২০১৩ সাল। আমরা কয়েকজন গেছিলাম আবুল সরকারের ঢেরায়। সেই কথপোকথনের নেতৃত্ব ও প্রধান সূত্রধর ছিলেন মোহাম্মদ রোমেল ভাই। প্রথমে প্রকাশ হইছিল দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশে, পরে ওয়েব ম্যাগ বানানে। সেই লেখাটার অসম্পাদিত অংশ থেকে…
অনেক আবুল সরকারের ভিড়ে তিনি হলেন বড় আবুল সরকার। থাকেন নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায়। চার দশকের বেশি সময় ধরে পালাগান করছেন বাংলাদেশে আনাচে কানাচে। এই গীতিকার ও গায়কের গানের অ্যালবামের সংখ্যা দুইশয়ের অধিক। তার তালাশে আমরা ক’জন গিয়েছিলাম ফতুল্লার পাইলট স্কুলের পাশে তার বাড়িতে। যানবাহনজনিত সংকট ও ভাঙা পথে ধূলি ধূসরিত সেই যাত্রায় স্বস্তি জাগিয়েছিল আবুল সরকারের মধুর গান ও কথা। এই দলে ছিলাম মোহাম্মদ রোমেল, ওয়াহিদ সুজন, গোলাপি ও তারিক মাহমুদ।
আমরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পছন্দের শিল্পীদের সাথে কথা বলছি। একটা হলো ভাবের গান। আরেকটা হলো যাদের গান মানুষ বেশি শোনে। তাদের নিয়ে আমরা একটা কাজ করার চেষ্টা করছি। কারণ ভদ্রলোকের পত্রিকাগুলোতে তাদের নিয়ে কোনো কথাই আসে না। নরম্যালি দুইদিনের বাচ্চা গান গাইলে তারা যেভাবে ফোকাস করে, আপনারা যারা হাজার হাজার মানুষের সামনে গান করেন- তা নিয়ে তারা কিছুই বলে না। আমাদের ইচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে তুলে ধরা। ইতিমধ্যে আমরা শাহ আলম সরকার, হাসান মতিউর রহমানের ইন্টারভিউ করলাম। ইচ্ছে আছে মমতাজ, আলেয়া, কাজল দেওয়ান বা আরো এ রকম যারা আছে বা গান লেখে এবং গায়- তাদের ইন্টারভিউ করব অথবা আপনি নিজেও আমাদের বলতে পারেন কাদের সাথে কথা বলা যায়।
আমি আছি, শাহ আলম আছে। তবে চার-দশটা বা বিশটা বিচ্ছেদ লিখলে কেউ লেখক হয়ে গেলো না। লেখক হতে গেলে তাকে সর্ববিষয়ে লিখতে হবে। যেমন সূফিবাদ, বাউলগান, শরিয়ত, মারেফত, হাদিস এসবসহ আরো বিষয়ে যার লেখা আছে। তাকে আমরা লেখক বলি। এখন শাহ আলম আছে, আগে ছিলেন অনেকে… এই… রজ্জব দেওয়ান, এখন নাই। আমিও লিখি। আগে এদের সাথে জুটি বাধতাম। এখন তাদের অনেকে মরে গেছে। এখন নতুনদের সাথে গাই। এই শাহ আলম, লতিফ দেওয়ান। শাহ আলম এখানেই থাকত। আমরা যখন গান গাইতাম মমতাজ তখন বসে বসে শুনত।
শাহ আলম সরকার আপনার প্রশংসা করলেন। আপনার কাছ থেকে সে তার বিদ্যা …
আমার কাছে ধারণা নিতে পারে এতটুকু বলতে পারি। কিন্তু এদের বংশের মধ্যে প্রতিভা ছিলো। তার চাচারা মেধাবী ছিলো। মোহন্ত কাকা। ‘আমি তো মরে যাবো’ তার এই গানটা পপুলারিটি পেয়েছিলো। ওর বাপ-চাচাদের মধ্যে প্রতিভা নিয়ে একজনের পর একজন আসছে। আমার এখানে ছয় বছরের মতো ছিলো। কিছু একটা তো পায়-ই।
আপনার ওস্তাদ…
আমার যে ওস্তাদ নাম বললে এখন অনেকে চিনবে না। সরকারি শিল্পী ছিলেন। তিনি বেতার ও টেলিভিশনের গান করেছেন। হাজি শাহাবুদ্দীন বয়াতি। এখন জীবিত নাই।
জীবিতের মধ্যে আপনার বয়সী কি কেউ নাই?
দুই-তিন জন আছে। তারা এখন গায় না। একজন শামসু দেওয়ান। তিনি বড় লেখক না কিন্তু বড় গায়ক ছিলেন। তার বাড়ি ভুলতা। ধুপতারা গ্রাম। তার যুগে তিনি প্রধান গায়কদের একজন ছিলেন। আরেক জন আছে পরেশ আলী। বাড়ি জয়পাড়ায়। এক সময় খুব নাম ছিলো। এরা আমার আগের শিল্পী। আমি তাদের পরে ঢুকছি। যেমন এখনকার গায়করা আমার পরে ঢুকছে। তিনি রজ্জব দেওয়ান, আমার, লালন, জালালের গান গাইতেন। যারা লেখে না তারা সবার গান গাইতে পারে। যারা লেখে তারাও অন্যের গাইতে পারে। তবে দেশ-কাল-পাত্র ভেদে নিজের গানটাই গাইতে চায়। আবার নাম করবে তাই খামখেয়ালি করে এদিক-ওদিক থেকে কথা নিয়ে সুর করে ফেললে বড় লেখক না। এই লেখক টিকে না। টিকে ঐ লেখক যে সবসময় সব দিকে সৃষ্টি করে দিয়ে যেতে পারে। আমাদের পরে তেমন লেখক নাই। আলেয়াও কিছু বিচ্ছেদ লেখে। লতিফ সরকারও লেখে। এই লেখা তো আমি গ্রহণ করব না। আমার বইয়েই তো ৫০০ গান আছে।
আপনার বয়স কতো?
আমার মার কথামতো আমার জন্ম ১৩৬১ সালের ২৪শে বৈশাখ। সে মোতাবেক এখন ঊনষাট-ষাট চলছে।
কোন জেলায়?
মুন্সীগঞ্জ জেলার শিবনগর থানায়। গ্রাম সুরদিয়া, পোস্ট অফিস পুকটিয়া। আমি ১৯৬৯ বা তার একবছর আগে খালার সাথে শ্যামপুরে মামার কাছে চলে আসি। অর্থনৈতিক কারণে সিক্স পড়া অবস্থায় চলে আসি। যাত্রাবাড়িতে স্কুলে ভর্তি হই। আর গানের ব্যাপারটাও এখানেই শুরু। এখন যেটাকে বাউল গান বলে সেটাকে আমরা বলি প্রশ্নোত্তর বা পালাগান। আমরা সঠিক বাউল না। বাউল গান তো কুষ্টিয়া অঞ্চলের গান…
বাউল গান…
যারা লালন ভক্ত। ঐ যে বাউলের যে ভাব তার মধ্যে পরিপূর্ণতা আছে। একতারা নিয়ে ছুটল, পয়সা পিছনে ছুটল না। তারা লোভী না তো। আমরা তো পয়সার জন্য গান গাই। এটা আরেকটা দেশ।
পালাগান নিয়ে যা বলছিলেন?
প্রথমে পর্যায়ে এটা ছিলো কবিগান, তারপর হলো জারিগান, তার থেকে হলো পালাগান। শারয়ত-মারেফত, খাজার জীবনী, বড় পীরের জীবনী, নারী-পুরুষ ইত্যাদি।
এই যে পরিবর্তনটা কবে থেকে হইছে তা কি বলতে পারেন?
আমার দাদা ওস্তাদ কবি, গান গাইতেন। এরপর কেন জানি জারিগানে আসলেন। কেমন একটা ভাব দিয়ে ফেললেন। এটা ৬৯-৭০ সালের আগে। বিশেষ করে এর গুরুত্ব আসছে কারবালা থেকে। এখন এটাকে কেউ বলে মনসুরের জারি, কেউ বলে হাসানের জারি। আবার কেউ বলে ঈসমাইলের জারি- একটা গানের মধ্যে পুরো কুরবানের ঘটনা। এরপর বয়াতিদের থেকে পালাগান। আবার মিরপুর থেকে নাম দিয়ে দিলো বাউল শিল্পী। এটা কীভাবে যেন সমাজের মধ্যে পরিচিতি পেয়ে গেল। বাউল নামটা আদিতে এদের মধ্যে ছিলো না। ছিলো কুষ্টিয়ার লালন ভক্তদের মাঝে। ইন্ডিয়াতেও এমন হইছে।
মানুষ যখন দেখছে আমাদের মধ্যে প্রশ্ন-উত্তর, আড়াআড়ি হচ্ছে। এটা তাদের কাছ পছন্দ হয়ে গেল। এইতো সেই আমল থেকে। আমি ওস্তাদ, খালেক দেওয়ান, আলাউদ্দিন বয়াতি, রহমান বয়াতির সাথে গাইতাম।
কবিগান, জারিগান ও পালাগানের বিষয় ভাবনার মধ্যে তো পার্থক্য আছে?
খুব একটা পার্থক্য আসে না। কবিগানে কাহিনি যায়, তত্ত্বও যায়। জারিগানেও কাহিনি যায়, তত্ত্ব যায়। বিষয় প্রায় একই। সামান্য পরিবর্তন হয়। সুর-কথা-ছড়া-ছন্দের মাধ্যমে এই পার্থক্য ধরা পড়ে। তবে কবিগান গায়কদের বেশি শিক্ষিত মনে হতো। হিন্দুরাই বেশি গাইতো। কবিতা লিখতে যে পদ্য লাগে… কাছ থেকে দেখেছি তারা পদ্য ছাড়া কথাই বলত না। এটা সুরের মধ্যেই পার্থক্য আছে। দেরে দেরে দেরে দেরে দেরে না না…
কীর্তনের সুর মনে হচ্ছে?
তাও হতে পারে। আমি বলতে পারি কীর্তন এখান থেকে নিছে। তখন কী বলবেন?
কবিগান ও জারিগানের সুরের মধ্যে পার্থক্য আছে?
জারির সুর হলো এমন .. আল্লাহ বলো, রাসুল বলো, দিলে বলো সার। চার কালেমা মুখে নিয়া হয়ে যায় ব্যাপার।
এতে প্রশ্ন-উত্তর থাকে না। তবে এমন হয় তাকে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করে গান গাইতে সাহায্য করা হয়। দুই জন গায়ক থাকে। আমি জানি প্রশ্ন করা হলে অন্য জন অ্যাডভান্স হতে পারবে। এক থেকে দুইয়ে যেতে পারবে। তাই প্রশ্ন করে এগিয়ে দেয়া হয়। তাদের দীর্ঘ সময় গান গাইতে হয়। অন্য গায়ক যখন গায় তখন বিশ্রাম নেয়া যায়। আমরা তো সারারাত গান করি।
অন্যদিকে পালাগানে পক্ষ-বিপক্ষ থাকে। পালাগানকে বিচার গান বলে, বয়াতি গানও বলে। কোন এলাকায় শরিয়ত-মারেফত গান, দোতারা গান, কোন এলাকায় বলে মালজোড়া গান। এটা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বলা হয়। আমি কুষ্টিয়া গেলে বলবে বাউল, বিষ্ণুপুরে গেলে বলবে বয়াতি আসছে, কুমিল্লায় সরকার, করিম শাহ’র দেশে বাউল, নেত্রকোনায় বাউল।
শ্রীমঙ্গল-আখাউড়া-বাঞ্চারামপুরের দিকে ছিল জীবন সরকার, বাদশা সরকার, আলমাস সরকার। সবাই মারা গেছে। তারা কুমিল্লায় ভাষা পাইছে। এদের বাউল, বয়াতি বললে কেউ চিনবে না। সরকার বলতে হবে। সরকার আসছে ফারসি ভাষা থেকে। যারা লেখালেখির দায়িত্ব থাকে। যেমন বড় বড় মহাজনরা লেখালেখির জন্য তাদের দোকানে সরকার রাখে।
আমরা কি বলতে পারি কবিগানে এক ধরনের হিন্দু ব্যাপার আছে?
এটা তো আসছে হিন্দু থেকে। তখন মুসলমান কবি, গায়কেরা ভাবল সবতো হিন্দুর হয়ে গেলো। আমাদের ঢোকানোর একটা জায়গা আছে – মহররম। এটা ঢোকানো যায়। তখন মুসলমানদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হলো। এভাবে কবিগান থেকে জারিগান চলে এলো।
মুসলমান সমাজে গান নিয়ে নেতিবাচক ধারণা ছিলো। আব্বাসউদ্দিনের আগে কোনো মুসলমান গায়ক দেখা যায় না। জারিগানটা কি সমাজের মধ্যে গানের স্থান করে নেয়ার জন্যই হইছে?
আমাদের আব্বাস উদ্দিন নজরুলকে বললেন আপনি হিন্দুদের নিয়ে গান লিখেন। আমাদের মুসলমানদের জন্যও লিখেন। নজরুল লিখলেন। আব্বাস উদ্দিন এইসব গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়ে গেলেন। অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন দেখলেন কবিগানে ঠাকুররা রামায়ন করছে। তখন তিনি বিষাদ সিন্ধু করলেন। আল্লাহ পাক তারে অনেক উপরের স্থানে উঠাইছেন। আমরা যারা গায়ক তারা তো এখান থেকেই জ্ঞানার্জন করে গান গাই।
আপনার গান শেখার বিষয়টা বলেন?
যখন যাত্রাবাড়ির স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি আমার ওস্তাদ বললেন ক্লাসিক্যাল শিখতে। আমি ১৯৭৩ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে ভর্তি হলাম। প্রিন্সিপালের নাম বেদার উদ্দিন আহমেদ, ওস্তাদের নাম সোহরাব হোসেন। সেখানে নজরুল ও রবীন্দ্রসংগীত শিখলাম। প্রথম বছরেই প্রথম স্থান অর্জন করলাম। তখন বিভিন্ন জায়গায় গান গাইতাম। গ্রামে গান গাইতে গিয়ে দেখি সেখানে লোকে বয়াতি গান বুঝে ভালো। অন্যদিকে পাশ করার পর পরিণয়ে আবদ্ধ হলাম। টাকা-পয়সার দরকার আছে। এভাবে পালাগানে চলে আসি। লেখার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই ছিলো। কিছুই হতো না। তারপর চেষ্টাটা ছিলো। এরপর কেউ বলল রেকডিং করতে হবে। এই দায়িত্বের মাধ্যমে গান লেখা হয়। আমার সব গান বিক্রি করে দিছি।
লেখার বিদ্যা কই পাইলেন?
এর জন্য তো পড়াশোনা লাগে। আমি প্রচুর পড়ছি। পড়াশোনা আর কবিত্ব শক্তি। প্রয়োজনের তাগিদে চলে আসছে। লেখার মাধ্যমে কিছু প্রতিষ্ঠা করব এটা আমার মনের মধ্যে ছিলো। তবে না জানলেও তো হবে না। জ্ঞান ভাসা ভাসা হলে হবে না। আপনাকে ভিতরে যেতে হবে। আবার মুসলমান ধর্ম জানলে হবে না। অন্য ধর্মও জানতে হবে। আমার এমনি কোনো গুরুবিদ্যা নাই। তবে প্রাধান্য দিয়েছি লেখাপড়াকে। আপনি একবার না বুঝলে হাদিস তিনবার পড়েন। দেখবেন বুঝতে কোনো গুরু লাগবে না। শিক্ষা কম হলে বুঝও কম হয়। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা আলাদা বিষয়। তবে সাধনা গুরুত্বপূর্ণ।
আপনাকে লোকে প্রথম পছন্দ করল কোন সময়ে?
নজরুলগীতি গাইতাম বাড়ি বাড়ি। সেটা ছিলো সৌখিনদের জন্য। পরে যখন দেখলাম লোক পল্লীগীতি পছন্দ করে ব্যবসা হিসেবে সেটা ধরলাম। এখন অবশ্য ব্যবসার দিকে তেমন লোভ নাই। তবে লেখালেখি পড়াপড়ির মধ্যে ব্যবসার ব্যাপার নাই। এটা অন্য ব্যাপার। আমি ১৯৭৪-এ স্টেজে উঠি। তখন খাজা মঈনুদ্দীনকে নিয়ে কোনো গান ছিলো না। আমি লেখা শুরু করি। এখন বাংলাদেশে প্রচার হয়ে গেছে বাংলাদেশে খাজা বাবার গানের প্রথম লেখক আমি।
রেকর্ডিং শুরু হলো কীভাবে?
ডেমরায় আবুল কাশেমের সুরমেলা নামে একটা রেকর্ডিং ঘর ছিলো। তখন এতো যন্ত্রপাতি ছিলো না। বিদেশ থেকে একটা টেপ (রেকর্ড প্লেয়ার) আনছিলো। মাইকে গান গাইতাম। সেখান থেকে রেকর্ডিং করা হতো। এই ক্যাসেট খুব হিট করছে। নাম ছিলো খাজার জীবনী, এখন পর্যন্ত বাজে। টাকা-পয়সা তখনকার হিসেবে ভালোই দিছে। গীতিকার হাসান মতিউর রহমানের ভাই বাচ্চুর একটা প্রতিষ্ঠান ছিলো ঝংকার। এটার স্টুডিও ছিলো। সেখান থেকে করলাম ‘কোন বাগিচার ফুল’। সেটার অনেক জনপ্রিয় গান আছে। যেমন- ঘুম আসে নারে, একা ঘরে রইরে। সেটা পরে বেবি নাজনীন গাইছে।
এইসব গান আপনি তো শুনবেন না। এগুলো সাধারণ মানুষ শুনে। আপনি থাকেন ঢাকায়। আমরা গান করি ঐ কুমিল্লা, ঐ মানিকগঞ্জ। এই যে উকিল মুন্সী গান লিখছে হাজার হাজার। আপনি জানেন দুই-চারটা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে যান। তারা শিল্পীদের মুখে মুখে শুনে অনেক গান জানে। আগে শহরে প্রত্যেকটা গলিতে খাজা বাবার শিন্নি হতো। এখন হয় না। হইলে আপনারও জানতে। এখন তো গলিতে করতে অনুমতি দেয় না।
অডিও’র বিষয়টা…
ওরা তো আমাদের ডেকে নেয়। আমাদের নিজেদের তো অডিও করার ক্ষমতা নাই। তারা বলার পর আমরা কন্ট্রাক করি। এককালীন টাকা নিয়ে নিই। তারা যখন দেখল এই শিল্পীকে দিয়ে গান করালে ব্যবসা হবে, তখন আসে। তারা পাবলিকের কাছেই আমাদের কথা জানতে পারে। একেক অ্যালবামে দশটা গান করি। আবার জারিতে একটা গান হয়। পালায় করি তিনটে গান করি। এখান তিন গানের জন্য তিরিশ হাজার টাকা। এরপর আসলো সিডি। বিভিন্ন জায়গায় স্টেজ করে গানের শুটিং হয়েছে। এফডিসিতেও হয়েছে।
গানের বিষয় কে ঠিক করে?
তারা বলে দেয়। যেমন খাজা বাবার ক্যাসেট আছে দশটা। তবে এক গান দুই ক্যাসেটে গাওয়া যায় না। প্রয়োজনে একই ভাব দুইবার আসতে পারে কিন্তু গান আলাদা হতে হবে।
অন্য শিল্পীরা কি আপনার গান গাইছে?
বহুত গাইছে। লেখক তো বাধা দিতে পারে না। আমি সবার জন্য গান লিখি। তবে নির্দিষ্ট করে কোনো শিল্পীর জন্য লিখছি বলে মনে পড়ে না। আমি আর শাহ আলম (সরকার) গানে বিভিন্ন সময় সাহায্য করছি। কিন্তু একজন শিল্পীর জন্য দশটা গান লিখছি এমন হয় না। গান বিক্রি করে দেয়ায় আমার কপিরাইট নাই। তবে সিনেমার ক্ষেত্রে কপিরাইট আমার। শবনম পারভীন তার সিনেমায় আমার ঘুম আসে না ব্যবহার করছে। একটা মেয়ে নাচতে নাচতে গাইছে। আমার ভালো লাগে নাই। তাই ফিল্মে গান দিই নাই।
আপনার অডিও আর সিডির সংখ্যা কত?
সব মিলিয়ে দুই শতাধিক হবে।
বর্তমানে কি অবস্থা?
মোবাইল আসার পর থেকে কমে গেছে।
লালনের গানে আমরা তত্ত্ব পাই, আপনার গানে কী তত্ত্ব আছ?
সাধারণ গানও আছে, তত্ত্ব গান আছে। সেটা যে দেশে যে ভাব তার সাথে মিলিয়ে হয়। এখন চেষ্টা করি বাক্যটা যেন ওজনদার হয়। উপরের দিকেই তো যেতে হয়। একবার উপরে উঠলে নিচে নামা যায় না। সুরও ভিন্ন করতে হয়। নইলে লোকের ভালো লাগে না।
এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক গান লিখি না। যেমন ঘুম আসে না-তে মোহন বাঁশির কথা বললাম। এটা কার বাঁশি? খাজা বাবা না আল্লাহ। ইসলাম ধর্মে তো এই ধরনের বাঁশির কথা নাই। এটা কৃষ্ণের বাঁশি- ব্যক্তিকেন্দ্রিক গান। আমাদের তো দেশ-কাল ভেদে গান গাইতে হয়। যেমন হিন্দুদের পালা-পার্বণে আপনি তো মুসলমানদের গান গাইতে পারেন না। তখন হনুমানকে বিরাট কিছু বুঝাইতে পারব। এখন এমন হইছে হিন্দুদের কাছে এদের বড় করে তুলব। কিন্তু ইসলামের মধ্যে একে আনব না, প্রাধান্য দেয়া যাবে না। যেহেতু আমার ব্যক্তিগত ধর্ম আছে।
এটা কি সমাজের কোন চাপের কারণে?
না। এটা ধর্মের কারণে। আমি আল্লাহ-রাসুল (স.) বিশ্বাস করি। কোরআন-হাদিস-ওলি-আউলিয়ার দর্শন বড় আমার কাছে।
পার্থক্য পান কোথায়?
এটা বলা যাবে না। সবার সামনে বলা যাবে না।
এটা তো আপনার মনেরও পরিবর্তন?
হ্যাঁ। এটা আমার ধর্মীয় পরিবর্তন। আল্লাহ রাসুল (স.) বলছেন কোনো কিছু জানা থাকলে তা অন্যকে শিক্ষা দাও। এটা আমার দায়িত্ব। আমার জুনিয়রদের বলাও আমার দায়িত্ব। বৈষ্ণবদের মতো গান আমারও আছে। আমি দাবি করি আমি সূফিবাদি। তাই ওইসব গান নিয়ে বই বের করি নাই। সূফিবাদি গান নিয়ে বই বের করছি। বাউলবাদের সাধনা জল, নীর, ক্ষীর, যোগ, মহাযোগ…। এটা দিয়ে কী করব। আমি যদি পারি রাতভর ইবাদত করব। নইলে ঘুমাবো। এটাও আল্লাহর নিয়ামত।
সূফিবাদের সাধনা কী?
সূফিবাদের সাধনা কোরআন-হাদিস থেকে যে আধ্যাত্মিক সারটা আসছে- নিজেকে জানলে রবকে জানবে বা আমি ফকিরের ভেদ, ফকির আমার ভেদ সেটার চর্চার করা। তাদের সারাজীবন কাটে আল্লাহকে পেতে।
আমরা জানি তারা দেহকেন্দ্রিক, তাহলে সূফিরা কি দেহকেন্দ্রিক না?
ইসলামও দেহকেন্দ্রিক। ইসলামের দেহকেন্দ্রিকতা হলো শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়া আপনাকে ইবাদত বন্দেগী করতে হবে। মনে মনে স্মরণ করলেই নামাজ হয় না। সেজদা আল্লাহ চায়। অথবা রাত জেগে কেয়ামূল লাইল। আল্লাহ তো বলছে ঐ ব্যক্তির চোখমুখ আমার হয়ে গেছে। বাউলবাদে ধরো জল সাধন করলা। না, এখানে তা বলব না…। বাউল মত সহজিয়া থেকে আসছে, বৌদ্ধ ধর্ম থেকে আসছে। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু থেকে আসছে। তারপর তো লালনে এসে এর বিস্তার ঘটছে। আবার এর মধ্যে তিনি ইসলাম আনছেন- যে রাসুল, সে মুর্শিদ, সেও খোদা হয়। তার গুরু সিরাজ সাই ছিলেন ফকির। তাই লালনকেও ফকির বলা হয়। এদিকে বাউল ওদিকে ফকির। একে যদি ইসলামিক অর্থে ত্যাগী ধরেন ঠিক আছে। কিন্তু আউল-ঝাউল ধরলে ইসলামে যায় না। ভালো দিক হলো তারা বলে অন্যায় করব না, জাতি বিভেদ করব না। ইসলাম জাতি বিভেদ করে কিন্তু অন্যের ধর্মে হিংসা করে না। সহ্য করে। মানুষকে নিজের করে নেয়।
আপনি কি ইসলামের কারণে গুরু ধরেন নাই?
ইসলামে গুরু ধরার বিষয় নাই এমন না। ইসলামে সবাই গুরু ধরছে। সে যুগের সাথে বর্তমানে একটু পার্থক্য হয়ে গেছে। নবীর যুগ আসবে না, বেলায়েতের যুগ নাই। খাঁটি পীর কমে গেছে। ভালো কাউকে পাইলে ধরবেন। আশা তো ত্যাগ করা যাবে না। এখন তো ব্যক্তিকেন্দ্রিক করি না। গ্রামের মানুষও চায় আধ্যাত্মিক বা দেহতাত্ত্বিক গান গায়।
শহরের গানে অনেক হালকা কথা থাকে। অন্যদিকে গ্রামে যেসব গান করেন সেগুলোতে ভাবের কথা, অনেক জটিল কথা থাকে। তাইলে আপনি কি বলছেন গ্রামের মানুষেরা শহরের মানুষের চেয়ে চিন্তা-ভাবনায় উচুঁমানের?
ভাবের গান গাইলে কান্না চলে আসে। এটাই তো এই দেশের ভাব। গ্রাম আর শহরের পার্থক্য হলো গ্রামের মানুষ সহজ-সরল। শহরের মানুষ আধুনিক। সে এমএ পড়বে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। তার চিন্তা এই দিকে থাকে। গ্রামের মানুষ ক্ষেত-খামারে কাজ করে। তারা ভাবে আমি মরে যাবো। আল্লাহ তুমি আমাকে রক্ষা করো, দয়াল আমাকে রক্ষা করো। গ্রামের মানুষের মধ্যে যে প্রেম ভাব আছে তা শহরে নাই। শহরে হাততালি পেতে পারি কিন্তু প্রাণটা নাই। গ্রামে কান্নার ভাব প্রবল। প্রাণটা বেশি পাওয়া যায়।
বাউলের ভাব তো অঞ্চল ভেদে আলাদা। করিমের বাউল গান আছে কিন্তু চোখের পানি আনার মতো গান নাই। মানিকগঞ্জের সুরে কথায় চোখের পানি আসে। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনার সুর উড়ে উড়ে যায় আর মানিকগঞ্জে ঢাবা ঢাবা। অন্তরের গভীর থেকে আসে। কুষ্টিয়ার সুর এরকম কান্নার মধ্যে না, বুঝের মধ্যে আছে। বাঞ্চারামপুর, হোমনা, দাউদকান্দি এসব এলাকার মধ্যে কান্না আছে। সিলেট চিটাগাং নোয়াখালিতে তো নাই-ই। বরিশাল খুলনায় কিছু পাবেন। আবার বিজয় সরকার আর উকিল মুন্সীর ভাব একই না।
আমরা যদিও লালনকে শ্রেষ্ট বাউল মনে করি কিন্তু জালাল খাঁ’র একটা গানের কাছে কিছু না। কিন্তু নড়াইল গিয়া জালালের গান করেন কিছু হবে না। সেখানে লাগবে বিজয়ের গান।
জালালের গান নিয়ে বলছিলেন। কোন গানটা?
যেকোনো গান। লালনের গান দুই অন্তরা তিন অন্তরা। তার একটা আবিষ্কার আছে। সে আবিষ্কারের কারণে সে শূন্যের মধ্যে আছে। কিন্তু জালালের গানের মধ্যে সৃষ্টি আছে। গভীর কথা আছে, কঠিন কথা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচার পায় নাই। শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে। আমাদের বাউলশিল্পীদের মধ্যে এমন কোনো শিল্পী নাই যিনি জালালের গান জানেন না। লালন জালালের আগে এবং তার মধ্যে কীর্তনের একটা ঢং আছে। অল্প কথার মধ্যে মানুষের ভালো লেগে গেছে। আর জালালের গান তো বিশাল। জালালের সুরে পার্থক্য আছে। লালনের সুর রবীন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলছেন তার সুরে পার্থক্য আনা যাবে না। নজরুল বলছে কেউ যদি ভালো করতে পারে, যেন করে। কিন্তু তারপরও আমরা বুঝি। লালনেরও একই ধরনের ব্যাপার হয়ে গেছে। লালন ১৩০ বছর আগের। তার জনপ্রিয়তা তো হবেই। তখন তো হিন্দু সমাজেরই প্রচলন ছিলো বেশি। ধুতি পরত, মোহাম্মদের আগে শ্রী লিখত। তিনি আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন দেশ-কাল-পাত্রে। পরে আমাদের বাংলা সাহিত্যের মধ্যে ভেসে উঠেছেন।
জালাল সূফি না বাউল?
বাউলই তো। সেই কম পড়ছে কিন্তু জানত অনেক। আমি তো কুমিল্লার মনমোহনের কাছে করিমের দাম দিবো না। করিম কী গান লিখছে। পাতলা। বাতাসে উড়ে যায়। আঞ্চলিক স্বার্থে কিছু লোক তাকে বাচাইয়া রাখছে। সম্রাট বানাইছে। সম্রাট তো লালনই। এক দেশে কত সম্রাট থাকে?
সূফিদের নিয়ে এখন ভালো গান কে লিখছে?
একজন আছে। হাসান চিশতি। লাল মিয়া যার গান গাইছে। অন্যদের মধ্যে ছিলো। জালাল, মনমোহন, লালন, ভব পাগলা, বিজয় সরকার, দ্বিজ সরকারে আছে। খুঁজে নিতে হয়। লেখককে একপক্ষ নিলে হয় না। হয়তো পার্ট পার্ট নিতে পারে। লেখক হতে হলে সব বিষয়ে লিখতে হবে। এই যে আপনাদের মনেমোহনের কাছে অনেক সূফি বাউল কিছু না।
আপনি সূফিবাদি গান নিয়ে বই বের করছেন। বৈষ্ণববাদি গান নিয়ে বই করেননি কেন?
যদি বেঁচে থাকি পরবর্তীতে করব আশা করি। এখানে রাখি নাই। কারণ রাম-রহিম তো একই না। আলাদা ব্যাপার। রহিম আল্লাহর গুণবাচক নাম। দশরথের ঘরে জন্ম নেয়া রাম মৃত্যুবরণ করেছেন। আল্লাহর তো জন্ম-মৃত্যু নাই। লালনের গানের মধ্যে আছে ‘রাম রহিম হয় কোন জনা’। কিন্তু কোনো বাউল এটা করে না। বয়াতি গানের মধ্যে এক ধরণের প্রহেলিকা আছে। যেমন- আমি বলতাম পানির মালিক খোয়াস খিজির। আসলে তো আল্লাহ। এইসব নিয়ে কেউ খোঁজ করে না। তার গাওয়ায় ও আধ্যাত্মিকতায় কেউ খোঁজ করে না, উচ্চ পর্যায়ে গবেষণা করলে ধরা পড়ত।
আপনার সন্তানদের মধ্যে কেউ কি গানে আসছে?
চার ছেলে দুই মেয়ে। তাদের গানে আসতে দিইনি। ভুল বোঝার সম্ভাবনা আছে। এর জন্য তো সাধনা লাগে।
সারা দেশে গান করেন। এখন আগের তুলনায় শ্রোতাদের মধ্যে কি পরিবর্তন আসছে?
আগে তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে গানই গাইতাম পারতাম না। বলত এইসব কী গান। এখন ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। সারা বাংলাদেশে পরিবর্তনটা আসছে। মানুষ হাদিস-কোরআনের গান বেশি শুনতে চায়।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
তোমারা কষ্ট করে অনেক দূর থেকে আসছ। তোমাদেরও ধন্যবাদ।
চমৎকার সাক্ষাৎকার
ধন্যবাদ
very nice interview
ধন্যবাদ