পৃথিবীতে হাঁটাহাঁটির দিনগুলো

ইউনিভার্সিটির স্মৃতিগুলো ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। এ নিয়ে হতাশা আছে এমন না। নতুন করে রংতুলি নিয়ে না বসলেও কিছু কিছু চিরকাল রঙিন হয়ে থাকবে। বাস্তবজ্ঞান হারা কোনো দিন তারা সত্য হয়ে ফিরতে পারে, এতটা নাদান কি হবো!

জারুল ফুলের দিনে বাসে ঘুমিয়ে পড়া। জেগে ওঠার পর মনে হবে, আহ শান্তি! অনেক জনম ঘুমালাম। এটা তো ভুলবো না। ফজরের নামাজের পর ও দুপুরের খাবার পর বারান্দায় বসে কফি খাওয়া, পাখির গান শোনা। এটাও ভুলব না। হ্যাঁ, ক্লাশ-বন্ধু-আড্ডা সবই ক্রমশ ধূসর। বাকি শুধু হাঁটাহাঁটির দিনগুলো। দুপুর-সন্ধ্যা-রাত-সোনালু ফুলও ছিল সঙ্গী।

কলেজ থাকাকালে আমি আর সুজন ছুটির পর প্রচুর হাঁটতাম, যতক্ষণ না ওর বাড়ির কাছে পৌঁছে যাচ্ছি। তারপর বাসার কাছাকাছি এসে দুজন দুদিকের রিকশা নিতাম। কত অল্প পথ, হাসি পেতো। এরপর কলেজ ছাড়াকালে ভীষণ একা একা দিনগুলো ক্রমাগত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরপাক, দুনিয়ার সঙ্গে কানেক্ট করার উদগ্র বাসনা।

ইউনিভার্সিটির হাঁটাহাঁটির দিনের সূচনা মাসুদের সঙ্গে, ‘ফাদার ফিগার’ মাসুদ জাকারিয়া। মনে আছে, প্রথম যখন মাসুদ-রিফাতদের বাসায় থাকতে গেলাম, অনেক রাত পর্যন্ত শহরের উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে হেঁটেছিলাম। মাসুদ তখন ভীষণ কবি, ভাবুক ও প্রেমিক মানুষ। হাঁটা শেষ হলেও ওর গল্প শেষ হতো না। সম্ভবত এখনো! ক্যাম্পাসে কখনো কখনো রাতের বেলায় রিকশায় বের হয়ে পড়তাম আমরা। সেখানে আকাশ-প্রান্তর সবই বিশাল ছিল। এমনকি পরীক্ষার দিন সকালে আমাদের পাওয়া যেতো প্যাগোডার পেছনে সুইসগেটে।

দুনিয়াটা কী? বা পেছনের দিনগুলো। মাঝে মাঝে মনে হয় টেলিভিশন দেখার মতো। টেলিভিশন আবিষ্কারের আগে সেটা কী ছিল! এমন একটা ধাক্কা পাইছিলাম, আমি আর মিশু সেদিন অনেকটা রাতে হাঁটতে হাঁটতে কলা ভবনের ঝুপড়িতে গেছিলাম। দেখলাম তখনও কিছু দোকান খোলা, বৃষ্টি আসবে এমন একটা ব্যাপার। দোকানিদের তাড়াহুড়ো। আমার মনে হচ্ছিল, পুরো জিনিসটা আমাদের সামনে ঘটছে না, আমি টিভি দেখছি। কেন মনে হইছিল জানা নাই। হয়তো তাদের জগতটাও আমাদের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারছিল না, যেহেতু লেনা-দেনা নাই কোনো। এমন নাও হতে পারে। এরপর থেকে পুরোনো দিকগুলো কোথাও দেখা একটা ঘটনা মনে হয়। বাস্তব নয়। এমনকি কখনো কখনো কোনো ঘটনায় মনে হয়, এমন কোথাও ঘটছে যে সময়ে আছি, তখনকার নই! ওহ! পৃথিবীতে হাঁটাহাঁটির কথা বলছিলাম।

গত বছরের শেষ দিকের ঘটনা। আমি আর মিশু খিলগাঁওয়ে হাঁটছি। যেহেতু আমার ‘মাঝপথে হাঁটতে না পারার দুঃস্বপ্ন আছে ও অসুখের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছিলাম’ বেশ ক্লান্ত লাগছিল। তখন একটা কথা ভেবে মজা পাইলাম।

ধরেন, একজন ফেরেশতা ১৬-১৭ বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলো। আবহাওয়া শুকনোই ছিল, দুটো ছেলে হাঁটতে বের হইছে, ঢাউস একটা চাঁদের আলোয়। হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি। সব কিছু ঠান্ডা করে থেমেও গেল। ঠান্ডায় বড় ছেলেটার গা কাঁপছে, ছোট ছেলেটা নিজের শার্ট খুলে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ভাই পরেন। এই যে, আরেকজনের পোশাক গায়ে পড়ে নেওয়া। গন্ধ ও অনেক স্মৃতিসমেত! তারপর থেকে আমরা হেঁটে যাচ্ছি দুই ভাই। ওহ! ফেরেশতাকে ভুলে যাই নাই। উনি অনেকবার পৃথিবীতে আসছেন। অবাক হয়ে দেখেন আর ভাবেন— এ ছেলে দুটো এত হাঁটে কেন! মান-অভিমান নিয়েও পরম্পরের সঙ্গে কথা না বলে ঘণ্টার পর হাঁটে!

হাঁটাহাঁটির সেরা দিনগুলোর একটা আসছি দারাশিকো ভাইয়ের সঙ্গে, অষ্টগ্রামে। ভীষণ গরমে হাওরের মাঝের চকচকে রাস্তায় হাঁটছিলাম। যেখানে দুনিয়া অনেক বড়। আকাশ ভরা তারা। কী যে আনন্দ! মনে মনে কেঁদে কেঁদে অস্থির!

হাঁটাহাঁটির মজার সঙ্গীর শাহনেওয়াজ। ইউনিভার্সিটিতে হলে নাকি আমাকে চিনতো, যদিও ঢাকায় পরিচিত হওয়ার পর মনে হয় নাই কখনো দেখছি! হা হা হা! ওর সঙ্গে ২০-৩০ জেলায় ঘোরা হইছে। ওর হাঁটার ধরন মজার। কোথাও যাচ্ছি, হনহন করে হাঁটতে থাকবে, সঙ্গী তাল মেলাতে পারছে কিনা, দেখাদেখির সময় তার নাই। কতবার যে ভিন জেলায় গিয়ে রাগ করে আমি উল্টো দিকে চলে গেছি! হ্যাঁ, আমি রাগ করতেও পারি ভীষণ। এমনও হইছে কোনো জায়গায় গাড়িতে করে গেছি, আমরা জানি ফেরার পথে কিছু পাওয়া নাও যেতে পারে! তারপরও গেছি, আর লম্বা পথ হেঁটে হেঁটে ফিরছি। ভাগনি মায়েদার ছোটবেলার খেলার একটা লাইন মনে পড়ছে, কাঁঠাল গাছে পানি দিতে দিতে আমার কোমর ভেঙে গেছে রে!

পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সম্পর্ক সূত্রও কি হাঁটাহাঁটি নয়, বাবাকে নিয়ে যখন ভাবি দেখি, উনার হাত ধরে হাঁটছি। সবুজ আল ধরে হাঁটি, ভোরে। আর দাদার সঙ্গে যতটুকু অন্তরঙ্গতা সেই হাটবারে দেড়-দু’ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাজার-সদাই নিয়ে বাড়ি ফেরা, আর বাকি সময় তাকে এড়িয়ে চলতাম, ভয়ে… হাঁটাহাঁটি তো নেশার মতো। মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাবেন। তখন ক্লান্তি আপনাকে ছুঁতে পারবে না। এমন ঘোর মাঝে মাঝে হয় তো!

হাঁটাহাঁটির কথা তো বলে শেষ হবে না। আর দুনিয়া মানে যতক্ষণ হাঁটাহাঁটি ততক্ষণ থাকা। শেষ গল্পটা সুন্দরবনের। অসংখ্যবার হাসপাতালে যাওয়ার ধকল থেকে রিল্যাক্স খুঁজছিলাম, সে সময়ে শাহনেওয়াজ বলল, চলেন সুন্দরবন যাই। আপনার কাছে টাকা থাকবে না জানি, আমিই দিয়ে দিচ্ছি। তো, পশুর নদীতে গিয়ে জাহাজে ওঠাও একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। সেটা অবশ্য হাঁটা নয়, দৌড়। কারো কাছে জীবন মানে দৌড়।

যাই হোক, টুরের দ্বিতীয় দিন ভোরে একটা এলাকায় নামছিলাম, অন্য জাহাজের আগে আগে। বন, বান্দর, শূকর, হরিণ দেখে-টেখে ফেরার পর জম্পেশ নাশতা। তারপর হলো একটা লম্বা পথ ধরে হাইকিং। চার-পাঁচ ঘণ্টার জার্নি। কোনো সমস্যা নাই। কেবিনে গিয়ে রেডি হওয়ার পর শরীরে অস্বস্তি (যা এখনো যাই নাই, আবার হাসপাতালে হাসপাতালে দৌড়), বুঝলাম হাইকিং হচ্ছে না। জাহাজের লোকজন, আমি আর সন্দেহজনক এক দম্পতি ছাড়া কেউ নাই। মনের কষ্টে সবার চলে যাওয়াটাও দেখলাম না। পরে ফ্রেশ হয়ে ডেকে বসলাম। জাহাজের চালক, ওই দম্পতি অনেক সান্ত্বনা দিল। অহেতুক হাঁটাহাঁটির নিন্দা করলেন। কিন্তু মনে পড়ে রইলো পথে! সেখান থেকে মন তুলে আনা কঠিন। আনতেও চাই কি! যতদিন আছি। পৃথিবীতে।

Comments

comments