কিছু কিছু খ্যাতি বিড়ম্বনার কারণও হতে পারে! যেমন; উকিল মুন্সীর অজস্র কীর্তি থাকলেও ‘সোয়া চান পাখি’ গান নিয়ে স্পষ্ট একটা বিড়ম্বনা আছে। গুণী মানুষেরা এই সব ব্যাপার কীভাবে গ্রহণ করে তা বলা মুশকিল— তবে একই বিষয় নিয়ে বছরের পর বছর বিভ্রান্তি, একটা অস্বস্তির ব্যাপার তো বটে!
‘সোয়া চান পাখি’ গানটা যে রশিদউদ্দিনের এই নিয়ে আসলে বিভ্রান্তি ছিল না কখনো। অন্তত উকিল মুন্সীর চর্চা যখন সীমিত পরিসরে বা ভাবচর্চার সিলসিলার মধ্যে জীবন্ত ছিলেন ও আছেন। কিন্তু পরবর্তীতে বিখ্যাত লোকের ‘ক্ষুদ্র’ ভুলে এই বিতর্কের সৃষ্টি। এটা স্পষ্ট করে বললে হুমায়ূন আহমেদ বা বারী সিদ্দিকী দায় এড়াতে পারেন না- ভুল ধারণা দেওয়ার ও কখনো সত্যটা জানতে না চাওয়া বা সংশোধন না করার। এটা এক ধরনের উদ্ধত্যও বটে!
হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় গানটি উকিল মুন্সীর নামে ব্যবহার হয়। একই ছবিতে উকিলের বিখ্যাত কিছু গান থাকলেও এই ভুল নিয়ে বেশি শোরগোল হয়েছে। এটা সম্ভবত গানটির সহজিয়া বিরহী আঙ্গিকের জন্য।
হুমায়ূন আহমেদের জন্ম নেত্রকোণার মোহনগঞ্জে নানার বাড়িতে, উকিল মুন্ষীর বাড়ি জৈনপুর কিন্তু বেশি দূরে নয়। একইভাবে গানটি যার কণ্ঠে বেশি জনপ্রিয়তা পায় সেই বারী সিদ্দিকীর বাড়িও কাছাকাছি এলাকায়। কিন্তু তারা কখনো এই ভুল নিরসনের উদ্যোগ নেননি। এখনো ইউটিউবে থাকা ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমার ভিডিওতে গীতিকার হিসেবে উকিল মুন্সীর নামই আছে। যদিও ঠিক তার উপরে ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজ’ গানটির গীতিকবি হিসেবে রশিদউদ্দিনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এই ভুল বোঝাবুঝি প্রসঙ্গে যতটুকু জানা যায়, এই ছবির জন্য হাওরের অঞ্চলের গান খুঁজছিলেন হুমায়ূন। সে সময় কোনো একজন (নাম প্রাসঙ্গিক নয়) ‘সোয়া চান পাখি’ তাকে সংগ্রহ করে দেন। অথচ তার আগেই একাধিক সংকলনে গানটি রশিদ উদ্দিনের বলেই উল্লেখ ছিল।
এই ভুল আরও ছড়িয়েছেন গায়ক বারী সিদ্দিকীও। এই বিষয়ে তার উত্তর সংক্ষিপ্তই ছিল। ‘হুমায়ূন স্যার গানটি দিয়েছেন, আমি গেয়েছি’ টাইপ। আবার বিভিন্ন আসরে তিনি গানটির দুটি অংশ গেয়েছেন। গল্প হিসেবে জানাতেন উকিল মুন্সীর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এই গানটি তিনি তৎক্ষণাৎ রচনা করেন, গাইতে থাকেন। এর পর একটা জবাব দেন রশিদ উদ্দিন। যেখানে আবার রশিদের ভানিতাও রয়েছে। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টের (২০১৫) এক সেশনে গানটি করার সময় তিনি জানান, গানের পরের অংশটি (রশিদ উদ্দিনের নামে) তিনি ও হুমায়ূন আহমেদ মিলে যোগ করেছেন! লেখার সঙ্গে ভিডিওটি যোগ করা হলো- যদিও এখানে বারী সিদ্দিকীর কথোপকথনের অংশটুকু নেই।
উকিল মুন্সী নিয়ে আরও লেখা: উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে
অথচ হুমায়ূন যখন ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে উকিল মুন্সীর স্ত্রীর মৃত্যুর বর্ণনা দেন- সেখানে গান তো দূরের কথা, উকিল উপস্থিতই ছিলেন না। তার সম্পর্কে বলা হয়- জালাল খাঁর বাড়িতে গেছেন তত্ত্ব আলোচনায়! যদিও ১৯৭৮ সালে খুব কাছাকাছি সময়ে উকিল মুন্সীর স্ত্রী, ছেলে আব্দুস সাত্তার ও উকিল মুন্সী নিজে মারা যান। ততদিনে উনি সৃজনীশক্তি অনেকটাই রহিত হয়েছেন। অর্থাৎ, ফিকশনের জন্য ততটা তথ্য বা তত্ত্ব তালাশে যাননি হুমায়ূন।
সারা জীবনের সংগীতের পেছনে ছোটা রশিদ উদ্দিন তার বাড়িকে বাউল তত্ত্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত করেন। ফলে নানা চিন্তা ও মতের গীতিকবিরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। এ কেন্দ্রে সাধক উকিল মুন্সীর অংশগ্রহণ ছিল সক্রিয়। ‘সোয়া চান পাখি’ অবশ্যই উনার পরিচিত। এ ছাড়া উকিলের স্ত্রীর মৃত্যুর প্রায় ১৪ বছর আগে রশিদ উদ্দিন মারা যান। কেউ কেউ এমন দাবি তোলেন ছেলে সাত্তার মিয়ার লাশ নিয়ে আসাকালে উকিল মুন্সী আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি ও সোয়াচান পাখি গান দুটি গান। অথচ যে সময়ে সাত্তার মিয়া ও হামিদা বানু মারা যান, তার আগেই উকিল মুন্সী গান ছেড়ে দেন। এ ছাড়া তখন গানটি গাইলেও উকিল মুন্সীর বলে কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
দুর্ভাগ্যবশত: আমি যখন ২০১২ সালে উকিল মুন্সীর বাড়ি ঘুরতে যায়- তখনও জানতাম (শ্রাবণ মেঘের দিন সিনেমা সূত্রে) ‘সোয়া চান পাখি’ তারই গান (যে বিভ্রান্তি আমার বইয়েও অনেকটা রয়ে গেছে। কারণ আমার ব্যক্তিগত জার্নিটি অবিকল রাখতে চেয়েছিলাম। এর জন্য অনেকে ভুল বুঝেছেন, তাই আন্তরিকভাবে দুঃখিত)। অবশ্য তখন উকিল মুন্সীর নাম ছাড়া কিছুই জানতাম না। সে সময় উকিল মুন্সীর পুত্রবধূ রহিমা খাতুন হুমায়ূন-বারীর রোমান্টিক তত্ত্ব নাকচ করে দিয়ে জানান— “পীর যখন মারা যান, উকিল মুন্সী তার শিয়রে বসা। পীর নিজ কন্ঠে উকিলের- আতর গোলাপ ছিটাইয়া শুইয়া রইলাম বিছানায়, বন্ধু তোমারি আশায়… গানটি গাওয়ার পর সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজেকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেন। চাদর ঢাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এই ঘটনা উকিলের মনে বড় প্রভাব ফেলে। সেই উপলক্ষ্যে উকিল গানটি রচনা করেন। উকিল রহিমাকে এই ঘটনা জানিয়েছেন।” (ওই সময় রেকর্ড করা বয়ান থেকে অংশটুকু বিধৃত করি ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ বইয়ে।) পরে গোলাম এরশাদুর রহমানের বইয়ে জানতে পারি গানটি রশিদ উদ্দিনের।
অবশ্য আমার বইটি প্রকাশের বছরখানেক আগেই মাহবুব কবির প্রকাশ করেন ‘উকিল মুন্সির গান’ শীর্ষক বই। তিনি যথেষ্ট সময় নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করেছেন— নিশ্চিতই ছিলেন ‘সোয়া চান পাখি’ উকিল মুন্সীর লেখা নয়। তবে এতসব লেখার পর ফেইসবুক সার্ফিং করতে গিয়ে মাহবুব কবিরের দারুণ একটা পোস্ট পায়, যা ২০১৮ সালের ১১ মে দেয়া। যা উল্লেখ করলে হয়তো এত গল্পেরও প্রয়োজন পড়ে না।
লেখাটা এমন—
“বারী সিদ্দিকীর গপ্ কই যায়
গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে নেত্রকোণায় রমা প্রেস থেকে ছাপা বাউলসাধক রশিদ উদ্দিনের গানের বই ‘স্বররাজ লহরী’, গোলাম এরশাদুর রহমানের সংগ্রহ ও সম্পাদনায় ১৯৯৪ সালের জুনে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘নেত্রকোণার বাউল গীতি’, মো. গোলাম মোস্তফার সংগ্রহ ও সম্পাদনায় ২০১৩ সালে সম্পাদকের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘রশিদ গীতিকা’ এবং সর্বোপরি পরিবারের সদস্যদের কাছে সংরক্ষিত রশিদ উদ্দিনের স্বহস্তে লেখা পাণ্ডুলিপিতে থাকা ‘সোয়াচান পাখি’ গানটি হুবহু তুলে ধরছি-
আমার সোয়া চান পাখি
আমি ডাকিতাছি, ঘুমাইছ নাকি।
তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি
আইজ কেন তুই হইলে নীরব, মেল দুইটি আঁখি।।
বুলবুলি আর তোতা ময়না কত নাম তোর রাখি
শিকল কেটে চলে গেলে কারে লইয়া থাকি।।
তোমার আমার মধুর পিরিত, চন্দ্র সূর্য সাক্ষী
অকস্মাৎ কেন ভেঙ্গে দিলে, বুঝলাম না চালাকি।।
বিশ্বজোড়া এই পিরিতি, সবই দেখছি ফাঁকি
বাউল কবি রশিদ বলে ডাকলেই বা হবে কি।।
এখন একটি চ্যানেলে লাইভ অনুষ্ঠানে এই গানটি নিয়ে কণ্ঠশিল্পী বারী সিদ্দিকী যা বলেছিলেন তা হুবহু তুলে ধরছি- ‘কবরের পাশে গান রচনা হয়েছিল। আমি সংগ্রহ করেছি মাত্র। উকিল মুন্সির গান… বাউল রশিদউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে… মৃত লাশ… উকিল মুন্সি স্ত্রীর লাশকে কোলে নিয়ে গানটা গেয়েছিলেন… কোন সুরে কোন তালে… আমি সংগ্রহ করেছি মাত্র…।’ এইসব ডাহা আজগুবি গপ্। একদিন বারী ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিনি বললেন, এই গল্প আমি শুনেছি, আর কিছু জানি না।
কারো কাছে এই গল্প শুনেই তিনি গানের শেষ লাইনটি পাল্টে এবং গানটির কয়েকটি শব্দ পরিবর্তন করে ও এতে আরও দু’একটি শব্দ জুড়ে দিয়ে গাইলেন- ‘বাউল রশিদ বলে চলরে উকিল ডাকলেই বা হবে কি।’ লোকগান নিয়ে কত কিছু যে হয়, আশ্চর্য…। এবার শেষ কথা বলে বিদায় নিতে চাই। ঘটনা হলো- বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন মারা যান ১৯৬৪ সালে। অন্যদিকে মহাজন উকিল মুন্সি ইন্তেকাল করেন ১৯৭৮ সালে। উকিল মুন্সির স্ত্রীও মারা যান ১৯৭৮ সালে। তো, বারী সিদ্দিকীর ওই গপ্ কই যায়?”
অবশ্য হুমায়ূন ও বারীর এই অবহেলাকে আরও বৃহত্তর অর্থে দেখা যায়। বিশেষ করে উকিল মুন্সীকে জনপ্রিয় করার জন্য অনেকে অনেকেই হুমায়ূনের প্রসঙ্গ টানে। আসলে, উকিল মুন্সী বা অন্য কোনো সাধক কোথায়, কীভাবে হাজির হবেন— সেটা হয়তো অন্য ব্যাপার। শুধু কাউকে আবিষ্কার করলে তো চলে না। তাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা প্রাসঙ্গিক করে তোলার ব্যাপার থাকে। তেমন কিছু ঘটে নাই। ফলে ‘বিরহি বাউল’ বলে ব্যাখ্যার যে চল, হাওরের ভূ-প্রকৃতির কান্নাকে ধরে রাখার যে বাসনা, তা অনেকটা জাদুঘরে সাজানোর মতো বিষয়। ভাসা ভাসা। সে দিকে ‘অবহেলা’ আছে বৈকি। বাংলার ভাব সাধনা কেউ কেউ ‘ঘর সাজানো’র উপকরণের মতো ভাবতে পারেন, সে স্বাধীনতাটুকু থাকুক। বা নিজেদের বৈষয়িক বা ইমেজ নির্মাণের প্রয়োজনে ব্যবহার করলেন! কিন্তু এটাই শেষ নয়। একে শেষ হিসেবে ভাবার মধ্য দিয়েই হয়তো ‘সোয়া চান পাখি’র হদিসের দরকার পড়ে না। ‘সোয়া চান পাখি’ কেন ‘সোয়া চান’ বা এর লেখকই কে বা এতটুকু ভাবার অবসর আমাদের নাই। আরও স্পষ্ট বললে, আন্তরিকতা থাকলেও সম্মানটুকুও যথাযথ দেওয়া হয় না। যদিও নিজের লেখা বা গায়িকা স্বত্ত্বে একচুলও ছাড় দিতে রাজি না আমরা।
দোহাই: এই প্রসঙ্গটি নিয়ে লিখব এমনটা কখনো ভাবি নাই। কিন্তু একই ভুল বারবার চোখে পড়ায় জবাব হিসেবে এই লেখা।