নৈঃশব্দ্যে খোলা আছে আপন জগতের দুয়োর

পাখি ও পাপ। নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। প্রথম প্রকাশ একুশে বইমেলা ২০১১। ঋতবর্ণ প্রকাশন চকোরিয়া, কক্সবাজার। প্রচ্ছদ লেখক। চৌষট্টি পৃষ্ঠা। বায়ান্ন টাকা।

এখানে প্রাচীরের ছায়া লেলিহান জ্বর / প্রিয়তম যাতনা বসো একটু দূরে / ছায়াতলে শুয়েছে নিশ্চুপ রোদের শহর [আমার বুক থেকে চুরি করে , পৃষ্ঠা:৯]

পাখি ও পাপ। মানুষ পাখির মতো উড়তে চায়। উড়া হলো স্বাধীনতার প্রতীক। নিস্কলুষতার প্রতীক। শান্তির প্রতীক। পাপ- নশ্বর জগতে একমাত্র মানুষই পাপবিদ্ধ হয়। মানুষ পাপের অধিকর্তা। পাখি অপাপবিদ্ধ। পাখি কি কখনো মানুষের মতো হতে চায়। তা আমাদের অজানা। কিন্তু একই মানুষের মধ্যে পাখি হবার বাসনা আছে, আবার সে পাপও করে। আলো আর অন্ধকারের মতো। পাখি ও পাপ। নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের প্রথম কবিতার বই। প অনুপ্রাস কানে বেশ বাজে। বাজতেই থাকে। সেই বাজনায় আমন্ত্রণ আছে।

সেই আমন্ত্রন ধরে নির্ঝরের কবিতার ভূবনে আগমন। কবিতার ভূবনে আসা-যাওয়ায় কবিতার কবিকে বিশ্বাসের ঘটনা আছে। সে আমায় কোথায় নিয়ে যাবে। তবে, এটা ধর্মতত্ত্ব বা জ্ঞানতত্ত্বের বিশ্বাস না। ধর্ম ও জ্ঞান নিয়া কবিতা হয় না, এমন না। তবে সে মামলা অন্য। আমি সে দুনিয়ার কথা বলছি, যে দুনিয়ার বাদশা হলেন কবি। তিনি আমাকে তার রাজ্যে নিয়ে যাবেন। কাব্যের সুধায় সেই রাজ্যে নিত্য বসন্ত বিরাজমান। সেই দুনিয়ায় শব্দই বদলে দেয় বর্তমান-ভূত-ভবিষ্যত। সময়কে বাদ রাখতে পারলে ভালো হতো- কিন্তু মানুষ পিছুটানে বন্দী। এই যে, ভবিষ্যত সেটাও কি এক ধরণের পিছু টান নয়? আমরা যেহেতু বর্তমানেই আছি যেহেতু কবিতার দুনিয়ায় সামনে পিছনে একই হলে ভালোই তো লাগে। সেই যাই হোক সময় বা পিছুটান কোনটা বাদ দিলে বিশ্বাসকে কোথাও রাখতে পারছি না। বিশ্বাস তো সময়েই পয়দা হয়। সুতরাং, কবির দুনিয়াকে অলীক ভাবার উপায় নাই। সে মোতাবেক কথা দাড়ায়, এই কবির কবিতা নিয়া আমার মধ্যে বিশ্বাসের ভাব পায়দা হলো, সেটা আসলে দুনিয়াদারির বিষয়। আগাম বলে দিতে পারি, এই কবিকে আমি অবিশ্বাস করছি না- আবার সেই বিশ্বাস দোকানদারির বিশ্বাস। অর্থ্যাৎ, কবি আর তার কবিতার পাঠকের আলাদা আলাদা মামলা। এইটাই মজার জিনিস। সেই দুনিয়াকে স্বাক্ষী মেনে কবিতার মধ্যে কবি যা দিচ্ছেন আর পাঠক যা খুজে পান তাকে গ্রহন প্রক্রিয়াকে বিশ্বাস বলা যায়।

দেখা নেই/ চোখের গভীরে নদীটা রেখেছি কাচের ঘরে/ একা থাকি/ দেয়ালে সাপগুলি রেখেছি সেলাই করে [দেয়ালে সাপগুলি রেখেছি সেলাই , পৃষ্ঠা: ৩১]

ধর্মতত্ত্ব এবং জ্ঞান তত্ত্বের আচারে-বিচারে একটা জিনিসকে কবুল করে নিতেই হবে। সেটা হলো ছাচসহ যুক্তির ধারণা। যুক্তি দুনিয়ার নানা জিনিসকে আগাম হাজির-নজির মেনে কথা বলতে শুরু করে। তার হিশেব তা ছকে বাধা। সেখানে আপনি আর পাখি নন। অথবা আপনার কাজ শুধু মেনে নেয়া। এর বাইরে গেলে হবে না। ভেবে দেখেন, যে দুনিয়াটা আপনি আর কবি মিলে বানিয়েছেন সেখানে অনেক কিছু আগাম হাজির থাকলেও খোদ দুনিয়াটা হাজির নাই। এটাই হলো কবিতার মজা। কিন্তু এই ভাবাভাবির মধ্যে কোনটা দিয়া আপনাদের দুনিয়া সাজাবেন সেটা আপনি খুজে বের করছেন আগাম হাজির দুনিয়া থেকে। কোথাও থাকল হিমালয়ের চুড়া আবার কোথাও বা এদো পুকুরের পদ্ম। সেই ফুল আবার যে সে নয়- আপন রঙে তারে সাজাচ্ছেন। যে রং চেনা-অচেনা বস্তু জগতে অনুপস্থিত। কবিতার এই ঘটনা নিয়া দুটা কথা পারা যায়। এটা আপনার-আমার ভেতর উপস্থিত আছে। নিশ্চিত আছে। কিন্তু কবিরা যা পারে, আমরা তা পারি না। শুধু কবিরাই সেটা পারেন।

একটা টলটলে পুকুর এসে কথা বলে / আমি তার পাড়ে বসি বুকে পা ডুবিয়ে / একটা যন্ত্রণাকাতর মাছ আসে / আমার আঙুল কেটে নিয়ে যায় দূরে / রক্ত ক্রমশ রঙহীন হতে থাকে / রঙহীনতার মধ্যে থাকে কেবল লাবণ্য/যা অংকের মতো ছক তৈরি করে [যা অংকের মতো ছক , পৃষ্ঠা: ১৪]

এখন সেই আগাম হাজির দুনিয়া নিয়া কথা বলা যাক। কবি যে জগত সংসার থেকে ইট-কাঠ-বালি-খড়ি-মাটি কুড়িয়ে সাজিয়ে রাখছেন তার একখানা সামষ্টিক জায়গা আছে। মোট কথা গুণ থাকলে চলে না তারে ধারণ করার মতো বস্তুর ধারনা থাকতে হয়। তাকে আমরা ব্যক্তিক চৈতন্য থেকে সামষ্ঠিক চৈতন্যে নির্বাসিত করতে পারি। নির্বাসন বলছি এই কারণে- একের ভাব অন্যের কাছ একদম আলাদাভাবে ধরা পড়তে পারে। সেই জায়গায় কবির সংসার পাঠকের সংসার বলে ভ্রম হইতে পারে। কিন্তু সেতো চৈতন্যের অদৃশ্য কারবার। হোক অদৃশ্য- আমরা তার হক্বদার বটে। আহা, দেখছি কবিতার মধ্যেও ইনসাফী কারবার আছে। সেই ইনসাফী কি হক্বদারের চৈতন্যে বিশ্বাস বলে জারি থাকে? গোলমেলে বিষয় বটে।

অনেকদিনের পথগুলি খুলে খুলে দেখি / ভাঁজে ভাঁজে আমার পদচিহ্ন আছে / সেদিনরাতের ঝড়ে ধূলিগুলি উড়ে / তারপরে বৃষ্টিতে ক্রমশ কাদা / সেদিন রাতের বাতাসে কারো ঘর পুড়ে যায় / পুড়ে যায় প্রকৃত আগুনে পদচিহ্ন আর ধূলির পরিণতি সে জানে না / সে আগুনের কথা ভেবে ভেবে অন্যমনা / অনেকদিনের পথ খুলে দেখি / আমার চিহ্নগুলিই হয়ে আছে প্রকৃত আগুন [আমার চিহ্নগুলিই হয়ে আছে , পৃষ্ঠা: ১৭]

এটা সংসার- সংসার বানানোর কায় কারবার। সেই সংসারটা কেমন? কেমন বলার মধ্যে কোন সন্দেহ নাই। খাটি বিশ্বাসপ্রবণ হয়ে মেনে নেয়ার ইচ্ছে আছে। যেটা আগাম হাজির। আসুন সেই ইচ্ছেকে পরিত্যাগ করি। এই পরিত্যাগটা মূল্যবান। আমি জানি না ত্যাগ আর পরিত্যাগের মধ্যে পার্থক্য কি। এবার কবির ইচ্ছেতে আসি। একজন কবি অথবা কবিতার পাঠকের কাছে এই ইচ্ছে নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু। ধরুন, সংসারটাই হাজির নাই। কিন্তু সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা আগাম হাজির হইয়া দাড়িয়ে আছে। আপনি কবি মানুষ, পিছুটান মনে করে তাকে তাড়াবেন কেন? আপনার ইশক বলে, আসো। ঘরে আসো। এইটাই কি কবির সংসার। সেই সংসারের গাথুনীতে মশলা হলো কবিতার সেই প্রবণতা। সেই প্রবণতা আমি আবিষ্কার করি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের কবিতার প্রকরণ নির্বাচন ও সেইগুলা ব্যবহারের ভাব-ভালোবাসায়। এই ভালোবাসায় খাদ নাই এটা যেমন নিশ্চিত করে বলা যায় না। আবার তবে সেই কবির সংসারে আমার অবিশ্বাস উদয় হয় না, এমন তো নয়। আম-পাঠক তাকে আপন ঘর মনে করতে পারে। তারা খান-দান গান করেন। আবার এমন হইতে পারে- তার মধ্যকার বাসা বাধা পূর্বানুমান ও সংস্কার নানা কর্মে নানা রূপে ধরা দেয়। তারপরও শ্রী চৈতন্যের ধর্মতত্ত্বের জবানে বলি, বিশ্বাসে মিলায় হরি। পাঠকের কাছে কবির চৈতন্য শব্দরূপ কবিতা হয়ে হাজির। খেয়াল করার বিষয় আগে কবির অনুভূতি তারপর তার কবিতা, পাঠকের বেলায় তার উল্টো। এখন পাঠক কবিকে তুলোধুনো করলেও কবি এগিয়ে থাকেন। তবে সেই কবিকে তুলোধুনা করলে স্বস্থি পাবার কথা। সেটা পাখি ও পাপের কবিতাগুলা পড়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলা যায়। আমরা যদি কিছু কবিকে তুলোধুনো দিয়েও ঘরের মানুষ হতে দিই আর ভালোবাসলে আপনার মানুষ বলেই ভালোবাসি- সেতো অরূপ জগতে আমার-আপনার শূণ্যের পাতা সংসার।

মনে হলো একফালি হাওয়া লিখে ফেলি গোপনখাতায় / খাতাটা হারিয়ে গেছে শহরের পথে / চাইছি জানলার বুক গলে আসুক পৃথিবীর সমস্ত বাতাস / আসুক ঘাস আর কলাপাতায় ভর করে / জানলাটা পালিয়ে গেছে কী অবলীলায় / শহরের রাস্তাটা উঠেছে শেষে করিডোরে / জানলাখানি গোপনখাতায় লিখেছি একদা অস্ফুটভোরে [জানলাখানি গোপনখাতায় লিখেছি একদা, পৃষ্ঠা: ২৫]

যা দিয়ে শুরু করেছিলাম- কবিতার সাথে বিশ্বাসের সম্পর্ক। বিশ্বাস শব্দ হিসেবে অপূর্ণ। অনুভূতি হিসেব অপূর্ণ। কিন্তু সম্ভাবনা আকারে সে অপার। সেই সম্ভাবনার দুয়োরটা যদি খোলা থাকে, তবে কাব্যের শক্তি খানিকটা আন্দাজ করা যাবে। কিন্তু বিশ্বাস মানে সাধারণত কোন কাজ বা সক্রিয়তা নয়। যেমন- আমি ভুতে বিশ্বাস করি। এখন ধরেন বললাম, ভুতে বিশ্বাস করি। দেখা যাবে বিশ্বাস করার বিষয়টা আগে থেকে হাজির বা আপনি বিশ্বাস করতে প্রস্তুত। এটা হলো প্রবণতা। সেই প্রবণতার সাথে কবিতাকে মিলালাম কেমনে? ঐ যে বললাম, বিশ্বাস মানে সক্রিয়া নয়, মানসিক একটা ব্যাপার স্যাপার। কিন্তু আমি বলছি কবিতায় বিশ্বাস এক ধরণের সক্রিয়তা বটে। সক্রিয়তা এই অর্থে সে সম্ভাবনা আকর। সেই সম্ভাবনাকে অলীক বলে এড়ানোর উপায় নাই, আবার ইট-কাঠ-পাথরের মতো জিনিস নয়। সেটা নির্ঝরের কবিতায় শেষ পর্যন্ত কতটা পাওয়া যায়, তাতে সন্দেহ আছে। দুঃখ হয় যদি হাওয়ায় বিশ্বাস করার পর হাওয়া যদি জলে কম্পন না তোলে। আহা, বাশিওলা সুর তুলে আনমনা করে চলে গেল। চলে গেল।

আমি বেড়ে উঠি সুন্দরস্পর্ধায়/ আমি শস্যের গোপন প্লাবন / তার হাতে তুলে দেবো পৃথিবীর অন্ধকার / আমি তাকে আলো নামে ডাকি / বাকি থাকে একটি দিন হাজারটা দিন/ অন্যদিনের মোড়ে দাঁড়িয়ে কাকে খুঁজি / পাশাপাশি বনের প্রান্তে মাঠ আর গ্রাম জেগে / অন্ধকার তার চোখের কাঁখে / তাকে চিনি না [তাকে চিনি, পৃষ্ঠা: ৬৪]

কবির কবিতার বিশ্বাস প্রবণতার মধ্যে মানব সংসারের তাবৎ গ্লানি লেগে থাকে হয়তো। সেটা এই পাঠককেই মহিমা দান করে। সেজন্য কবিতা হয়তো নিরাময় গুনদারী। কবিতার সেই দুনিয়া আসলে কি সেটা হয়তো শেষ পর্যন্ত একজন পাঠকের কাছে অব্যক্ত থাকে। কবির কাছেও বটে। তারপরও আমরা নানাভাবে ব্যক্ত হতে চাই। কবির কাজ হয়তো অব্যক্ত হতে ব্যক্ত হবার যে ইচ্ছে- তাকে পথ দেখানো। একজন কবি হতে পারেন উৎকৃষ্ট ধাত্রী। তাকে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। নির্ঝর হয়তো ষোলআনা বিশ্বাসযোগ্য ধাত্রী নন কিন্তু নিদেন পক্ষে দশআনা সে আমাদের সেই কবি। নির্ঝরের কবিতার আয়না মুখ দেখতে গিয়ে কখনো কখনো ঘোলা কিছু দেখি। ঐ যে বাশিওলার বাশির টানে ঘর ছাড়লাম। ঘরের বাহির হইয়া দেখি সে কোথাও নাই। খুব কষ্ট লাগে। খুব কষ্ট লাগে।

> পাখি ও পাপ’র কবিতা পড়তে ক্লিক করুন

> লেখাটি ছোটো কাগজ মলাট-এর দ্বিতিয় সংখ্যা ও বইয়ের দোকান সাইটে প্রকাশিত।

Comments

comments

Comments are closed.