অপারেশন টেবিলের ঝাপসা দুনিয়া

(ব্যর্থ এক সার্জারি নিয়ে ভোগান্তির কাহিনি এটা। যার মূল পর্ব শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, এখনো চলমান। এখন একটা সিনেমাটিক ক্লাইমেক্সে দাঁড়ায়া আছে। তবে সেই গল্পে দুর্ধর্ষ কোনো অ্যাখ্যান নাই, বিরাট কোনো বাঁক-বদল নাই। অনেক বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস আছে। কিন্তু এ গল্প আমার খুবই কাছের, আমার বর্তমান। আমার স্বজনদের জন্য পরীক্ষার, আমাকে ভালোবাসার। সেই গল্পটা আমার বন্ধুদের জানাতে চাই, অন্তত এক অধ্যায়ের সমাপ্তির আগে আগে। … অবশ্য পুরো গল্পটা এভাবে শেয়ার করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই)

আগের পর্ব: অসুখের দিন, বাবা আর আমি পাশাপাশি

কোনো এক ঈদে ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পথে, নোয়াখালী

মেজো খালু মারা গেলেন। অনেক দিন পর পরিবারে কেউ মারা গেলেন, যার খুব কাছ থেকে আমি ঘুরে এসেছি। উনার লাশ নেওয়া হলো নোয়াখালী। দুলাভাই সঙ্গে গেলেন। লাশটুকু দেখতেও আমার যাওয়া হলো না। আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছি।

অসুখের শুরুটা এমন। তখন ‘কাঠবিড়ালি’ নামের একটি সিনেমা মুক্তি পাইছে। অফিসের ফাঁকে দুজন বন্ধুর সঙ্গে এক শনিবার দেখতে গেলাম। অফিসে ফিরে কিছুক্ষণ কাজ করলাম। সন্ধ্যার সময় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে একটা অনুষ্ঠানে গেলাম। প্রকাশিতব্য চার-পাঁচটা কবিতার বই নিয়ে আলোচনা, পরস্পরের উদ্যোগে। বের হওয়ার পর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আড্ডা দিলাম, পায়ে অনেক ব্যথা হচ্ছিল। গাড়ির প্রচণ্ড জ্যাম আর পরদিন ছুটির দিন হওয়ায় তাড়া ছিল না তেমন, শুধু ক্ষুধা ছিল।

রবিবার গোসল করে দেখে আপা রাই সরিষার শাক ভাজছে। সাথে রুই মাছ ভাজা। শাকের গন্ধটা এত ভালো লাগলো, বললাম, ‘আজ অনেকগুলো ভাত খাবো’। সত্যি সত্যি এক-দেড় প্লেট খেয়ে ফেললাম। প্রতিক্রিয়া পেলাম দ্রুতই। দুপুরের পর থেকে ভয়ংকর পেটে ব্যথা। শাক যতক্ষণ পেটে ছিল ততক্ষণ ব্যথা আর অস্বস্তির মধ্য দিয়ে গেলাম। এত দিন হালকা জ্বর আর ব্যথা থাকলেও আবার ভীষণ জ্বরে পড়লাম।

এর মাঝে সার্জেন খোঁজাখুঁজি চলছিল। আল হামরা হাসপাতালের একজন সার্জেনের নাম পাইলাম। ডা. শাহ মোহাম্মদ ফাহিম খোঁজ নিয়ে বললেন, তিনি অভিজ্ঞ ও বেশ সুনাম আছে।

বাবা তখনো জানতে পারেন নাই কিছুই। আমার প্রতি আম্মা-বাবার যে আবেগ সে কারণে আমরা উনাদের কিছু বলতে পারি না। উনাকে বলা হলো, ডাক্তার কিছু ওষুধ দিছেন। শিগগিরই সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার উনার সমস্যাও ঠিক ধরতে পারছেন কিনা বুঝতে পারছিলেন না। অনেকগুলো টেস্ট আর ওষুধের পরামর্শের পর বাড়ি ফিরে গেলেন। আমিও আবার অফিস যাওয়া শুরু করলাম। আমাদের ডেপুটি এডিটর মাহবুব মোর্শেদ ভাই বলছিলেন, ‘সুজন তাড়াতাড়ি অপারেশন করান। একজন মানুষ শরীরের মধ্যে পাথর নিয়ে ঘুরছে এটা ভাবতে কেমন লাগে?’ কিন্তু প্রতিদিন এত ক্লান্তি ভর করে যে, যাবো যাবো করে যাওয়া হয় না।

একদিন ফেসবুকে খেয়া মেজবার একটি পোস্ট দেখে মনে হলো, হাসপাতাল তো উনার বাড়ির কাছে। উনাকে নক দিতে বললেন, চলে আসেন ফার্মগেটে। একসঙ্গে হাসপাতালে যাই।

অফিস থেকে বের হলাম। ভাবলাম, ফার্মগেট এমন কী আর দুরত্ব। হলি ফ্যামিলি যাওয়ার মতো বোকামি করলাম আবার। বাংলামোটর থেকে বেশ দ্রুত আসার চেষ্টা করলাম। তারপরও ২০-২৫ মিনিট লাগলো। অসম্ভব ব্যথা হচ্ছিল সারা শরীরে। সেজান পয়েন্টের সামনে খেয়ার সঙ্গে দেখা। উনি নাকি আমাকে চিনতেই পারছেন না। ও হ্যাঁ, ততদিন আমার ওজন মোটামুটি ১০-১২ কেজি কমে গেছিল। অবশ্য ওজন আগে থেকেই কমছিল, কিন্তু কোনো কষ্ট ছাড়া ওজন কমা নিয়ে আসলেই খুশির ছিল না। শরীরের ভেতর পাথর জমছে, উল্টো দিকে এর প্রতিক্রিয়া ওজন না বেড়ে কমছে! একটু অদ্ভুতই তো!

খেয়ার সঙ্গে বছর দু-এক পর দেখা। ফলে অনেক কথা জমেছিল। কথা বলতে বলতে চলে গেলাম। আল হামরা হাসপাতালের রিসিপশনে একটা ফোল্ডার দিল— যেখানে সব ডাক্তারের নাম, পরিচয় ও শিডিউল দেওয়া আছে। আমি আকবর আহমেদের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন, তিনি সিনিয়র ডাক্তার। উনার বেশ সুনাম আছে। চাইলে আজ সন্ধ্যায় কথা বলতে পারি। আমি তো কোনো কাগজপত্র নিয়ে যাই নাই। বললাম, পরে আসবো।

আমরা কাছের একটা রেস্টুরেন্ট বসলাম। খেয়া বলল, ওর নাকি মুরগির গ্রিল খাইতে ইচ্ছে হচ্ছে। ওয়েটারকে গ্রিল অর্ডার দিলেন। আমি বললাম, মাংস তো খাইতে পারবো না। আমার জন্য একটা সবজির অর্ডার দেন। উনি বলছিলেন, আমার চিমসে যাওয়া চেহারা-সুরত দেখে গ্রিলের কথাই মনে পড়ছিল। আমরা দুজনেই হাসলাম। পরে বললেন, হাসপাতালে ভর্তি হলে খাবার নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনি বললে আমি বাসা থেকে রেধে নিয়ে আসবো।

মনে আছে, অপারেশনের সময় ঠিকঠাকের পর রাশেদ আমাকে চিকেন খাওয়াইতে নিয়ে গেছিল। সঙ্গে ছিল ফাহিম মুনতাসির। আমিও ভয়ে ভয়ে খাইলাম। এটাও কি আমার চেহারা দেখে পছন্দ করছিল! হাসপাতালের এ দিনগুলোতে আমার পাশে নিয়মিত ছিল রাশেদ। ও আমার স্কুল বন্ধু। একসঙ্গে ক্লাস সেভেন থেকে পড়েছি। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে, তবে আলাদা সাবজেক্টে। একই হলেও ছিলাম কিছুদিন।

দিন কয়েকের মধ্যে সিরিয়াল দিয়ে সন্ধ্যার দিকে ডাক্তারের কাছে আসলাম। ডা. আকবর আহমেদ বললেন, ইউএসজি, এক্সরে, রক্ত পরীক্ষা করান। অপারেশন তো মাস্ট। গলব্লাডারের পাথরের অন্য কোনো চিকিৎসা নাই।

পরদিন সকালে এসে ইউএসজি করালাম। ওই বিভাগের হেড ভদ্রমহিলা। উনি বললেন, আপনার অবস্থা তো খারাপ। গলব্লাডার দেখা যাচ্ছে না। পাথরের কিছু শ্যাডো দেখে বোঝা যাচ্ছে গলব্লাডার ওখানে আছে। সম্ভবত ফেটে গেছে। সিটি স্ক্যান করে দেখেন। পরে ডা. আকবর আহমেদ বললেন, হ্যাঁ, খারাপ তো বটে। এ অবস্থা হয়ে গেল, আপনি একটুও বুঝতে পারেন নাই। কিন্তু সিটি স্ক্যান করে টাকা খরচ করবেন কেন? যা বোঝা যাচ্ছে ল্যাপারোস্কপি করা যাবে না। ওপেন সার্জারি করতে হবে। যেহেতু পেটই কাটা হবে আলাদা করে এ পরীক্ষা করে শুধু শুধু অনেকগুলো টাকা খরচ করবেন কেন। এরপর আরও কিছু টেস্ট করালাম। ইসিজিও ছিল।

একদিনের কথা মনে পড়ছে। সকালে হাসপাতালে গেছি। সম্ভবত যেদিন ইউসিজি করালাম। অ্যাপের মোটরসাইকেলে অফিসে গেছি। হাতভর্তি হাসপাতালে রিপোর্ট। খুব গরম আর জ্যাম। হোটেল সোনারগাঁও পার হয়ে নেমে গেলাম। শরীরে ভীষণ ব্যথা, গরম তো আছে— এর মাঝে খেয়াল করলাম বেল্ট থাকা সত্ত্বেও আমার প্যান্ট যেন খুলে পড়ে যাচ্ছে। হাত দিয়ে ধরে হাঁটা শুরু করলাম। কী যে বিব্রতকর অবস্থা। কান্নাও পেল। এরপর বাংলামোটর মোড়ে আসার পর খোঁজাখুঁজি করে একজন মুচি পেলাম। উনাকে দিয়ে বেল্টে একটা ছিদ্র করালাম। এরপর একটু স্বস্তি পেলাম। সে দিনের অবস্থাটা এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে।

ও সময় দেশে করোনা নিয়ে ততটা তোড়জোর শুরু হয় নাই। তবে হাসপাতালগুলোতে এ নিয়ে কিছু প্রস্তুতি চলছিল বোধহয়। ঠিক মনে নাই, কোনো এক হাসপাতালে চীনা লোক দেখে রোগীরা কী যেন বলাবলি চলছিল। যাই হোক, ডা. আকবর আহমেদ রিপোর্ট দেখে বললেন, দ্রুত অপারেশন করে ফেলেন। আগামী সপ্তাহ আমি আবার ওমরাহ করতে যাবো। কাল পারবেন। বললাম, না। আরেকটা দিন সময় লাগবে। অফিসে ছুটি, টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। সেদিন মঙ্গলবার ছিল, উনি বললেন, তাহলে বৃহস্পতিবার সকাল সকাল চলে আসেন। আটটার পর কিছু খাবেন না। এসে ভর্তি হয়ে যাবেন।

বুধবার অফিসের যাওয়ার আগে ব্যাংকে গেলাম টাকা তুলতে। অনেকক্ষণ পর জানালো আমার অ্যাকাউন্ট ডরমেন্ট করা হয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন লেনদেন হয় নাই কোনো। আমি বললাম, গত কয়েক মাসে টাকা জমা দিলাম। তারপরও এ ব্যবস্থা। তারা বলছে, বেশ আগেই ডরমেন্ট হয়ে গেছে। অথচ এতদিন টাকা জমা দেওয়ার সময় বলে নাই। এখন কাগজপত্র জমা দিয়ে অ্যাকউন্ট সচল করলে টাকা পাবো। সেটার জন্য সময় লাগবে। এত অল্প সময়ে টাকা কোথায় পাবো? কী একটা নাটকীয় অবস্থা। ভাগনে নিশানকে ফোন করতে বলল, কোনো সমস্যা নাই। ও টাকা দিচ্ছে। তারপর অফিসে এসে সম্পাদককে জানালাম। কিছু কাজ করে বাসায় ফিরলাম। শুনলাম, অপারেশনের কথা শুনে আমার বউ রওয়ানা দিয়েছে ওর ট্রেনিংস্থল থেকে, সঙ্গে আসছে ভাগনি ও তার স্বামী।

২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল সকাল আল হামরায় চলে গেলাম আমি, দুলাভাই ও আমার বউ। ভর্তি হলাম। কেবিনে ঢুকে কাপড়-চোপড় ছাড়লাম। ডাক্তার ও নার্স এসে দেখে গেল। শরীরের তাপমাত্রা বেশি বলতে একবার মেপে গেল। দুই বা তিনটার পর এসে একজন কেবিন বয় এসে হুইল চেয়ারে করে আমাকে নিয়ে গেল। হুইল চেয়ারে এর আগেও বসছি মানে মাসখানেক আগে হাসপাতালে যখন ভর্তি হইছিলাম। কিন্তু এখন যখন হাসপাতালের করিডর দিয়ে যাচ্ছিলাম কেমন একটা বিচ্ছেদের ব্যাপার ঘটতেছিল। এমনও হলো ভাবি একটা ছবি তুলে রাখি। কী আজব একটা ভাবনা না! এটা সম্ভবত দেখনেওয়ালা যে জীবন-যাপন করছি তার ফলাফল। অথচ এতে আমার কিছু আসে আর যাবে না। এ ধরনের অসুখ-বিসুখের যে ব্যাপারগুলো ঘটে তা আসলে অন্যদের সঙ্গে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাগাভাগির মানে কী? যদিও কাজটা আমি নিজেই করছি। এর মধ্যে নিজেকে হয়তো খানিকটা সুবিধাপ্রাপ্ত বা মানুষের করুণা আদায়ের ব্যাপার থাকে। করুণাকে আমি খারাপ অর্থে দেখি না। বরং সোসাইটিতে এর বিকৃত অর্থ তৈরি হয়েছেই বলে মনে করি।

যাই হোক, আমাকে অন্য একটা বিল্ডিংয়ে নেওয়া হলো, যা অপেক্ষাকৃত পুরোনো। করিডরে অনেক মানুষ বসা। অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া রোগীদের স্বজন। একটা রুমে বসানো হলো। যেখানে স্যালাইন চলছে, ব্যথা কাতরাচ্ছে এমন রোগী আছেন। আমার হাতেও স্যালাইন লাগানো হলো। পাশে বসে ছিল অল্প বয়সী একটি ছেলে। তার বোধহয় কোনো জটিল সমস্যা ছিল— এতদিনে বিস্তারিত মনে নাই। ঠিক কতক্ষণ ছিলাম জানি না, একজন আয়া এসে ডেকে নিলেন। ওয়াশরুমে গেলাম। আগের বিল্ডিং যতটা ঝকঝকে, এটা তার চেয়ে বেশি ম্লান। অবশ্যই ইতিমধ্যে আমার হাইপাওয়ারের চশমা খুলে নেওয়া হয়েছে। স্যান্ডেল জোড়াও ওয়েটিং রুমে দিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে রাশেদ ও আপাও আসছেন। চশমা দিতে দিয়ে আপাকে এক ঝলক দেখলাম।

এদিনও নাকি বেশ সাজগোছ করা ডাক্তার চোখে পড়ছে অপারেশন থিয়েটারে। সম্ভবত তারা কোনো অনুষ্ঠানের যাবে সন্ধ্যায়। যেমনটা এনডোসকপি করার দিন আমার মাথা ধরে ছিলেন ‘বিয়ের পোশাক’ পরা এক নারী। পরে আরও কয়েকজনকে দেখছিলাম সাজুগুজু করা। ভাবুন তো, ডাক্তারদের জীবন— অসুস্থতা, কাটাকুটি, চিৎকার-চেচামেচি, ভুল হওয়ার শঙ্কা, এর মাঝেই জীবন বয়ে যায়।

অপারেশন টেবিলে শুয়ে পড়লাম, দুই হাত ছড়িয়ে। মাথার ওপর কড়া আলো। চশমা না থাকায় সবকিছু ঘোলা ঘোলা অপার্থিব লাগছিল। আল্লাহকে ডাকতেছিলাম। একজন একটা নল এগিয়ে নিয়ে এলেন মুখের কাছে। তারপর একটু পরই অন্ধকার! ঠিক অন্ধকার কিনা জানি না। এরপর আবারও অজ্ঞান হতে হবে! অজ্ঞান হওয়াকে একটা অনিশ্চিত বিষয় বলে মনে করি। এটা ঘুমের মতো কিছু না। ঘুমে আমরা স্বপ্ন দেখি, তাকে ঘুম বলেও ক্লেইম করতে পারি। এমনকি মৃত্যুর ভাইও বলি। কিন্তু অজ্ঞান হওয়া এমন একটা অবস্থা— যেখানে আমরা কোনো কিছুই ক্লেইম করতে পারি না। এবং তখনো ভাবতে পারি নাই, এমন অবস্থায় আরও তিনবার পড়তে হবে।

এখানে দুটো জিনিস মনে রাখতে পারেন। এক. আমাকে অতিরিক্ত টাকার খরচ থেকে বাঁচাতে সিটি স্ক্যান করাতে মানা করেছিলেন ডা. আকবর আহমেদ। দুই. কয়েকদিন পর ওমরাহ’য় যাচ্ছেন। তার আগেই হাতের সার্জারিগুলো শেষ করতে হবে।

চলবে …

Comments

comments