পাঠকের লেখায় ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’

ইফতেখার জামিল লিখেছেন

আমার একজন প্রিয় মানুষ ওয়াহিদ সুজন ভাই_ তার প্রাথমিক পরিচয়, চিটাগাং বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্র, বিনোদন সাংবাদিক ও আমলি ইমানদার। দর্শন , বিনোদন-সমালোচক ও আমলি ইমানদার , এই তিন বৈশিষ্ট্য একসাথে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার বটেই এবং একই সাথে নতুন নাগরিক সমাজে লড়াইয়ের নতুন সমীকরণও বটে। কয়েকদিন আগে তার একটা বই প্রকাশিত হয়েছে, “উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে” এই নামে । তিনি ও তাঁর বই, আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কেন?

আমরা যে সমাজ-সভ্যতায় আছি, সে সমাজে একইসাথে দুটি পৌত্তলিকতা আছে_ যৌক্তিক ও নান্দনিক। যৌক্তিক পৌত্তলিকতার অর্থ হল, আমাদের হাজির চিন্তাতরিকার মধ্যে এই অনুমান প্রধানভাবে কাজ করে যে একমাত্র যুক্তির মাধ্যমে সত্য ও কারণের নিশ্চিতি সম্ভব_ ফলে পৃথিবীর হাজির সঙ্কট ও সমস্যা শুধু মাত্র যুক্তি ও বুদ্ধির মাধ্যমে মীমাংসা এবং অবস্থাবুঝে নতুন সত্যও হাজির করা সম্ভব_ এর ক্রিটিক আপনারা নিটশের কাছে পাবেন , জালালুদ্দিন রুমির কাছেও পাবেন।

দ্বিতীয় পৌত্তলিকতা হল, নান্দনিক পৌত্তলিকতা। হাজির সভ্যতা নানা বিনোদন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের রাজনৈতিক নৈতিকতায় সন্দেহ সৃষ্টি , খৃষ্টান ধর্মতত্ত্বীয় সঙ্কট হাজির করে মানবিক সার্বভৌম ক্ষমতার পথ তৈয়ার করা এবং জনগণের মধ্যে সমষ্টির ধারণা দুর্বল করে “ব্যক্তিগত নাগরিক” হিশেবে রুপান্তরিত করার চেষ্টা করে । ফলে এই সভ্যতার নান্দনিকতার নৈতিক ও রাজনৈতিক সমালোচনায়জরুরি। শারুখ খান, কাটরিনা বা সানি লিওনের শানে নুজুল বুঝার জরুরত আছে এবং জরুরত আছে প্রাচ্যের নান্দনিকতার প্রচারে ও ব্যাখ্যায় সময় ব্যয় করারও।

তারও আগে আমাদের সমাজে মারেফতি-দুর্বলতা, একইসাথে মারেফাতকে আমলে ও শরিরে বহন করায় অবহেলা আছে, ফলে দার্শনিক জায়গা ও ক্ষমতা তৈয়ারের জন্য আমলি ইমানের গুরুত্ব অপরিসিম। সুজন ভাই এটি জানেন এবং আরও ভালোভাবে নিশ্চিত হবার জন্য হয়তো, তাঁর মধ্যে প্রথাগত অর্থের ধর্মীয় নিশ্চিতি নিয়ে প্রশ্ন ও পর্যালোচনা আছে। ( এ বিষয়ে তার এমফিল আছে) ।

সুজন ভাইয়ের মধ্যে ক্রিটিকাল চিন্তার প্রবণতা আছে। এবং একই সাথে তিনি সাংবাদিক-লেখকও বটে। এর ফলে – ক্রিতিকাল ও সাংবাদিক চিন্তকদের মত- তার মধ্যেও নতুন সত্য নির্মাণে ও নৈতিকতার চিরন্তনতা ধরতে দ্বিধা আছে, সে থাকুক।

আমিও ব্যক্তিগতভাবে ভাবের জগতের কাজ করতে আগ্রহী_ আমার আগ্রহ ইসলামি চিন্তার মধ্যে এর সুলুক খোঁজা এবং উপমহাদেশের সিলসিলার ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা হাজির করার দিকে। উপমহাদেশে কখনই মারেফাত ও শরিয়তের মধ্যে বৈপরীত্য ছিলনা, এ অর্থে যে, এ অঞ্চলের মুসলমানরা মারেফাত ও ইখলাস ছেড়ে শুধু জড়-আমলে ব্যস্ত হননি এবং একই সাথে দার্শনিক-মারেফাতের কথা বলে আমল ছাড়েননি। সুজন ভাইয়েরও হয়তো এই বিশ্বাস আছে।

এই বিশ্বাস থেকে বলা যায়, আমার আর সুজন ভাইয়ের পথের দূরত্ব খুব কম!

মূল লেখার লিংক এখানে

…………………..

চিহ্ন ধরে খুঁজে ফেরার গল্প : তানিয়া রহমান

গল্প না বলে উপায় নেই আসলে বইটি পড়ে। লেখক ওয়াহিদ সুজন উকিল মুন্সীকে জানার জন্য যে খোঁজাখুঁজি করেছেন, সেই অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন গল্প বলার ঢঙে। পাঠকের এ-ও মনে হতে পারে যে তিনি নিজেও সেই যাত্রার সাথি হয়ে নেত্রকোনার পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর এই গল্প বলার ঢঙের কারণেই বইটি হয়ে উঠেছে অনন্য। বইটির ভূমিকা লিখেছেন ফরহাদ মজহার। বাংলার নদীয়ার ভাবের সঙ্গে একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন তিনি ভূমিকাতে। উকিল মুন্সীর গানের প্রধান উপজীব্য বিচ্ছেদ, এমন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন ফরহাদ মজহার এখানে। আবার একই সঙ্গে নদীয়ার বিচ্ছেদ ভাবনার সঙ্গে এই বিচ্ছেদী ভাবের মিল ও অমিলগুলো ব্যাখ্যাসহ হাজির করেছেন। বইটি পড়ে উকিল মুন্সীকে জানা তো যাবেই, বাংলার ভাবের জায়গায় উকিল মুন্সীর কী অবস্থান, সেটা এই ভূমিকা থেকে কিছু অনুমান করা সম্ভব।

লেখক তার ভূমিকায় লিখেছেন, হুমায়ূন আহমেদ আমাদের উকিল মুন্সীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। প্রয়াত লেখক চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের সিনেমায় আমরা কিছু মাটির গন্ধমাখা গান শুনতে পেয়েছিলাম। ‘পূবালী বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’Ñএ গানগুলো তারই কল্যাণে আমাদের কর্ণগোচর হয়েছে। এই গানগুলো যিনি বেঁধেছিলেন, তিনিই উকিল মুন্সী। উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে বইটির নাম নিয়ে বইয়ের প্রথম পর্বেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেখক। কীভাবে তিনি উকিল মুন্সীকে জানতে আগ্রহী হলেন এবং সেই জানাটা কোন চিহ্ন ধরে শুরু করবেন, তেমন একটা জায়গা থেকে চিহ্ন হিসেবে তিনি কবরকে বেছে নিলেন। উকিল মুন্সীর কবর যেখানে, সেখান থেকেই শুরু হোক খোঁজা।

বইটি তিনটি পর্বে হাজির করেছেন লেখক। ‘ভ্রমি চিহ্ন ধরে’, ‘কার্তিক ও নাইওর’ ও ‘ছাপার অক্ষরে উকিল মুন্সী’।

প্রথম পর্বে এসেছে লেখকের চিহ্নকে গন্তব্য ধরে নিয়ে যাত্রার বর্ণনা। সেই যাত্রার অভিজ্ঞতার সঙ্গে লেখক সংযুক্ত করেছেন উকিল মুন্সীর বিভিন্ন গানের লাইন। এই পর্বে উকিল মুন্সীর খোঁজখবর করেন এমন লোকজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার, কথা বলার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ পর্ব পড়তে গিয়ে পাঠক পরিচিত হবেন একটা লোকালয়ের সঙ্গে, উকিল মুন্সীর গানের সঙ্গে এবং উকিল মুন্সীর পরিচয়টাও এ পর্বে জানা যাবে।

উকিল মুন্সীর নামটা ‘গাতক’ হিসেবে একটু বেমানান সাধারণ অর্থে। কিন্তু যে অভিনব তথ্যটি এই বইয়ে অপেক্ষা করছিল তা হলো, উকিল মুন্সী একটি মসজিদের ইমামও ছিলেন, এবং তিনি একতারা বাজিয়ে গানও গাইতেন। নানা জন নানা রকম তথ্য দিলেও এটা পরিষ্কার যে উকিল মুন্সী খুব বেশি দিন আগের মানুষ নন। জন্মসাল না জানা গেলেও একটা সূত্রে জানা যায় উকিল মুন্সী মারা গেছেন ১৯৮০-৮১ সালের দিকে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে একজন মসজিদের ইমাম একতারা বাজিয়ে গান করে জীবন কাটিয়ে গেছেন, এটা তথ্য হিসেবে খুবই চমকপ্রদ।

দ্বিতীয় পর্বে এসেছে উকিল মুন্সীর গানের ‘কার্তিক’ ও ‘নাইওর’ প্রসঙ্গে দার্শনিক আলোচনা। নেত্রকোনা অঞ্চলের হাওর অঞ্চলের জলের সঙ্গে রয়েছে ‘নাইওর’ যাওয়ার একটা সম্পর্ক। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়াকে নাইওর যাওয়া বলে। মেঘ ছাড়া, জল ছাড়া যে নাইওর যাওয়া সম্ভব হয় না। এ জলের অর্থ কী, আর নদীয়ায় জলের কী অর্থ, এ ধরনের একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন লেখক এ পর্বে। আবার অন্যদিকে কার্তিক মাসে জলের খেলা থাকে না। হাওর সে সময় যায় শুকিয়ে। জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে উকিলের গানে আষাঢ় আর কার্তিক ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক।

তৃতীয় পর্বে উকিল মুন্সীর গান বা উকিল মুন্সীর কথা ছাপার অক্ষরে কোথায় কোথায় প্রকাশিত হয়েছে, এ-সম্পর্কিত তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসে উকিল মুন্সীর পরিচয় কীভাবে লেখা হয়েছে, তা কতটুকু বাস্তব, কতটুকু কল্পনা, সেটাও এ পর্বে জানা যাবে।

উকিল মুন্সীর বিচ্ছেদী গানের সঙ্গে যারা পরিচিত, তাদের জন্য তো অবশ্যই, যারা বাংলার নানা রকম ভাবের গান শুনতে চান, বুঝতে চান, তাদের জন্যও এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখাটি সাম্প্রতিক দেশকালে প্রকাশিত

……………………………………………..

মোশাররফ হোসেন লিখেছেন-

হুমায়ূন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’ যারা পড়েছেন তারা হয়তো উকিল মুন্সীর সাথে কিছুটা পরিচিত, তবে ইতিহাস আর সাহিত্য সবসময় পাশাপাশি হাত ধরে চলে না বলেই হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের উকিল মুন্সী আর বাস্তবের উকিল মুন্সীর মধ্যে তফাৎটা অনেক বেশী। হুমায়ূন আহমেদ শুধু সাহিত্যে নয়, চলচ্চিত্রেও উপস্থিত করেছেন উকিল মুন্সীকে। তার শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিতে উকিল মুন্সীর গান

“আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে পূবালী বাতাসে-

বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি আমার নি কেউ আসে রে।।”

ব্যবহার করেছেন। কথা উঠেছিল সেই গানটির জন্য উকিল মুন্সীকে শ্রেষ্ঠ গীতিকারের জাতীয় পুরষ্কার দেয়া হবে, হুমায়ূন আহমেদের কাছে উকিলের ঠিকানা জানতে চাইলে এই অকূপমন্ডূকতার জবাবে হুমায়ূন আহমেদ উকিলের কবরের ঠিকানা দেন, একি সাথে এটাও বলেন – এখন যে কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামকে কোন ধরনের পুরষ্কার দেওয়া ধৃষ্টতা, উকিলের ক্ষেত্রেও তাই।

উকিল মুন্সীকে তার এলাকার লোকজন ডাকে ‘উ-হিল’ মুন্সী, শুনতে কিন্তু বেশ শ্রুতিমধুর। বাংলার ভাব ঘরানার মানুষ উকিল মুন্সীর নাম কিন্তু উকিলও নয়, মুন্সী ও নয়; তার নাম আব্দুল হক আকন্দ। মা-র স্বপ্ন ছিল ছেলেকে উকিল বানাবে সেজন্য ছোটবেলা থেকেই তাকে ডাকতো উকিল নামে। বড় হয়ে ছেলে হল মসজিদের ইমাম, লোকজন ডাকতে শুরু করলো মুন্সী নামে, আর আব্দুল হক তার পৈতৃক নাম হারিয়ে পরিচিতি পেল উকিল মুন্সী নামে।

উকিল মুন্সী ভাবুক মানুষ, তার গানগুলোও তাই ভাবগান নামেই বেশী পরিচিত। তবে তার ভাব-চর্চার সুনির্দিষ্ট কোন ছক ছিল না, ছিল না কোন পরিমণ্ডল। আর এ কারণেই হয়তো তাকে নিয়ে লোকজনের আগ্রহ কিছুটা কম। নির্দিষ্ট কোন পরিমণ্ডলে আটকা না পড়লেও উকিল মুন্সী প্রাধান্য দিয়েছেন বিরহ বা বিচ্ছেদ ভাবকে।

ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রকে লালন করা উকিল মুন্সীর পিতৃবিয়োগ ঘটে মাত্র ১০ বছর বয়সে, এরপর কিছুদিন এখানে সেখানে লালিত পালিত হয়ে ১৮ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে যোগ দেন ঘাটুগানের দলে। ঘাটুগানের দলের সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে একসময়ে বাড়িতে ফিরে এসে পাশের গ্রামে বিয়ে করে শুরু করেন মসজিদে ইমামতি। এসময় উকিল গজল রচনা শুরু করেন।

একসময় মুরিদ হন হবিগঞ্জের সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ (রহঃ), উনি ছিলেন সুফী সাধক হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর ৩৬০ জন শিষ্যের একজনের উত্তরসুরি। একদিকে গ্রামের মুসল্লিদের পছন্দের ইমাম, অন্যদিকে একতারা হাতে মানুষের প্রিয় বিরহী বাউল। ভাটি বাংলার গ্রামীণ সমাজে এ রকমটা অচিন্তনীয় হলেও উকিল মুন্সী তার চরিত্রের বিনয়, মাধুর্য, মানব-প্রেমী হৃদয়, দরাজ গলা, ভরাট ও মিষ্টি কণ্ঠস্বর সর্বোপরি তার সৌম্য-কান্তি অবয়ব, সংগীত ও ধর্ম প্রতিভার অপূর্ব সমন্বয়ের কারণেই তার জীবনে তিনি বিস্ময়কর সাফল্যকে ধরতে পেরেছিলেন। সন্ধ্যায় মিলাদ মাহফিল বা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তার দরাজ কণ্ঠের মোনাজাত শুনে ধর্মপ্রাণ মানুষ বুক ভাসিয়েছে কেঁদে, গভীর রাতে তার বিরহ বিচ্ছেদের আর্তনাদে মুখর মরমি গান শুনেও একিভাবে কেঁদেছে সংগীত পিয়াসী সর্বস্তরের মানুষ।

প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের ২৯ তারিখ উকিল মুন্সীর বাড়িতে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। দূর দূরান্ত থেকে আসে অনেক লোক, ওরস উপলক্ষে সারা রাত হয় গান বাজনা। আর গান শুধু উকিল মুন্সীর ই হয় না, গাওয়া হয় জালাল খাঁ, উমেদ আলী, আবদুল মজিদ, আবদুল হাকিম, রাধারমণ, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমের মতো বিখ্যাত সাধক ও বাউলদের গান।

নিলয়, Tofazzel, Saif, Kaushik শোয়েব, Habibur যাবা? বা অন্যকেউ কি আগ্রহী? আগামী ফাল্গুনের ২৮ তারিখ, মার্চের ১২। আর প্রকৃতির কি অদ্ভুত খেয়াল! সে রাতেই কিনা এবারের ফাগুনের পূর্ণিমা। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে উকিলের বাড়ি মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে। মোহনগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ধূলি ধূসরিত সর্পিল পথ বেয়ে যেতে হবে অটো বা মোটর সাইকেলে। দুই পাশে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজের সমারোহ, দিগন্ত-জোড়া ফসলের ক্ষেতের ভেতর দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা রাস্তাটা পাড়ি দিয়ে গিয়ে পৌঁছাতে হবে বেতকি নদীর পাড়ে। নদী পাড় হয়ে ১০ মিনিটের হাটা পথ। বাড়ির আগেই বাজার, নাম উকিলের নামে- উকিল বাজার। নামটা হতে পারতো হাবলঙ্গের বাজার; হুমায়ূন আহমেদের বহুল ব্যবহৃত এই নামটা ধার করা উকিলের গান থেকেই,

“হাবলঙ্গের বাজারে গিয়া,
এক টেকা জমা দিয়া,
আনিও কন্যা কিনিয়া,
মনে যদি লয়”।

উকিলের বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গেছে বেতকী নদী। পথ চলতে চলতে উকিলের বাড়ির সামনে এসে হয়তো নদীর বুকেও উকিলের জন্য ভালোবাসা জেগে উঠেছিল, তাই ঠিক তার বাড়ির সামনে থেকেই মোড় নিয়ে নদী চলে গেছে আরেকদিকে। কি অসাধারণ চিন্তা করে দেখো, বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে মনে হবে দুই দিক থেকে নদীর দুইটি স্রোতধারা এসে লুটিয়ে পড়েছে উকিলের ঘরের উঠানে। নদীর দুই স্রোতধারার সাথে নিজের চিরন্তন দুঃখকে মিলিয়ে নিয়েই হয়তো উকিল রচনা করেছেন,

“একটি নদীর তিনটি সুতা,
আছে তিন গাঙের মাথা…”।

বিরহী উকিলের গানে প্রভাব ছিল ঘাটু গান, মালজোড়া গান আর শরীয়তী শাস্ত্রীয় সংগীতের। বিরহ রচনা করতেই করতেই কিনা তার শেষ জীবন ও কেটেছে বিরহের নিদারুণ যন্ত্রণায়, মাত্র অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে প্রাণপ্রিয় স্ত্রী এবং সবচেয়ে আদরের পুত্র বিখ্যাত বাউল আবদুস সাত্তারের মৃত্যুশোক সইতে না পেরে আট মাসের মধ্যে তিনিও ইহধাম ত্যাগ করেন। কথিত আছে স্ত্রীর মৃত্যুর পরেই তিনি রচনা করেন,

“সোয়াচান পাখি আমার সোয়াচান পাখি,
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।
তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি,
আজ কেন হইলে নীরব মেলো দুটি আঁখি।
বুলবুলি আর তোতা ময়না কত নামে ডাকি,
শিকল ভেঙ্গে চলে গেলে কারে লইয়া থাকি”।

স্ত্রী শোকে কাতর উকিল নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর বাতাস গায়ে লাগিয়েই কি রচনা করেছেন –

“লিলুয়া বাতাসে প্রাণ না জুড়ায় না জুড়ায়
একা ঘরে ঘুম আসে না শুইলে বিছানায়।
নিষেধ করি ওরে হাওয়া লাগিস না মোর গায়,
যার পিরিতে পোড়া অঙ্গ তারে মন চায়।
ঘরে আর বাহিরে উকিল ঘুরি সর্বদায়,
এমন বান্ধব নাইরে আমার বন্ধুরে দেখায়”।

উকিলের উঠানে একটা বড়ই গাছের নিচে উকিলের আর তার ছেলে আবদুস সাত্তারের কবর, বরই গাছটার বয়স অজানা, এই গাছের নিচেই কি উকিল বসে লিখেছিলেন,

“বরই পাতার গরম জলে,
শোয়াইয়া মশারির তলে,
আতর গোলাপ চন্দন মাখাইয়া দে,
সজনী তোরা সাজিয়ে গুছিয়ে দে মোরে”।

উকিলের বাড়ির সামনে নদীর পাড় জুড়ে করচ গাছের সারি। সার বেধে দাঁড়ানো গাছগুলোতে সারা বছরই কিচির মিচির করতে থাকে নাম না জানা হাজারো পাখি, শেষ রাত্রিতে গাছের পাতা চুইয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা শিশির নদীর শান্ত পানিতে তোলে টুপটাপ ছন্দ, মাটিকে করে স্যাঁতস্যাঁতে –

“সংবাদে কি অঙ্গ জুড়ায় সখি বিনা দরশনে,
শিশিরে না ভিজে মাটি বিনা বরিষণে”।

দরশন বিনে কি আর মন জুড়ায়? সামনেই যেহেতু ওরস, একবার তো ঘুরে আসাই যায়, তাই না? গিয়ে না হয় হারিয়ে গেলাম বিরহী উকিলের জনপ্রিয় গানে –

“মনের দুঃখ মনে রইলোরে বুঝলিনারে সোনার চান,
চন্দ্র সূর্য যত বড় আমার দুঃখ তার সমান”।

কিংবা তার বিরহী গানে –

“আমার গায়ে যত দুঃখ সয়,
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়।
নিঠুর বন্ধুরে বলেছিলে আমার হবে
মন দিয়াছি এই না ভেবে
সাক্ষী কেউ ছিল না সেই সেময়…”

কিংবা তার সবচেয়ে বিখ্যাত গানে –

“তুই যদি আমার হইতিরে ও বন্ধু আমি হইতাম তোর,
কোলেতে বসাইয়া তোরে করিতাম আদর রে বন্ধু,
তুই যদি আমার হইতি রে…”

যাবা? থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদের প্রতিচ্ছবিকে বেতকীর বুকে রেখে, ফাগুনের হিমেল হাওয়ায় করচের নিচে বসে মুন্সীর বিরহী গানের তন্দ্রায় মোহাচ্ছন্ন হতে?

———-

বইয়ের নামঃ উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে
লেখকঃ ওয়াহিদ সুজন
প্রকাশনাঃ ঐতিহ্য
গায়ের দামঃ ২১০ টাকা

বইয়ের শুরুতে ওয়াহিদ সুজন লিখেছেন এই বইটাকে তিনি আসলে উকিল মুন্সীর উপরে গবেষণাধর্মী বই বলতে চাচ্ছেন না, বলছেন এক ধরণের ভ্রমণ কাহিনী। এই বইয়ের রিভিউ লিখে আমিও বলতে পারছি না এটা ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ বইয়ের রিভিউ, বরং বলা উচিৎ উকিল মুন্সীর বাড়িতে ভ্রমণের নিমন্ত্রনপত্র।

লেখাটি ফেসবুকে বইপোকা গ্রুপে প্রকাশিত।

………………………………………..

এএএম সৌমিক লিখেছেন–

গল্প না বলে উপায় নেই আসলে বইটি পড়ে। লেখক ওয়াহিদ সুজন উকিল মুন্সীকে জানার জন্য যে খোঁজাখুঁজি করেছেন, সেই অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন গল্প বলার ঢঙে। পাঠকের এ-ও মনে হতে পারে যে তিনি নিজেও সেই যাত্রার সাথি হয়ে নেত্রকোনার পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর এই গল্প বলার ঢঙের কারণেই বইটি হয়ে উঠেছে অনন্য।

বইটির ভূমিকা লিখেছেন ফরহাদ মজহার। বাংলার নদীয়ার ভাবের সঙ্গে একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন তিনি ভূমিকাতে। উকিল মুন্সীর গানের প্রধান উপজীব্য বিচ্ছেদ, এমন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন ফরহাদ মজহার এখানে। আবার একই সঙ্গে নদীয়ার বিচ্ছেদ ভাবনার সঙ্গে এই বিচ্ছেদী ভাবের মিল ও অমিলগুলো ব্যাখ্যাসহ হাজির করেছেন। বইটি পড়ে উকিল মুন্সীকে জানা তো যাবেই, বাংলার ভাবের জায়গায় উকিল মুন্সীর কী অবস্থান, সেটা এই ভূমিকা থেকে কিছু অনুমান করা সম্ভব।

লেখক তার ভূমিকায় লিখেছেন, হুমায়ূন আহমেদ আমাদের উকিল মুন্সীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। প্রয়াত লেখক চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের সিনেমায় আমরা কিছু মাটির গন্ধমাখা গান শুনতে পেয়েছিলাম। ‘পূবালী বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’Ñএ গানগুলো তারই কল্যাণে আমাদের কর্ণগোচর হয়েছে। এই গানগুলো যিনি বেঁধেছিলেন, তিনিই উকিল মুন্সী। উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে বইটির নাম নিয়ে বইয়ের প্রথম পর্বেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেখক। কীভাবে তিনি উকিল মুন্সীকে জানতে আগ্রহী হলেন এবং সেই জানাটা কোন চিহ্ন ধরে শুরু করবেন, তেমন একটা জায়গা থেকে চিহ্ন হিসেবে তিনি কবরকে বেছে নিলেন। উকিল মুন্সীর কবর যেখানে, সেখান থেকেই শুরু হোক খোঁজা।

বইটি তিনটি পর্বে হাজির করেছেন লেখক। ‘ভ্রমি চিহ্ন ধরে’, ‘কার্তিক ও নাইওর’ ও ‘ছাপার অক্ষরে উকিল মুন্সী’। প্রথম পর্বে এসেছে লেখকের চিহ্নকে গন্তব্য ধরে নিয়ে যাত্রার বর্ণনা। সেই যাত্রার অভিজ্ঞতার সঙ্গে লেখক সংযুক্ত করেছেন উকিল মুন্সীর বিভিন্ন গানের লাইন। এই পর্বে উকিল মুন্সীর খোঁজখবর করেন এমন লোকজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার, কথা বলার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ পর্ব পড়তে গিয়ে পাঠক পরিচিত হবেন একটা লোকালয়ের সঙ্গে, উকিল মুন্সীর গানের সঙ্গে এবং উকিল মুন্সীর পরিচয়টাও এ পর্বে জানা যাবে। উকিল মুন্সীর নামটা ‘গাতক’ হিসেবে একটু বেমানান সাধারণ অর্থে। কিন্তু যে অভিনব তথ্যটি এই বইয়ে অপেক্ষা করছিল তা হলো, উকিল মুন্সী একটি মসজিদের ইমামও ছিলেন, এবং তিনি একতারা বাজিয়ে গানও গাইতেন। নানা জন নানা রকম তথ্য দিলেও এটা পরিষ্কার যে উকিল মুন্সী খুব বেশি দিন আগের মানুষ নন। জন্মসাল না জানা গেলেও একটা সূত্রে জানা যায় উকিল মুন্সী মারা গেছেন ১৯৮০-৮১ সালের দিকে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে একজন মসজিদের ইমাম একতারা বাজিয়ে গান করে জীবন কাটিয়ে গেছেন, এটা তথ্য হিসেবে খুবই চমকপ্রদ।

দ্বিতীয় পর্বে এসেছে উকিল মুন্সীর গানের ‘কার্তিক’ ও ‘নাইওর’ প্রসঙ্গে দার্শনিক আলোচনা। নেত্রকোনা অঞ্চলের হাওর অঞ্চলের জলের সঙ্গে রয়েছে ‘নাইওর’ যাওয়ার একটা সম্পর্ক। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়াকে নাইওর যাওয়া বলে। মেঘ ছাড়া, জল ছাড়া যে নাইওর যাওয়া সম্ভব হয় না। এ জলের অর্থ কী, আর নদীয়ায় জলের কী অর্থ, এ ধরনের একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন লেখক এ পর্বে। আবার অন্যদিকে কার্তিক মাসে জলের খেলা থাকে না। হাওর সে সময় যায় শুকিয়ে। জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে উকিলের গানে আষাঢ় আর কার্তিক ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক।

তৃতীয় পর্বে উকিল মুন্সীর গান বা উকিল মুন্সীর কথা ছাপার অক্ষরে কোথায় কোথায় প্রকাশিত হয়েছে, এ-সম্পর্কিত তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসে উকিল মুন্সীর পরিচয় কীভাবে লেখা হয়েছে, তা কতটুকু বাস্তব, কতটুকু কল্পনা, সেটাও এ পর্বে জানা যাবে। উকিল মুন্সীর বিচ্ছেদী গানের সঙ্গে যারা পরিচিত, তাদের জন্য তো অবশ্যই, যারা বাংলার নানা রকম ভাবের গান শুনতে চান, বুঝতে চান, তাদের জন্যও এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

রিভিউটি রকমারি ডটকমে প্রকাশিত।

………………………………………………………….

গুডরিডস থেকে দুটি রিভিউ

স্বাধীন প্রান্ত লিখেছেন —

” সোয়াচান পাখি ” কিংবা ” আমার গায়ে যত দুঃখ সয়” উকিল মুন্সীর এই গানগুলো প্রয়াত বারী সিদ্দিকীর কল্যাণে লোকের মুখেমুখে ফেরে কিংবা হুমায়ূন আহমেদের “মধ্যাহ্ন” উপন্যাসের মাধ্যমে উকিল মুন্সীকে পাঠক চিনতে শেখেন অন্যভাবে। আগ্রহ জন্মায় এই কৃতী মানুষটিকে নিয়ে আরো জানবার।

ওয়াহিদ সুজন উপন্যাসের উকিল মুন্সীকে নয়, আসল উকিল মুন্সীর সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। অনেকটা ভ্রমণ-কাহিনী ধাঁচের এই বই ভ্রমণ-সাহিত্য নয়। আবার, গবেষণাগ্রন্থও বলা যায় না।মোটামুটি তিনটি প্রবন্ধ নিয়ে বইটি। বাজারে প্রচলিত মিথের সত্যতা বনাম সত্যিকারের উকিল মুন্সী যার প্রকৃত নাম আব্দুল হক আকন্দকে পাঠকের কাছে প্রামাণ্যভাবে উপস্থাপন করেন। যাতে ভেঙে যায় এই সাধক ও কবিকে নিয়ে অনেকের রচিত তথ্য বিনে মিথ্যা বোনা তথ্য! অথচ মাত্র ১০৮ পৃষ্ঠা বইটির! আর প্রচ্ছদটাও খুব সুন্দর।

বইটির প্রেক্ষাপটে সুন্দর এই ভূমিকা লিখেছেন ফরহাদ মজহার।

” আমি আগে না জানিয়া সখিরে,
কইরে পিরীতি
আমার দুঃখে দুঃখে জীবন গেল,
সুখ হইল না এক রতি। ” ( পৃষ্ঠা ২১)

সংবাদকর্মী ওয়াহিদ সুজন বিরহী উকিলের এই গানটি দিয়ে শুরু করছেন বইটি। যাতে প্রথমেই পাঠক উকিলের ভাবজগতের সন্ধান পায়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে উকিলের চিহ্নের খোঁজে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু এই চিহ্ন কি? চিহ্ন স্রেফ উকিলের কবর দেখা না। তাঁর গানের মর্ম বোঝার চেষ্টাও চিহ্নের সামিল।

বাড়ির সন্ধানে লেখক –

” একজন মুরুব্বিকে জিজ্ঞেস করলাম উকিল মুন্সীর বাড়ি কোথায়? জানালেন কাছেই। আরও জানালেন – এই গ্রামের কলম মেম্বার উকিল মুন্সীর নাতনি জামাই। তিনি উকিল মুন্সীর যাবতীয় তথ্য জানাতে পারবেন। ” ( পৃষ্ঠা ২৬)

নেত্রকোনায় গিয়েই জানা গেলে উকিলের মেয়ের সাথে দেখা হবে। মোটামুটি আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। কারণ “মধ্যাহ্ন” উপন্যাসে তো জানা গিয়েছিল উকিল নিঃসন্তান। এবং সেও তো ব্রিটিশ আমলের কথা। মেয়ে থাকলেও তো তার এতদিন বেচেঁ থাকার কথা নয়। কথাসাহিত্যকে বাস্তব ধরে ওয়াদুদ সুজন আরো গোলমেলে অবস্থায় পড়েন। যখন জানতে পারেন, উকিল মুন্সীর চারজন ছেলে-মেয়ে ছিল এবং তাঁর স্ত্রী বিখ্যাত লাবুশের মা মারা গেছেন দেশস্বাধীন হওয়ার পর! আবার গ্রামের আরেকজন প্রবীণ জানালেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ-ছয় বছর আগে মারা গেছেন উকিল মুন্সী। এ যেন এক গোলকধাঁধা।

এই অবস্থা থেকে উদ্ধার ঘটল উকিল মুন্সীর পুত্রবধূ রহিমা সাথে খাতুনের সাক্ষাতের পর। লেখক এ পর্যায়ে লিখেছেন,

” সম্ভবত ১৯৮০-৮১ সালের দিকে উকিল মুন্সীকে অনেক শোক পোহাতে হয়। সে সময় তার স্ত্রী মারা যান। উকিল মুন্সীর স্ত্রীর মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস পর বড় ছেলে আবদুস সাত্তার মারা যান। রহিমা খাতুনের জবানে জানা যায় এই শোক উকিলকে বেশ দুর্বল করে দেয়। মোটামুটি আট মাসের ভেতরই স্ত্রী আর ছেলের পর উকিলও মারা যান। ” (পৃষ্ঠা ২৮)

উকিলের মৃত্যু বিভ্রাট নিয়ে তথ্য আরো আছে।

“সোয়াচান পাখি ” গানটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বারী সিদ্দিকী জানিয়েছিল মৃত বউয়ের শিয়রের পাশে বসে উকিল মুন্সী গানটি রচনা করেন। এদিকে উকিলের পুত্রবধূ দাবি করেছেন,

” এইসব বানানো কথা। উকিল মুন্সী এই গান বেঁধেছিলেন তার পীর মুর্শিদকে নিয়ে। ” ( পৃষ্ঠা ২৯)

সুনামগঞ্জের রচির পীর হযরত মোজাফফর এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন উকিল। তাঁরই প্রতি নিবেদিত হয়ে রচনা করেছেন একেরপর এক বিচ্ছেদী গান। “আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে। ” গানটাও তেমনি প্রক্ষাপটে রচিত।

মিথ বনাম বাস্তবতার ফারাক বুঝতে, খুঁজতে ওয়াহিদ সুজন ক্রমাগত নেত্রকোনা ঘুরেছেন। কথা বলেছেন অনেকের সাথে। ছেলেবেলায় পিতার মৃত্যু, মায়ের আবার বিয়ে ব্যক্তিজীবনকে ভিন্নদিকে নিয়ে গিয়েছিল উকিলের। ভবঘুড়ে সেই জীবনে রীতিমত ঝড় তুলেছিল “লাবুসের মা”। এই অবিবাহিত ষোড়শী ছিল গ্রামের “আতরাফ” লবু হোসেনের মেয়ে। অভিজাত পরিবারের ছেলে উকিল মুন্সীর সাথে বিয়ে মেনে নিতে চায় না পরিবার। বিচ্ছেদে পাগলপ্রায় হয়ে যান উকিল মুন্সী।বিয়ে হয়। পরিবারও মেনে নেয়। একইসাথে চলে মসজিদে ইমামতি ও সঙ্গীত সাধনা। এমনও হয়েছে গানের মজলিশ ছেড়ে জানাজার নামাজে যেতে হয়েছে উকিলকে। পঞ্চাশের দশকে মওলানা মঞ্জুরুল হকের গানবিরোধী সমাবেশে মুনাজাত পরিচালনা করিয়েছিলেন মুন্সী!

বহুবিচিত্র শতবর্ষী এক জীবনকে যাপন করেছেন উকিল মুন্সী। সেই উকিলকে, তাঁর দর্শন আর গানকে জানতে সদাউৎসাহ দেখিয়েছেন ওয়াহিদ সুজন। এনেছেন প্রাসঙ্গিকতার স্বার্থে উকিলের সমসাময়িক অন্যান্য শিল্পীর কথা। ভাববাদের নিরিখে কিছুটা ব্যাখা, বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন – এই সব প্রশংসনীয়। তবে এত চেষ্টাও পাঠক হিসেবে আমাকে কতকটা বিচ্ছিন্নতায় ভুগিয়েছে কারণ ওয়াহিদ সুজন যেন ধারাবাহিকতা রাখতে পারছিলেন না। কোন কথার প্রসঙ্গে কার কথা আসছে তা বুঝতে বেগ পেতে হয়েছে কিছুটা। মানে, লেখাটা সাজাতে পারলেন না পুরোপুরি। প্রথমে শুরু হল ভ্রমণকাহিনি হিসেবে তা থেকে সরতে সরতে কোথায় যেন চলে গেলেন লেখক! পড়াশোনা করেছেন এই বিষয় নিয়ে। তবুও তথ্যগুলো গোছাতে পারেন নি।

হোক অগোছালো।তবুও উকিল মুন্সী ওরফে আব্দুল হক আকন্দকে বাস্তবতার নিরিখে পাঠকের সামনে আনবার প্রচেষ্টার জন্য ওয়াহিদ সুজনকে ধন্যবাদ দেয়া যেতেই পারে। আর বিশেষ কৃতজ্ঞতা কথাসাহিত্য থেকে ইতিহাস শেখার প্রচেষ্টাকে আরো একবার ঐতিহাসিক ভুল প্রমাণ করার জন্য।

………………….

ছন্দা লিখেছেন—

উকিল মুন্সী সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য সহায়ক গ্রন্থ। টবে খুব বেশী তথ্য বা খুব স্বচ্ছ ধারণা এই বই থেকে পাওয়ার উপায় নেই। তাঁর একটিই কারন তথ্য’র স্বল্পতা। উকিল মুন্সী সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ইতিহাস সম্ভবত নেই কোথাও। উকিল মুন্সী একই সাথে শরিয়ত পন্থী, বাউল এবং উনার পীর-শিষ্য পরম্পরা দেখে উনাকে অনেকটা সুফী মতবাদেরও মনে হয়। এইযে বিভিন্ন মতবাদ এবং পরিচয়ের মধ্যে উকিল মুন্সীর বিচরণ, সেখান থেকে প্রকৃত উকিল মুন্সীকে বের করা আনার জন্য আরও গবেষনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। তবে এই হয়ত শূরু।

……………………………………………………

ঐতিহ্য আয়োজিত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়া রিয়াজুল ইসলামের রিভিউ

বইয়ের শুরুতেই লেখক বইটিকে ভ্রমণ কাহিনি হিসেবে উল্লেখ করলেও একে শুধুমাত্র ভ্রমণ সাহিত্যের তকমা সেঁটে একটি শ্রেণিভূক্ত করে দেয়া চলেনা। ভ্রমণের সাথে এর মুখ্য যোগসাজশ থাকলেও দর্শনে স্নাতক করা ওয়াহিদ সুজনের হাতে এর প্রতিটি অধ্যায় যেন হয়ে উঠেছে রীতিমত ধর্ম-দর্শনের এক একটি নিবন্ধ। বইটিতে ভ্রমণের চিত্রময় প্রাকৃতিক বর্ণনা যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি এতে আলোচিত হয়েছে দর্শনের সূক্ষ্ম তত্ত্ব যেমন, ভাবগানের নিমিত্ত বিশ্লেষণ, সুফিবাদের ঘরানা, মুরিদ-মুর্শিদ সম্পর্ক, উকিলের বিচ্ছেদ যন্ত্রনার স্বরূপ অন্বেষণ ইত্যাদি। আর, এভাবেই উদ্ঘাটিত হয়েছে কালের পরিক্রমায় ফিকে হয়ে আসা এক চিরবিরহীর বিচিত্র আখ্যান।

বইটিকে লেখক তিনটি পর্বে সজ্জিত করেছেন। প্রথম পর্ব ‘ভ্রমি চিহ্ন ধরে’। উকিল মুন্সীর ব্যাপারে গবেষণায় প্রবৃত্ত হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি এ পর্বে তিনি উল্লেখ করেছেন উকিলের স্মৃতি অনুসন্ধানের লক্ষ্যে তিনটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এ পর্বের মুখ্য বিষয়বস্তু উকিল মুন্সীর পারিবারিক জীবনাচার। একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিকতার বাইরে সামগ্রিকভাবে উকিল মুন্সী নামটি খুব একটা পরিচিত না হলেও তাঁর রচিত অনেক গান বিভিন্ন এলাকায় প্রসিদ্ধ। মূলত, চিরবিরহী এই সাধকের পারিবারিক জীবন অনেকাংশেই অজ্ঞাত, তবে যতটুকু জানা যায় তাও যেন বিরহে পরিপূর্ণ। শৈশবে বাবাকে হারানো উকিল মুন্সীর প্রকৃত নাম আব্দুল হক আকন্দ। মায়ের ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে ছেলে উকিল হবে তাই আদর করে ডাকতেন উকিল বলে। বাবার মৃত্যুর পর মা অন্যত্র বিয়ে করলে উকিলের জীবনে একরকম বৈরাগ্য নেমে আসে। বৈরাগ্য কাটিয়ে একপর্যায়ে ভালবাসেন লাবুশের মাকে কিন্তু তাঁকেও হারাতে হয় জীবদ্দশায়। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী এমনকি মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে ছেলে হারানোর এক বুক বেদনা নিয়ে চিরতরে চলে যান এই চিরবিরহী। ব্যক্তিগত জীবনে এক অপূর্ব সমন্বয়ের নাম উকিল মুন্সী, তাঁর মার্জিত জীবনবোধ এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও রীতিমত বিস্ময়কর। তিনি একাধারে গ্রামবাসীর পছন্দের ইমাম এবং বিরহী বাউল। এমনও হয়েছে বাউল গানের আসরে বিরতি দিয়ে নামাজের ইমামতি করেছেন। একজন বাউল এর মসজিদে কিংবা ইদের নামাজে ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি লাভই প্রমাণ করে তাঁর ব্যক্তিত্বের নিষ্কলুষতা।

দ্বিতীয় পর্বের অভিধা “কার্তিক ও নাইওর”। এ পর্বে লেখক উকিলের রচিত গানের ভাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে এদের স্বরূপ উম্মোচন করেছেন। তাঁর রচিত গানের ভাবপ্রধানতা বা বিরহ বাহুল্যের কারণে সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিকতা এবং পারিপার্শ্বিকতার বাইরে এ গানগুলোকে মানবিক প্রণয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হয়। তবে ওয়াহিদ সুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এক অজ্ঞাত উকিলের অনুসন্ধান শুরু করেন। কারণ, তার প্রাথমিক ধারণা নেত্রকোনা হাওড় প্রধান অঞ্চল এবং পীর-মুরিদীর তীর্থভূমি সিলেটের লাগোয়া এর অবস্থান, ফলে উকিলের গানে সুফিবাদের প্রভাব থাকা অসম্ভব নয়। বাস্তবেও দেখা যায় তাই, উকিল মুন্সী হবিগঞ্জের এক পীরের শিষ্য এবং নিজেও সক্রিয়ভাবে পীর-মুরিদীর সাথে জড়িত। ফলাফলস্বরূপ তাঁর গানগুলোর ভাব অনুশীলনের দিকে গভীর মনযোগ দিলেই অনুধাবন করা যায় যে, এ বিরহের আখ্যান অশরীরী, যেন শরীরকে ছাপিয়ে উঠে আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের এক করুণ আকুতি। লেখকের দৃষ্টিতে তাঁর গানে বিশেষ করে নাইওর, কার্তিক, দক্ষিণ ইত্যাদি পরিভাষার প্রতীকী ব্যবহার খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ।

“ছাপা অক্ষরে উকিল মুন্সী” শীর্ষক তৃতীয় পর্বে তিনি আলোচনা করেছেন সাহিত্য ভাণ্ডারে উকিল মুন্সীকে উপলক্ষ করে এ পর্যন্ত সংযোজন। লেখকের মতে, ভাবের প্রাচুর্য, নিজস্ব ধারা কিংবা রচনায় মৌলিকতা সত্ত্বেও সমসাময়িক অন্যান্য গীতিকবিদের মত এতটা চর্চিত হন না উকিল মুন্সী। তাঁকে ঘিরে যে সামান্য কাজ হয়েছে তাও অপূর্নাঙ্গ। এখানে দুইটি রচনার ব্যাপারে তিনি আলোচনা করেছেন। প্রথমটি, মাহবুব কবির সম্পাদিত উকিলের গানের সংকলন ‘উকিল মুন্সীর গান’ এবং দ্বিতীয়টি, হুমায়ূন আহমদ রচিত উপন্যাস ‘মধ্যাহ্ন’। ‘উকিল মুন্সির গান’ বইয়ে উকিলের রচিত সহস্রাধিক গানের মধ্যে মাত্র দুইশতাধিক গান সংগৃহীত হয় যা খুবই নগন্য। তবে নগন্য হলেও এই উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানান লেখক। দ্বিতীয়ত,’মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকনন্দিত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমদ উকিল মুন্সীকে নির্দিষ্ট গণ্ডি হতে মুক্ত করে তাঁকে সমগ্র দেশের সামনে তুলে আনেন। তবে লেখকের মতে, উপন্যাসের বর্ণনা এবং সঠিক ইতিহাসের সাথে রয়েছে বিস্তর তফাৎ।

সর্বোপরি, পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও লোকগীতির অবদান সামান্য নয়। প্রান্তিক জনসাধারণের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে উকিল মুন্সীর মত সাধকরাই ধারণ করেন জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্য। কিন্তু, কালের পরিক্রমায় কিংবা প্রজন্মের অবহেলায় আজ তাঁরা নিষ্প্রাণ। ওয়াহিদ সুজনের বক্তব্যে, উকিল যা, তা তো তিনি আছেনই। আমাদের স্বীকৃতি বা চর্চা তাঁকে নয় বরং নিজেদেরকেই লাভবান করবে। এক্ষেত্রে “উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে” বাংলা লোকসাহিত্য গবেষণায় হতে পারে এক অসামান্য সংযুক্তি।

………………………………………………………….

ওয়াহিদ সুজনের কথা : সবাইকে ধন্যবাদ। মোশাররফ হোসেনের লেখা থেকে বোঝা যায় ‘সোয়াচান পাখি’ গানটি নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। যার রেশ বইটিতেও আছে। প্রকৃত পক্ষে গানটি লিখেছেন রশিদউদ্দিন।

Comments

comments