গাদিঘাটে তখন সকাল ৮টার সামান্য বেশি। সকাল ৬টায় ঢাকা থেকে রওনা হয়ে ২ ঘণ্টা লেগেছে। খিদেও জেগেছে বেশ। কিন্তু কোনো দোকানে নাশতা নেই। এরই মধ্যে শেষ! তাহলে না খেয়েই থাকতে হবে?
আগের দিন তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী আজ এক ডিগ্রি বাড়ার কথা। তার বদলে আকাশে ধূসর বর্ণের মেঘের আনাগোনা। তাই খাবারের তালাশ ততটা ক্লান্তিকর নয়, যতটা পেরেশানির। খানিকক্ষণ পর মিলল খিচুড়ির দোকান। সেখানেও প্রথম দফার খাবার শেষ। বাড়িতে ফের রান্না চড়ানো হয়েছে। ভাতিজাকে দোকানে বসিয়ে সেই খাবার আনতে গেছেন চাচা। আধঘণ্টা লাগতে পারে খাবার আসতে।
এক.
স্থানীয় কয়েকজনও খিচুড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। প্রাইমারি স্কুলে পড়া একটা বাচ্চাও আছে, গায়ে সাদা জামা-নীল প্যান্ট আর ব্যাগ। সামনে বসা এক হাস্যমুখ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা সাংবাদিক! ঠিক বলছি না?’ উত্তর না দিয়ে প্রশ্নবোধক হাসি দিলাম। বললেন, ‘মানুষ দেখলে চেনা যায়।’ যদিও আমাদের একজন সংবাদকর্মী নন, বেলা যত বাড়তে থাকবে, ওনাকে দেখব একটু পরপর ফোন রিসিভ করতে এবং এর মাধ্যমেই অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করবেন।
ওই ভদ্রলোক কথায় কথায় জানালেন, একটা কুরিয়ার সার্ভিসের কাজ নিয়ে ঢাকায় ছিলেন অনেকদিন। দলবল নিয়ে রাতের বেলায় ছিল ডিউটি। আর প্রায়ই পুলিশের উপদ্রবের শিকার হতেন। গচ্চা যেত টাকা। কাহাতক বারবার একই বিড়ম্বনা সহ্য করা যায়। তাই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। এখানে ভালোই আছে। তো ঘরে নাশতা না করে এখানে কী?
ব্যবসাপাতি বাদ দিলে স্থানীয়দের পেশা মূলত কৃষিকেন্দ্রিক। জলাভূমির কারণে এক ফসলি হওয়ায় বাকি সময় অন্য কাজ করতে হয়। মাছ ধরা বা অবস্থাপন্নদের ফাই-ফরমাস খাটা। আজ তারা কয়েকজন মিলে একজনের ভিটায় মাটি ফেলছেন। ফজরের নামাজের পরপর কাজ শুরু, চলবে ১২টা পর্যন্ত। কাজের বিরতি নেন ৭টার দিকে। এ সময় তারাই নাশতা করতে আসেন। এত সকালে খুব কম লোকেরই বাড়ির বাইরে আসা লাগে, তাই খাবারের খরিদ্দারও কম।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের এ অঞ্চল নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বলার মতো তেমন বেশি ঘটনা নেই। জলাভূমি বা এখানকার ফসলাদির কথা বাদ দিলে যা আছে— ২০১১ সালে আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে ঘটে যাওয়া লঙ্কাকাণ্ড। জীবন-জীবিকায় হাত দেয়ার সরকারি পরিকল্পনায় স্থানীয়রা ক্ষেপে যায়। সংঘর্ষে লাশও পড়ে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন তারা। রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও অধিকার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া গেল। একজন বলছিলেন, সব জমির মালিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্র চাইলেই যেকোনো জমি দখলে নিতে পারে। অন্যজনের আলাপ এর বিপরীতে। জনগণ কোনো পক্ষকে ক্ষমতা দেয় বলে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে তারা। ফলে জনগণের অধিকার, রুটি-রুজিকে খর্ব করা যাবে না। তাদের মতামত গ্রাহ্য করতে হবে। যা-ই হোক, পরবর্তীতে বিমানবন্দরের পরিকল্পনা বাতিল হয়। ওনারা বলছিলেন, সরকারের প্রধান নির্বাহী নাকি বিমানবন্দরের পরিকল্পনা জানতেন না। ওনার কানে বিষয়টি যাওয়ার পর জনগণের পক্ষে রায় দেন।
কথায় কথায় জানা গেল, বর্ষাকালে বিলে পানি থাকে, তাই ভ্রমণকারীরা এ সময়টা বেছে নেন। কিন্তু বিলের অন্যরূপ না দেখলে জানা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। জানুয়ারির দিকে ফসল ওঠে। তখন যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। আর মাঝে বয়ে গেছে খাল ও ছোট ছোট জলা। আমন্ত্রণও জানিয়ে রাখলেন। এটা ঠিক, ঋতু বৈচিত্র্যের এ দেশে কোনো একটি স্থানকে এক মৌসুমে দেখে বিশিষ্টতা বোঝা যাবে না। ফিরে আসতে হয় ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে। তাহলে আপনি একটা বড় চিত্র আঁকতে পারবেন।
দুই.
ওই আড্ডায় বাবু ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। পাঙ্কুমার্কা চুলের কাট, চিকনা লম্বা গড়নের মানুষ। একবার প্রতারিত হলেও আবার মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছেন। শিগগিরই পাড়ি জমাবেন। এখানে অনেকেই ভ্রমণকারীদের নৌকায় ঘুরিয়ে আয়-রোজগার করেন। বাবু ভাইয়ের নিত্য কাজ সেটা না হলেও তিনি প্রস্তাব দিলেন বিল ঘুরে দেখানোর। আমরাও রায় দিলাম।
খিচুড়ি শেষে চা খাওয়ার পালা। একটা দোকান পাওয়া গেল, সেখানে বেশ ভিড়। স্থানীয়দের জন্য জুতসই আড্ডার জায়গা। একজন মুরব্বির হাতে অনেক টাকা। জানা গেল, শিগগিরই ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন হবে। আসছেন নামি মাওলানা সাহেব। বড় আয়োজনের জন্য টাকা-পয়সা তোলা হচ্ছে। মাওলানা সাহেবের নাম শুনেছিলাম, সঙ্গে কিছু মন্তব্যও। কিন্তু ভুলে গেছি পরে।
চা পান শেষে হাঁটতে হাঁটতে খালের ওপর ব্রিজে দাঁড়ালাম। নিচে কালো কুচকুচে জল। কয়েকজন লোক মাছ নিয়ে বসেছেন। দরাদরি চলছে। জিজ্ঞাসা করলাম, বিলের মাছ কিনা। উত্তর এল, ‘না।’ বিল থেকে একটা নৌকা আসছে, ব্রিজ পার হয়ে যাবে। কালো জলের আবহে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। আর কালো রঙটাও মায়া জাগায়। সচরাচর তো এমন দৃশ্য দেখি না। কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। প্রশ্ন হলো, খালের পানি কালো কেন? এ থৈ থৈ বর্ষায় অঝোরে চুইয়ে পড়া পানির রঙ এমন হওয়ার কথা না। আর এমন নয়, আকাশজোড়া কালো মেঘ, বরং ধূসর মেঘ ভেদ করে মাঝে মাঝে সূর্য কিরণে আমাদেরও ছায়া গজাচ্ছে।
রাস্তাটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা সে পথে খানিকটা এগোলাম। এক পাশে বিল, তীরে রাখা নৌকা, মনে হয় প্রতি পরিবারেরই নৌকা আছে এ অঞ্চলে। অন্য পাশে বাড়ি, স্কুল বা অন্যান্য স্থাপনা। মুন্সীগঞ্জ থেকে শুরু করে পদ্মার ওপারে মাদারীপুরের দিকে বিশেষ ধরনের বাড়ি দেখেছি। চৌচালা, পুরোটা টিনের তৈরি। একই নকশা, একই রঙ। দেখতে ছিমছাম। কোথাও কোথাও দেখলাম, মাটি থেকে উপরে আলাদা প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়ানো। এমনকি এমন ডিজাইনের পাকা দালানও দেখেছিলাম। এক জায়গায় ছোট বিজ্ঞাপন দেখলাম— ‘জাগ দিয়ে বাড়ি সরানো হয়।’ বাহ! দারুণ তো। বাবু ভাই বললেন, বাড়িগুলো নানা অংশে খুলে নেয়া যায়। দেখতে পলকা মনে হলেও খরচ যে কম পড়ে এমন না।
রফা হলো প্রথম ধাপে জোহর ওয়াক্ত পর্যন্ত আমরা বিলে ঘুরব। এরপর খাওয়াদাওয়া শেষে চাইলে আরেক দফা ঘুরে আসতে পারি। বাবু ভাই বারবার জোহর ওয়াক্তের গুরুত্ব দিচ্ছিলেন, ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না।
এবার নৌকায় ওঠার পালা। অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেও নৌকার দেখা নেই। পরে আমাদের বসিয়ে গেলেন বাঁশের মাচায়। বিশ্বকাপের মৌসুম চলছিল তখন। আমাদের পাশে এসে বসল জার্সি পরা দুই কিশোর। এলাকার বাড়িঘর, মোবাইল টাওয়ার সব জায়গায় পতাকা। একটি বাড়ির পুরো দেয়ালজুড়ে দেখলাম জার্মানির পতাকা। বেচারা! দলটা হেরে গেছে কয়েক দিন আগে।
বাবু ভাই এসে জানালেন, পারিবারিক নৌকাটা নেই। ওনার বাবা নিয়ে গেছেন কোথাও। তাহলে? হাল ছাড়ার পাত্র নন উনি। আর দেখলাম সবার সাথে তার সম্পর্কটাও আন্তরিকতাপূর্ণ। গ্রামে এ ব্যাপারটা দেখতে পাবেন। একটু খোলা মনের মানুষ হলে যা হয় আরকি! বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে গালাগালির সম্পর্ক! শেষে ছোট একটা কোষা নৌকা পাওয়া গেল। আমরা উঠতে উঠতে হাজির হলো সানাউল্লাহ। বাবু ভাইকে বললেন, তিনিও যেতে চান। পাশের বড় নৌকাটা তাদের। দ্রুত বাড়ি গিয়ে চাবি নিয়ে এলেন। আর পেছন পেছন এলেন তার মা। ছেলেকে ডাকছেন। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে— কিছু খায়নি, সানাউল্লাহ সেই ডাক অগ্রাহ্য করে নৌকার অন্য বৈঠাটা হাতে নিল। পারের কচুরিপানা ঠেলে এগোতে শুরু করলাম।
পাড়ের কাছাকাছি সব জায়গায় কচুরিপানা দেখতে পাবেন এখানে। পানি শুকিয়ে গেলে পানা মাটিতে বসে যায়। ওই জায়গায় লাউ ও কুমড়ার চাষ হয়। অনলাইনে কিছু ছবি দেখেছিলাম। খাল বেয়ে বয়ে যাচ্ছে কুমড়াভর্তি নৌকা। বেশ মনোহর দৃশ্য। মাথার ভেতর আনমনে বাজতে থাকে দেশাত্মবোধক কোনো সুর! প্রকৃতি ও দেশাত্মবোধের এ সম্পর্ক কি সব সংস্কৃতিতে মেলে?
পাড় থেকে দূরে যেতে যেতে কালো জল ফর্সা হতে শুরু করেছে। সানাউল্লাহ বলল, ধান ও অন্য ফসলের নাড়াসহ কীটনাশকের কারণে পানির এমন রঙ। নামলে নাকি গা চুলকায়! যদিও অনেককে দেখছি গা করে না, আমরাও পরে নেমেছিলাম।
তিন.
বিলের প্রধান আকর্ষণ সাদা শাপলা, যেটা আমাদের জাতীয় ফুল। অনেক বিল দেখেছি, যেখানে গোলাপি শাপলার সমাহার, কদাচিৎ চোখে পড়ে দু-একটা সাদা শাপলা। আর এখানে পুরোপুরি উল্টো। গোলাপি শাপলা চোখেই পড়ল না। আর হ্যাঁ, শাপলা দেখার ভালো সময় কিন্তু খুব ভোর বা বিকালে। বিকাল থেকে ফোটা শুরু করে, বেশির ভাগ ফুলই ভোর অবধি জেগে থাকে। নিশাচর আরকি!
জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে মাছ ধরার নিয়ম কী? সেটা নাকি জায়গার মালিকানার ওপর নির্ভর করে। বিষয়টা অবশ্য পরিষ্কার হলো না।
রোদ নেই। জল ছুঁয়ে আসা হাওয়া আমাদের ধুয়ে দিচ্ছিল। দৃশ্যে তেমন বৈচিত্র্য নেই। জল ও উদ্ভিদের যুগলবন্দির দৃশ্য বিছিয়ে রাখা হয়েছে সমতল প্রান্তরে। দূরে হঠাৎ হঠাৎ জেগে থাকা উঁচু ভূমি উঁকি দিচ্ছে। কিছু দূর আসতে দেখা গেল, একটা মোটাসোটা রেখা জলজ উদ্ভিদের আখড়াকে দুই ভাগ করে লম্বালম্বিভাবে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। এটা হলো খাল। সানাউল্লাহর ভাষায়, সরকারি খাল। কেমন একটা ঠাট্টার সুর। খালটা গভীর ও সারা বছর সম্ভবত পানি থাকে। ইচ্ছে হলো ঝাঁপ দিই।
বাংলাপিডিয়া অনুসারে আড়িয়াল বিল ঢাকার দক্ষিণে পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর মাঝখানে অবস্থিত প্রায় ১৩৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি অবভূমি। ধারণা করা হয়, অতি প্রাচীনকালে এ স্থানে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল ছিল, পরবর্তীতে উভয় নদীর প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে এ স্থান শুষ্ক হয়ে বিলে পরিণত হয়। বিলটি ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ জেলা এবং পদ্মা নদীর মাঝখানে একটি ছিটমহলসম জলাভূমি।
আরো জানলাম, দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন এ বিলের মাটি খুবই উর্বর।
একটা ভ্রমণ কাহিনী পড়ে জানলাম, বিলের মাঝে বয়ে যাওয়া খালকে অনেকে মনে করেন ইছামতি নদী। কথিত আছে, পদ্মায় গ্রাস হওয়া রাজানগরের রাজা রাজবল্লভ রায় এ খাল খনন করেন। রাজবল্লভ রায় ছিলেন আলিবর্দি খাঁর সহযোগী। আলিবর্দি খাঁ বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা। সৈয়দপুর হয়ে খালটি রাজানগর, শেখেরনগর, আলমপুর থেকে দক্ষিণে আড়িয়াল বিলের ওপর দিয়ে শ্রীনগর হয়ে পদ্মায় মিশেছে।
সানাউল্লাহ জানাল, শুধু ছোট ছোট কোষা নৌকা বা ভ্রমণবিলাসী ইঞ্জিন নৌকাই নয়, বড় বড় নৌকার দেখা মিলবে এখানে। তাদেরই নাকি শতবর্ষী একটা নৌকা আছে, যেখানে শ’খানেক যাত্রী এঁটে যায়। এখন নাকি এত বড় নৌকার দরকার পড়ে না, শিগগিরই ভেঙে ফেলা হবে। খবরটি যাচাইয়ের ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পাড়ে ওঠার পর ভুলে যাই।
নৌকা চলছে। মাঝে মধ্যে ছুঁয়ে চলছি শাপলা আর জল। এর মধ্যে পানির নিচে সাপ দেখা গেল। ভয় পেয়ে গেলাম। দ্রুত হাত তুলে নিলাম। এরপর আরো কঠিন আগাছার বনের মধ্যে ঢুকে গেলাম। এগোতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। দূর থেকে দেখা দ্বীপের মতো একটা জায়গায় পৌঁছেছি। মাটির একদম কিনারায় নৌকা নিয়ে বাবু ভাই বললেন, ‘চলেন ঘুরে দেখি।’ কিন্তু ওই যে সাপের ভয়ে আমরা কাবু। উনিও কোনো ভালো খবর দিলেন না। বললেন, ‘শুকনো মৌসুমে বিলজুড়ে অনেক সাপ থাকে। পানির সময় আর কোথায় যাবে! এসব উঁচু জায়গায় বাস করে।’ বোঝেন অবস্থা? ওই জংলা মতো জায়গায় আমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। বারবার বলছিলেন ভালো লাগবে, কিন্তু আমরা অশুভ ভাবনার বাইরে কিছু পেলাম না। বলেই ফেললাম, ‘ভাই ওদিকে না যাই। অন্য কোথাও চলেন।’
আগাছা জঙ্গল থেকে বের হয়ে এলাম। সামনে বিশাল বাঁশের কাঠামোয় বড় জাল লাগানো। কয়েকজন নৌকা নিয়ে এসেছেন। জাল ঠিকঠাক করছেন।
ভাসতে ভাসতে ওই দ্বীপের অন্য অংশে থামলাম। বিলের মাঝে মাঝে এ রকম অনেক দ্বীপ আছে। যাকে ‘ডাঙ্গা’ না বলে ওনারা বলেন ‘ডেঙ্গা’। এটা মূলত দীঘির পাড়। যার এক পাশ খোলা, বিলের সঙ্গে সংযুক্ত। পানি কমে গেলে মাছেরা আশ্রয় নেয় এসব জায়গায়। আর যারা দীঘির মালিক তাদেরই পোয়াবারো। একেক মৌসুমে একেকটা দীঘি ৫-৬ লাখ টাকায় নিলাম হয়। আমরা খোলা মুখ দিয়ে ঢুকলাম। এ পারে জঙ্গল অপেক্ষাকৃত কম ঘন। এক পাশে নৌকা বাঁধা হলো। ডেঙ্গায় নেমে হাত-পায়ের আলস্য কাটালাম।
পাড়ের কাটা অংশ বরাবর লম্বালম্বিভাবে নৌকাটা এঁটে গেছে। এক পাশের পাটাতন তুলে নিলেন বাবু ভাই। ছোট ছোট গাছ-লতাগুল্মে ভরা পাড়ে পেতে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম।
চার.
আমরা পাঁচজন নৌকা-পাড় মিলিয়ে শুয়ে আছি। কেউ কেউ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন অদ্ভুত শান্তিদায়ক পরিবেশ অনেকদিন দেখিনি। জল থেকে সবুজ আলোর ছটা উঠছিল। মাথার ওপর বড় বড় গাছের সবুজ ছাউনি। ফিঙে উড়ছিল মাথার ওপর। মনে হচ্ছিল, এখানে ১ ঘণ্টার ঘুমে কেটে যেতে পারে সহগ্র বছরের ক্লান্তি। কিন্তু ঘুম আসছিল না। জেগে জেগে হিজিবিজি চিন্তা আসছিল। মাঝে মাঝে চোখ বুজে জল, সবুজ, আকাশের এ ঐকতানে নিজেকে খুঁজছিলাম।
আকাশে মেঘের আনাগোনা। কখনো কখনো মেঘ সরে যাচ্ছিল। আর নৌকাও বাতাসের গতি বুঝে পাতার ছাউনি নেই এমন জায়গায় চলে যাচ্ছিল। বৈঠা মেরে সরে আসছিলাম বারবার। কয়েকবারের মাথায় সাহায্য করল সানাউল্লাহ। সে এমনভাবে নৌকাটা রাখল, আর সরে যাচ্ছিল না।
ছায়া দেয়া সবচেয়ে উঁচু গাছটায় অনেকটা কদবেলের মতো ফল। তবে আরো ছোট। হঠাৎ হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার পর মনে হচ্ছিল, যদি দু-একটা ফল মাথায় এসে পড়ে! একটা গল্পও মনে পড়ল। এক লোক বটগাছের নিচে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, এত বড় গাছ অথচ কত ছোট ফল, হওয়ার কথা মটকার মতো। আর লতাজাতীয় গাছ তরমুজ, কত বড় তার ফল। খোদাতাআলার এ কেমন বিচার? এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ টুক করে একটা বটফল তার গায়ে এসে পড়ে। তখন ভাবলেন, বটের ফল যদি মটকার মতো হতো, কী যে হতো!
গল্পটা ভাবতে ভাবতে মনে হচ্ছিল, আহা! এ জীবনে ভাবার মতো কত সুন্দর ব্যাপার আছে, দেখার মতো কত সুন্দর দৃশ্য আছে। আর চেয়ে থাকার মতো চোখ, শোনার জন্য কান। তার পরও প্রতিদিন কতবার রিক্ত হই, ধ্বংস হই, মরেও যাই।
সবাই যখন জাগল, তখন একটা সমস্যা বুঝা গেল। খিদে লেগেছে। সানাউল্লাহ শুনে অবাক হলো, ঘুরতে এসেছি অথচ স্ন্যাক-জাতীয় কিছু নিয়ে আসিনি। সে বলল, আমাকে বলতেন, বাড়িতে নুডলস রান্না হয়েছে। নিয়ে আসতাম।
জোহরের সময়ও হয়ে এসেছে। তো ফিরতি পথ ধরলাম। কিন্তু আমাদের তো পানিতে নামা হলো না? গোসল করা যায় নৌকা এসে দাঁড়াল এরকম একটা জায়গায়। কথা হলো, প্রথমে কে নামবে? সবাই যেন সবাইকে পরীক্ষা করতে চায়। কেউ স্বীকার করছে না সাঁতার জানে! যা-ই হোক, লাফ দিলাম। এরপর অনেকক্ষণ দাপাদাপি হলো। একদম ছোটবেলার মতো। আনাড়িভাবে ডুব আর সাঁতার দিতে গিয়ে নাকানিচুবানি খেলাম। নাক-মাথা জ্বলছিল। গোসল শেষের জটিল পর্ব হলো কাপড়চোপড় পরা। যারা খোলা নৌকায় এ কাজটা করেননি, কতটা জটিল ব্যাপার তারা বুঝতে পারবেন না! তার ওপর প্রাইমারি স্কুলে চলছিল টিফিন পিরিয়ড। রাস্তা থেকে একদল শিক্ষার্থী আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল কৌতুকভরা দৃষ্টিতে!
তাড়া দিচ্ছিলেন বাবু ভাই। জানালেন, জোহরের জামাত মিস করতে চান না। অনেক বছর নাকি নামাজ পড়েননি। তা নিয়ে আফসোসের অন্ত নেই। এবার বুঝতে পারলাম জোহরের বৃত্তান্ত। এত তাড়া সত্ত্বেও জামাত জুটল না তার ভাগ্যে।
বিলে যাওয়ার পথে সাহায্য করছিল হাওয়া। এবার হলো উল্টোটা। নৌকা এগোতেই চাইছে না। আর বাতাসও তেঁতে উঠেছে। এক ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়েছে বোধহয়। দরদর করে ঘামছিলাম।
নামাজের বিরতির পর খাবারের খোঁজে বের হলাম। বাবু ভাই নিয়ে এলেন সেই পুরনো চায়ের দোকানে। ব্যাপার কী? কারণ গাদিঘাটে কোনো ভাতের হোটেল নেই। চা-চিপস-বিস্কুট-জুস-চানাচুর খেয়ে কাটাতে হবে। সম্ভব? চা-বিস্কুট খেয়েই সামলে নিলাম আপাতত। বাবু ভাইকে পারিশ্রমিক দিতে চাইলে বললেন, ‘যা ইচ্ছে দেন। না দিলেও সমস্যা নেই। টাকা কাগজ আর সংখ্যা বৈ কিছু নয়।’ একটা সংখ্যা তার হাতে গুঁজে দিয়ে আমরা পথ চললাম। বাড়ি যাওয়ার খুব তাড়া এমন না! তবে গুলিস্তান বা ফার্মগেটের জ্যামে পড়ে ভ্রমণের আবেশটুকু মুছতে চাই না আপাতত।