সুইজারল্যান্ড একটা সুন্দর দেশ!

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত ‌‌‘উত্তরা’ মুক্তি পায় ২০০০ সালে।  সমরেশ বসুর গল্পের ভিত্তিতে চিত্রিত এই সিনেমায় নাম ভূমিকায় আছেন জয়া শীল। আছেন তাপস পাল ও শঙ্কর চক্রবর্তী। রাইসুল ইসলাম আসাদ খ্রিস্টান পাদ্রি চরিত্রে অভিনয় করেন।

সুইজারল্যান্ড একটা সুন্দর দেশ! টাইফয়েডের ঘোরে আমার বন্ধু তার বোনকে কানে কানে বলছিল। বোন সরল বিশ্বাসে বলল, তুমি গেছিলা? আমার বন্ধু বলল, বেয়াদব মেয়ে! তারে যখন আমি হাসপাতালে দেখতে গেলাম, কিছু একটা বলতে চাইলো। মুখের কাছে কান নিতে বলল, মিশেল ফুঁকো কত বড় দার্শনিক! অথচ লোকটা শুয়ে থাকে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের সাথে। ওর টাইফয়েড ভালো হয়ে যাওয়ার পর এই ঘটনাগুলো বললাম। কী প্রতিক্রিয়া দেখাইছিল মনে নাই। মেলা বছর আগের কথা। ইউনির্ভাসিটি সেকেন্ড ইয়ারে। মে বি!

যখন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘উত্তরা’ দেখতে ছিলাম। পুরুলিয়ার রেলরোডের আশপাশে যার গল্প। খোলা মাঠ। হালকা জঙ্গল। সবুজ ঘাস। দেখে সুইজারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ফিল আসতেছিল। পরে দেখলাম লোকার্নোর ফান্ড বা কিছু একটা পাওয়া সিনেমা। সেখানে একজন পাদ্রী আছেন, আমাদের রাইসুল ইসলাম আসাদ। ধাক্কা খাইলাম। ওনাকে শুধুমাত্র গরীবের সুইজারল্যান্ডে মানায়। হ্যাঁ, চার নবদীক্ষিত খ্রিস্টান দেখা যায়। স্যামুয়েল, পিটার…। যারা ফ্রি খাওয়া ও আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্নে খ্রিস্টান হইছে। যেহেতু তাদের ধর্ম এক। আমেরিকা গিয়া সাদা মেম বিয়ে করবে। তাদের বাচ্চারাও হবে সাদা। আমেরিকা যাওয়া খুব সোজা। কলকাতা গিয়া জাহাজ ধরতে হবে। সাগর পাড়ি দিলে সামান্য হাঁটা পথ!

এরা চেহারা সুরতে এতই খবিস- মনে হয় ম্যাক্সিম গোর্কির ‘আমার ছেলেবেলা’ থেকে উঠে আসছে। যাই হোক, গল্পের যে নায়িকা- উত্তরা। সেই মনে হয় এই বাঙলায় হতে পারতো প্রতিরোধের প্রাণ ভোমরা। কিন্তু দেখেন, দুই বলশালী পুরুষ (নিমাই ও বলরাম)। একজন উত্তরা জামাই, আরেক জন জামাই-এর কলিগ। তারা এই নারীর দেহের জন্য কুস্তি লড়ে যাচ্ছে। যেখানে পাদ্রীকে বাঁচানোর জন্য উত্তরা চিৎকার তাদের কানে যায় না।

তখন জোনাথন সুইফটের গল্প থেকে ছিটকে পড়ার মতো সেই এক লিলিপুট। আদতে সে লিলিপুট নয়। একজন বামন। সে-ই উত্তরার ডাকে সাড়া দিয়া পাদ্রীরে বাঁচাতেই যায় গুণ্ডার হাত থেকে। পারে না। তখন উত্তরা ঠিক করে, জামাইয়ের কাছে ফিরিবে না আর। তার পায়ের নূপুর খুলে ছুড়ে ফেলে। বন্দিত্ব থেকে মুক্তি। যেটারে উত্তরা আগে বলছিল, ‘শিকলই তো!’

পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

তখন বামন বলে, আমাকে বিয়ে করো। আমাদের বাচ্চারা তোমার মতো ভালো হবে। উত্তরার চিন্তা, বাচ্চারা যদি বামন হয়? বামন বলে, তাহলে ভালো। তাদের গ্রামে সবাই ভালো। সবাই বামন। যেদিন দুনিয়ায় বামনের রাজত্ব হবে সেদিনই শান্তি। তাদের দেশ কই? এই যে পাহাড়। তার ওপাশে। সেখানে অবশ্য যাওয়া হয় না। বামনকে গুণ্ডারা মেরে ফেলে। রেপ শেষে উত্তরাকেও মারে। শুধু ওই ছেলেটা রয়ে যায়। যাকে আশ্রয় দিছিলো পাদ্রী।

ওই ছেলের মা-বাবার দেওয়া নাম রাখাল, যেহেতু তাদের অপঘাতে মৃত্যুর পর পাদ্রীর আশ্রয়ে গিয়া ব্যাপটাইজ হইছে, এখন ডাকা হইতেছে ম্যাথু। এই নিয়া ঝগড়া আছে খানিক। কারণ ধর্ম পাল্টানোতে ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা বাধ্য হওয়ার একটা তর্ক থেকেই যায়। গরীবের মানুষের ক্ষেত্রে তো আরও বেশি। সেই ছেলে এর পর কার কাছে থাকবে, কী পরিচয় হবে জানি না! সে চলে যাইতেছে মুখোশ পরা নাচুনে দলের সঙ্গে।

এটা যে কী ব্যাপার! বুঝি না। ঘটনার ফাঁকে ফাঁক গান ও নৃত্যকলা ভালো লাগতেছিল। কিন্তু, মনে হচ্ছিল- এই যে শিল্প। তা অনেক কিছু মুখোশের আড়ালে রেখে সত্য বলতে চায়। অনেক কিছুকে এক করতে চায়। যেন এই সব বিরোধ কোনো ব্যাপার না। শিল্প গুছায়া দিচ্ছে। একে ছাড়া আমরা বাঁচি না। যেন সেও আরেক মুখোশ।

আর…সুইজারল্যান্ড। ‘আ ফেয়ারওয়েল টু আমর্স’এর নায়িকারে নিয়া যেখানে থাকতে চায় নায়ক। যেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশের অনেক অনেক কালো টাকা জমা আছে। সে টাকা দিন দিন শুধু বাড়ছেই। সেখানকার লোকেরা খুব সুখী। আমাদের সেটা মনে হয় কখনো কখনো। যেমন; নিউজিল্যান্ড। যে দেশে গরু খায় সবুজ ঘাস বারো মাস!

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত ‌‌‘উত্তরা’ মুক্তি পায় ২০০০ সালে।  সমরেশ বসুর গল্পের ভিত্তিতে চিত্রিত এই সিনেমায় নাম ভূমিকায় আছেন জয়া শীল। আছেন তাপস পাল ও শঙ্কর চক্রবর্তী। রাইসুল ইসলাম আসাদ খ্রিস্টান পাদ্রি চরিত্রে অভিনয় করেন।

Comments

comments