতের অনেক প্রতিবাদী সিনেমা যেন প্রবীর মিত্রের চরিত্রটির পরবর্তী পর্যায়। যেখানে বুলবুলের মতো চরিত্রগুলো কোনোভাবে সমাজে থাকছে না। যেখানে স্রেফ ক্ষুধার জন্য তাড়িত নাম-পরিচয়হীন মানুষেরা একদিন অসাম্যের বিরুদ্ধে সমাজের আত্মা হয়ে ওঠে। অবশ্য বাংলা সিনেমার এ ধারার যাত্রা শেষ পর্যন্ত সুখকর নয়। সিনেমা এখন আর সেই সব মানুষের কথা বলে না।
ববিতা এক সাক্ষাৎকারে জানান, পরপর অনেক গ্রামকেন্দ্রিক সিনেমা করেছেন আমজাদ হোসেন। ওই সময় কেউ কেউ বলছিলেন, তিনি শহরকেন্দ্রিক কোনো সিনেমা বানাতে পারবেন না। সেই চ্যালেঞ্জ নেন আমজাদ। দেখালেন যেন শহুরে মানুষেরা সাংস্কৃতিক লড়াইকে হাতিয়ার বললেও মূল সংকটের সামনে দাঁড়াতে পারছে না। ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র গল্পের বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবা যায়, ক্ষমতার সম্পর্কের মুখোমুখি হয়ে সাংস্কৃতিক লড়াই কীভাবে পথ হারিয়েছে, তা হয়তো বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকালে সাফ হয় অনেকটা।
দুই.
আমজাদ হোসেন তার সেরা সিনেমাগুলো পরপর নির্মাণ করেছেন; নয়নমণি (১৯৭৬), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), সুন্দরী (১৯৭৯), কসাই (১৯৮০), দুই পয়সার আলতা (১৯৮২), জন্ম থেকে জ্বলছি (১৯৮২) ও ভাত দে (১৯৮৪)। সব ছবিই বঞ্চনাবিরোধী। ক্ষুধাতাড়িত মানুষের গল্প।
‘ক্ষুধা’র মোকাবেলার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে ‘ভাত দে’ সিনেমার মধ্যে। সম্ভবত আমজাদের সেরা নির্মাণও। অবশ্য এ ছবিকে গোলাপী এখন ট্রেনের ভিন্ন রকমের প্রকাশ বলতে চাই। গোলাপী এখন ট্রেনে যূথবদ্ধ একটা ইতিহাসের তালাশ করা হয়। যেখানে ক্ষুধিত ও নিরন্ন মানুষ এক হয়ে মুক্তির সন্ধান করে। দেখতে চায় কোথায় বাঁধা আছে তাদের ভাগ্য? তারা আসলে কোথায় যেতে চায়? অন্যদিকে ‘ভাত দে’ ভিন্ন প্রজন্মের স্বতন্ত্র যাত্রা। প্রতিরোধে যেতে অক্ষম মানুষ শেষ পর্যন্ত কীভাবে নির্মমতাকে মেনে নেয়। আর নির্মমতাকে মেনে নিয়েই ভয়কে খর্ব করে। গোলাপী এখন ট্রেনের নারী গ্রামে লড়াই শুরু হলে শহরে আশ্রয় নেয়, আর ভাত দের জরি বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েও এক মুঠো ভাতের জন্য লড়ে।
এভাবে সম্ভবত সামগ্রিক প্রতিরোধের ধারণাটি হারিয়েছেন খোদ আমজাদ হোসেনই। অথবা সামষ্টিক সংকটকে একটি সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির চোখ থেকে দেখিয়েছেন। যেখানে মানবিক মর্যাদা সম্পর্কিত ধারণাটি ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। ভাত দে সিনেমায় এর বলি হন শাবানা-আলমগীর। ‘সুন্দরী’-তে দেখা যায় উপোস থেকে কীভাবে নিজের মনে যা আসে তা বলতে থাকেন ববিতা। আমজাদ হোসেন এমন পরিস্থিতি নির্মাণ করতে গিয়ে হতাশ হয়েছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু সমসাময়িক থেকেছেন।
এ সমসাময়িকতা প্রসঙ্গে অন্য একটি সিনেমার প্রসঙ্গ টানা যাক। গোলাপী এখন ট্রেনে নির্মাণ হয় আমজাদের লেখা উপন্যাস ‘দ্রৌপদি এখন ট্রেনে’ অবলম্বনে। এর এক বছর পর মুক্তি পায় আবু ইসহাকের উপন্যাস থেকে নির্মিত দেশ-বিদেশে পুরস্কার পাওয়া স্মরণীয় সিনেমা ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ (শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহ উদ্দিন শাকের)। অন্য প্রসঙ্গগুলো মুলতবি রেখে বলতে পারি, এ ছবিও নিরন্ন মানুষের কষ্টকে তুলে ধরেছে। মূল চরিত্র জয়তুনকে রেশনের জন্য শহরে যেতে দেখি আমরা। গোলাপী এখন ট্রেনেও একই চিত্র উঠে আসে ববিতা, রওশন জামিল ও আনোয়ারার মাধ্যমে। তারা পদে পদে লাঞ্ছনা সহ্য করে শহরে যায় একমুঠো ভাতের জন্য। দুই. সিনেমার বর্ণনাভঙ্গি ও শৈল্পিক নকশা একদম আলাদা, দর্শকও আলাদা, বক্স অফিসের গল্প আলাদা। আর সময়কালের ফারাকটা দেখুন। একটা গল্প পঞ্চাশের দশকের, অন্যটা সত্তরের দশক।
আমজাদের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে— ১৯৪২ সালে। তার জন্ম পরবর্তী স্মৃতি ও অন্যান্য প্রেক্ষাপটে পঞ্চাশের দশকের ওই গল্প জাগরূক থাকার কথা। কিন্তু সিনেমা নির্মাণের জন্য সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বেছে নিলেন। এটা ঠিক, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’কে বিষয় ভাবনায় হয়তো সমসাময়িক বলা যায়, আবেদনও চিরায়ত। কিন্তু কখনো কখনো মনে হতে পারে, অতীতের সংকট দেখিয়ে বর্তমানকে লঘু করা যায়।
অন্যভাবেও আলোচনাযোগ্য ভাত দে। বাংলাদেশের সিনেমায় স্বাধীনতা-পরবর্তী দুর্ভিক্ষের চিত্র কোন সিনেমায় এতটা খোলামেলা উঠে এসেছে? আসেনি। আরো বড় বিষয় হলো, ভাত দে কোন বয়ান তৈরি করে? আজকাল খুব একটা আলোচনা না হলেও ইতিহাস বলে, স্বাধীনতা-পরবর্তী খাদ্য সংকট যতটা খাদ্য উৎপাদন বা বৈদেশিক সাহায্যের অভাবজনিত, তার চেয়ে বেশি বণ্টনজনিত-নিয়ন্ত্রণের অভাবজনিত। আর সিনেমাও মুনাফালোভীদের বিরুদ্ধে। যেটা স্বাধীনতা-পরবর্তী কিছু সিনেমায়ও দেখতে পাই। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে এর খোলামেলা রূপটি দেখানোর তাকদ দেখিয়েছেন আমজাদ হোসেন, যার শুরু নয়নমণি। যে গল্পের শুরু নায়কের বাবার কালোবাজারির দৃশ্য দেখিয়ে। তবে বলা যায়, সেই অর্থে সরাসরি শাসকশ্রেণীর সমালোচনা এসব সিনেমায়।
ওই যে বললাম, নয়নমণি থেকে ধাপে ধাপে ভাত দে-তে এ লড়াই ব্যক্তির একার হয়ে যাচ্ছে। যেমন করে সিনেমাজগতেও আমজাদ হোসেন একলা হয়ে যাচ্ছেন। একদম শুরুতে উদ্ধৃত বাক্যটির মতো। তিনি হয়ে গেলেন ‘একলা প্রদীপ’।
তিন.
হ্যাঁ, সংকট তো আছেই। সমাধানও নিশ্চয় আছে। কোথায় নিদান দেখেন আমজাদ হোসেন? গোলাপী এখন ট্রেনে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছবিটি শ্রেণীসংগ্রামের।’ ফাহমিদুল হক ও অমিতাভ রেজার সঙ্গে আগে উল্লিখিত আলোচনায় বলেন, “শ্রেণীসংগ্রাম, তার ইতিহাসটা না জানা থাকলে চরিত্রগুলো বিকশিত করার বা চরিত্রগুলোর মুখে যথাযথ সংলাপ বসানোর মতো বুদ্ধিটা পরিচালকের থাকবে না। শ্রেণীর মধ্য থেকেই চরিত্রগুলোকে বেছে বেছে নিতে হবে। আমাদের সময়েও দেখেছি, পলিটিক্যাল ছবি করেছে, চরম রাজনৈতিক বক্তব্য, যেমন ‘জীবন থেকে নেয়া’, দৃশ্য থেকে দৃশ্যে। কিন্তু ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’-তে কী করলাম, রাজনৈতিক বক্তব্য উচ্চকিত করিনি।” আমজাদ হয়তো ভেবেছিলেন ইশারাই যথেষ্ট। যেমন ট্রেনে ববিতা বলছে, ‘বাংলাদেশে কোনো কেলাস নাই গো। আমরা হগলেই এক কেলাসের মানুষ।’ অথবা ফারুকের ‘ক গোলাপী কিছু ক’ সংলাপটি।
সুন্দরীতে আবার অনেকটা খোলাসা হলেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দোহাই দিয়ে নিজের জমির ধান ফেরত চায় সুন্দরী। এ দুটি নাম সামনে রেখে আমজাদ হোসেন বাংলার রাজনৈতিক মনীষাকে চিহ্নিত করেছেন, জানান দেন তার গল্পগুলো তৃণমূলের কেন? কেন তিনি বেছে নিলেন সাধারণ মানুষের কাহিনী? জন্ম থেকে জ্বলছিতে ফ্ল্যাশব্যাকে আদর্শবিচ্যুত নেতার বক্তৃতাও সরাসরি আঘাত।
নয়নমণি সিনেমায় একটা সংলাপ আপনাকে চমকে দিতে পারে। সেই চার দশক আগের সিনেমা! যেখানে সমাজের নেতৃস্থানীয় এটিএম শামসুজ্জামান নয়ন চরিত্রের ফারুককে গালি দিচ্ছেন ‘নাস্তিক, কম্যুনিস্ট’ হিসেবে। যদিও কমিউনিস্টসুলভ কোনো সক্রিয়তা দেখা যায় না। এ দুটো শব্দকে এক করে দেখার প্রবণতা আজও বিদ্যমান। উল্টো দিক থেকে ধর্ম সম্পর্কে একই ধাঁচের সমালোচনা আজও পপুলার। ধর্ম ও রাজনীতি প্রশ্নে আসলে আমরা কতটা এগিয়েছি এখনো। আর পরস্পর নিজেদের পর্যালোচনা করেছে কীভাবে?
আমজাদ হোসেনের সঙ্গে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর যোগাযোগ ও চিন-পরিচয় ছিল, বিশেষ করে ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন আমজাদ হোসেনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তা সত্ত্বেও শ্রেণীসংগ্রাম ও ধর্ম প্রশ্নের সুরাহা পাওয়া যায় না আমজাদের সিনেমায়। ধর্মকে মোটামুটি একটা সামন্ত শ্রেণীর হাতে বন্দিই দেখা যায়। ধর্মকে কীভাবে তারা শোষণের হাতিয়ার করে, সেই গল্প আছে। উল্টো দিকে ধর্ম কীভাবে শোষণবিরোধী, তার ইশারা নেই। স্রেফ ধর্ম-কর্ম করে ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা। আবার খোদার প্রতি ক্ষোভ ফুটে ওঠে। এ প্রসঙ্গে ভাত দে সিনেমার ‘তিলে তিলে মরে যাব, তবু তোরে ডাকব না’ গানটি ভালো উদাহরণ। অথবা সুন্দরীর ‘তোমারও দুনিয়া দেখিয়া শুনিয়া মনের আগুন দ্বিগুণ…।’ আমজাদ অবশ্য বলছেন, মানুষের ভাগ্য নিজেকেই বদলাতে হবে, এখানে দৈব কোনো ফয়সালা নেই।
চার.
এক ধরনের প্রথাগত বয়ান সত্ত্বেও গোলাপী এখন ট্রেনের একটি দৃশ্য দর্শকদের আঘাত করে। যে দৃশ্যে দেখা যায় সামন্ত শ্রেণীর নেতার সন্তান ফারুক সমাজ থেকে বিভেদের বীজ উপড়ে ফেলতে চায়। ফিরিয়ে দিতে চায় যার যার অধিকার। নিরন্ন মানুষকে দিতে চায় খাদ্য। তখন শ্রেণীস্বার্থের কারণে অন্যরা তার প্রতি নিষ্ঠুর হতে কসুর করে না। প্রথমে ফারুককে পাগল সাব্যস্ত করে আটকে রাখে, পরবর্তীতে বিষ প্রয়োগ করে খুন করে।
বোঝাই যাচ্ছে প্রবল প্রতিরোধের ধারণা আছে আমজাদের সিনেমায়, যেটা তার সচেতন প্রয়াসের অংশ। কিন্তু সিনেমার চরিত্রের দিক, এর বুদ্ধিবৃত্তিক বা রাজনৈতিক মীমাংসা অতি সামান্য। তারা শক্ত কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ায় না। হয়তো একে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের বামপন্থী ফ্যান্টাসির খণ্ডিতায়ন হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়।
আমজাদের সিনেমার তাত্ত্বিক একটা জায়গা হয়তো আছে। সেটা এমন যে, তার সিনেমার উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলোকে অংশত আশ্রয় নিতে দেখা যায় বাউলিয়ানায়। অথচ তারা ভাবালুতায় আক্রান্ত, বলছে, এ দুনিয়া কিছু না। এটা সম্ভবত স্থানিক দর্শন আকারে উপস্থিত, যার শুরু-শেষ বা আদি-অন্ত একার্থে জগেক নিরর্থক উপস্থাপন করে লঘুতা আরোপ করা। পরিহাস! সেই জগতেই ভাত-কাপড় বা বাসস্থানের জন্য লড়ছে চরিত্রগুলো। প্রতিবাদী মানুষের বয়ান তত স্পষ্ট নয়। তাদের গন্তব্য আসলে কোথায়?
গ্রামের প্রেক্ষাপট বাদ দিলেও সেই জন্ম থেকে জ্বলছির বুলবুলের চরিত্রেও প্রতিরোধের ধারণাটি গণসংগীতকেন্দ্রিক, অথচ তারই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে। ফলে একদম বাস্তব সমাজের সমান্তরালে জনসংস্কৃতিকে প্রতিরোধের ধারণার কাছাকাছি দেখিয়েও অর্থবোধক কিছু আরোপ করেননি। বুঝি সিনেমার ‘শ্রেণীসংগ্রাম’ বিষয়টি বাস্তবতার মীমাংসার প্রয়াস। কিন্তু ছন্নছাড়া, লক্ষ্যহীন, স্বপ্নহীন ও নেতৃত্বহীন। ব্যাপারটা কি এমন? সিনেমার মতো ব্যাপারটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় অমীমাংসিত, আর বাস্তবের মতো সিনেমাও অমীমাংসিত রেখেছেন। আঘাত করতে চেয়েছেন। এর উত্তরটা সিনেমার বাইরে থেকে আসুক।
সব মিলিয়ে মনে হয়, আমজাদ হোসেন বারবার সাধারণ মানুষের ‘ভাত-কাপড়ের’ অধিকার নিয়ে তাড়িত ছিলেন। তার কোনো ঐহিক মীমাংসা আর ঘটেনি। মাঝে কিছু প্রথাগত ঢঙের সিনেমার পর ‘কাল সকালে’-তে দেখি পুরনো স্মৃতির পুনরাবৃত্তি। সেখানকার একটা বিষয় উল্লেখ করে পারছিল না। মূল চরিত্র শাবনূরের পর্দা নামটা মনে নাই। সে এমন দরিদ্র যে পরনের কাপড় ধুয়ে দিলে গামছা গায়ে জড়িয়ে থাকতে হয়। তার বন্ধু অপু বিশ্বাসের চরিত্রটির নাম বাসন্তী। সে কলকাতা থেকে শাবনূরের জন্য শাড়ি কিনে আনে উপহার হিসেবে। খেয়াল করে দেখুন ‘বাসন্তী’ পরিচিত চরিত্র কিনা! এই ছবিতে এসে বাস্তবের আব্রু রক্ষা করতে গায়ে ছেড়া জাল জড়ানো মেয়েটি হাজির হচ্ছে অন্যভাবে। সিনেমাটি হয়তো তৃপ্তিদায়ক নয় কিন্তু আমজাদ স্পষ্ট দেখেছেন, মানুষ এখনো এ দেশে তার ন্যূনতম অধিকারটুকু নিশ্চিত করতে পারেনি। উন্নয়নের গল্পে হাততালি পাওয়া শহর বা মফস্বল এখন ‘ভিক্ষুকমুক্ত’। কোথাও কোথাও দেখবেন রাস্তার মোড়ে এ ঘোষণা ঝুলছে। আর তার নিচেই খাবি খাচ্ছে অন্ন-বস্ত্রহীন মানুষ। আমজাদ হোসেন তো চলেই গেলেন। সে গল্প এখন তবে কে বলবে?
/লেখাটি বণিক বার্তার সিল্পরুটে প্রথম প্রকাশ হয়