ইকবালের ‘ব্যক্তিগত নোটবই’ যেখানে তর্জমায় হারায়া যায় খোদা!

যেকোনো লেখা যা দ্বারা প্রকাশিত হয়, সে অক্ষর পাঠককে যা দেখায় বা বোঝায়, তা নাও হতে পারে। হতেও পারে। কখনো কখনো সেটার জন্য অন্য কিছুর বোঝাপড়া লাগে। লেখকের চিন্তার সিলসিলা। তা-ই সিলসিলা ছাড়া বোধহয় যা মনে হয়, তা অন্যকিছু। যে পড়ছে বা তর্জমা করছে, তার আইডিয়া অন্যের নামে চালায়া দিচ্ছে। লেখক পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলে একটা অর্থ দাঁড়ায় বটে, তা আবার কারো কারো কাছে অনর্থ মনে হতে পারে। মনে করা উচিত যে অনুবাদ মানে শুধু ভাষা জানা, এমন না। ইন্টারেস্টিং একটা বিষয় দেখে তা মনে হলো।

ছবি: বইটির প্রকাশক বাতিঘরের সৌজন্যে

গত বছর আগে মুহাম্মদ ইকবালের নোটবইয়ের একটা অনুবাদ পড়তেছিলাম। জাভেদ হুসেনের অনুদিত ‘ব্যক্তিগত নোটবই’। তো, পড়ে গেলাম এভাবে—

ঈশ্বর কি আছেন? বহুশত বছর এই প্রশ্নে
মগ্ন ছিল প্রাচ্যের হৃদয় আর বুদ্ধি।
নতুন একটা প্রশ্ন তুলতে চাই আমি,
প্রাচ্যের জন্য নতুন প্রশ্ন— মানুষ কি আছে?

এটা পড়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে নাই। বরং মনে হইছে এখানে ধর্মচিন্তা বাদ দিয়ে যে হিউম্যানিজম আছে; সেটা বোধহয় যারা বা যিনি অনুবাদ করেছেন তার চিন্তার সঙ্গে সঙ্গত হওয়ায় টান অনুভব করছেন। ইকবাল হয়তো মানুষকে দুনিয়ায় ফিরায়া আনতে চান। হইতেও তো পারে। তো, ইকবালকে জানেন এমন এক বন্ধু বইটা হাতে নিয়ে বললেন, এ তর্জমা বোধহয় ঠিকঠাক হয় নাই। অর্থগুলো হারায়া গেছে।

ইকবালের বই বলতে সেই অতিপরিচিত ‘ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ পড়ছিলাম থিসিসের সময়। এক যুগ আগে। সেখানে দেখছিলাম, একেকটা বাক্যের পেছনে কতটা দার্শনিক সিলসিলা ধরে আগাইছেন তিনি। ইকবাল জানতে গেলে ইসলাম ধর্ম আপনাকে জানতে হবে। এবং দুনিয়ার অন্য ধর্ম, চিন্তা ও দর্শন থেকে ইসলাম কেন আলাদা তাও জানতে হবে। তো, এটা যে নোটবই বা টুকরো-টাকরা কথা সেটা যে স্রেফ মনের খেয়াল, বা তাৎক্ষণিক ভাব এমনটা ছিল না বোধহয়। একটু নড়েচড়ে বসলাম।

তো, ইংলিশ বইটা অনলাইন থেকে নামায়া দেখলাম। এ লাইনগুলা এভাবে লেখা—

For centuries Eastern heart and intellect have been absorbed in the question Does God exist?
I propose to raise a new question – new, that is to say, for the East – Does man exist?

পড়ে যা বুঝলাম- এ তর্জমা ঠিকঠাক হওয়ার জন্য যে দার্শনিক বোঝাপড়া দরকার, তার একটা ঘাটতি আছে। সেটা যে ভুল তা না। অর্থ বা অনর্থের ব্যক্তিভেদ স্বীকার করতে হবে।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা, এটা মূলত এজিস্টেন্স বা অস্তিত্ব সম্পর্কিত। ‘ঈশ্বর কি আছেন?’ এটা সম্ভবত ‘Does God exist?’ হলেও তা না। অথবা সম্ভবত Does man exist? ‘মানুষ কি আছে?’ হলেও তা না।

অস্তিত্ব সত্তার অন্তর্গত দিক, মানে গুণ না। এবং সরলীকরণভাবে ‘অস্তিত্ব’ কখনো ‘খোদা’ ও ‘মানুষের’ ক্ষেত্রে একই না, অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে। এটা যদি ‘খোদা’র ধারণা নেতি অর্থেও নেয়া হয়। যেমন মানুষের থাকা আর পানির গ্লাসের থাকা এক না। পড়ে আমার মনে হইলে এই ‘exist’ এর সুরাহা না করে এ লাইনগুলার অনুবাদ সম্ভব না।

‘অস্তিত্ব’ সম্পর্কিত পপুলার যে ধারণা আধুনিক দর্শকে সেটার মুসিবিদা করতে হলে মার্টিন হাইডেগারের ‘বিয়িং’ ধারণাটা সামনে আনা দরকার। যার সূচনায় এরিস্টটল পর্যন্ত আগানো যায় হয়তো। ইকবালের লগে নিটশের ভাবনার জায়গাটা বুঝতে হবে। এমনকি ইসলামিক দার্শনিক ঐতিহ্যের লগে ফেনোমেনালজির সাদৃশ্যের দিকটাও খোলাসা করে আগাইতে হবে। নইলে মানুষ কীভাবে মানুষ থেকে খোদায় যাবে তা বোঝা যাবে না। আবার ইকবালের ‘খোদা’ তো স্রেফ দর্শন বা আইডিয়ার খোদা না। তাইলে আমরা মানুষ ও খোদার এ অস্তিত্বশীলতারে কীভাবে ব্যাখ্যা করবো। এর জন্য ইসলামিক ঐতিহ্যে হয়তো তালাশ করতে হবে। আমরা পার্সিয়ান ট্র্যাডিশনেও চেক করতে পারি। মোল্লা সদরা থেকে হুসেন নসর…ও!

এখন বাংলা যে অনুবাদ সেখানে মানুষের চিন্তার ক্ষমতা, অজ্ঞতা বা নিরশ্বর ভাবনার একটা জায়গা আছে। সম্ভবত ইমানুয়েলের কান্টের যে নোমেনাকে জানা যায় না, সে অর্থে ‘খোদা’ আলাপ দরকারি না। মানুষকে জানা যায় বলে তাকে কেন্দ্র করে আমাদের চিন্তা আবর্তিত হইতে পারে বোধহয়। যেহেতু পুবের সেলিব্রেটেড দর্শনে নিরশ্বরবাদের জায়গা বিস্তুর।

এত কথা আসলে বলার ছিল না। হা হা হা। মুহাম্মদ ইকবালরে বোঝার যে জটিলতা, তা বোধহয় তার এই নোটবইয়ে ক্লিয়ার করাই আছে। তাতে আমার আসলে কথা বাড়াইতে হয় না। তিনি যে খোদা, অস্তিত্ব ও বিশ্বাসের আলাদা মিনিং ভাবতেছেন আমাদের চেয়ে আমের চেয়ে, সেটা তার বইটাতেই আছে। যেমন-

The Existence of God My

friends often ask me, “Do you believe in the existence of God”? I think I am entitled to know the meaning of the terms used in this question before I answer it. My friends ought to explain to me what they mean by “believe,” “existence” and “God”, especially by the last two, if they want an answer to their question. I confess I do not understand these terms; and whenever I cross- examine them I find that they do not understand them either.

এ লেখাটা আমাদের একটা সুবিধা করে দেয়। আমরা ইকবালের কথাগুলা বুঝতে না পারলেও না পারা মানুষেরা কিন্তু তার বন্ধু হতে পারে।

একইভাবে ইসলামি চিন্তার জায়গাগুলো ক্লিয়ার না করে হরে-দরে জালালুদ্দীন রুমি, মনসুর হাল্লাজ প্রভৃতির যে অনুবাদ তা মাঝে মাঝে হতবুদ্ধিকর। তবে সেগুলো যে অনুবাদকের মহিমায় নতুন কিছু হয়ে উঠে না; তা তো না।

Comments

comments