হেগেল, খ্রিস্টীয় ট্রিনিটি ও কতিপয় ভুল বোঝাবুঝি

পিটার বেনসনের ‘হেগেল অ্যান্ড ট্রিনিটি’ অবলম্বনে এ লেখা। এবং অনুবাদকের কতিপয়ও বোঝাবুঝির আশঙ্কা সত্ত্বেও লেখকের নির্দেশিত কিছু বোঝাবুঝি ও তার দেখানো ‘সঠিক’ পথই আমাদের গন্তব্য। যেখানে জর্জ উইলহেম ফ্রেডরিখ হেগেলের ‘তিন’ সংখ্যাটির প্রতি অবসেশন ব্যাখ্যা করেছেন পিটার। তার মতে, এ বিষয়ে কিছু বিভ্রান্তি আছে। আর বিভ্রান্তি তৈরিতে কার্ল মার্কসেরও কিছু ভূমিকা আছে!

পিটার লেখার শুরুতে ব্রিটেনের ব্রায়ান মাগীর উদাহরণ টানেন। নিজ দেশে দর্শনকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ব্রায়ানের অনেক অবদান আছে। তার লেখায় প্রচুর তথ্য আছে, গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক চিন্তাগুলোকে সংক্ষিপ্ত ও সহজ করে তুলে ধরেছেন আগ্রহীদের সামনে। এখানে ‘তবে’ দিয়ে একটা প্রসঙ্গ টেনেছেন পিটার। হেগেল খুবই কঠিন। যদি তাকে নিয়ে লেখায় যদি গুরুত্বপূর্ণ গলদ থাকে— তাহলে তো সমস্যা আরও বাড়ে। এ কারণে হেগেলের চিন্তা নিয়ে ব্যাপক ভুল বোঝাবুঝি ছড়িয়েছে।  

হেগেল প্রসঙ্গে ব্রায়ান অবশ্য ঠিকভাবেই বলেছেন, “ধারণা, ধর্ম, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ নিজেই— সবকিছু সবসময় পরিবর্তিত হচ্ছে।” কিন্তু এরপর যা বললেন, হেগেল “(এই প্রক্রিয়াকে) বর্ণনা করার জন্য একটি শব্দভাণ্ডার তৈরি করলেন। পুরো প্রক্রিয়াটিকে তিনি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া বা কেবল দ্বান্দ্বিক বলেছিলেন, এবং একে তিনটা প্রধান পর্যায় নিয়ে গঠিত হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন … থিসিস, অ্যান্টিথিসিস, সিন্থেসিস।”

হেগেলের দর্শনের একটা ‘ফ্যাক্ট’ আকারে এই তিনটা পর্যায় পাঠ্যপুস্তক ও জনপ্রিয় ধারণাগুলোতে বারবার উঠে এসেছে। যদিও হেগেল নিজে কখনো দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করতে ‘থিসিস, অ্যান্টিথিসিস, সিন্থেসিস’ শব্দগুলো ব্যবহার করেননি। তবে এটা সত্য যে তার লেখাজোখায় কদাচিৎ ‘অ্যান্টিথিসিস’ শব্দটির দেখা মেলে। কিন্তু তার লেখার বিশাল সম্ভারে কখনো দ্বান্দ্বিকতার তৃতীয় পর্যায় হিসেবে ‘সিন্থেসিস’কে উল্লেখ করা হয়েছে— এমনটা পাওয়া যায় না।

এই তিন শব্দের ব্যবহারের সূত্রপাত হেগেল সম্পর্কে তার মৃত্যুর সামান্য পরে প্রকাশিত একটি বইয়ে। আফসোস, এর সমালোচনার জন্য তিনি জিন্দা ছিলেন না। এই পরিভাষা আবার ব্যবহার হয় ১৮৪৭ সালে তরুণ দার্শনিক কার্ল মার্কসের একটা বইয়ে এবং ক্রমশ এর প্রভাব বাড়তে থাকে। বিষয়টি অবাক করা বৈকি। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে মার্কসের নামেই ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ পরিভাষাটি প্রচলিত। ইতিহাসের কী দারুণ প্রতিশোধ!

হেগেলের দর্শন সম্পর্কে মার্কসের বিবরণ মোটামুটি সঠিক। কিন্তু ‘সিন্থেসিস’ শব্দটির ব্যবহার পরবর্তীকালে গুরুতর ভুল বোঝাবুঝি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি বহন করেছেন ব্রায়ান। তিনি লেখেন, “কারণ সিন্থেসিস হলো নতুন পরিস্থিতি, এটি নতুন বিরোধ ধারণ করে, এবং সুতারাং থিসিস, অ্যান্টিথিসিস, সিন্থেসিসে নতুন triad বা ত্রয়ীর সূচনা হয়।” অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এই ধরনের চিন্তা অনেক মানুষের জন্য হতবুদ্ধিকর এবং তা-ই হেগেলের চিন্তাকে ঘিরে অতিরঞ্জিত রহস্যের ধোয়া ছড়াতে অবদান রেখেছে।

হেগেল ও কার্ল মার্কস

থিসিস ও অ্যান্টিথিসিস বিবেচনা করলে, নতুন বিরোধগুলো সিন্থেসিসের মধ্যে বিদ্যমান বলে মনে হচ্ছে? আরেকটু বিস্তার ঘটিয়ে বললে, যদি তা-ই হয় তাহলে এরা কেন মূল বিরোধগুলো যা এদের তৈরি করেছিল তার থেকে ভিন্ন? অথবা এই সিন্থেসিস কি নতুন থিসিস গঠন করে, যার বিরুদ্ধে এর সমকক্ষ ও বিপরীত অ্যান্টিথিসিস তৈরি করতে হবে? উভয় ব্যাখ্যাই এমন একটি প্রক্রিয়া নির্দেশ করে যা অনির্দিষ্টকালের জন্য চলবে। একটি ওয়াল্টজ ছন্দের মতো:

1, 2, 3,                    

           1, 2, 3,         

                      1, 2, 3,      

……. অনন্তকালের জন্য।

এই যদি হয় ঘটনা, তবে এটি হেগেলের ভুল ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা। বরং ‘দ্বান্দ্বিকতা’ নিয়ে বুঝতে হলে আরও সতর্ক পর্যবেক্ষণ দরকার। এ উপলক্ষে ত্রয়ী ও পিরামিডের ধারণায় আসা যাক।

আগে-ভাগে বলে নেওয়া ভালো, সবকিছুকে তিনে ভাগ করার প্রতি অবেসেশন ছিল হেগেলের। এর জন্য তার বই পড়া লাগে না, শুধু সূচি দেখলেই বোঝা যায়। সেখানে তিনটি সেকশন থাকে, এরপর প্রতিটি সেকশনের তিনটি সাব-সেকশন, এগুলোও সাব-সাব-সেকশন আকারে থাকে। এমনকি স্বতন্ত্র অনুচ্ছেদে (এমনকি স্বতন্ত্র বাক্যগুলোতে) প্রায়শই তিনটি পৃথক অংশ থাকে। তিনের প্রতি তার এই অবসেশন কেন? অন্য অনেকের মতো হেগেলও কি বিশ্বাস করতেন এই সংখ্যাটির একটি রহস্যময় অর্থ রয়েছে? তিনি আসলে রহস্যে বিশ্বাস করতেন না। এর বিপরীতে, তিনি ভেবেছিলেন একেবারে সবকিছু শেষ পর্যন্ত ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আর তার লেখার মধ্যেই বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যার ভিত্তি রয়েছে (যাকে তিনি অ্যাবসুলেট নলেজ বা পরম জ্ঞান বলেন), এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের তালাশ করা ‘থিওরিস অব এভরিথিংক’-এর অনুরূপ বলা যায়। এর মানে নয় যে, একজন একদম সবকিছু জানবে। বরং বলা হয়, এই জাতীয় সমস্ত জ্ঞানের জন্য কেবলমাত্র একটি সাধারণ অন্তর্নিহিত কাঠামো রয়েছে।

হেগেলের বিপুল রচনায় আমরা তিনটি ভাগ পাই- তর্কশাস্ত্র, প্রকৃতি এবং স্পিরিট বা আত্মা সম্পর্কিত চিন্তা (যেখানে মানব জীবনের সবকিছু যুক্ত)। নিজের সমস্ত কাজই দ্বন্দ্বিক নিয়মে গঠন করেছেন, এর উপবিভাগ ধীরে ধীরে ত্রয়ীতে বিভক্ত হয়েছে। এবং এটি প্রমাণ করে যে হেগেলের দ্বান্দ্বিকতা কোনো অন্তহীন ওয়াল্টজ নয়। মানে এই রকম নয় –

1, 2, 3,                    

           1, 2, 3,         

                      1, 2, 3,      

এর বদলে এটাই দেখা যায়-

দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার আকার পিরামিডের মতো। এর সাব-ক্যাটাগরিগুলো এরপর উপ-বিভাগে বিভক্ত হতে থাকে। কিন্তু শীর্ষে একক এ-তে (পরম জ্ঞান) সবকিছু মিলিত হয়। এই পরম জ্ঞানই তিনটি পরিপ্রেক্ষিতে বিভক্ত- তর্কশাস্ত্র, প্রকৃতি ও আত্না। এদের রয়েছে সাব-ক্যাটাগরি। এরা ভাগ ভাগ হয়ে পিরামিডের নিচের দিকে যেতে থাকে।

অবশ্য আমরা কেউ— এমনকি হেগেলও পরম জ্ঞানের অবস্থান থেকে অনুসন্ধান শুরু করি না। বরং এখানে উল্টোটি অর্থাৎ শেষ থেকে শুরুর আশা করি। জ্ঞানের ছোট ছোট এলাকাগুলো আমরা জীবনের ধারাবাহিকতায় ও মানব ইতিহাসের দীর্ঘ পরিশ্রমী পথ ধরে ধীরে ধীরে অর্জন করি। হেগেলের মতে, ইতিহাসেরও একটি দ্বান্দ্বিক কাঠামো আছে। মূলত একটি পিরামিডের নিচ থেকে উপরের দিকে যাওয়ার প্রক্রিয়া। ইতিহাস শুধু একগুচ্ছ ঘটনার এলোমেলো অনুক্রম নয়। এর প্যাটার্ন অংশত তৈরি হয়— কারণ আমরা অতীত থেকে শিখি, এবং এর পুনরাবৃত্তি থেকে নিজেদের বিরত রাখি। আমাদের ক্রমবর্ধমান জ্ঞান শুধু পৃথক ফ্যাক্টসের সামগ্রিক সংগ্রহ নয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণের মোড়ে এসে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি সচেতনতার নতুন পথ ধরে উঠতে পারে, পিরামিডে একধাপ উপরে ওঠে।

এটা এমন নয় যে আমি যা জানি তার সবকিছুর সংশ্লেষণ ঘটে, বরং এক পর্যায়ে সব সম্ভাবনা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন আমরা পুরেপুরি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজতে বাধ্য হই। যে গোলকধাঁধায় আমরা আটকে পড়েছি, তার থেকে বের হতে— নাগালে থাকা প্রতিটি রাস্তায় তালাশ করে যা পাই, তার ভিত্তিতে আমরা বিশ্বের নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে বাধ্য হই। অবশ্য একটা স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ সংক্ষিপ্ত সময়ের পর, দেখতে পাই আমরা নতুন ও সম্ভবত আরও গভীর গোলকধাঁধার মধ্যে রয়েছি। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, একে হেগেল ‘হতাশার মহাসড়ক’ বলেছেন। কেবল হতাশা ও ব্যর্থতায় আমাদের পা সামনে এগিয়ে যায়।

কোথা থেকে যাত্রা করব তা নির্ভর করে কোন ঐতিহাসিক সময়ে জন্মেছি। যেমন; হেগেলের জন্ম ১৭৭০ সালে, কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থও একই বছরের। দুজনই তরুণ বয়সে ফরাসি বিপ্লব দ্বারা পুরো ইউরোপ জোড়া তোলপাড়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ওয়ার্ডসওয়র্থ লিখেছিলেন, “Bliss was it in that dawn to be alive,” কিন্তু এই পরম সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

অন্যদিকে নিজের ‘ফেনোমেনোলজি অব স্পিরিটে’-এ ফরাসি বিপ্লব নিয়ে অধ্যায়ে চমকে দেওয়া শিরোনাম দেন হেগেল- ‘চরম স্বাধীনতা ও সন্ত্রাস’। হেগেল এ আক্ষেপ আটকে ছিলেন না যে ভুল হয়ে গেছে, বরং ইতিহাস যেন একটি কাঙ্ক্ষিত পথ অনুসরণ করছে। অতীতের দিকে ফিরলে দেখি, বিপ্লবের মাধ্যমে স্থিতিশীল সমাজ কাঠামো ভেঙে যাওয়ার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে এ জাতীয় সন্ত্রাসের উত্থান সম্ভব। তবুও এই ভাঙন নিজেই ফরাসি সমাজ ব্যবস্থার আগের অবস্থার বিরোধগুলোর অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে ছিল। যে স্বাধীনতা ফরাসি সমাজে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে লাভার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল তা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার বৈধ দাবিগুলোকে সামঞ্জস্য করার জন্য নতুন সামাজিক কাঠামোর প্রয়োজন। যাই হোক, এটা স্পষ্ট যে, পরবর্তী পদক্ষেপ সম্ভবত স্বাধীনতা ও সন্ত্রাসের সিন্থেসিস (সম্ভবত এখানে তাদের সেরা অংশগুলো থাকবে)।

আদতে, ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতার পরবর্তী পদক্ষেপ অপ্রত্যাশিত মোড় নেয়। অদ্ভুতভাবে, একনায়কের (নেপোলিয়ন) অধীনে ব্যক্তি স্বাধীনতা সর্বোত্তমভাবে (এই নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে) সংহত ও বিকাশ লাভ করে। ঐতিহাসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এই বিরোধী ফলাফলগুলো হেগেলের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে বারবার এসেছে।

স্বাধীনতা, সন্ত্রাস ও একনায়কতন্ত্রের এই যাত্রায় ইউরোপের ইতিহাস পুরোপুরি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। উদারনৈতিক রাজনৈতিক দর্শন এবং এর অনুসরণে ফ্রান্সের বিপ্লবীদের দ্বারা প্রথমবার মানুষের সার্বজনীন অধিকার ঘোষিত হয়। যার ওপর সবকিছু অধীনস্ত। উদারনৈতিক সমাজে ব্যক্তি অধিকারের চাহিদা ও সামাজিক সংসক্তির প্রয়োজনীয়তা একটি লক্ষণীয় ও চলমান দ্বন্দ্ব দ্বারা চিহ্নিত হয়। হেগেলের ‘লেকচারস অন দ্য ফিলোসফি অব হিস্ট্রি’ ধরলে, এই বিবাদ ও সমস্যা ইতিহাস দখল করে আছে। এবং যার সমাধান ভবিষ্যতে সম্পন্ন হবে। সুতরাং, তিনি বিশ্বাস করতেন না উদারনীতিবাদ ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ হিসেবে চূড়ান্ত। এমন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কোজভ ও ফুকুয়ামার মতো চিন্তাবিদরা প্রায়শই ভুলভাবে তার ওপর আরোপ করে।

হেগেলের দৃষ্টিকোণ থেকে উদারপন্থা নৈতিক চিন্তার এমন একটি নতুন বিন্যাস প্রচারের অনুমতি দেয় যা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে তার কেন্দ্রে স্থান দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্রমিক ঘটনা থেকে হেগেলের পদ্ধতি উঁচু পর্যায়ে যায়, যেখানে নৈতিক চিন্তার বিভিন্ন রূপের মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটে। পুরো স্তরটির (নৈতিকতার) উচ্চতর পর্যায়ে কেবল একটি মাত্র উপাদান থাকে, যাকে তিনি গিস্ট (স্পিরিট, যাকে এখানে আত্মা বলছি) বলে ডাকেন।

এবার আসবো ত্রিভুজ ও ট্রিনিটির ধারণায়। হেগেলের চিন্তা পদ্ধতিকে কমপক্ষে দুটি দিক থেকে দেখা সম্ভব। একদিকে, একটি প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ও অন্তর্দৃষ্টির অদল-বদলের মাধ্যমে মানবতা ধীর অগ্রগতিতে পরম জ্ঞানের দিকে উঠতে থাকে। এটি আমরা পাই ‘ফেনোমেনোলজি অব স্পিরিটে’। অন্যদিকে, একদম সবকিছুর পরিপূর্ণতা থেকে শুরু করা যায়, যা নিজেই পরম এবং দেখাতে পারি এটি কীভাবে ছোট থেকে ছোট পরিপ্রেক্ষিতে ভাগ হচ্ছে, যতক্ষণ না বিশ্বের এবং মানব জীবনের সব ভিন্ন ভিন্ন ডোমেইন সমগ্রে নিজের স্থানটি প্রকাশ করছে। এই পদ্ধতি পাওয়া যাবে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলোসফিক্যাল সায়েন্সেসে’।

প্রথম যাত্রা কেবল এগিয়ে যায়, কারণ প্রতিটি পর্যায়ে অসন্তুষ্ট মানুষ দেখতে পায় যে সম্পূর্ণ, সুসংহত ও অটল কোনো সত্যে পৌঁছাতে পারছে না। হেগেলের কাছে সম্পূর্ণ সত্য শুধু সমগ্রের মাঝে পাওয়া যায়, অংশের মধ্যে নয় এবং এই ক্ষেত্রে সমগ্রের মধ্যে প্রতিটি অংশের নির্ধারিত স্থান রয়েছে। এই সমগ্র (সম্পূর্ণ বা পরম) শুধু সব দ্রব্য বা সাবসটেন্সকেই নয় সবজেক্টিভিটিকেও ধারণ করে, যা বাস্তবতার মধ্যে সমানভাবে একটি অংশ। এই সমগ্র হেগেলের কাছে একটি ঐক্য। মহাবিশ্বের আত্মচেতনা হিসেবে এটি মূলত ঈশ্বর। বিভিন্ন উপলক্ষে এ কথা হেগেল বলেছেনও।   

ঈশ্বর সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি আনঅর্থোডক্স, ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক আরও বেশি আনঅর্থোডক্স। তবুও হেগেল নিজেকে একজন খ্রিস্টান বলতেন এবং বলতেন, পৃথি্বীতে ঐতিহাসিকভাবে সব ধর্মের বিকাশ ঘটেছে, আর খ্রিস্ট ধর্মের মধ্যে সত্যের সম্পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। খ্রিস্টীয় চার্চের নানান ধরনের বিভেদের মধ্যে হেগেল তার আলোচনার জন্য বেছে নিয়েছেন ট্রিনিটি। যেখানে ঈশ্বরের একক সত্তার মধ্যে রয়েছে পিতা, পুত্র ও পবিত্রাত্মা বা স্পিরিট।

যদি হেগেলের পিরামিডের প্রক্রিয়ার দিকে তাকাই। অর্থাৎ, সম্পূর্ণতা দিয়ে শুরু এবং দেখি কীভাবে সবকিছু এর মধ্যে আছে। আরও পরিষ্কারভাবে ত্রিপক্ষীয় (tripartite) বিভাগের উৎস দেখতে পাই, যার মধ্যে বারবার এভাবে ভাগ হতে থাকে। সবকিছুর উৎস মূল ত্রয়ীর মিলনে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। এভাবে হেগেলের দ্বান্দ্বিকতাকে উপলব্ধি করতে থিসিস, অ্যান্টিথিসিস ও সিন্থেসিস এই তিন আধা-যৌক্তিক পদের চেয়ে পিতা, পুত্র ও পবিত্রাত্মা বেশি সহায়ক।

এর মানে হেগেলের পদ্ধতি চূড়ান্তভাবে খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে এবং অবিশ্বাসীদের কাছে এর প্রাসঙ্গিকতা নেই? আসলে তা নয়। হেগেল ভেবেছিলেন তার দর্শন বিশ্বাসের সঙ্গে জ্ঞানকে প্রতিস্থাপন করে। ঈশ্বরের ত্রিত্ববাদী ধারণা বিশ্বাসের জায়গা থেকে নেওয়া হয়নি। তবে বিশ্বের ত্রয়ী কাঠামো ও অভিজ্ঞতা দ্বারা এটি প্রকাশিত হয়েছে। হেগেলের দ্বান্দ্বিকতা কোনো যৌক্তিক ফর্মূলার পুনরাবৃত্তিমূলখ প্রয়োগ নয়। যেমন- থিসিস; নেগেশন অব থিসিস, নেগেশন অব দ্য নেগেশন ইত্যাদি। বিপরীতে, হেগেলের উক্ত প্রতিটি ত্রয়ী নতুনভাবে শনাক্ত হয়েছে, প্রতিটি পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ধরে, আগেই পরিচিত কোনো পথ অনুসরণ না করে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে উল্লেখিত ঈশ্বরের তিন পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে একত্রিত হয়েছে।

রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্মে ট্রিনিটি

ট্রিনিটি মতবাদ প্রথম বিস্তারিত পাওয়া ৪০০ খ্রিস্টান্দে লিখিত সেন্ট অগাস্টিনের ‘ট্রিটিজ ডে ট্রিনিটেট’ বইয়ে। এ বিষয়ে পরবর্তী সব আলোচনার ভিত্তি এই বই। যেমন; থমাস একুইনাসের ধর্মীয় দর্শন।

হেগেলের আগে বিশ্বজগত ও মানুষের মধ্যে ২২টি ভিন্ন ধরনের ত্রয়ীর উদাহরণ পেয়েছিলেন অগাস্টিন, যা ঐশ্বরিক ট্রিনিটির অনুরূপ। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের মন, জ্ঞান ও ভালোবাসা। যা হেগেলের পদ্ধতির মূল বিভাজন তর্কশাস্ত্র, প্রকৃতি ও আত্মার খুবই সমান্তরাল। তার কাছে তর্কশাস্ত্র অ্যারিস্টটলের অবরোহ পদ্ধতির মতো একগুচ্ছ নীতির সেট নয়। বরং ধারণাগুলো নির্দিষ্ট কোনো বস্তুর দ্বারা উপস্থাপনের আগেই একটি নিয়মতান্ত্রিক বিন্যাস। হেগেল অর্ধ রূপকার্থে নেন একে, তার তর্কশাস্ত্রের মূল বিষয় হলো “নিজের চিরন্তন সত্তার মধ্যে ঈশ্বর প্রকাশিত হন প্রকৃতি ও একটি সসীম মন সৃষ্টির আগেই।” অগাস্টিনের ‘সৃজনশীল নীতি’ অনুসারে, তর্কশাস্ত্র বা লজিক তাই পিতা ঈশ্বরের সঙ্গে একত্রিত হতে পারে।

প্রকৃতি হলো সৃষ্ট জগৎ, যার সম্পর্কে আমরা জ্ঞান অর্জন করি। সেন্ট জনের গসপেলে বর্ণিত বিখ্যাত ‘শব্দ’ এখানে প্রযোজ্য, যেখানে ‘শব্দ (অর্থাৎ ধারণা) মাংসে (অর্থাৎ মূর্ত ও বিশেষ) পরিণত হয়’। যিশুর আবির্ভাবের মাধ্যমে সার্বিক (ঈশ্বর) পরিণত হয় বিশেষে (একক মানুষ)। একইভাবে, হেগেলের ‘প্রকৃতির দর্শন’ দেখায় কীভাবে (আগে থেকে নির্ধারণ ছাড়াই) ‘তর্কশাস্ত্র’-এর দেখানো পথ ধরে সার্বিক ধারণার বিন্যাস বিশেষ কোনো ফ্যাক্টসের জ্ঞান বিজ্ঞানসম্মতভাবে তালাশ করে।

হেগেলের পদ্ধতির তৃতীয় অংশ হলো আত্মার দর্শন। আত্মা বা স্পিরিট (জার্মান গিস্ট) শব্দটিকে একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন হেগেল, যা তার দর্শনের একদম মর্মস্থলের রয়েছে। আত্মার সঙ্গে সবসময় ‘সম্পর্ক’ জড়িত। একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির অবশ্যই চেতনসম্পন্ন, তবে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কই তাকে আত্মার (নিছক চেতনার চেয়ে উচ্চতর) পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। এই স্তরটিতে শিল্প, ধর্ম ও সমাজের সব কিছুই অন্তুর্ভক্ত।

সমান্তরালে অগাস্টিন যেভাবে ট্রিনিটিকে প্রকাশ করেছেন তা চমকে দেওয়ার মতো। ‘ট্রিটিজ’-এর বুক ফিফটিনে জানান, প্রেমের দ্বারা পিতা ও পুত্র যুক্ত। দুইয়ে উপস্থিত ভালোবাসাকে ‘স্পিরিট’ বা পবিত্রাত্মা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।  সুতরাং পবিত্রাত্মা যেমনটা ভাবা হয় তত পৃথক সত্তা নয় (যা অস্পষ্ট ও প্রতীকী ঘুঘু আকারে রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্মে দেখা যায়) বরং পিতা ও পুত্রের মধ্যে প্রেমের মূর্তপ্রকাশ। পিতা, পুত্র ও তাদের মধ্যে যে সম্পর্ক (প্রেম), তা হলো আত্মা (হেগেল ঠিক এভাবেই বুঝেছেন)।

এ আলোচনায় হেগেলের দর্শনে ‘সমগ্রের’ প্রাসঙ্গিকতা সংক্ষিপ্তাকারে উঠে এসেছে। কিন্তু ‘দ্য ফেনোমেনোলজি অব স্পিরিট’-এর বহুল আলোচিত ও খুবই দরকারি প্রথম অধ্যায়টি বিবেচনায় আনলে দেখা যায়, তিনি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যকে সন্দেহাতীত সত্যের ভিত্তি হিসেবে ধরে নেওয়া অভিজ্ঞতাবাদী তৎপরতার সমালোচনা করেছেন। এই বিষয়ে তার বিস্তারিত আলোচনা আজও প্রভাববিস্তারকারী। এই সম্পর্কিত পুরো কাঠামোটি বেশ উত্তেজনাকরও বটে। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে বস্তুর তাৎক্ষণিক জ্ঞান হয় এ বিষয়টি প্রথমে বিবেচনায় আনেন। এরপর এটি বিভ্রান্তিকর বলে প্রমাণিত হলে তখন বিবেচনায় নেন যে কমপক্ষে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবশেষে তিনি দেখান বিষয়ী ও বিষয়ের সম্পর্কে সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হওয়া উচিত।

এই প্রক্রিয়া অনুসারে এদের আমরা থিসিস, অ্যান্টিথিসিস ও সিন্থেসিস বলতে পারি। কিন্তু খেয়াল করুন ‘সিস্থেসিস’কে সাধারণত যেভাবে বর্ণনা করা হয়, এখানে তৃতীয় অবস্থাটি প্রথম দুটির সংমিশ্রন নয়। তাদের সম্পর্কের দিকেই মনোযোগ হেগেলের। একে তার রিলেশনাল ক্যাটাগরি হিসেবে ‘স্পিরিট’-এর সদৃশ বলা যায়, কিন্তু খুবই নিচু পর্যায়ের। এভাবে দেখা যায়— বিরোধ মীমাংসা তো দূরে থাক, আগের ঘটনার মতো ‘সিন্থেসিস’ সন্তোষজনক নয় বলে প্রমাণিত, যা ভাবুকদের সমস্যাটি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে। এ ক্ষেত্রে নতুন একটি ধারণার সেট ব্যবহার করে আলোচনাকে উচ্চতর পর্যায়ে নিতে হবে। আর প্রথম ত্রয়ীর তৃতীয় পদ দ্বিতীয় এয়ীর প্রথম পদ হবে না, যা ইতিমধ্যে নতুন ধারণাগত প্যারাডাউমের মধ্যে উপস্থিত।

দর্শন, ইতিহাস ও সাহিত্যকে একসঙ্গে জারিত করে ফেনোমেনোলজি বিস্ময়কর ও আকর্ষণীয় নানা ধরনের থিমের গোলকধাঁধা তৈরি করে। যেখানে একটির অপরের মধ্যে হারিয়ে যাওয়াটা সহজ। এবং হেগেলের দর্শন নিয়ে ধাঁধা আরও ঘনীভূত হয়। কিন্তু এই লেখার উদ্দেশ্য স্মরণ করলে বোঝা যায়, হেগেলের দ্বান্দ্বিকতার মূল ভিত্তি সরবরাহ করে খ্রিস্টীয় ট্রিনিটি যা আমাদের গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, ইতিহাসকে যদি আমরা হেগেলের আলোয় দেখি, তবেই …।

ইতিহাসের নানা বাঁক হিসেবে নিয়ে ইতিহাসের দর্শনের ওপর হেগেলের লেকচারগুলো পরবর্তী চিন্তকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু এটা কি এমন বার্তা দেয় হেগেলের সমস্ত চিন্তাভাবনা মূলত ইতিহাসের দর্শন?  না, এটা তার দর্শনের বহুতলের মধ্যে একটি মাত্র।

Comments

comments