সেপ্টেম্বরে লালন সাইজী’র তিরোধান দিবসে কুষ্টিয়া গিয়া ছিলাম। সাথে ছিলেন দাউদুল ইসলাম। তিনিই রাহবার। গড়াই নদীর তীরে বেশ ভালোই জমিয়াছিল। গিয়াছিলাম রবিবাবুর কুঠি বাড়ি। এরপর পদ্মা পার হয়ে পাবনা। কুষ্টিয়া দিন তিনেক থাকার পর গেলাম ঝিনাইদহ।সেখানে ছিলাম আরো তিন দিন। নবগঙ্গা নদীর
পাড়ে ঝিনাইদহ শহরটা বেশ সুন্দর। ছিম-ছাম, চুপ-চাপ। এই শহরের আশেপাশে যেখানে ঘুরেছি- মিয়ার দালান, পাগলা কানাইয়ের মাজার, ঢোল সমুদ্র, সাধুগুরু রফিকউদ্দিন ফকিরের আস্তানা, গাজী কালু চম্পাবতীর মাজার, বারো বাজারে সুলতানি আমলের ডজনখানেক মসজিদ (পুর্ননির্মিত), নলডাঙ্গার মন্দির (পুর্ননির্মিত), মল্লিকপুরে এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো বটগাছ ইত্যাদী। ভ্রমন কাহিনী লেখা আমার ধাতে নাই (আপাতত)। তাই কিছু টুকরো ঘটনা ফেসবুকে শেয়ার করেছিলাম। সেগুলো এইখানে এক করে দেয়া হলো। এই সকল কর্ম ঘটিয়াছে সেপ্টেম্বরের ১৬ থেকে ২৩ তারিখের ভেতর।
ভাড়াখাটা ম্যানেজারের হোটেলে কেন উঠি নাই!
কুষ্টিয়া লালন আখড়ার কাছাকাছি একটা হোটেলেই রুম খালি ছিলো। সেই দুর্দিনে দাউদ কইলো, ‘এই হোটেলে উঠব না’। কইলাম, ‘ক্যান’। সে উত্তর দিলো, ‘এই হোটেলের ম্যানেজার অন্য হোটেলে চাকরী করে। খোজ নিয়ে দেখেন এই হোটেলের দরোজাই নাই’। খেয়াল করসেন কি মারাত্বক চিন্তা!!
চিত্রা নদীর পাড়ে কি কথা কহে হৃদয়!!
নদীর নাম চিত্রা। ঝিনাইদহের নলডাঙ্গার মা সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের সামনে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহমান। একসময় নাকি নলডাঙ্গার রাজা এইখানে তার প্রিয় হস্তীকে(পয়সা বেশী হলে লোকে মানুষ দেখে না) স্নান করাইতেন। আহা! সেইদিনও নাই। রাজাও নাই। তার বংশধর’রা দেশান্তরিত। তবে পুরানা মন্দিরগুলোর সংস্কার হইতেছে। ভালোই লাগিলো, পুরোহিতের মুখ ঝামটা ব্যতিরেকে। তানভীর মোকাম্মেলের একখানা মুভির নাম ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’। বেশ জমিয়াছিল। দেশান্তরিত উচ্চবর্ণ নিয়া নানা আহাজারিতে আমাদের অনেক মুভি ভাসিয়া গিয়াছে। সামনেও আসিতেছে কিছু।
কিন্তু কেউ কয় না তাদের কথা- যারা সেই বীরভূম, কলকাতা নগর থেকে ভাসিয়া আসিয়াছেন এই হা-ভাত বাঙালের দেশে। হায়! সেই বেদনার ঝড় শুধু আপন হৃদয়ে প্রবাহমান। মাঝে মাঝে দেখা দেয় স্মৃতিচারণে। এমন একজন হাসান আজিজুল হক। তার লেখায় বেশ মজা পাই মাইরী!
পাখি! কেমন আছো পাখি!
বাংলাদেশের মানুষ’রা ভিক্ষুকরে ফকির বলে। কিন্তু ফকির যে অর্থে ফিকির করে, এরা সে অর্থে কি কিছু ফিকির করে! তারপরও শব্দটা মাথার ভেতর ফিকির থেকে ফকির হয়ে থাকে। আমাদের মায়েদের দেখি ভিক্ষুককে সম্মান দেয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।
কোন কোন ধর্ম যদিও বিশেষ পর্যায়ে অন্যের বাড়ি গিয়া হাত পাতার কথা বলে- সেটা কখনো চোখে দেখি নাই, অন্তরেও তার বিশেষত্ব অনুরণিত হয় নাই।
লালনের আখড়ায় এমনিতে নানা ধরণের ভিক্ষুকের দেখা মেলে। সাধারণ পোশাকের ভিক্ষুকদের (শুনেছি এরা সিজেনাল) আচরণে মনে হইল তারা যেন কি মোক্ষ লভিয়াছেন! হঠাৎ সামনে সে বলল, দে! বাপ দে! এমন ভঙ্গিতে বলে যেন, তাকে দেখার সাথে মনোবাঞ্চা পূর্ণ হবার মতো কিছু একটা হয়ে গেছে। বিশেষ করে মহিলাগুলো কতই না ভঙ্গি জানে। একটা সুর কখনো ভুলব না। গলার সুর চুলের মতো সরু পর্যায়ে এনে কানে কানে বলে,পাখি! কেমন আছো পাখি!
দ্রুত উড়াল দিই। সে জানে না, এই চিকন সুর পাখির কাছে কি পরিমাণ ভীতিকর।
বাংলাদেশের অনেক জায়গায় গাজী, কালু আর চম্পাবতীর মাজার আছে!!
ঝিনাইদহের বারো বাজারের কাছেই গাজী, কালু আর চম্পাবতীর মাজার। পাশে একটা দীঘি। সেখানে বসে শান্তি শান্তি লাগতেছিল। ঠান্ডা বাতাস আসতেছিল। মাথার উপর সামিয়ানার উপর বট গাছ। আমার মনের কথা দাউদ বলে ফেলল, ‘ভাই, কেমন শান্তি শান্তি লাগতেছে’।
মাজারে খাদেম ছিলো না। মানতে আসা এক বৃদ্ধের সাথে অনেক কথা হলো। মনে হইতেছিল, এই লোকের ঈমান মজবুত না। সে সবকিছু কেমন সংশয় নিয়ে বলতেছিল। যেমন- ‘বাবা, এটা আমরা শুনছি। আমি তো দেখি নাই। তারা বাঘের পিঠে ছড়ে আসছেন’। এমনো হইতে পারে আমাদের দুর্বল ঈমানের লোক মনে হইছে! তিনি আরো জানাইলেন, ‘বাংলাদেশের আরো অনেক জায়গায় গাজী, কালু আর চম্পাবতীর মাজার আছে। এই যেমন মাগুরা’।
অনেক জায়গায় মাজার আসে শুনে আমার এক যুক্তিবাদি ধার্মিক বন্ধু কইলেন, ‘এটা কি লোকে বিশ্বাস করবে’। সে সব সময় নিজের মত লোকের উপর চাপাইয়া দেয়। আমি বললাম, ‘কেন দুনিয়ার সাত জায়গায় আবদুল কাদের জিলানী (রঃ)র লাশ দেখা গেছিলো। এটা সম্ভব না কেন’। তিনি এইবারও বলেন, ‘এটা কেমনে সম্ভব’! আমি বলি, ‘সেটা আমারে জিজ্ঞেস করেন কেন। আমার কাছে এটা এই সম্ভব-অসম্ভবের বাইরের বিষয়’।
ফিরিয়া গিয়াছি অনেক দূরে!!!
এই ফটোর সর্ব বামের মানুষটা আমি। মসজিদটা তার আদি নাম হারাইয়াছে। কলা বাগানের ভেতর থাকা এই মসজিদের নাম (বই-খাতায় লেখা আছে) শুক্কুর মল্লিকের মসজিদ।আমি ভেবেছিলাম সুলতানি আমলের সেই মসজিদটা এখনো টিকিয়া আছে। হয়তো যৎসামান্য সংস্কার দরকার হয়েছে। পরে শুনিলাম-
এই জায়গায় যে একটা মসজিদ আছে আশেপাশের লোক জানিত না। জায়গাটা ছিলো জঙ্গল আর্কীন। পরে প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের পন্ডিতগণ এটা আবিষ্কার করেন। পুরানো ভিতের উপর আগের নকশায় মসজিদটি নির্মাণ করেন, এরশাদ সরকারের শাসনের শেষ দিকে। ঝিনাইদহের বারো বাজারে তিন-চার কিলোমিটার জায়গার মধ্যে এই রকম ডজনখানেকের উপর মসজিদ আছে। তার প্রায় দশখানা নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। বিস্মৃতি ব্যথা জাগাইলেও, পুনর্নির্মাণের কারিশমায় ভালোই লাগিলো।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাইলাম। জানাইলাম- কি সৌভাগ্য আমি ইতিহাসের ভেদ মুছে দিয়া ফিরিয়া গিয়াছি অনেক দূরে।
>মোবাইল ফটো: দাউদুল ইসলাম ও ওয়াহিদ সুজন।
ভাইয়া, ভালোই লাগলো লেখাটা পড়ে। আপনাদের ট্যুরের সব ফটো দেখেছি। সম্ভবতঃ খুবই চমৎকার কেটেছে আপনাদের সময়।
রিক্তের বেদন।
তোমাকে দেখে ভালো লাগল।
সব সময়ের মতোই। শুভ কামনা।
Your writing is really gorgeous. I like your writing.
ধন্যবাদ কামরুল। শুভ কামনা।
ধন্যবাদ সুজন ভাই। এই সুন্দর পোস্টের জন্য। প্রত্নতত্ত্বের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে ঝিনাইদহ তথা বারবাজার সম্পর্কে কিছু শেয়ার করতে আগ্রহী হলাম। বিষয়টুকু আপনার পোস্টে যোগ করতে অনুরোধ করছি। প্রয়োজনবোধে এডিট করে নিয়েন……….
প্রাচীনকালের প্রমত্তা বুড়ি ভৈরব বা ভৈরব নদের তীরে এক সুবিশাল এলাকাব্যাপী প্রাচীন এই জনপদটির উত্থান ঘটেছিল। মুসলিম যুগেও এই জনপদটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশেষ করে পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহের সময়ে (১৪৪২-১৪৫৯ খ্রি.) বাংলার এই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল প্রকৃতপক্ষে মুসলিম শাসনাধীনে আসে। ও’মলী-এর বর্ণনা অনুযায়ী যশোর জেলা পনের শতকের মাঝামাঝির পূর্বে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম শাসনাধীনে আসে। এই অঞ্চলে তাঁর শাসন সুপ্রতিষ্ঠার জন্য মাহমুদাবাদ (বারবাজার) এবং খলিফাতাবাদ (বাগেরহাট) নামক দুইটি প্রশাসনিক শহর গড়ে তোলেন। এই মাহমুদাবাদ পরবর্তী সুলতানি আমল এবং মুঘল আমল পর্যন্ত মুসলিম বাংলার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এখানে মাহমুদাবাদ থেকে মুদ্রা অংকিত হত। বারবাজার অঞ্চলে দুটি জাহাজঘাটার সন্ধান পাওয়ায় ধারণা করা যায় যে, এই অঞ্চল বড় ধরণের একটি ব্যবসা কেন্দ্র হিসাবেও গড়ে উঠেছিল। অতএব বাংলায় বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম বাংলার অন্যান্য এলাকার মত মাহমুদাবাদ তথা বারবাজার এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই স্থাপত্য ইমারত গড়ে ওঠে; কিন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই কালের বিবর্তনে সে সমস্ত স্থাপত্য নিদর্শনাদি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এই অঞ্চলের প্রতিটি এলাকাতে দেখা যায় পুরাতন ইটের ছড়াছড়ি, প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তিসমূহের ধ্বংসাবশেষের স্মৃতিচিহ্ন। সময়ের আঘাতে সে স্থাপনাসমূহের অনেকগুলোই মাটির সঙ্গে একেবারেই মিশে গেছে; আবার কোন কোনটি পরিণত হয়েছে বর্তমান কালের জনবসতি পূর্ণ এলাকায়। এই সমস্ত জনবসতি নির্মাণ করতে স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকেই ধ্বংসাবশেষের পুরাতন ইট ব্যবহার করেছে। ফলে বারবাজার অঞ্চলের অনেক স্থাপত্য নিদর্শনই আর অবশিষ্ট নেই, নিমজ্জিত হয়েছে কালের গর্ভে। তারপরও স্থাপনাসমূহের ধ্বংসস্তুপ তথা প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি এবং এগুলো সম্পর্কিত স্থানীয় জনশ্র“তি তৎকালীন সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য, প্রশাসন, ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে জানা ও গবেষণার জন্য বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই সমস্ত তথ্য ও তৎকালীন সময়ের ইতিহাস উদ্ঘাটনের জন্য বাংলাদেশ প্রতœতত্ত্ব বিভাগ বারবাজার অঞ্চলে উৎখনন কার্যক্রম পরিচালনা করে। এতে প্রায় ১১টি স্থাপত্য নিদর্শন আবি®কৃত হয়েছে। স্থাপত্য নিদর্শনসমূহের মধ্যে অধিকাংশই মসজিদ বলে প্রতœতত্ত্ববিদগণ অনুমান করছেন। মসজিদ ছাড়াও এ সমস্ত প্রতœক্ষেত্রে আবি®কৃত স্থাপত্য নিদর্শনাদির মধ্যে রয়েছে কথিত জাহাজঘাটা, সেনানিবাস, সমাধিক্ষেত্র প্রভৃতি। এই সব স্থাপত্য নিদর্শনাদির সঙ্গে লক্ষণাবতী, গৌড়, পান্ডুয়া, দেবকোট, খলিফাতাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে সুলতানি আমলে নির্মিত স্থাপত্য নিদর্শনাদির সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
ধন্যবাদ অনর্ব। আমার কাছে এই অঞ্চল সম্পর্কে লেখা ছোট একটা বই আছে। ইচ্ছে করে এখানে কোন তথ্য যোগ করি নাই। ভালো থাকুন।
খুবই ভালো লাগলো ভাই। আপনার ভ্রমন চালিয়ে যান।
শুকরিয়া। দোআ করেন যাতে জীবনব্যাপী ভ্রমন চালিয়ে যেতে পারি। আশা করি কোন কোন ভ্রমনে আপনিও শরীক হবেন।