বাসায় ফেরার আনন্দ

(ব্যর্থ এক সার্জারি নিয়ে ভোগান্তির কাহিনি এটা। যার মূল পর্ব শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, এখনো চলমান। এখন একটা সিনেমাটিক ক্লাইমেক্সে দাঁড়ায়া আছে। তবে সেই গল্পে দুর্ধর্ষ কোনো অ্যাখ্যান নাই, বিরাট কোনো বাঁক-বদল নাই। অনেক বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস আছে। কিন্তু এ গল্প আমার খুবই কাছের, আমার বর্তমান। আমার স্বজনদের জন্য পরীক্ষার, আমাকে ভালোবাসার। সেই গল্পটা আমার বন্ধুদের জানাতে চাই, অন্তত এক অধ্যায়ের সমাপ্তির আগে আগে। … অবশ্য পুরো গল্পটা এভাবে শেয়ার করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই)

আগের পর্ব: এক. অসুখের দিন, দুই. বাবা আর আমি পাশাপাশি, তিন. অপারেশন টেবিলের ঝাপসা দুনিয়া

অন্ধকারে ডুব দিয়েছিলাম, সেখান থেকে চেনা পৃথিবীতে ফিরলাম। ব্যাপারটা বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো। আস্তে আস্তে কড়া হতে থাকা আলোর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম, আশপাশে মানুষের কথাবার্তা, কাতরানি শোনা যাচ্ছে। পোস্ট-অপারেটিভ বেডে শুয়ে আছি।

নোয়াখালী ২০১২/ নামলিপি: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

মাথার নিচে কোনো বালিশ নাই, আর যেটা চোখে মারল— কড়া আলো লাগছে, এর ওপর চোখে চমশা নেই। আর একটা ব্যথা। বুক থেকে নিচের দিকে। কেউ একজন এসে বললেন, জ্ঞান ফিরেছে। আমি জড়ানো গলায় (পুরোনোকালে ড্যাম হওয়া ক্যাসেটে যেমন শব্দ আসতে) বললাম, ব্যথা ব্যথা। তিনি বললেন, ঠিক হয়ে যাবে। এর পর আমি একে ডাকি, ওকে ডাকি। কেউ হয়তো ফিরে তাকায়, কেউ তাকায় না। বুঝতে পারি না কত সময় গেছে।

অ্যানেসথেসিয়ার ঘোর ঠিক মতো কাটে নাই। একজনকে বললাম, আমার চশমাটা এনে দেন। একটু পর চশমা আসলো। খানিকক্ষণ পর আপা আসলেন, হাতটা ধরলেন। আপাকে চাইতেছিলাম আমি। এ মুহূর্তে ঠিকঠাক মনে পড়ছে না, কিন্তু সেটা হয়তো ছিল এ পৃথিবীকে সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তেরগুলোর একটা। আমি আছি, আপনজনদের মাঝে আছি এ চেয়ে আনন্দের অনুভূতি আর কী হতে পারে। আপা অল্পক্ষণ ছিলেন। কাটাকুটিকে উনি অনেক ভয় পান। আমার জন্যই এলেন। বলছিলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।

ব্যথা তো কমছে না। ডাক্তার বা কেউ একজন বললেন, ধৈর্য্য ধরেন। ঠিক হয়ে যাবে। এরপর একটা ইনজেকশন দেওয়া হলো। যখন কেবিনের বেডে তোলা হচ্ছে, তখন জ্ঞান ফিরল।

ওই বছর জুলাই মাসে এই নিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলাম, অ্যানেস্থেশিয়ার বাংলা অবেদনিক। গুগলে স্পেলিং চেক করতে গিয়া পাইলাম। আমার দুবার অ্যানেস্থেশিয়া নেওয়ার অভিজ্ঞতা হইছে। কেমন একটা ব্যাপার যেন! একটা ভয় থাকে- যদি আর চেতনে না ফিরি। ঘুমানোর সময় ঘুম না ভাঙার ভয় থাকে না। অভ্যাসের কারণে হয়তো। বা না ভাঙলেও মরণ হবে আরকি! যে মরণকে আমরা মেনে নিই। কিন্তু অ্যানেস্থেশিয়ার প্রভাব না কাটার ভয় সেই অর্থে মরণের ভয় না, স্রেফ চেতনে ফিরে না আসার ভয়। মানে দুইবারই এমন হইছে। প্রথমবার সিরিয়াস কাটাকুটি ছিল- চার ঘণ্টার মতো বেহুঁশ ছিলাম। সিনেমায় যেভাবে দেখায় সার্জারির আগে রোগী দেখে আলো কেমন যেন বেশি বেশি ছড়ানো। এটা দেখি সত্যি বটে। এমনকি চেতন হওয়ার খানিক পরও প্রচুর আলো চোখে লাগে- অন্ধকার থেকে ফেরার কারণে। এমনও ভাবতেছিলাম- ঘুমরে একটা অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করার চান্স আছে। বা স্বপ্নের মাধ্যমে ঘুম নিজেকে জানান দেই। স্বপ্নের মধ্যে এটা ভাবাও সম্ভব আমি ঘুমের মধ্যে আছি। কিন্তু অ্যানেস্থেশিয়া নেওয়ার পরের অভিজ্ঞতাটা কই জমা থাকে? কিছু ভাবার চান্স কি থাকে? দ্বিতীয়বার মেবি দেড় ঘণ্টার মতো বেহুঁশ ছিলাম। তখন হইলো কী একটা রাবারের মতো জিনিস আবার বামপায়ে জড়ায়া নেওয়া হলো। এটা নিয়া পরে জিগাসা করা হয় নাই। আমি তখন ভয় পাইছিলাম পুরোপুরি বেহুঁশ না করলে হয়তো পা ছোড়াছুড়ির কোনো প্রক্রিয়া থাকতে পারে। ডাক্তার তখন বলল, এটা কী হচ্ছে আপনি বুঝতেও পারবেন না। জেগে উঠার দুই অভিজ্ঞতায় যন্ত্রণাকর। বিশেষ করে প্রথমবার খুব ব্যথা টের পাচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ পর ইনজেকশন দেওয়ার পর পোস্ট অপারেটিভ রুমে থেকে নেওয়ার বিষয়টা টের পাই নাই। দেখি কেবিনে। বাট, যেটা বারবার মনে হয়- ওই সময় আমি কি কিছু ভাবি, অবেদনিক অবস্থায়। সেটা আসলে কীভাবে জানা যায়। একটা ঘাঁ-এর ক্ষেত্রে লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া ইউজ করা মুখটা কেটে বড় করা হইছিল। আমার ভয় ছিল- এই বুঝি ভীষণ ব্যথা পাবো। ভয়ের মধ্যে থাকতে থাকতেই দেখি নার্স ব্যান্ডেজ জাড়ায়া বলতেছে উঠে পড়েন। সে হিসেবে ‘অবেদনিক’ শব্দটা ঠিক আছে!

দশটার মতো বাজে হয়তো। ডাক্তার এসে বলে গেলেন, একটু একটু করে পানি খেতে পারবো। আমার অবস্থা এমন, যা যেকোনো অপারেশনের রোগীরই হয়, নড়াচড়া বা উঠাবসা নতুন করে শিখতে হয়। এটা না শেখা পর্যন্ত, মানুষ মূলত উল্টে থাকা তেলাপোকা। যেমন; ছয় মাস বয়সের আগের বাচ্চা। হালকা স্যুপও খেলাম বোধহয়। আস্তে আস্তে সবাই বিদায় নিলো। থাকলাম আমি আর বউ। আমার আরামের জন্য যতটা সম্ভব করলেন। ভাগনে নিশান এক বন্ধুর বাসায় চলে গেছে, যেকোনো প্রয়োজনে চলে আসবে। ওর রাত জাগার ভীষণ নেশা। রোগীর কাছে থাকতে হলে রাতের ডিউটিটা ওর কাঁধেই চাপে। এর আগে দুলাভাই ও বাবার অসুস্থতার সময় রাত জেগে পাহারার কাজটা ওই-ই করেছে।

অপারেশন থিয়েটারে রাশেদও ছিল। ডাক্তার আমাকে আগেই বলেছিলেন, ওকেও বললেন, ল্যাপারস্কির চেষ্টা করছেন, দুটো ফুটো করছেন বটে কিন্তু সম্ভব হয় নাই। ওনার ভাষ্য, আমার গলব্লান্ডার পচে-গলে গেছে। তাই ওপেন সার্জারিতে যেতে হলো। সে জিনিস আবার রাশেদকে দেখালেন। রাশেদ দুটো বিষয় বলছিল। অপারেশনের পর ঠিকঠাক পরিষ্কারের জন্য ঠান্ডা ও গরম পানির ব্যালেন্স করতে না পারায় নার্সকে বকা দিচ্ছিলেন ডা. আকবর। আর বারবার বলছিলেন আসরের নামাজের সময় চলে যাচ্ছে।

বাজে ঘটনা পরদিন ভোরে। ভোরে দিকে প্রশ্রাবের বেগ নিয়ে ঘুম ভাঙল। রাতে নিজের চেষ্টায় উঠতে পারলেও এখন পারছি না। বউও কোনোভাবে তুলতে পারছেন না। ওয়ার্ড বয় বা নার্স কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর আমাকে একটা বোতল দিলেন। কিন্তু টয়লেট ব্যবহার নিয়ে খুঁতখুঁতে হওয়ায় এটাও সম্ভব হচ্ছিল না। কাছাকাছি টয়লেট না থাকায় স্রেফ প্রশ্রাবের জন্য আমাকে যে কতভাবে নানা সময় ভুগতে হয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকে। এ জিনিস থেকে আমার ভ্রমণ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। যাই হোক, অনেকটা বাজে সময় কাটানোর পর এক ওয়ার্ড বয়কে পাওয়া গেল। উনি আমাকে ধরে বসালেন, এরপর বাথরুম গেলাম। শান্তি।

২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮-৯টার দিকে ডাক্তার আকবর আহমেদ আসলেন। বললেন, আপনার তো ভয়ংকর ধৈর্য্য। ধৈর্য্য ভালো, তবে এতটা নয়। পুরো গলব্লান্ডার পচিয়ে ফেলেছেন। ভাগ্য ভালো ইনফেকশন অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়ে নাই। উনার কাছে এরপর অনেকদিন যেতে হয়েছে। পুরোটা সময় ধৈর্য্য নিয়ে প্রশংসা বা কটাক্ষ— পরিস্থিতি বুঝে করে গেছেন। বললেন, চিন্তার কিছু নাই। দু-তিন দিনের মধ্যে ছুটি পাবো। সারাক্ষণ শুয়ে থাকতে মানা করলেন। এক প্রকার ধমকই দিলেন। লম্বা নিঃশ্বাস ও হাঁটা-চলার উপদেশ দিলেন। এর পর থেকে উনার আসার সময় হলে হাঁটাহাটিঁ করতাম বা চেয়ারে বসে থাকতাম। পরদিন বসে থাকতে দেখে খুশি হলেন। বলছিলেন, ভালো খবর আছে। বললাম, কী? ‘সারাদেশের সব প্রতিষ্ঠানে মূর্তি বানানোর একটা পরিকল্পনা ছিল, সেটা বাতিল হয়েছে।’ ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। বললাম, কার? উনি বললেন, বুঝলেন না! ‘ওহ!’ এ আশঙ্কা আমি বুঝতে পারি। যেকোনো ধার্মিক মানুষও হয়তো ফিল করে, কিন্তু অবস্থা বুঝে মেনে নেই বেশিরভাগই। আমি কী ভাবি, সেটা ডাক্তারকে জানালাম না। পরের বছরে তো দেশে ভাস্কর্য বনাম মূর্তি ভীষণ শোরগোল তোলে। এ নিয়ে ধর্মের কত কত ব্যাখ্যা জেনেছি। সে সব ব্যাখ্যা শুনে মনে হয়েছে, ধর্ম করা ট্রাডিশনাল লোকেরা কিছুই জানে না। শেষ মুহূর্ত বিতর্কিত মূর্তিটি কোথাও বসেনি। তত দিনে মিটিং-মিছিল ও মামলা-কারাদণ্ড কত কিছু হয়েছে। কিন্তু, আলাদা মর্যাদা বা ভাবমূর্তি নিয়ে যতই বিতর্ক হোক বা আমাদেরকে মূর্তি ও ভাস্কর্যের পার্থক্য বোঝানো হোক, মর্যাদা ব্যাপারটা কী ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি। সেটা শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার ছবি ছেঁড়া বা অনলাইনে বিদ্রূপ বা সমালোচনার প্রতিক্রিয়া থেকে বুঝতে পারি। ডিজিটাল আইন দিয়ে বুঝতে পারি। সোসাইটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পবিত্রতার ধারণাটা আসলে কী সেটা দিয়ে বুঝতে পারে। কোনো কিছু মূর্তি আকারে হাজির থাকা, আর কথা-ভাবে ভাবমূর্তি আকারে হাজির থাকার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সেই ভেদ তো এখানে গুছে গেছে। পরবর্তী ঘটনাগুলোতে ডাক্তার সাহেবের মনোভাব কী ছিল জানি না।

এ দুই-তিনদিন লম্বা জ্যাম ঠেলে প্রতিদিন হাজিরা দিতেন আপা-দুলাভাই, ভাগনি-তার জামাই। রাশেদও ছিল। একদিন খেয়া আসলেন। উনার মধ্যে ঝলমলে একটা ব্যাপার আছে। সেই ভাবটার সঙ্গে ফলও নিয়ে এলেন, বেশিরক্ষণ থাকলেন না। কোন এক আপু তাড়া দিচ্ছে। আগেও দেখেছি আপুরা ওকে খুব তাড়া দেয়! আর ছেলে দরদকে নিচে রেখে এসেছে, ডাক্তার দেখাবে। এক সন্ধ্যায় দারাশিকো ভাইও আসলেন। রাফসান গালিব আর আমার এক শ্যালক আসছিল। আসলে তো ভালোই লাগে।

আমার বউ অনেক কষ্টে দুদিনের ছুটি নিয়ে আসছিল। শনিবার তার ক্লাশে থাকার কথা। বলে-কয়ে সেদিন থাকলো। রবিবার মানে ২৩ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল থেকে আমার ছুটি হওয়ার কথা। উনি সেদিন ভোরে বাসে চলে গেলেন। ১২টা নাগাদ ক্লাশে ঢুকলেন। আমার জন্য কী যে হ্যাপা। যাওয়ায় সময় বালিশের নিচে ভালো অঙ্কের টাকাও রেখে গেছেন। সেদিন ১০টার দিকে সেলাই ড্রেসিং চেঞ্জ করার কথা। সঙ্গে থাকা ড্রেনেজ ব্যাগ। এই ব্যাগ একটা লম্বা নল দিয়ে পেট থেকে ঝুলছে। রক্ত-পানি জমা হচ্ছে। এটা নিয়ে ভয় লাগতেছিল। আমি বলতেছিলাম, ব্যথা লাগবে না তো! আকবর আহমেদ ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘ব্যথা আর ব্যথা। সমস্যা যখন জটিল ছিল তখন ব্যথা কই ছিলো। অন্য দিকে তাকান।’ এরপরও আমি ব্যথা ব্যথা বলছিলাম আর ডা. আকবরের সঙ্গে থাকা সুন্দরী ডাক্তার বললেন, ব্যথা ব্যথা করছেন কেন? ড্রেনেজ ব্যাগ তো খোলা হয়ে গেছে! তাকিয়ে দেখি আসলেই তো। ডাক্তার এ কাজগুলো কী নিপুণভাবে করে। এরপর ড্রেসিং করে ডাক্তার জানালেন, এখন চাইলে বাড়ি যেতি পারি। এক সপ্তাহ পর এসে ড্রেসিং খুলতে হবে। উনি দুদিন পর ওমরাহ করতে যাচ্ছেন। অন্য একজন ডাক্তারের নাম লিখে দিলেন, তার কাছে আসলেই চলবে। তবে আমি ওইদিন বাড়ি ফেরার মতো ভরসা পাচ্ছিলাম না। যদি কোনো ঝামেলা হয়, অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম আরেকদিন হাসপাতালে থাকবো। ডাক্তার বললেন, তাও করতে পারেন।

হাসপাতালে যে বিষয়টা দেখবেন, আপনার বিল সহজে রেডি হবে না। অন্যদের ক্ষেত্রে এমনটা দেখছি। রোগীর বাড়ি যাওয়ার একটা তাগাদা থাকে, বারবার বলা সত্ত্বেও বলবে, এই তো হয়ে যাচ্ছে, হবে। এই সব। হয়ে গেল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত উবার ডেকে দুইটা নাগাদ বাসায় ফিরলাম। খানিকক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নিলাম, তারপর হাত-মুখ ধুলাম। পরের এক সপ্তাহ গোসল না করেই থাকলাম। জীবনে এত লম্বা সময় এ অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয় নাই।

ঘুমানো ও সোফায় বসার জন্য বিশেষ ভঙ্গি রপ্ত করে নিলাম। যদিও দুটো অপশন থাকলে আমার প্যাচ লেগে যায়। বামে বা ডানে কোন দিতে কাত হয়ে উঠবো। আবার দেখা গেল আপার রুমে নিয়ে শুয়ে আছি। উঠার সময় প্যাচ লেগে গেল। কারণ বালিশ আমার বিছানা থেকে উল্টো দিকে।

রাতের বেলা কেউ না কেউ মশারি লাগিয়ে দিত। মশারির ভেতর আপা পানির বোতল দিয়ে যেতেন। ঘুমের সময় ফোন দূরে বা বন্ধ রাখার অভ্যাস। সাইলেন্ট মুড তো আছেই। আপা বালিশের মাঝে ফোন রাখতেন। রাতে যেন সমস্যা হলেই জানাই। আহা, বাসায় ফিরে আসা কত আনন্দের।

তখন করোনার প্রকোপ বাড়া শুরু হয়েছে। আমার সার্জন ওমরাহ করতে চলে গেলেন। এর এক কি দুদিন পরই সৌদি আরব ওমরাহ’র ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে। যেটা প্রায় দেড় বছরের মতো বহাল থাকে।

ফেব্রুয়ারির ২৯ বা মার্চের ১। রাত আটটার দিকে ডা. হাসান আল মান্নার কাছে গেলাম। অপেক্ষা করতে করতে শুনছিলাম, রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা বলছেন, মান্না স্যারের কখনো এত রোগী থাকেন না। আকবর স্যার নাই, সব উনার রোগী আসছেন। আমি ভাবছিলাম, সেলাই কাটার কথা। কতটা ব্যথা পাবো আল্লাহ জানেন।

কম বয়সী একজন ডাক্তার। বেডে শুয়ে পড়তে বললেন। টান দিয়ে টেপ তুলে ফেললেন। কাটা জায়গা তাকিয়ে আমি তো অবাক। কী ভয়ংকর! পুরোটা স্টাপলিং করা। এ জিনিসের কথা আমি কখনো শুনি নাই। ডা. মান্নাকে বললেন, ব্যথা পাবো? বললেন, টেরই পাবেন না। অন্যদিকে তাকান। অন্যদিকে তাকাতে হাতে থাকা কাচি মতো যন্ত্র নিয়ে মিনিট খানেকের মধ্যেই পিনগুলো কেটে ফেললেন। শুধু একটা তোলার জন্য সামান্য টান লাগে। উনি সরি বললেন।

ডা. মান্না প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বলছিলেন, আপনার মতো সুন্দর একজন মানুষের এমন অবস্থা ভাবা যায় না। এ কথায় কী বলা যায়! বয়স শুনে বলছিলেন, ওহ! আমাকে দেখে তো এত বয়স মনে হয় না। কথাটা শুনে ভালো লাগলেও পরে যখন ডা. কাফীর মুখে এ কথা শুনতাম গা জ্বলতো। বললেন, সব ঠিকঠাক আছে। দু-তিনদিন পর থেকে অফিস করতে পারবো। গোসল করতে পারবো। একটা মলম দিলেন, দিনে দুবার করে এক সপ্তাহ লাগাতে হবে। ডা. আকবর একবার বলছিলেন, কিছু বেদনা-ব্যথা থাকতে পারে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ডা. মান্নাও বললেন, কয়েক মাস অস্বস্তি থাকতে পারে। তারপর সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ভালোই লাগছিল, সব ঠিক হয়ে গেছে।

বাসায় ফিরে সেদিন আর গোসল করিনি বোধহয়। ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে। পরদিন জম্পেশ একটা গোসল দিলাম। কী আনন্দ! দু-তিনদিন পর থেকে অফিস শুরু করলাম। সিএনজি বা উবার ব্যবহার করছিলাম, কয়েকদিনের মধ্যে পকেট ফাঁকা।

স্বস্তি ফিরলেও খাবার-দাবার স্বাভাবিক হলো না। শরীরের নানান জায়গায় ব্যথা ঠিকই থাকলো। কখনো কখনো জ্বরের মতো অনুভূতি। বেশ কয়েকদিন অফিস পুরো না করে বাসায় ফিরে আসলাম। ততদিন কিন্তু আমরা মাস্ক পরা পুরোদস্তুর শিখে গেছি। বাসে কেউ হাঁচি বা কাশি দিলে অন্যরা কী যে আতঙ্ক নিয়ে তাকাতো। এতদিন তো এক লোক হাঁচি দিতে দিতে শেষ। লোকজন পারলে বাস থেকে নামিয়ে দেয়।

চলবে …

Comments

comments