মধ্যাহ্নের উকিল মুন্সী

এক.

উকিল মুন্সীর জম্ম নেত্রকোনার খালিয়াজুড়িতে। জীবনের শেষ চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন মোহনগঞ্জ উপজেলার জৈনপুরে। ১৩৮৫ বাংলা সনের (১৯৭৮ ঈসায়ী) পৌষ মাসের দুই তারিখে তিনি মারা যান। বেতাই নদীর কূলে জৈনপুরের সেই বাড়ির উঠোনে তার কবর। হুমায়ুন আহমেদের জম্ম নানার বাড়ি মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরে। উকিল মুন্সী যে বছর মারা যান সে বছর হুমায়ুনের বয়স ৩১। ১৯৯৪ সালের যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ উপন্যাসটি উৎসর্গপত্রে লিখেন সাধক ও কবি উকিল মুন্সী। ২০০০ সালে শ্রাবণ মেঘের দিনে চলচ্চিত্রে বারী সিদ্দীকীর কন্ঠে ব্যবহার করেন উকিলের তিনটি গান। এর বাইরে হুমায়ুন আহমেদ তার মধ্যাহ্ন উপন্যাসের প্রথম খণ্ডে (২০০৬) গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আকারে হাজির করেন উকিল মুন্সী ও তার স্ত্রী লাবুসের মাকে।

Capture

উপন্যাস ও ইতিহাস গ্রন্থ এক নয়। ইতিহাস রচনা একটি সচেতন ও যৌক্তিক প্রক্রিয়া। উপন্যাস ঘটনাকে ইতিহাসের যৌক্তিক ছাচে হাজির করে না। হাজির করে ইতিহাস আশ্রয়ী বয়ান। সে দিক থেকে মধ্যাহ্নের উকিল মুন্সী বেশ ভালো উদাহরণ হতে পারেন। এই উপন্যাসের ভূমিকায় হুমায়ুন লিখছেন যে-কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়- চেষ্টা করে দেখি সময়টাকে ধরা যায় কিনা। সময়কে ধরতে তিনি আরো হাজির করেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজা রঞ্জন মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম জয়নুল আবেদীনকে।

মধ্যাহ্ন উপন্যাসে হুমায়ুন মানুষকে ব্যাখ্যা করতে ফিরে গেছেন অতীতে। মানুষের ধারাবাহিকতার মধ্যে মানুষকে দেখা। এক অর্থে  মানুষের বাইরে যে সময় নাই সে সময়ের মধ্যে মানুষ কিভাবে মিথক্রিয়া করে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও বটে। যে হুমায়ুন সবসময় সম্পর্কের গল্প শুনাচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি চাচ্ছেন সময়কে ধরা যায় কিনা। সময় কি তবে প্রধান চরিত্র? সে হিসেবে উকিল কি নিছক সময়ের মাঝে সাজিয়ে দেয়া উসিলা। দেখা যাক হুমায়ুনের বর্ণনা থেকে ঐতিহাসিক উকিলের বাইরে কোন উকিলকে উদ্ধার করা যায়।

মধ্যাহ্নে উপন্যাসের পটভূমি বান্ধবপুরে উকিল ও লাবুসের মায়ের আগমন ১৯১৩ সালের কোন এক সন্ধ্যায়। হুমায়ুন সে বর্ণনা দিচ্ছেন এইভাবে-

মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রামের মসজিদের ইমাম আব্দুল হক আকন্দ এসেছেন বান্ধবপুরে। যেহেতু মসজিদের ইমাম, লোকজনের কাছে তাঁর পরিচয় মুনসি। মুনসি সাহেবের ডাকনাম উকিল। বাবা-মার আশা ছিলো এই ছেলে বড় হয়ে উকিল হবে।  সেই থেকে তার পরিচয় উকিল মুনসি। বড়ই আশ্চর্যের কথা, মুনসি হয়েও তিনি গানবাজনা করেন। লোকজন তাঁর গানবাজনা খুব যে মন্দ চোখে দেখে তা-না। তখনকার মুসলিম সমাজে উগ্রতা ছিল না। মসজিদের ইমাম সাহেব ঢোল বাজিয়ে গান করছেন, বিষয়টাতে কেউ অন্যায় খুঁজে পায় নি। বরং, তাঁর গান লোক মুখে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। (পৃ: ৯৭)

এই পরিচয় করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তিনি ঐতিহাসিক উকিলকে চিহ্নিত করে দিচ্ছেন। তিনি নৌকায় বসে গাইছেন আষাঢ় মাইসা ভাসা পানিরে। বান্ধবপুরের মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনছে। হুমায়ুনের বর্ণনার উকিলের তখন মধ্যবয়স। কিন্তু প্রকৃত বয়স (১৮৮৫-১৯৭৮) হিসেব করলে দাড়ায় মাত্র ২৮ বছর। উপন্যাস মতে এর কয়েকবছর পর নিঃসন্তান লাবুসের মা মারা যান। যদিও লাবুসের মা মারা যান ১৯৮০-৮১ সালের দিকে।

উকিল মুন্সী ও পুত্র আবদুর সাত্তারের কবর। জৈনপুর, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।

উকিল মুন্সী ও পুত্র আবদুর সাত্তারের কবর। জৈনপুর, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।

জালালপুরে বেড়াতে এসে উকিল লাবুসের মা এর প্রেমে পড়েন এবং এই প্রেম নিয়ে একটি গান রচনা করেন- ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে, সোনার জালালপুর। সেখানেতে বসত করে, উকিলের মনচোর। (পৃ: ৯৮)

এই ঘটনা উল্লেখ করে হুমায়ুন শুরুতেই জানিয়ে রাখছেন উকিল মুন্সী প্রেমিক মানুষ। যার প্রেম নারী থেকে আল্লাহ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই প্রেমে আছে আনন্দ। দেওয়ানা উকিলের মতে লাবুসের মা দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী নারী। তিনি বান্ধবপুর গ্রামে এসেছেন চাঁন বিবিকে দেখতে। সুকন্ঠী চাঁনবিবির রূপের প্রশংসা তিনি শুনেছেন। তিনি উকিলের গান খুবই দরদ নিয়ে গান। উকিল দেখতে চান চাঁনবিবি তার স্ত্রীর চেয়ে সুন্দরী কিনা।

চাঁন বিবি অপর নাম জুলেখা। এই স্বাধীনচেতা ও আপাত পিছুটানহীন মহিলার ঠাই হয় রঙ্গিলা নটি বাড়িতে। জুলেখা এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র জহিরের মা। জুলেখা সেই সময়ে দুই প্রধান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের সংস্পর্শে আসেন। নেত্রকোনা অঞ্চলকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বলয়ের সাথে সাথে উকিল মুন্সীর পরিচয়ে সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক পরম্পরায় যুক্ত করছেন। জুলেখাকে সন্তান জহির ঘৃণা করে। জহিরকে লাবুসের মা সাথে করে নিয়ে যান। তার নতুন নাম হয় লাবুস। যে মাকে সন্তান ঘৃণা করছে, উকিল মুন্সী তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করছেন। (পৃ: ১০৭) বিপরীত দুটি চিত্র মধ্যাহ্নের ক্যানভাসে এসে মিশছে। যেখানে ঠাই হবে আরো নানান কিসিমের মানুষের। তারমধ্যে একজন লাবুস। জুলেখার পুত্র জহিরে (লাবুস) এসে ইতিহাস তার নতুন ধরণের যন্ত্রণা প্রকাশ করছে ।

হুমায়ুন হতে চেয়েছেন সময় ধরার কারিগর। নির্বাচন করেছেন লাবুস নামটি। যদিও এই নামে কেউ ছিলো না। ইতিহাস বলে উকিল মুন্সীর স্ত্রীকে ডাকা হতো লাবুসের মা নামে। যা নামে আছে কিন্তু কোন বস্তু নির্দেশ করে না তার মর্ম বস্তু চরিত্রের উধ্বে। তা নাহলে মানুষ তাকে ধারণ করবে কেন। কোন কোন ক্ষেত্রে আদর্শিত বা সার্বিক আকারে ব্যাখ্যাত হয়। সেই অর্থে জহির তাদের মানস পুত্র। সেই পুত্রের মাধ্যমেই রচিত হবে মধ্যাহ্নের দিনপুঞ্জী। হুমায়ুন  ইতিহাসের অনেকগুলো ধারাকে এক সাথে মিলাতে লাবুসকে যথার্থ মনে করেছেন।

দুই.

হুমায়ুন কেন ইতিহাস না ধরে একটা নতুন কাহিনী বানাতে গেলেন। সত্য বা মিথ্যার তর্ক দিয়ে এটার মীমাংসা হবে না। বরং একজন লেখক জগত ও ইতিহাস ব্যাখ্যার জন্য নিজস্ব তরিকা বানান। এ তরিকার ভেতর দিয়ে তিনি নিজের চিন্তাকে পরিচ্ছন্ন করেন। উকিল মুন্সীর উপস্থিতিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, ময়মনসিংহ অঞ্চলের গীতিকবিতার ঐতিহ্যিক ধারাকে স্বাক্ষী না রেখে বেইনসাফ করতে চান নাই। হুমায়ুন নিজেও সেই ঐতিহ্যের উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি। সে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্বের দিক থেকে উকিলের উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ। কেন তাকে বেছে নিলেন- এটাও প্রশ্ন হতে পারে।

মধ্যাহ্ন। এর প্রথম খণ্ড ২০০৬-এ এবং ২য় খণ্ড ২০০৭-এ প্রকাশিত হয়। ২০০৮-এর মে মাসে দুই খণ্ড একত্রে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশক অন্যপ্রকাশ, ঢাকা। প্রচ্ছদ ধ্রুব এষ। ৪০৮ পৃষ্টা। মূল্য ৫৫০.০০ টাকা।

মধ্যাহ্ন (অখণ্ড)
প্রথম প্রকাশ: মে, ২০০৮
প্রকাশক:  অন্যপ্রকাশ, ঢাকা
ISBN 984 868 494 8
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
৪০৮ পৃষ্টা
দাম ৫৫০ টাকা।

বান্ধবপুরের যে কয়জন মানুষ উকিল মুন্সীর সংস্পর্শে আসেন তারা হলেন মাওলানা ইদরিস, জুলেখা, জহির (লাবুস) ও হরিচরণ সাহা। হরিচরণ সাহা বান্ধবপুরের জমিদার। একদিন জহির পুকুরে পড়ে যায়। হরিচরণের মনে হয় এ যেন স্বপ্নে দেখা শ্রীকৃষ্ণ। তিনি পানি থেকে উদ্ধার করা জহিরকে কোলে নিয়ে কৃষ্ণের সামনে প্রার্থনায় বসেন। সে অপরাধে জাতিচ্যুত হরিচরণ একাকী বসবাস করতে থাকেন। আধ্যাত্মবাদে ঝুকে পড়েন। কিন্তু প্রচলিত কোন ধরণের আধ্যাত্মিক ধারায় তাকে পাওয়া যায় না। সে হরিচরণের সাথে হুমায়ুন দেখা করিয়ে দেন উকিলের। একইভাবে বান্ধবপুরের মাওলানা ইদরিসের আতিথেয়তা নেন উকিল।

উকিল মুন্সী ও মাওলানা ইদরিস দুইজনই মসজিদের ইমাম। দুইজনের চিন্তাগত দুরত্ব প্রায় অলঙ্গনীয়। লাবুসের মা মাওলানা ইদরিসের সাথে ভাই-বোন সম্পর্ক পাতালেও মাওলানা তার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। উকিল তখন বলেন, নবীজির স্ত্রীদের জন্য পর্দা বাধ্যতামূলক। আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের স্ত্রীদের জন্য পর্দা বাধ্যতামূলক না। (পৃ: ৯৯) একইভাবে নটীবাড়ি নিয়ে মাওলানার অস্বস্থি উকিলের মাঝে নাই। অন্যদিকে, হরিচরণ এবং মাওলানা ইদরিস দুই ধর্মের মানুষ। তারা ভাব ও কর্মে যেন একই উত্তর খুঁজে তৎপর। যা তাদের সামনে রহস্যের পর্দা তুলে দেয়। সাদা চোখে তারা শেষ পর্যন্ত অপ্রকৃত্বস্থ ও বিষস্ন। অন্যদিকে উকিল মুন্সীর মধ্যে বিষস্নতার রেশমাত্র নাই। নেই দার্শনিক জটিলতা। সবকিছুর বয়ান বেশ সাদাসিদে। তিনি বলেন, মানুষের গুন বাতাসের আগে যায়।ৃ দোষ থাকে নিজের অঞ্চলে। (পৃ: ১০৪) তিনি গুনের কদর করতে ছুটে যান নটী বাড়িতে। নটী বাড়ির বাইরে নৌকায় বসা লাবুসের মা। এই যে দৃশ্যকল্প হুমায়ুন তৈরি করেছেন তার মধ্য দিয়ে তার দৃশ্য তৈরি ও কল্পনার কারিগরি অসাধারণভাবে ফুটে উঠে। অতীত নিয়ে আমাদের অন্ধকার ধারনার বিপরীত নির্মান। এই দৃশ্যের মধ্যে কোন কালিমা নাই আছে দৃঢ়তা। সমাজের নানাস্থরে থাকা মানুষের মুখোমুখি হবার দৃঢ়তা। একই সাথে ধর্ম ও মানুষের পাপ-পূণ্যের ভেদের নতুন অর্থ তৈরি হয়।

উকিল তাহাজ্জুদের নামাজের পর গান গাইতে পছন্দ করেন। গান গাওয়া নিয়ে মাওলানা ইদরিসকে বলছেন, আমি তো গান গাই সবেরে শোনানোর জন্য, কেউ না শুনলে ফায়দা কি? (পৃ: ৯৯) হরিচরণের আধ্যাত্মিক ভাবালুতা ও বিষস্নতার বাইরে উকিল জীবনের আনন্দ-বেদনাকে যুগপৎ ধরতে চান। তিনি নটির গুনপনা দেখতে নটিবাড়িতে যান, বড় মাছ দেখে আনন্দিত হন, নিজেই মাছ কুটেন, মসজিদের ইমাম, শিষ্যের গান তুলেন মুখে, তত্ত্ব নিয়ে বাহাস করেন, হাতে ঢোল পায়ে নুপুরের তালে গান ধরেন। উকিলের উপস্থিতি খুব অল্প হলেও একই চরিত্রের মধ্যে এতো বৈচিত্র্য এই উপন্যাসের অন্য কোন চরিত্রে নাই। যার উপর ভর করেছে গীতিকবিতার ইতিহাস। যার মধ্যে আছে ধর্ম,  দর্শন ও চর্চা।

উকিল মুন্সীর গান বিচ্ছেদ প্রধান। তাকে বলা হয় বিরহী বাউল। হরিচরণও পছন্দ করেন বিচ্ছেদের গান। উকিল তাকে বলছেন, আল্লাহ বা যে নামেই তাঁকে ডাকা হোক, তিনি থাকেন বিচ্ছেদে। (পৃ: ১০২)  বিচ্ছেদ যখন নির্বিশেষ গুন আকারে হাজির হয়, সেখানে অন্তুভুক্ত হয় সকল মানুষ। এর রাজনৈতিক মাজেজা আছে। হরিচরণের ঋষিসূলভ আত্মমগ্নতার বাইরে এই উপলব্দি নতুন কিছু। আল্লাহ বা অন্য কিছু যে ইতিহাসের বাইরের বিষয় তাকে পাওয়া যায় দুনিয়াবি বিচ্ছেদে। সেই বিচ্ছেদ রচনা করছেন উকিল মুন্সী যিনি ইতিহাসের ভেতরকার আনন্দ-বেদনা সকল কিছুতে তার শরীকানা দাবি করছেন। এই দাবির স্বর্তস্ফুর্ততা হরিচরণের মধ্যে নাই। উকিল আল্লাহকে শুধু ধারণা আকারে ইবাদত ও ঈমানে রাখছেন না। বরং, এই ঈমানের মর্মে আছে আনন্দ। সে আনন্দ বুঝে এই দুনিয়ার হাকিকত, মূল্য, অর্থময়তা এবং উদযাপন।

জুলেখাকে উকিল বলেন, সব কিছু তাকে ছেড়ে গেলেও গান ছেড়ে যাবে না। (পৃ: ১০৭) গানের মূল্য শুধু শিল্প আকারে না- জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রশ্ন জড়িত। হুমায়ুন আহমেদ হাবলঙ্গের বাজার ধারণাটি নানাক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। হাবলঙ্গের বাজার হলো শেষ বিচারের দিনের মেটাফর। লাবুসের মায়ের বরাতে জানা যায় সে গানের কথা। উকিল গেছে জালাল খাঁ-র বাড়িতে। আলোচনার বিষয় হবলঙ্গের বাজার। এর গুঢ় অর্থ সাধকরা জানে। বাতেনী বিষয় তারা প্রকাশ করেন না। বাতেনী অস্থিরতা সত্ত্বেও জাহেরী দুনিয়ার সাথে গড়েছেন সহজ সম্পর্ক। জালাল খাঁ বিশেষ যে গান নিয়ে অস্থির-

হাবলঙ্গের বাজারে গিয়া, এক টেকা জমা দিয়া, আনিও কন্যা কিনিয়া মনে যদি লয়। (পৃ: ২২২)

মধ্যাহ্নের ইতিহাস আধুনিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে। চ্যালেঞ্জ করে আলোকনকে। যেমন- আধুনিকতা কবিদের ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতো বিবর্ণ করে তোলে। আধুনিকতা মানুষকে আর কিছু না দিলেও অনিবার্য হতাশা দিয়েছে। মধ্যাহ্ন যেখানে শেষ হচ্ছে যেখানে ভাঙ্গছে ব্রিটিশ কলোনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে ফেলা আনবিক বোমা সূচনা করছে নতুন এক যুগ। যা আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে মানুষের ইতিহাসে। এমন এক রাজনীতি যা শুধু ইউরোপ বা আমেরিকার নিজেদের বিষয় নয়, এটা দুনিয়ার সব জায়গায় প্রভাব ফেলছে। তাই জাপান যখন পোড়ে লাবুসও পুড়ে। এই ঝলসে যাওয়া যিশুর মত নয়। এতে মানুষের মুক্তি ঘটছে না। ঝলসানো লাবুস নতুন ধরণের উপনিবেশের চিহ্ন।

আপাত নির্বিরোধী ও এক পর্যায়ে মানব সেবায় ব্রত লাবুস ঝলসে যায়। নিরন্তন ভোগের মাঝেই মানুষের নতুন ইতিহাস রচিত হয়। সেই ইতিহাসে উনসুনি (সুহ্ম কলা কৌশলে ওস্তাদ ব্যক্তি) জানা উকিলের বিদায় ঘন্টা বেজে উঠে। থাকতে পারেন না মসজিদের ইমাম যিনি গান করেন। শিল্পের শুকিয়ে যাওয়া তার জনসানসেরই চিহ্ন। লুপ্ত হয় সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যার ধারাবাহিকতা। ফলে হুমায়ুন ঐতিহাসিক উকিলকে বাদ দিয়ে উকিলকে কোন সারমর্মের মধ্যে ধারণ করেছেন সেই মূল্যায়ন তাৎপর্য। মধ্যাহ্নের উকিল সম্পূর্ণ না হলেও উপন্যাসের পরিসরে খণ্ডিত নন। উকিলের মানবিক সম্পর্কের ভেদ নাই। তার মানুষ ধারণা মানবতায় গিয়ে হোচটও খায় না। আধুনিকতা মানবতাকে যেভাবে প্রশ্ন আকারে হাজির করে তার তা করার দরকার পড়ে না। তিনি তো কোন কিছুকে ভাগ করে আবার জোড়া লাগান না। সবই একই সুত্রে সম্পর্কিত।

সে সম্পর্ক ইতিহাসের পরম্পরায় হাত ধরাধরি করে চলে। কারণ তাকে ধরে রাখে উধ্বের কিছু। হুমায়ুনের সময় ধরার মধ্যে আছে বীজের মধ্যে মহীরূহের ধারণা। উকিলের শ্বাশত বিচ্ছেদ যা সকল মানুষকে এক করে। উকিলের বিচ্ছেদের জ্বালায় হুমায়ুন পুড়েন। তিনিও লেখেন বিচ্ছেদের গান। সেখানে আছে অধরা-ধরার খেলা ময়মনসিংহের বহমান গীতিকবিতার ধারা। সে ধারার অব্যক্ত প্রতিধ্বনি হলো লাবুস। উকিল সাধনায় ধারণ করেন সুর, লাবুস শরীরে ধারণ করে রাজনীতি।

……………………………………………………………………………………………………………..

উৎসর্গ: ব্লগার ইমন জুবায়ের। যিনি আমার লেখা অবলম্বনে উকিল মুন্সীকে নিয়ে গল্প লিখে অভিভুত করেছেন।

> লেখাটির যুগান্তর সাময়িকী সংস্করণ: মধ্যাহ্নের উকিল মুন্সী

>উকিল মুন্সী নিয়ে আমার যত লেখা : উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে

Comments

comments

12 thoughts on “মধ্যাহ্নের উকিল মুন্সী

  1. অম্মা! এত কিছু? মধ্যাহ্ন পড়ে এত কথা তো মনে আসে নাই! এমন করে তো চিন্তা করা হয়ে ওঠেনি? আবারও এই বইটা পড়তে হবে, আগের পড়াটা ছিল একেবারেই অসম্পূর্ণ পড়া।
    ধন্যবাদ ভাই ওয়াহিদ সুজন।

    • 🙂
      এই লেখাটার জন্য দ্বিতীয়বার পড়তে হয়েছে।
      প্রথমবার পড়ার পর এইসব ভাবনা মাথায় আসে নাই।

      কিন্তু যখন উকিলকে নিয়া লেখা খুজতেছিলাম। সবাই বলল এই বইটা পড়তে। আমার তো আগেই পড়া ছিলো। একই সাথে জানতাম এইখানকার তথ্য ঐতিহাসিকভাবে মেলে না। এরমধ্যে কি ধরণের তাৎপর্য থাকতে পারে ভেবে আড়াই দিন সময় নিয়া পড়লাম উইথ বাঁশি।

      একটা কিছু খোঁজার উদ্দেশ্য তো ছিলো। সম্ভাবনাটা এক অর্থে নিজেকে পড়াও।
      দ্বিতীয়বার পড়া হলে জানাইয়েন। আপনার রিডিং অনেক ইন্টারেস্টিং হতে পারে।

      আপনাকে দেখে ভালো লাগল। ভালো থাকুন।

  2. লেখাটা দেখে আসছিলাম গতকাল থেকে। মোবাইল থেকে পড়তে পারছিলাম না। এখন পড়ে দেখলাম। অসাধারন। উকিল মুন্সী নিয়ে আগের লেখাটার ব্যাপক।

    ব্লগার ইমন জুবায়েরের মৃত্যু গতকাল থেকে এখনো ভুলতেই পারছি না। আমাদেরও একদিন চলে যেতে হবে।

    • ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।

      যখন সামু-তে নিয়মিত ছিলাম ইমন জুবায়েরের লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। কত বিষয়ে কত লেখা। তার পড়া ও লেখার ক্ষমতা দেখে চমকে উঠতাম।

      হুমম… চলে যেতে হবে।

  3. আবু নইম মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ সুজন, গুগুলে সার্চ দিলাম ‘উকিল মন্সি’। তোমার লিখা পেলাম।আমি মুগ্ধ।মধ্যাহ্ন আমার পড়া ছিল।কিন্তু তোমার লিখা পড়ে মনে হল, আবার পড়ি। বহুত শোকরিয়া।

Comments are closed.