এক.
অনেক দূর চলে এলাম, তাই না!
শাহীন বলে, আরে না। আসার পথ সব সময় দীর্ঘ হয়। সামনে চল। ছোট একটা নদী আছে।
কী নাম?
কাগজে কলমে কোন নাম আছে কিনা জানি না। তবে লোকে বলে ছোট দরিয়া।
বড় দরিয়া কই?
ছিল। একসময়। এখন আর নেই।
নেই মানে কী?
হারিয়ে গেছে। প্রথমে নদীটা ভাঙতে শুরু করে। এখন আমাদের বাড়ি যেখানটায় আছে। তত দূর পর্যন্ত চলে আসে। তারপর মানুষ যখন সরতে শুরু করে, তখন আবার চর পড়তে শুরু করে। এখন একটা নদী আছে বটে। বিশ মাইল দূরে।
সর্বনাশ!
আলাপে আলাপে আমরা শীর্ণ স্রোতোধারাটার কিনারে চলে এসেছি। হাঁটু পরিমাণ পানি আছে। স্বচ্ছ। নিচে বালি চিকচিক করছে।
আমরা তীর ধরে বসি। অগ্রহায়ণের বাতাসে রহস্যময় গন্ধ। আকাশটা রুপার মতো চকচক করছে। নদীর অল্প জলে অস্পষ্ট ছায়া নড়ছে। সূর্যের দিকে না তাকিয়ে দিকের হিসেব করার চেষ্টা করি। এটা আমার কাছে মজার খেলা। আকাশের রং ধরে এসেছে। শাহীন অনেকক্ষণ ধরে কী যেন ভাবছে। ধ্যানী, নির্বাক। ওকে অবশ্য এমনই দেখে এসেছি। খুব একটা কথা-টথা বলত না। এ নিয়ে ক্লাসে আমরা তাকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করতাম। এখানে অবশ্য তাকে অন্যরকম লাগছে। তখন কেমন একটা রাগী রাগী ব্যাপার ছিল। এখন খুবই কোমল লাগছে।
শাহীনকে একা রেখে আমি হাঁটতে শুরু করি। এতক্ষণ খেয়াল করি নাই। নদীর ওপারটায় অনেক মানুষের আনাগোনা। মাটির একটা রাস্তা। কেউ কেউ ঝাঁকা নিয়ে যাচ্ছে। হাটবার বোধহয়। অথচ ভেবেছিলাম- বাংলাদেশ থেকে হাটবার বিষয়টা কত আগে মিলিয়ে গেছে।
আজ হাটবার নাকি?
হু। তারাকান্দির হাট।
চল ঘুরে আসি।
খানিক দূর আছে। ব্রিজ দিয়ে যাবি, না কোনাকুনি নদী পার হবি?
হাঁটুপানি বললেও আরেকটু বেশি পানি। যা হোক, পার হলাম। এখন ঠাহর হলো এটা মাটির রাস্তা নয়। পাকা রাস্তা। বোধহয় নতুন হয়েছে। ছাল-চামড়া এখনো অক্ষত আছে।
দুই.
‘মওলা আমার ইজ্জত নিয়া নে রে, মওলা আমার ইজ্জত নিয়া নে। মওলা আমার জীবন নিয়া নে রে, মওলা আমার জীবন নিয়া নে।’
অদ্ভুত আহাজারিময় গানটা কানে ধাক্কা মারে। বাজার এসে গেছে এ কথা বলে দেয়। বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষ। সাদা পাঞ্জাবি আর নীল বা সাদায় স্ট্রাইপ দেওয়া লুঙ্গি পরনে। সার বেঁধে দোকানিরা বসা। এ সব দেখি দেখি-ভাবি, মনে রাখি। পরে কখনো লিখলে কাজে লাগবে। না, আমার একটা নোটবুক রাখা দরকার। নানা ধরনের খাবারের গন্ধ আসছে। কিন্তু যাকে বেছে নেয়ার নাক ঠিকই নিয়া নিল। পেঁয়াজি। এতক্ষণ ব্যাপারটা প্রায় খেয়ালই করি না। আমাদের ঘিরে বেশ লোকজন জমে গেছে। বাহ বেশ বেশ। শহর থেকে আসলে খানিক খাতির তো পাওয়া যায়। সে ভ্রান্তি কাটতেও সময় লাগল না। সবাই শাহীনকে নিয়ে ব্যস্ত। নানা ধরনের কথা বলছে তার কিছুই বুঝি না। শুধু ক্ষণে ক্ষণে আক্ষেপ।
তারাবিবি। কী। চকিত মনে পড়ে একটা দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল। ‘তারাবিবি মনোহর স্টোর’। এ দোকানের আসতে মনে পড়ল একটা পকেট টিস্যু দরকার। শাহীনকে বলতে সে বলল, আমার কাছে এক্সটা আছে। প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়া আসে।
তাকে একজন বলছে, ভাইজান নিজের এলাকারে এভাবে ভুলে গেলে চলে। আমরা তো আপনা মানুষ। আত্মীয়স্বজনের লগে সম্পর্ক না রাখার বড় গোনাহ কাজ। লোকটার সোনালি দাঁড়ি চিকচিক করে। দৃশ্য সুন্দর। তার দুই হাতের মাঝে শাহীনের মুখ। শাহীনের অস্বস্তি বুঝতে পারি। ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরে বলেন, ভাইয়ের লগে তো পরিচয় হলো না।
বলি, শাহীনের বন্ধু। একসাথে পড়তাম।
ও, দেখে বুঝা যায়। বেশ শিক্ষিত মানুষ। শহর থেকে আসছেন। আমার নাম সৈয়দ ইসরাফিল হোসেইন। দেখেন শাহীন ভাইজানের লগে কতদিন পর দেখা। উনারা তো এদিকে পা-ই মাড়ান। অথচ এখানে তার দাদাজানের..
শাহীন বাধা দিয়ে বলে, ইসরাফিল সে কথা থাক।
অ.. আমরা মূর্খ মানুষ। মাটি কামড়ে আছি। আপনাদের মতো সুযোগ-সুবিধা নাই। আ… শাহীন আমার ভাই।
আমার মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখে বলে, তেনার বাপ হইল আমার দাদা হলো তার দাদার চাচাতো ভাই। সে সূত্রে আমরা রক্তের ভাই না! কী বলেন। হা হা হা। এখানে আমার একখান ছোটখাটো দোকান আছে। আর লোকজন ধইরা বাইন্ধা এলাকার মেম্বার বানাইছি। যদি আমার দোকানে তসরিফ রাখেন।
ইশারায় বুঝলাম উনার দোকানের নামই তারাবিবি।
শাহীন কারো কারো কথা বলছিল। এবার আমার দিকে ফিরে বলে, এ বাড়িতে না তোর জরুরি কী মেইল পাঠানোর কথা ছিল।
ও হা, হা, ভুলে গেছিলাম।
আপনার ইন্টারনেট লাগবে। বাজারে ব্যবস্থা আছে।
না, কিছু ডকুমেন্ট পাঠাতে হবে। আমার ল্যাপটপে আছে। এখানে হবে না। শুকরিয়া। আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে খুশি হলাম।
শাহীন প্রায় আমাকে টেনে আনল। সৈয়দ ইসরাফিল হোসেইন বিরক্ত হলো কিনা বোঝা গেল না। অভিব্যক্তিহীনভাবে হাত মেলালো।
তিন.
সরি দোস্ত। তুই নিশ্চয় খুব বিরক্ত হইসছ। জানছ এরা এমনই!
আরে না। এ লোক তো তোর আত্মীয়। কথা বলতে তো চাইবেই।
শাহীন চুপ করে থাকে।
পোকা ডাকতে থাকে। বাতাসের বেগ সামান্য বাড়ে। পাঁচমিশালি গন্ধটাও চেঞ্জ হয়।
কিন্তু একটা জিনিস বুঝতেছিনা। তোর এতো তাড়া কিসের। আমার মেইলটা কাল সকালে পাঠালেই চলত। আর তুই কিনা। সমস্যা কিরে..।
সমস্যা না। তোরে আজগুবি সব প্রশ্ন করবে। কী করেন। সরকারি না কোম্পানি। অনলাইন পোর্টাল সেটা আবার কী। বেতন কত? উপরি আছে? বিয়ে করছেন? কেন করছেন না? বান্ধবী আছে? শেষে একগাদা উপদেশ। আর ফ্যামিলির ইতিহাস… বিরক্তিকর!
এ গল্পে আমি যেহেতু বেশ সহনশীল একজন মানুষ। তাই তার কথার পাত্তা দিলাম না।
ধুর! জিগেস করত না হয়, এর থেকে হয়তো দারুণ কোনো গল্প মিলে যেতো।
কথা পরিবর্তন করে বলে, বাজারে আনলাম। কিছু খাওয়াতেও পারলাম না। চা খাবি।
হুমম। মুখটা একবারে শুকিয়ে গেল।
খানিকটা এগিয়ে বটতলার নিঃসঙ্গ একটা টং দোকান পাওয়া গেল। সামনে দুটি বেঞ্চি। আমরা মুখোমুখি বসলাম। শাহীন বেশ চিন্তিত।
গুড়ের চা খাবি। তোরা তো আবার গুড়ে চা, খাঁটি দুধের চা… এ সবের ভক্ত।
আমি ভক্ত-টক্ত নয়। যে কোনো কিছুতে ভক্ত হওয়া মানুষ আমি না। একটা হলেই চলে।
স্যার গরুর দুধের চা খান। স্পেশাল মালাই দিয়া বানাইয়া দিব।
ঠিক আছে। এক কাপ দাও। কাপ ভালো করে ধুয়ে দিও। চিনি এক চামচ।
তুই খাবি না।
না। আমি খাবো না। তুই খেতে থাক। আমি ততক্ষণে ছোট্ট একটা কাজ করে আসি। চাইলে মালাইও খেতে পারিস। এদের মালাইটা বেশ মজার হয়।
দ্রুত চলে গেল। ওর মতিগতি বুঝা ভার। আজ হঠাৎ কী হলো। সব কিছুতেই রহস্য।
দোকান কেমন চলে?
আপনাদের দোয়ায় ভালোই চলে।
কই? কোনো লোকজন তো দেখি না।
এখন তো লোকজন আসার সময় না। রাত আরেকটু বাড়ুক।
মানে কী?
এ ধরনের রাত আরেকটু বাড়লে এলাকার পোলাপান- অনেক মুরুব্বি আসে। তাস খেলে আরকি… টাকা-পয়সার ব্যাপার।
চারদিকে বেশ গাছপালা থাকলে মাঝখানে বেশ খোলামেলা জায়গা। অবশ্য গ্রাম নিয়া আমার তেমন আইডিয়া নাই।
বললাম, এটা নিয়া মুরুব্বিরা, ধরেন এই চেয়ারম্যান, মেম্বার বা বড় যারা আছে। তারা কিছু বলে না?
প্রথমদিকে মেলা ঝামেলা গেছে। পরে সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। ধরেন জায়গা মতো টাকা গেলে কোনো প্রবলেম নাই। তবে মাঝে-মাঝে পুলিশ এসে আসর ভেঙে দেয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আগের অবস্থা। মাঝখানে একটু বাড়াবাড়ি হইল।
কী রকম?
মাইয়া মানুষ আসত। নাচ-গান করত। তবে এটা বন্ধ হইছে। বোঝেন না জোখ উঠলে পোলাপান একটু বেশিই করে।
আমার চা শেষ হয়ে আসে। শাহীনের কোনো খবর নাই। দোকানি বলে, ভাই মালাই দিই। টেস্ট পাইবেন।
আচ্ছা দেন।
এবার তার প্রশ্ন করার পালা।
ভাইজান কোত্থেকে আসছেন?
ঢাকা।
কয়দিন থাকবেন?
আছি কয়েক দিন।
কী করেন?
এই লেখালেখি।
ও সাংবাদিক!
সে রকমই। সাথে গবেষণা। টুকিটাকি গল্প।‘
খুব খুশি হইলাম। আপনে বেশ এলেমদার মানুষ। তো কী নিয়ে গল্প লিখেন।
এই গ্রাম। গ্রামের মানুষ।
আপনে শহরের মানুষ। তাগো নিয়া না লিখে গ্রাম নিয়া লিখেন কেন?
আপনি বেশ ভালো প্রশ্ন করছেন। এসব বাস্তবিক ব্যাপারগুলো আমার পক্ষে ব্যাখ্যা করা কঠিন। ধরেন শহরে যা যা ঘটে। কিন্তু গ্রামে যেহেতু থাকি না। গ্রামের মানুষদের যেহেতু তেমন একটা চিনি না। তাই তাদের নিয়া লিখি। মানে তাদের নিয়া কল্পনা করা সহজ। তারা আবার আমার লেখা পড়েও না।
ভদ্রলোক কী বুঝল কে জানে। তবে মুখে বিগলিত হাসি দেখা গেল।
আমি একটু বেশি কথা বলি। কিছু মনে নিয়েন না। ধরেন, আমাগো গল্প পইড়া শহরের মাইনষের লাভ কী।
তারা হয়তো নিজেদের চেহারাটা দেখ চায় না।
বোধহয় আরও কিছু বলার ছিল। কিন্তু একটা জিনিস দেখে অবাক হলাম। তাকে থামিয়ে দিই। উপরে তাকাতে চোখে পড়ে। মোক্তার টি স্টল, তারাবিবি বাজার সংলগ্ন, হৃদয়পুর।
আপনাদের এ বাজারের নাম শুনেছি তারাকান্দি। এখানে লেখা তারাবিবি।
হা, তারাবিবিই তো। তারাকান্দি তো মেলা দূরের বাজার।
এ সময় শাহীন উপস্থিত হয়। তার চেহারা থেকে যাবতীয় চিন্তার ছাপ অদৃশ্য। আর কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে সে তাড়া লাগায়।
চার.
গল্পটা আসলে হারিয়ে যাওয়া সে নদীটার গল্প। কিন্তু কীভাবে যেন প্রকৃতির যেকোনো কাহিনিতে মানুষ যুক্ত হয়ে যায়। তা কোটি বছর আগের হোক বা পরের হোক…
শাহীনের এভাবে শুরু করাটা আমাকে বেশ চমৎকার করে। মনে হয় ঘটনাগুলোকে আমার সামনে সহজ করে তুলবে।
কত আগে পঞ্চাশ বা ষাট, নাকি তার বেশি। যা হোক হঠাৎ করে নদীটা ভাঙতে থাকে। ঠিক যেন ভাঙন নয়। নদীটি হাত-পা গজিয়েছে। সে চলতে শুরু করেছে। পথে যা পাচ্ছে খেয়ে নিচ্ছে। সেভাবে এদিককার সব পরিবার মোটামুটি সর্বস্বান্ত হলো। আমাদের ঘর-বাড়ি গেল। তারা আরও পুবে সরে এসে কোনোভাবে ছোট একটা বাড়ি করল। তখন আমার বড় আব্বা মানে দাদার বাবার বয়স কম? পঁচিশ থেকে ত্রিশ হবে। ভীষণ সুন্দর একজন মানুষ। বেশ শৌখিন। গানবাজনা যেমন তেমন পড়ালেখায় মজে থাকতেন। বিয়ে-শাদি করবেন না পণ করেছেন। এমন অবস্থা। তিনি কিনা বাবার এক ছেলে। নানান জনে বোঝানোর চেষ্টা করে। কোনো লাভ হয় না। কিন্তু মুশকিল আসান নিজে নিজেই হয়। পাশের গ্রামের এক কন্যাকে দেখে মজে গেলেন। তো, আর দেরি কিসের। বেশ ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে।
শাহীন চুপ করে আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে। আমি খু্বই আগ্রহ দেখায়। যদিও বুঝতে পারছি না কিসের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছি।
বউও পড়ছে তার মতো। হই হই টাইপ। এমনই একদিন চাঁদনি রাতে তারা গেল নৌবিহারে। সেদিন আগে কী ঘটেছিল কেউ স্পষ্ট জানে না। তবে নৌকা ডুবে যায়। মাঝি ছিলেন তিনি নিজেই। দুই দিন পর থাকে অজ্ঞান অবস্থায় তিন মাইল দূরে পাওয়া যায়। জ্ঞান ফেরে আরও সাত দিন পর। এরপর অনেক দিন কারও সঙ্গে কথা বলেননি। তার স্ত্রী খোঁজে জলে-স্থলে লোক পাঠানো হয়। কোনো লাভ হয় না। এদিক ঘটে আরেক ঘটনা। নদীতে চর পড়তে থাকে। শেষে কিনা কয়েক বছরের মধ্যে আগে অবস্থানে ফিরে যায়। আরও পরে এখনকার মতো দূরে সরে যায়। এমনকি মানুষ নামও ভুলে যায়। কী অদ্ভুত না।
একটু থেমে বলে, গলা শুকিয়ে গেছে। একটু চা খেয়েনি।
আমারও চায়ের তৃষ্ণা জেগেছে বেশ।
আমরা সেই দোকানে ফিরে। এখন দু-একজন খদ্দের দেখা যাচ্ছে। মনে হয় আসর বসতে আর বেশি দেরি নাই।
চাঁদ বেশ রোশনাই ছড়াচ্ছে। দেখতে বেশ অন্যরকম লাগছে। গ্রামের সীমারেখা অপার্থিব একটা রূপ দেখেছে। শাহীন শুরু করে, ইতিমধ্যে গ্রামে রটে যায়, নদীর জন্য একটা বলির দরকার ছিল। নদী নিজে তা পূরণ করে নিয়েছে। চিন্তা কর তখন আমাদের পরিবারের কী অবস্থা। তার মধ্যে বড় আব্বার মাথা খারাপ টাইপ হয়ে যায়। ও আচ্ছা, বলে রাখি তখন তাদের চার বছরের একটা বাচ্চা ছিল মানে আমার দাদা। অনুমান করা হয় নৌকা যেখানটায় ডুবেছে সেখানে গিয়ে বড় আব্বা প্রায় সময় বসে থাকতেন। কিচ্ছু না স্রেফ বসে থাকা। পরে একদিন উধাও হয়ে গেলেন। শোনা যায়, কোনো পীর বা ফকিরের সঙ্গে চলে গেছেন। এভাবেই চলছিল। এর সাত-আট বছর পর ফিরে এলেন। খুব স্বাভাবিক একজন মানুষ। কিছুদিন বাড়িঘরে থাকলেন। তবে আবার বিয়ে করতে রাজি হলেন না। কিন্তু কোনো এক চাঁদনীরাতে একজন লোক আমাদের বাড়িতে এসে খবর দিল- বড় আব্বা নাকি আবার নদীর সেই জায়গা গিয়ে বসেছে। তার চারদিকে আলো ঘিরে আছে। দাদাজান বললেন, এটা আজগুবি কথা। উনি ঘরেই তো আছেন। একটু আগে ভাত খেলো, গল্প করল। তিনি দরজার ঘা দিলেন। দরজা খুলে বড় আব্বা বের হলেন। লোকটা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর হলো কী পরদিন থেকে বড় আব্বাকে আর পাওয়া গেল। আর কোনো দিন তিনি ফেরেন নাই।
পাঁচ.
তারাকান্দি বাজার? সামনে থেকে অটো পাওয়া যাবে। তারাবিবি থেকে অনেক বড় বাজার। এখানকার অর্থনীতি নিয়ে একটা ধারণা পাবি। বেশ জমজমাট।
তুমি যে কাহিনি বলছস। তাতে গা ছমছম করছে। আচ্ছা তুই আমাকে সে সময় তারাবিবি না বলে তারাকান্দি বললি কেন?’
মিথ্যে বলছিলাম। কেন বলছিলাম এবার সে কাহিনিতে আসি- কিছুদিন যেতে না যেতেই রাষ্ট্র হয়ে গেলে বড় আব্বাকে ওই জায়গায় এক বটগাছের তলে গভীর রাতে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখা যায়। তার সঙ্গে আরও কারা যেন জিকির করে। এসব শুনে দাদাজান কয়েকবার দেখতে গেছেন, দেখেন একটা নবীন বটগাছ। তার আশপাশে মানুষের কোনো চিহ্ন নাই। এসব ঘটনা স্পেসিফিক কে দেখছে তা কখনোই উদ্ধার করা যায় না। এবারও তা হলো। এ সুযোগে আমাদের নামের আগে সৈয়দ যোগ হয়ে গেল। মানে হলো কিছু সৈয়দ ইমতিয়াজ আলী গদি নাম দিয়ে জায়গায়টার সংস্কার করল। এলাহী কারবার। এসব সৈয়দ কারবারের সঙ্গে আমরা কখনো যুক্ত না। আমাদের পূর্বপুরুষ কেউ সম্ভ্রান্ত পারস্যবাসীও না। আমরা দূরে দূরে রইলাম। লোক নানা ভক্তি শ্রদ্ধা দিয়ে যুক্ত করা চেষ্টা করল। তবে দূর সম্পর্কের কেউ কেউ এতে যুক্ত হলো। আজকে একজনকে তো দেখলি। সে গদির খাদেম। আরেকটু থাকলে নানান কথা শুনতে পারতি। এ হলো তোর কাছে চেপে রাখা কাহিনি।
আর তারাবিবি?
ও হ্যাঁ, পরে এখানে গদিকে কেন্দ্র করে অতিদ্রুত বাজার হয়ে গেল। অবাক ব্যাপার হলো বাজারের নাম রটল বড় আম্মার নামে তারাবিবি। এই তো।
একটা ব্রিজের রেলিংয়ে আমরা দুজনে বসি। পুরো গল্পটা বোঝার চেষ্টা করি। বেশ ইন্টারেস্টিং। কিন্তু একটা বিষয় তো এখনো জানা হলো না।
বলি, একটা কথা তো বললি। সে সময় তুই আমাকে রেখে কোথায় গেলি?
এ ভয় প্রথম থেকে ছিল। ভাবছিলাম না বলে পার পাবো। সৈয়দ ইমতিয়াজ আলী সাহেবের গদি দেখতে। এখনো নাকি কেউ কেউ থাকে দেখে। হুটহাট। আমি গ্রামে আসলে এক-আধটু সেখান থেকে ঘুরে আসি। তবে যাতে পরিচিত কেউ না দেখে। অনেক মানুষ। বৃহস্পতিবারে শিন্নি, বছরে একটা ওরস, মোমবাতি, গাছে সুতা- এ সব দেখি আর কি। আমি বিষয়গুলো নিয়ে দুই এক জায়গায় কথা বলেছে। তারা কোনো সিলসিলা ডিফাইন করতে পারেন নাই। আসলে উনি তো কোনো কথাই বলেননি এ বিষয়ে। তারা বলেছেন এটা একটা গোপন হাল।
ততক্ষণে শাহীনদের বাড়ি ফিরে এসেছি। ওর বাবা দরজা খুলে খাবারের তাড়া দেয়। আমার হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসি। রাতে ঘুমানোর আগে শাহীন পরিবারিক অ্যালবাম নিয়ে আসে। সেখানে সৈয়দ ইমতিয়াজ আলী ও তারাবিবির ছবি আছে। দেখে চমকে যায়। উনার চেহারা একদম শাহীনের বাবার মতো। সূক্ষ্ম কি একটা পার্থক্য আছে। ধরা যায় কি- যায় না।
শাহীন বলে, এটা আমাদের পরিবারের গোপন রহস্য। কেউ জানে না। গদির লোকেরা অনেকবার বড় আব্বার ছবি চেয়েছিল। সে আমলেই তার বাবা নিষেধ করে গেছেন। ভালোই হয়েছে। নইলে আব্বাকে কিনা মসিবতে পড়তে হতো।
ঘুম জড়ানো চোখে আমি বলি, ‘হু’।
শাহীন মশারি লাগিয়ে দেয় বাতি নিবিয়ে দেয়। জানালা দিয়ে আলোভরা বাতাস আসতে থাকে। হঠাৎ মনে হলো, তারাবিবিকে বলি দেওয়া হয়েছিল! গা শিরশির করে উঠলো।
*ব্যবহৃত চিত্রকর্ম: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য