অনেকদিন পর কাছাকাছি সময়ে দুইবার চট্টগ্রাম গেলাম। সর্বশেষ গত তিন জানুয়ারী। উপলক্ষ্য নাটকের দল অনাদিকল্পের নতুন নাটক সক্রেটিসের শেষ দিনগুলোর প্রথম প্রদর্শনী দেখা। চট্টগ্রামের ‘ফেইম স্কুল অব ডান্স, ড্রামা এন্ড মিউজিক’ এর এক যুগ ফুর্তি অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে নাটকটির প্রদর্শনী হলো। কমলাপুর ইস্টিশনে পৌছলাম রাত দশটায়। আরজু ভাই মোবাইলে টিকিট কেটে দিয়ে বললেন, ট্রেন ছাড়ার এক ঘন্টা আগে যেতে হবে। ইস্টিশনে কোথাও বাংলালিংক ই-টিকেটের চিহৃ টিহৃ দেখি না। অনুসন্ধানে গেলাম। সেখানে বলল, সামনের বুথে যান। দেখেন এত রাত পর্যন্ত কেউ আছে কিনা। অবাক লাগল, এইভাবে বলতেসে না থাকলে বলার কিছু নাই যেন। শেষমেষ মিনিট দশেক পর লোক আসল।
ট্রেনে উঠলাম দশটা আটান্ন মিনিটে। আগে থেকে ভাবতেসিলাম শীত কেমন লাগবে। সেই শীত উস্কে দিচ্ছিল এসি। যাত্রীদের অনেক ছিল্লা-ছিল্লি এসি ধরে টানাটানি কেউ আসল না। সারারাত ঘুমাতে পারি নাই। ট্রেন ছাড়ল সাড়ে বারোটায়। ট্রেন চট্টগ্রামে পৌছল সকাল এগারোটায়। আল্লায় মালুম ট্রেন কেমনে চট্টগ্রাম পৌছল।
অনেকদিন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক স্যারকে দেখি না। ভাবসিলাম ক্যাম্পাসে যাবো। কিন্তু এই ভরদুপুরে যাবার কোন সঙ্গী পাবো না। সুতরাঙ, সেই চেষ্টা বাদ। ইস্টিশনে এক কাপ কফি খেয়ে সোজা টিআইসি বা থিয়েটার ইনস্টিটউট চিটাগাঙ এর দিকে দৌড়। মনে পড়তেসিল মিশুর কথা। যারে প্রতিবার ট্রেনে তুলে দিতে চোখ ভিজে উঠত। ছয় ছয়টা বছর সাটল ট্রেনের পেছনে দৌড়িয়েসি। আহা। আগের দিন অরুপ বলতেসিল ক্যাম্পাসে গেছে, তার নাকি খুবই খারাপ লাগসে। মনে হয় বিয়ে করে কিছুটা আবেগ-টাবেগ তৈরি হইসে। উল্টা আর কি।
টিআইসি পৌছে অনাদিকল্পের সবার সাথে দেখা। ওরা ফাইনাললি লাইট, সেটের প্রস্তুতি নিয়া ব্যস্ত। মানুষ এতো পরিশ্রম করে মঞ্চ নাটক কাজ করে। আমার দ্বারা কখনো হবে না। একই কাজ কতবার যে করে। মজার বিষয় হলো প্লেটো আর ক্রিটো পাট ছাড়া সবাইকে চুল সাদা করতে হবে। কেউ কেউ আবার দাড়ি লাগাবে। এতো প্রাণবন্ততা দেখে কোথায় যে ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। এরমধ্যে পুরানা এক দোস্তকে জানালাম নাটক দেখতে চট্টগ্রাম আসছি। সে খোচা দিয়ে বলল, সব বন্ধুর ডাকে তো সাড়া দাও না। মজা লাগল, সময়ের সাথে কেউ আবেগী হয় আবার কেউ খোচাপ্রবণ হয়ে যায়। আমারও নিশ্চয় এমন কিছু না কিছু যোগ বিয়োগ ঘটেছে।
এরমধ্যে নাট্যকার তানবীর মুহাম্মদ আসলেন। চমৎকার গল্প লেখেন। নাটক লিখছেন অনেকদিন ধরে। তিনি অভিনয়ের সুক্ষ বিষয়গুলো ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। বুঝা যাচ্ছিল উনাকে সন্তুষ্ট করা কঠিন হবে। তানবীর ভাই থেকে বুঝার চেষ্ঠা করলাম এই সক্রেটিসে আলাদা কি আছে? তিনি বললেন সক্রেটিস জ্ঞানের পয়ম্বর। তিনি আল-কিন্দির কাজ নিয়ে কথা বললেন। গ্রীক দর্শনরে স্বর্ণযুগের পর আল-কিন্দির হাত ধরে এইসব আলোচনা আবার শুরু হয়। সেই যাইহোক তিনি পশ্চিমা বস্তুবাদের বাইরে সক্রেটিসকে দেখাতে চান। দেখা যাক কেমন হয়। একসময় আমরা অনেকে মনে করতাম সক্রেটিস পয়ম্বর ছিলেন। আসলে তার পয়ম্বর হওয়া না হওয়া দিয়ে কি আসে যায়। যেমন, লালন পয়ম্বর না।
দুপুর তিনটে পর্যন্ত মহড়া। তারপর খাওয়া দাওয়া। এরমধ্যে শুভ্রাকে উইশ করলাম। তার জম্মদিন ছিল। কাছাকাছি কি এক ননদের বাসায় ছিল। দেখা হয় নাই। কখনো কখনো মানুষের সাথে জানাজানি-দেখাদেখি কোন কিছুকেই সত্য মনে হয় না। সময় হয়তো বৃত্তের মতো। তাই অনেক কিছু পুনরাবৃত্তি করে। তাই মানুষ পুরানা অনেককিছু ছাড়া টিকে থাকে। কোন এক ফাকে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকাইয়া ছিলাম। সপ্তাহ দুয়েক আগে এই টিআইসিতে রানওয়ে দেখে গেসিলাম। এই দুই সময়ে কত ফারাক। সব অবাস্তব মনে হয়। বছর পাচেক আগে বিট্রিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে কি যেন মুভি দেখসিলাম। ঠিক, দিল্লী অনেকদূর। মাঝে মাঝে বাবা ফোন কওে খবর নিচ্ছিলেন। কি করতেসি, খাইসি কিনা। সবই কি অর্থহীন।
চারটেয় মেকআপ শুরু হলো। বাইরে দাড়াই সিলাম। মেকআপকে কেমন যেন ভালগার জিনিস মনে হচ্ছিল। কেন? স্মৃতি খুড়াখুড়ি করে পাইলাম কুষ্টিয়ার বেহুলা ভাসানের পুরুষের নারীর সাজার দৃশ্য। এইসব নাটকে পুরুষের নারী সাজার মাঝে কি কি ভাবের বিষয় আশয় আছে। কিন্তু নারীর সাজার বিষয়টিকে ভীতিপ্রদ আর ভালগার মনে হইসে। ব্যাপারটারে পুরুষতান্ত্রিক আকারে নিয়েন না। মানুষের মাঝে নানান কিছু থাকে। মেকআপ রুমে গিয়ে দেখলাম উফ মেকআপ নেয়া বিশেষ করে দাড়ি-টাড়ি নেয়া জটিল ব্যাপার।
আমিন ভাই, একজন সাধক মানুষ। শামীম ভাই, শুদ্ধ কবি। জানি এইবারও তাদের সাথে দেখা হবে না। সেই আগে থেকে শুদ্ধ মানুষদের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করত না। কেন কে জানে। মানুষ মনে হয় শুদ্ধতার ভার কমই বইতে চায়। মনে মনে আশা করতেসিলাম উনারা আসবেন। আসেন নাই। অনেকদিন আগে সোহেল বলতেসিল, ফেরেশতার চেয়ে শয়তানের সঙ্গ অধিক। কিন্তু মানুষের জগতে কেউ ফেরেশতাও না আবার শয়তানও না। মানুষ মানুষই।
ছয়টা দশ হবে হয়তো। নির্ধারিত সময়ের সামান্য পরে নাটক শুরু হলো। হা করে সংলাপ শুনে যাবার নাটক এটা। শুনে গেলাম। বিশেষ করে সক্রেটিসের জবানবন্দীর অংশটুকু। মাসউদুর রহমানের অভিনয় আর অবশ্যই মুখস্থ করার ক্ষমতা হৃদয় বিদারক ধরণের অসাধারণ। আহা, মানুষ কত কি পারে। সংলাপের মাঝখানে দাড়ির কিছু অংশ খসে গেলেও মাসুদ আর দর্শক সবাই অবিচল। এতো কিছু খেয়াল করার টাইম নাই কারো।
মোকাররম ভাই আর মোরশেদ ভাই। দুজনেই কবি। মোরশেদ ভাইও ব্লগ লেখেন। ভিন নামে। ইদানিং সেক্যুরারিজম ও সুফীবাদ নিয়ে মেতেছেন। অনেককিছুই জানতে পারতেসি। মাসুদ জাকারিয়া , তিনিও কবি মানুষ। দেখা হলো। মেহেদী হাসান ও রিফাত হাসানের সাথে দেখা হলো না। পরিচিত অনেকগুলো মানুষকে অনেকদিন পর দেখলাম। ভালো লাগল। তানবীর ভাই ও অনাদিকল্পের সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সবাই কতো আন্তরিক। দৃশ্যপট থেকে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছেন। দূরে কোথাও। সেখানে আবার পরিচিত সকলের সাথে দেখা হবে। কেউ ভাই কেউ বন্ধু কেউ পিতা কেউ পুত্র। তানবীর ভাই বারবার বলসিলেন তার সাথে যাবার জন্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের অনেক বৃত্ত। যেগুলো সে পেরুতে পারে না। আমিও তাই। তানবীর ভাই আপনার ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেসে। ভালোবাসার মূল্য দিতে পারব তেমন আশা করি না।
দাউদের ভেসপায় চড়ে ফিরসিলাম। ভেসপায় উঠা নিয়া মজার মজার কিছু কাহিনী আছে। এইবারও ভাবসিলাম উঠতে পারব না। সব মওলার ইচ্ছে। দাউদ তার বাসা থেকে চট্টগ্রাম ইস্টিশান পর্যন্ত এলো। ট্রেন ছাড়ল ঠিক এগারোটায়। তখনও দাউদের সাথে কথা শেষ হয় নাই। মনে হলো, যাদের সাথে কথা কখনো শেষ হয় না তারাই সবচেয়ে কাছের মানুষ। কোনটা সত্য আল্লায় জানে। তারপর অচেনা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
এতো এতো কথাবার্তা, উৎসর্গ: সাজি আপুকে । আমিও তার মতো মানি, বেচে থাকাটা দারুন ব্যাপার।
🙂
গুড পোস্ট। বহুদিন চট্টগ্রাম যাইতে পারতেসি না 🙁 🙁
মন পোড়ে
শুকরিয়া। আমি গেছি প্রায় একবছর আগে। সেপ্টেম্বর ২০১১। এরমধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে। সম্পর্কও। সামনের মাসে যাইতে পারি। 🙂