দুইবার সমাধিস্থ হয়েছিল যে কিশোর
ফিলিস্তিনি সেই মাহমুদ আল জাক-এর দেহাবশেষ শনাক্ত করেছিলেন তার বাবা আবদুল্লাহ, কোন শারীরিক আলামত দেখে না- বরং ইজরাইলি সেনাবাহিনীর হামলায় নিহত ছেলের কোমরের বেল্ট আর পায়ের মোজা জড়িয়ে কিছু মাংসের দলা শনাক্ত করেছিলেন হতভাগ্য বাবা। একদিন পর চৌদ্দবছর বয়সী মাহমুদের শরীরের বাকি অংশ খুঁজে পাওয়া যায়। সময় ২০০৬ সাল। স্থান দখলকৃত ফিলিস্তিন।
ইজরাইলি সেনাবাহিনী ওই হামলার নাম দিয়েছিল অপারেশন লকড কিন্ডারগার্টেন। যথোপযুক্ত নাম বটে। এই অপারেশনে নিহত হয়েছিল মোট বাইশ জন। যার বেশির ভাগই শিশু। এরপর ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে ইজরাইলি দৈনিক হারেট্জ’র পাঠকরা এ নিয়ে একটা নিবন্ধ পড়েছিলেন, সোজা বাংলায় শিরোনামটা ছিল এমন ‘দুইবার কবরস্থ হয়েছিল যে কিশোর’। লেখক ছিলেন গিডন লেভি।
গিডন লেভি
গত ছাব্বিশ বছর ধরে হারেট্জ পত্রিকায় লিখছেন গিডন লেভি। তিনি ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের কথা ধারাবাহিকভাবে লিখে আসছেন। বিশেষকরে পশ্চিম তীর এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু জীবনযাপন এবং সেনাবাহিনী ও ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের ভূমিকা নিয়ে তিনি সমালোচনা করেন। তুলনামূলক লিবারেল বলে পরিচিত ওই পত্রিকায় তাঁর জন্য নির্ধারিত কলামের নাম দি টুইলাইট জোন। সেই ২০০৬ সাল থেকে লিখছেন। তার মতামত বরাবরই ইজরাইলি কর্তৃপক্ষের বিপক্ষে যায়। একে তিনি একইসাথে রাজনীতি ও আবেগের জায়গা থেকে বিচার করেন। তার এই কাজকে কেউ কেউ বলে হামাসের পক্ষে প্রপাগান্ডা। মানবাধিকারের পক্ষ থেকে যেমন পুরস্কার পেয়েছেন, তেমনি কেউ কেউ তাকে ইজরাইলের প্রতি নিরাপত্তা হুমকি হিশাবে বিবেচনা করেন। কলামের লেখাগুলার সংকলন বের হয়েছে এবার বই আকারে, নাম ‘দ্য পানিশমেন্ট অব গাজা’। গিডন লেভি’র সর্বশেষ বই এটা।
লেভি বলেন, ‘খুন কর না’- এই বাক্যটি বলার চেয়ে খুন করা অনেক সহজ কাজ। যেকোন কিছুর উসিলায় এই খুন-খারাবী যুদ্ধ চলতে পারে। হতে পারে হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান। কিন্তু তার ফলাফল বা শাস্তি ভোগ করে সারা গাজার মানুষ। সেটা এখন মানবতার ওপর বিরামহীন গোলাবর্ষণ।’ লেভি মনে করেন এটি দুয়েক দিনের আগ্রাসন না। এটা উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ। যে অধ্যায়ের শুরু ১৯৪৮ সালের মিথ্যাবাদীতা, ধ্বংসযজ্ঞ ও বর্ণবাদী প্রপাগান্ডার মধ্য দিয়ে। অবশ্য ফিলিস্তিনের বর্তমান খবরাখবর লেভি সরাসরি নিজে গিয়ে সংগ্রহ করতে পারেন না। কারণ, নভেম্বর ২০০৬ সাল থেকে গাজায় ইজরাইলি সাংবাদিকদের যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইজরাইলি কর্তৃপক্ষ। ফলে স্থানীয় সূত্র ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন তিনি। সেই তথ্য নির্ভর করে ইংরেজি ভাষায় লেখেন। ফলে একইসাথে সামরিক আগ্রাসন ও প্রচারণাযুদ্ধ চালানো ইজরাইলের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের লড়াইটা জোর পায়। দুনিয়াবাসী আগ্রাসনের চিত্র দেখতে পায়। সমালোচক জিনন কুলটারের মতে, লেভি এই বইয়ের মাধ্যমে ইজরাইলি রাষ্ট্রের ভেতরকার বিষাক্ত মোনাফেকিকে উদাম করে দিয়েছেন। কারণ এই বইটি ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার সাথে ইজরাইলিদের রাজনৈতিক নীতিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার বয়ানও বটে।
সংবাদ আগ্রাসন
ইজরাইল তার সমস্ত কাজকে বৈধতা দেয়ার জন্য কথার খেলা খেলে। ভুল তথ্য দিয়ে সকল অপরাধের ন্যায্যতার খোলস পরায়। যেমন গাজায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়া ফোটিলার ভিডিও চিত্র। যেগুলা উত্তর আমেরিকার মিডিয়াতে দেখা গেছে। এটা স্পষ্টত পরিকল্পনামাফিক সরবরাহ করা। ইজরাইলের এই আগ্রাসনকে নব্য ইহুদি দার্শনিক বার্নার্ড হেনরি লেভি কারিগরি ভুল বলে সাফাই গান। যিনি এর আগে ২০১০ সালেই তেলআবিবে এক সম্মেলনে বলেছিলেন, ইজরাইলি সেনাবাহিনীর চেয়ে গণতান্ত্রিক সেনাবাহিনী এর আগে তিনি কোথাও দেখেন নাই, যারা নিজেরা নানা নৈতিক প্রশ্ন তুলে ধরে নিজেদের সামনে। অথচ এই ‘নীতিবান সেনাবাহিনী’ই ১৯৪৭-৪৮ সালে এক লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করার মাধ্যমে এক জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু করেছে, যা এখনও চলছে। এত নিরস্ত্র মানুষের রক্ত হাতে লেগে থাকার পরও ইজরাইল বুদ্ধিজীবীদের হাত করতে জানে। তারা জানে এদের দামে কিনতে হয়।
২৭ ডিসেম্বর ২০০৮ লেখা কলাম দ্য নেইবারহুডস বুলি স্টাইগস এনগেইন-এ গাজা হত্যাকাণ্ডকে লেখক যুদ্ধাপরাধ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি ইজরাইলি সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের নিন্দা জানান, যারা এসব ঘটনাকে নিছক ‘ভুল’ বলে সাফাই গান। তিনি ইজরাইলি দ্বৈত আবেগের কথা বলেন। একটি হলÑ প্রথমে কোন ভুল করে পরে নিজের চোখে এটাকে সঠিক চেহারা দিয়ে দুনিয়াজুড়ে প্রচার করা। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম অবশ্য এসব ইজরাইলি প্রচারণা ‘সংবাদ’ হিশাবে ছড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়তÑ হত্যা, গুম, জেল, অত্যাচার- এগুলাকে ‘ঠিক’ বলা; কিন্তু ন্যায়ানুগ কিনা উল্লেখ না করা।
নিষিদ্ধ নগরী
হামাস ২০০৬ সালের নির্বাচনে ব্যাপক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়। ফিলিস্তিনিদের কাছে সুবিধাবাদী বলে পরিচিত ফাতাহ শোচনীয়ভাবে হারে ওই নির্বাচনে। কিন্তু পরাশক্তিগুলা সেই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয় নাই। প্রধানত আমেরিকা ও ইওরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থন ও সহযোগিতায় ফাতাহ প্রধান মাহমুদ আব্বাস স্রেফ গায়ের জোরে ওই নির্বাচিত সরকারকে অস্বীকার করেন, নতুন সরকার গঠন করেন। কিন্তু নির্বাচিত হামাস সরকার গাজার নিয়ন্ত্রণ ছাড়ে নাই। সেই থেকে গত চার বছর ধরে ইজরাইলি বাহিনী গাজাকে অবরুদ্ধ করে সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ে ভোট দেয়ার অপরাধে শাস্তি ভোগ করছেন গাজার মানুষেরা।
লেভি তার বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন, অ্যা জাস্ট বয়কট। এই অবরোধকে তিনি বিষাক্ত মোনাফেকি বলে উল্লেখ করেন। তার মতে এর ফল হিশাবে তার দেশের সরকার, সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলা অপরাধী হয়েছে, কলঙ্কিত হয়েছে। গাজার মানবিক বিপর্যয়গ্রস্ত পরিবারগুলার নজির পেশ করেছেন তিনি তার এসব লেখায়। যেমন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধকে আইনি বৈধতা দেয়া হলেও আসলে ইজরাইলের নিজের দেশের আইনেই এর কোন আইনি ভিত্তি নাই বলে প্রমাণ করেছেন লেভি। ফিলিস্তিনিদের তরফে আক্রমণ প্রশ্নে তার পরিস্কার জবাব হল, আমরা ইজরাইলিরা-ই এটা শুরু করেছি।
লেভির এই বইটা ইজরাইলি আগ্রাসনের ওপর একনজরে অনেক তথ্য দেয় মোটা দাগে। আবার নাম, চিহ্ন, সাকিন জানিয়ে হাটে হাড়িও ভাঙ্গেন বিস্তারিতভাবে। লেভি নানা পরিসংখ্যান এখানে উল্লেখ করেন। যেমন- ডিসেম্বর ২০০৮ থেকে জানুয়ারি ২০০৯ এই তিন হপ্তায় অপারেশন কাস্ট লিড চলাকালে নিহত ১৩৩০ জন ফিলিস্তিনের ৪৩০ জনই শিশু। এর অপারেশন কাস্ট লিডকে লেভি তার আলোচনায় প্রধান করে তুলেছেন। এখানে আরও ৫০০০ মানুষ আহত হয়। গৃহহারা হয় প্রায় এক লাখ মানুষ। আসলে সংখ্যা কোন বিষয় না, যারা আমেরিকার বিদেশ নীতি বোঝেন, তারা জানেন, আমেরিকা শুধু এইগুলার পরিপ্রেক্ষিত খোঁজে। অথবা সেইসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় যেগুলা তাদের উদ্দেশ্য পুরা করে। এইখানে তাবৎ মানবিক আবেদন মাথা খুঁড়ে মরে। কিন্তু দেখার কেউ নাই। তাই সর্বশেষ ২ সেপ্টেম্বর ২০১০-এ বারাক ওবামার মধ্যস্ততায় শুরু হওয়া ‘সরাসরি’ শান্তি আলোচনা নিয়েও একই কথা উঠেছে।
একচোখা সংবাদমাধ্যম
ইজরাইলের পক্ষে দুনিয়ার প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলার একচোখা প্রচারণার বিষয়ে তিনি তার ক্ষোভের কথা বলেন। ইজরাইলি-আমেরিকান-ইওরোপীয় সংবাদমাধ্যমগুলা সবসময় আক্রমণ করে আর ইজরাইল তার প্রতিক্রিয়া জানায় মাত্র। তারা হামাসকে সন্ত্রাসী জঙ্গীবাদের ভূতের আশ্রয় করে রাখে। যার ফলে ইজরাইলি আগ্রাসনকে জায়েয করা সহজ হয়। লেভি উচ্চ কণ্ঠে বলেন, ইজরাইল এবং শুধু ইজরাইলই এই বেইনসাফির জন্য দায়ী। ইজরাইল এর জন্য কোন মূল্য পরিশোধ করে নাই। তার মতে এই হামলা রুখতে ও অবরোধ ভাঙতে ইজরাইল ছাড়া আর কারও কিছু করার নাই। তিনি বলেন; একমাত্র আমরা, ইজরাইলিরা-ই এই অবরোধ ভাঙ্গতে পারি। এরজন্য ইজরাইলের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। সাথে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ। তখনই এই অবস্থার সমাপ্তি ঘটবে।
এই বইয়ে একটা অধ্যায় ২০০৮ সালে বাজারে আসা একটা চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে। ওয়ালজ উইট বাশি’র একটা এনিমেটেড প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। ওরি ফলম্যানের এই চলচ্চিত্রটা ইজরাইলি দখলদারিত্বের গুণগানে মুখর। ১৯৮২ সালে লেবাননের শাবরা ও শাতিলা উদ্বাস্তু শিবিরে ইজরাইল গণহত্যা চালায়। অথচ ওই গণহত্যার স্মৃতি নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটি চমৎকারভাবেই ইজরাইলের সাফাই গায়। যেটি মানবতাবাদী বলে প্রশংসিত হয়। যেখানে গাজা প্রসঙ্গেও কোন কথা নাই। এখানে যা দেখা যায় তাতে মনে হয় ইজরাইল কোন অন্যায় করে নাই। লেভি বলেন, এটা কোনভাবেই যুদ্ধ বিরোধী চলচ্চিত্র না। গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার পাওয়া এই চলচ্চিত্রটা আসলে শিল্পের নামে অসততা।
এন্টি-সেমিটিজমের ভূত আছে, ফলে ওঝা এবার ইজরাইলি
লেখালিখির বিষয়বস্তু গাজা হলেও ইজরাইলি নিষেধাজ্ঞার কারণে লেভি অন্যান্য ইজরাইলি সাংবাদিকদের মতই গাজায় যেতে পারেন না। তিনি এইসবের পেছনে যে ইজরাইলি সশস্ত্র বাহিনী, তার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি ইজরাইলবাসীকে তার লেখার মাধ্যমে জানাতে চান তাদের স্বার্থরক্ষার নামে আসলে কি করা হচ্ছে। ইজরাইলের আগ্রাসন ও হত্যাকাণ্ড কিম্বা উদ্বাস্তু ও মৃত্যুর মিছিলে শামিল ফিলিস্তিনিদের নিয়ে বলতে বা লিখতে গেলে যে কারও মাথার ওপর একখানা খোলা তলোয়ার ঝুলতে শুরু করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার চিকন সুতায় বাঁধা সে তলোয়ার। যদি কোন এন্টি-সেমিটিজিম বা কেজো বাংলায় ‘ইহুদি-বিদ্বেষের’ বিন্দুমাত্র আলামতও টের পাওয়া যায়, তবে সুতা ছিঁড়ে যেকোন সময় টুপ করে তা চেপে বসতে পারে ওই বলিয়ে বা লিখিয়ের ঘাড়ে। আর ইহুদি বিদ্বেষ কি জিনিস সেটা ঠিক করার মালিকানা একমাত্র ইহুদিবাদী ইজরাইল অথবা তার পৃষ্ঠপোষক ও শুভানুধ্যায়ীরা, এমনকি সাধারণ ইহুদিরাও তা ঠিক করেন না।
শুধু বলিয়ে বা লিখিয়েরাই না, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলার হয়ে যারা আনুষ্ঠানিক কাজ করেন, তাদের কাজের ফলাফলও যদি ইজরাইল রাষ্ট্রের স্বার্থের বিপক্ষে যায় তবে এই ইহুদি বিদ্বেষের অভিযোগে মাথা কাটা পড়তে পারে। যেমন আমেরিকান বিচারক রিচার্ড গোল্ডস্টোন। জাতিসংঘের অর্থায়নে ‘ইজরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের’ কার্যকারণ নিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করতে তাকে নিয়ে একটা কমিশন তৈরি করা হয়Ñ গোল্ডস্টোন কমিশন। তার কমিশনের প্রতিবেদনটি গোল্ডস্টোন প্রতিবেদন নামে পরিচিত হয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত কোন কাজে আসে নাই। ইজরাইল ও তার বন্ধুরা ওটাকে ইহুদি-বিদ্বেষী হিশাবে শনাক্ত করে। ব্যস, মাথা কাটা পড়ল ওই উদ্যোগের। বৃটেনের দৈনিক গার্ডিয়ান-এ রিচার্ড লেজার্ড এই বইটার সমালোচনায় মন্তব্য করেন, তিনিসহ গার্ডিয়ান পত্রিকার ভাগ্যে হামাস সমর্থনকারী বা ইহুদি বিদ্বেষী বদনাম জুটতে পারে। তাহলেই কাজ সেরেছে। ওই তলোয়ারে যার মাথা কাটা পড়ে ইওরোপ কিম্বা আমেরিকায়, তার অনেকটা জাত যাওয়ার মত অবস্থা হয়।
এই অবস্থায় ইহুদি বিদ্বেষের কলঙ্ক নিতে চান না বৃটিশ বা আমেরিকান প্রকাশকরা। তাই লেভি’র বইয়ের মত কোন বই প্রকাশ করতে ভয় পান তারা। ঔপনিবেশিক ধারণা অনুযায়ী; আরব’রা মিথ্যাবাদী হয়, তাই তাদের কথাবার্তাও ইহুদি বিদ্বেষী হতে পারে। ফলে ধরে নেয়া হয় যে, আরবদের মধ্যে, বিশেষত আরব মুসলিমদের মধ্যে কোন নির্ভরযোগ্য সাংবাদিক বা ইতিহাসবিদ পাওয়া অসম্ভব। ফলে লেভির সুবিধা হয়েছে, একজন ইজরাইলি হিশাবে তিনি কথা বলতে শুরু করেছেন। ইজরাইলি ঔপন্যাসিক ডেভিড গ্রসম্যান ১৯৮৭ সালে তার ইয়োলো উইন্ড বইয়ে বলেছিলেন, ইজরাইলের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে, রাজনৈতিক মতের চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের চেয়ে একজন নাগরিকের জন্য ধর্ম এমনকি লিঙ্গ পরিবর্তন অনেক সহজ। সেই হিশাব গিডন লেভির লেখা গ্রসম্যানের দেয়া ‘চূড়ান্ত’ বিশেষণটিকে বদলে দিয়েছে।
দেশপ্রেমিক ইজরাইলি কিছুই জানে না
লেভি এমন আদর্শ ইজরাইলি চরিত্র দাঁড় করান, যারা খুব নৈতিক। এদের তিনি দেশপ্রেমিক মনে করেন। আবার তিনি এটাও বলতে চান কোন রাজনৈতিক খায়েশ ছাড়া এই ধরনের ঘটনা ঘটছে না। কারণ তার ভাষায়, ‘আমরাই আমাদের সৈন্যদের এমনভাবে শিক্ষা দিয়ে থাকি, যাতে তারা মনে করে ফিলিস্তিনিদের জীবন ও সম্পদের কোন মূল্য নাই। মনুষ্যত্বহীন করে তোলার যে প্রক্রিয়া বছরের পর বছর চলছে, এটা তারই ফল।’ লেভি তার বইয়ে তর্ক তোলেন ইজরাইলিদের গাজার বিষয়ে পরিকল্পনা করে অজ্ঞ রাখা হয়েছে। তারা জানে না, এইখানকার অবরোধ আসলে ‘সামষ্টিক শাস্তি’। তারা জানে না, ইজরাইলি বাহিনীর আক্রমণে যে হতাহতের ঘটনা ঘটে সেগুলা দুর্ঘটনা না, পরিকল্পিত এক গণহত্যার অংশমাত্র। তাছাড়া কোন সাধারণ নাগরিককে আহত বা নিহত করা নিয়ে কোন সেনা সদস্যকে জেরা বা শাস্তির মুখোমুখি হবার কথা শোনা যায় নাই আজ পর্যন্ত। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের আপন ভিটা মাটি ঘর বসতি থেকে জোর করে তাড়িয়ে নিজেদের ‘বসতি’ বানায় যেই দেশপ্রেমিক ইজরাইলিরা, এই বসতি স্থাপনকারীরাও কি উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে কিচ্ছু জানে না! সেই আলাপে যান নাই লেভি। তিনি শুধু বলছেন, ইজরাইলিদের বেড়ে ওঠা অংশটি নতুন কোন ধরনের রাজনৈতিক ইচ্ছায় নিজেদেরকে সরব করে তুলতে পারছে না।
হামাস নিয়ে তিনি যা বলেন
এই বইয়ের একটি অধ্যায়ে তিনি হামাসের সাথে আলোচনার কথা বলেছেন। সেখানে তিনি হামাসের সমালোচনা করে ১৯৮৭ সালের প্রথম ইনতিফাদাকে অপ্রয়োজনীয় ও ঘৃণাসূচক মনে করেন। ২০০৮ সালে গাজায় হামাসের অপারেশন কাস্ট লিডকে হামাসের নিজের ও জনগণের জন্য বোকামিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, হামাস এটা নিজের জনগণের জন্য ডেকে এনেছে। তাই বলে ইজরাইল যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এটি তারও কোন অজুহাত হতে পারে না। ফিলিস্তিুনি জনগণ ক্রমেই নিরস্ত্র প্রতিরোধের গুরুত্ব বুঝে উঠছে।
দ্যা পানিশমেন্ট অব গাজা
গিডন লেভি
ভারসো, যুক্তরাজ্য
১ মে ২০১০
>লেখাটি পাক্ষিক চিন্তা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত।
Comments are closed.