হালের হিট হলিউড সিনেমা ডিউন’ আমেরিকান লেখক ফ্রাঙ্ক হারবার্টের ১৯৬৫ সালের একই নামের সায়েন্স ফিকশন সিরিজ অবলম্বনে নির্মিত। শুরু থেকেই উপন্যাসের ধর্ম-সংশ্লিষ্টতা, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম থেকে প্রভাবিত হওয়া নিয়ে আলোচনা হয়ে আসেছে। অক্টোবরে ছবি মুক্তির পরও সেই আলোচনা আবার ওঠে এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।*
মহাকাব্যিক ডিউন
ভবিষ্যৎ মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে ডিউন উপন্যাসে মিথস্ক্রিয়া করেছে রাজনীতি, ধর্ম, বাস্তুসংস্থান, প্রযুক্তি ও মানবিক আবেগ। আর এর সবকিছু ঘুরপাক খেয়েছে আরাকিস নামের গ্রহ ও এর মূল্যবান খনিজ ঘিরে। সায়েন্স ফিকশনে একাধিক ঘরানার মিলমিশ আরও আগের ঘটনা। যেমন : আইজ্যাক আসিমভের ‘ফাউন্ডেশন’ সিরিজ। অনেকে বলেও থাকেন ‘ডিউন’ আসিমভের সিরিজটির কাউন্টার পার্ট।
‘ডিউন’-এর আরও পাঁচটি সিক্যুয়েল লেখেন হারবার্ট ডিউন মেসিয়াহ, চিলড্রেন অব ডিউন, গড এম্পায়ার অব ডিউন, হেরেটিকস অব ডিউন ও চ্যাপটারহাউজ : ডিউন। ১৯৮৬ সালে হারবার্টের মৃত্যুর পর তার ছেলে ব্রায়ান হারবার্ট লেখক কেভিন জে অ্যান্ডারসনের সঙ্গে মিলে ডজনখানেক সিক্যুয়েল লেখেন। শেষ পর্বটি আসে ১৯৯৯ সালে। উপন্যাস হিসেবে জনপ্রিয়তা ও পুরস্কার জিতে নেওয়া ‘ডিউন’ বার কয়েক উঠেছে রুপালি পর্দায়, টিভি সিরিজও হয়েছে। তবে কোনোটিই সাম্প্রতিক ছবিটির মতো আলোচিত বা ব্যবসাসফল হয়নি।
গল্প
গল্পের মূল চরিত্র পল অ্যাট্রেইডেস। এমন কিছু ক্ষমতা ও আশীর্বাদ নিয়ে তার জন্ম, যা পলের নিজেরই অজানা। মহাবিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর গ্রহে পরিবার ও নিজের লোকদের রক্ষা করতে তাকে সংগ্রাম করতে হয়। এ নায়ক মানুষের সর্বোচ্চ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। আর তা হলো, ভয়কে জয় করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা।
মহাবিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান এক পদার্থের একমাত্র উৎস বিপজ্জনক মরুগ্রহ আরাকিসের দায়িত্ব গ্রহণ করে পলের বাবা ডিউক লেটু। এ খনিজ মানব জীবনকে দীর্ঘায়িত করে ও চিন্তাশক্তির স্তরকে প্রসারিত করে।
লেটু যদিও জানত যে, এই সুযোগটি তার শত্রু হারকুনেন্সের তৈরি একটি ফাঁদ। তবুও উত্তরাধিকারী ছোট ছেলে ও আরাকিসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ডিউন হিসেবে পরিচিত পল এবং পলের দৈব মা ও লেটুর উপপত্নী লেডি জেকিকাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। লেটু সেই মূল্যবান পদার্থের খনির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন, যাতে দৈত্য স্যান্ডওয়র্মের উপস্থিতিতে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। একপর্যায়ে বৈরী এ গ্রহের বাসিন্দা ফ্রেমেনদের জন্য পল আবির্ভূত হয় মসিহা বা ত্রাণকর্তা রূপে।
মসিহা
মসিহা সম্পর্কে আমাদের কম-বেশি অনুমান রয়েছে। এ সিনেমাকে সেমেটিক ধর্মের বিকাশ ও ধারণাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়। এর মধ্যে ‘ডিউন’-এর ইসলাম সংশ্লিষ্টতা সেই ষাটের দশক থেকে আলোচিত। ফ্রেমেনরা মরুচারী প্রজন্মের পর প্রজন্ম পানির অভাব, মরুঝড়, জোরপূর্বক দাসত্বের শিকার। যাদের হিব্রু বাইবেলের ইহুদিদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়।
‘মসিয়াহ’র হিব্রু উৎসগত অর্থ হলো ‘অভিষিক্ত একজন’। সাধারণত ইহুদি ধর্মকে মেসিয়ানিক ধর্ম হিসেবে দেখা হয়, যাদের বিশ্বাস ও অনুশীলনের কেন্দ্রে রয়েছে এক ত্রাণকর্তার ধারণা। তবে মসিহা কে বা কী এ নিয়ে বিরোধ কম নয়। কিন্তু ইহুদি ধর্ম মূলত টেম্পল কেন্দ্রিক। আর ঈশ্বর নিজেই মুক্তিদাতা, সেখানে আলাদা করে মসিহার দরকার কী? তবে খ্রিস্টপূর্ব ৭০ সালে সেকেন্ড টেম্পল ধ্বংস হলে এমন বিশ্বাস জন্মায় রোমানরা যেহেতু ইহুদি ধর্মে অন্তস্তল ধ্বংস করে দিয়েছে, এখন একজন ত্রাণকর্তা দরকার। সর্বশেষ ১৭ শতকের দিকে সাব্বাতাই জেভির নেতৃত্বে ‘সাব্বেতাইনিজম’ নামের মেসিয়ানিক আন্দোলনের শুরু হয়। অটোমান সাম্রাজ্যে কিশোর বয়সে তিনি নিজেকে ইহুদিদের মসিহা ঘোষণা করেন। কিছু শিষ্যও জুটিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে তিনি বাধ্য হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
আবার আপনি যদি প্রথম শতকের জুদিয়ার হেরোড দ্য গ্রেটের রাজত্বে একজন ধনী গ্রিক বা রোমান হন তাহলে তার বিশাল বিশাল প্রাসাদ, রাস্তা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আপনার পছন্দ হবে। কিন্তু যদি একজন ইহুদি কৃষক হতেন, তবে আপনার কাছে হেরোড অনেক ভয়ানক একজন রাজা। সাধারণ জনগণ ও কৃষকরা তার ওপর ত্যক্ত-বিরক্ত। তাই হেরোডের মৃত্যুর পর চারদিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে, যতক্ষণ না নৃশংসভাবে রোম কর্র্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। রোমানরা জেরুজালেমের মন্দির পুড়িয়ে দেয় এবং দুর্নীতিগ্রস্ত পুরোহিতদের ক্ষমতা দিয়ে ‘ফিসকাস জুডাইকাস’ প্রবর্তন করেছিল ইহুদি ধর্মের অনুশীলন করলে কর দিতে হবে। এ কারণে প্রথম শতকের জুদিয়ার সঙ্গে মসিহার ধারণা দারুণভাবে খাপ খায়। হেরোডের মৃত্যুর পর এমন দাবি নিয়ে আসে জুদাস দ্য গ্যালিলিয়ান, পেরিয়ার সাইমনসহ অনেকে। এই মেসিয়ানিক উর্বর ভূমি থেকে একজন কাঠমিস্ত্রির পুত্রের আবির্ভাব হয়েছিল, তিনি যিশু।
অন্যদিকে, আরব ভূমির মানুষরা অনেক দিন ধরে এ হীনমন্যতায় ছিল যে, তাদের মধ্যে কোনো ঐশী বার্তাবাহক নেই। তেমন পরিস্থিতির মধ্যে আবির্ভাব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর। ধর্ম প্রচারের নানান পর্যায় শেষে তিনি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু পরে এ ধর্মের বিশেষ বিশেষ অংশে একজন ত্রাণকর্তা বা মসিহার ধারণা বিকশিত হয়। বলা হয়ে থাকে, ইমাম মাহদি শেষ যুগে আবির্ভূত হবেন এবং পৃথিবী থেকে অশুভ শক্তি দূর করে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। কোরআনে মাহদি সম্পর্কে সরাসরি কোনো উল্লেখ না থাকলেও হাদিস শাস্ত্রে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ইসলামিক ব্যাখ্যাগুলো মহাপ্রলয়ের আগে ইমাম মাহদির নেতৃত্বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পূর্বাভাস দিয়ে থাকে।
প্রথম শতকের জুদিয়া বা ষষ্ঠ শতকের আরব ছিল ভবিষ্যদ্বাণী ও নানা সংস্কারে ভরা। তেমন পরিস্থিতিতে ফ্রেমেনরা খুঁজছে একজন ‘মাহদি’, যিনি তাদের স্বর্গের দিকে নিয়ে যাবেন। ফ্রাঙ্ক হারবার্ট এ ধারণাকে প্রয়োগ করেছেন তার উপন্যাসে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট লক্ষণীয়ভাবে একই রকম আরাকিস ও জুদিয়া। বিশেষ করে পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (মেনা)। খনিসমৃদ্ধ আরাকিসে পাদিশাহ সম্রাট শাদ্দাম চতুর্থ যেন হেরোড দ্য গ্রেট। যার আছে ডিউক, ব্যারন ও লর্ডরা। যেভাবে রোমান শাসকের অধীনে জুদিয়া শাসন করত গভর্নররা। তাদের অধীনে সম্পদপূর্ণ ফ্রেমেনরা দাসের মতো নির্যাতিত হতো। ইহুদি ও ফ্রেমেনরা একইরকমভাবে উদ্বেগ ও ক্ষোভে ফুটছে। জুদিয়া, আরব বা আরাকিস গভীরভাবে ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর নির্ভরশীল। একইভাবে ‘ডিউন’-এ এক ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রান্তিক অবস্থায় মসিহার ধারণা পাওয়া যায়।
‘ডিউন’-এর ত্রাণকর্তার ধারণা প্রথম শতকের জুদিয়ার অনুরূপ। মানে এভাবে গল্পটি লেখা হয়েছে, ঠিক যেন সায়েন্স ফিকশনের নিউ টেস্টামেন্ট। এখানে পল মসিহার মতো আবির্র্ভূত হলেও ঐতিহাসিক কোনো চরিত্র (অবশ্যম্ভাবী যিশু) হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং ভবিষ্যদ্বাণীও ধর্মকে ফ্রেমেনদের মুক্তির ধারণা অনুযায়ী নকশা করা হয়েছে। তবে পলের সঙ্গে যিশুর অনেক অমিল। যিশু কখনো যোদ্ধারাজা দাউদের মতো ছিলেন না, বরং ‘প্রতিবেশীকে ভালোবাসো’ ও ‘অপর গাল বাড়িয়ে দাও’ এমন উপদেশ দিয়েছেন। এমনকি ক্রুসের ওপর তার মৃত্যু পলের পরিণতির চেয়ে বিপরীত। এই ক্ষেত্রে, পলের সামরিক সাফল্য খ্রিস্টান ধর্মের (হারবার্টের মতে, ‘জিহাদ’) তুলনায় ইসলামের উত্থানকে প্রতিফলন করে।
আরব প্রভাব
এ উপন্যাসে কল্পকাহিনীর আদলে চতুরভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক উপাদান যোগ করা হয়েছে। যা দর্শক অবচেতনে পরিচিত মনে করে। ইসলাম সংশ্লিষ্টতার প্রশ্ন বারবার আসার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সিরিজে চিত্রিত ফ্রেমেনদের সংস্কৃতি ও ভাষা উভয় ক্ষেত্রে নিখুঁত আরবি শব্দ ও পরিবেশের আশ্রয় নিয়েছেন হারবার্ট। নির্দোষ উদাহরণ, মরুভূমির জীব স্যান্ডওয়র্ম নেওয়া হয়েছে আরবি সাই-হুলুদ থেকে। আরও নেওয়া হয়েছে মাহদি, মুয়াদিব, উসুল, শরিয়া, শয়তান ও জিনের মতো পরিচিত শব্দ।
এ ছাড়া পুরো ছবিও মেসিয়ানিক ধর্ম সম্পর্কিত। উপন্যাসে আছে ‘জিহাদ’ও। সব মিলিয়ে মরুভূমি ও ইসলামের আবহে পুরো অ্যাডভেঞ্চার অর্থপূর্ণ ও সহজবোধ্য করতে আরবি শব্দ ও পদ বাছাই করা হয়েছে। পলের সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে ঐতিহাসিক চরিত্র ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’- খ্যাত টি এইচ লরেন্সের।
১৯৬০ সালে প্রকাশিত লেসলি ব্লাঞ্চের ‘দ্য সাব্রিস অব প্যারাডাইজ’কেও ‘ডিউন’-এর অনুপ্রেরণা মনে করেন কেউ কেউ, যেখানে ককেশাসের বীর ইমাম শামিল ও স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। মরুগ্রহ আরাকিসের আবহাওয়ার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের মিল পাওয়া যায়। সেখানকার পেট্রলকেন্দ্রিক রাজনীতিকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরে হারবার্ট। ফ্রেমেনদের মধ্যে উঠে এসেছে বেদুইন বৈশিষ্ট্য।
ইসলামি অনুষঙ্গ
‘ডিউন’ প্রসঙ্গে বাকনেল ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক আলী কারজো-রাবারি বলেন, এই বইয়ে ইসলামের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। এটা সুস্পষ্ট যে, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যব্যাপী দেখা যাওয়া প্রান্তিক বেদুইনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ফ্রেমেনদের বর্ণনা এঁকেছেন হারবার্ট।
আরও বলেন, ভাষা ও ধর্মের দিক থেকে ইসলামকে এখন আমরা যেভাবে দেখি সেরকম না হলেও ২০ হাজার বছর পরে বিশ্বে ইসলামের বিভিন্ন অংশ চিত্রিত করেছেন হারবার্ট। যার উপস্থিতি ও প্রভাব সর্বত্র। এ দিক থেকে হারবার্ট আসলেই অগ্রগামী।
এ অধ্যাপকের মতে, স্পষ্টতই, ‘ডিউন’-এর কোনো ধর্মই আজকের ধর্ম নয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার যেভাবে বিকাশ ঘটে, সেভাবে ধর্মের পরিবর্তন হয় বলে তিনি দেখেছেন। এখন কেউ যদি, ইসলাম বা আরব বা ইসলামিক বিশ্ব সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখেন, তিনি জানতে পারবেন ‘ডিউন’ ইসলাম ও আরব দ্বারা কতটা অনুপ্রাণিত। যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি নিয়ে উত্তর আমেরিকায় এক ধরনের ভীতি ও অজ্ঞতা আছে, সেখানে ইসলামকে মানব ঐতিহ্যের নিরপেক্ষ অংশের দিক থেকে দেখেছেন হারবার্ট। তিনি দেখেছেন, ইসলাম ভবিষ্যতের প্রাকৃতিক অংশ।
উপন্যাস ও সিনেমার অমিল
তবে উপন্যাস ও সিনেমার মধ্যে বেশ ফারাক রয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক লেখায় বলা হচ্ছে, ‘ইসলামিক’ বিষয়গুলো অনেকটাই মুছে দেওয়ায় এ সিনেমা খুব বেশি প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট ও কম সাহসী। ‘ডিউন’ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ, যেখানে ধর্মকে কাজে লাগানো হয়েছে। পল তার অনুসারীদের নিয়ে সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ পরিচালনা করে। হারবার্টকে সম্পাদকরা সেই ষাটের দশকে বই থেকে ‘মুসলিম স্বাদ’ কমাতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি সে পথে না হাঁটলেও সম্প্রতি পরিচালক ডেনিস ভিলেনিউভ এই কাজটিই করেছেন।
সমালোচকরা বলছেন, বহুস্তরযুক্ত রূপক ‘ডিউন’ ধারণ করেছে লরেন্স অব এরাবিয়ার সঙ্গে বেদুইনদের সম্পর্ক। রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদ ও ওপেকের বিরুদ্ধে ককেশিয়ান মুসলিমদের প্রতিরোধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ল্যাটিন আমেরিকায় আদিবাসীদের সংগ্রাম। এ যেন ২০ হাজার বছর পরের ভবিষ্যতের ইসলাম কীভাবে বিকশিত হবে তার সন্ধান। ‘ডিউন’-এর জগতে অন্য যেকোনো কিছুরই চেয়ে ইসলামকে দেখা যায় বেশি। যেভাবে অ্যালজেবরা বা টেবুলা রাসা এখন সর্বত্র বিস্তৃত। একইভাবে বেনে গেসেরিটের মুখে শোনা যায় কোরআনের এফোরিজম।
কিন্তু উপন্যাসের সাহসী দিকটিকে এগিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে ভিলেনিউভ যান প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দিকে। হারবার্টের আপাত সংবেদনশীলতা এড়ানোর জন্য সক্রিয়ভাবে ইসলাম, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ উপাদানকে কমিয়ে আনা হয়। ফলে ধর্ম, বাস্তুশাস্ত্র, পুঁজিবাদ ও ঔপনিবেশিকতার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র হয়ে গেছে বিমূর্ত। হারবার্টের মূল বই ইসলামকে বিশ্বের অংশ বললেও ছবির চিত্রনাট্যকার জন স্পাইটস দাবি করেন, যেসব বিদেশি প্রথা থেকে বইটি অনুপ্রাণিত তা আজকাল আর কাজ করছে না। মুসলিমদের বহিরাগত নন্দনতত্ত্ব হিসেবে বিবেচনার ফলে ছবির সঙ্গে উপন্যাসের দৃষ্টিভঙ্গি বিপরীত দিকে যায়। যা গতানুগতিক হলিউড সিনেমায় দেখা যায়। ফ্রেমেনদের ভাষা হিসেবে ককেশিয়ান ভাষার সঙ্গে আরবি কথোপকথনের সংমিশ্রণ দেখিয়েছেন হারবার্ট। কারণ হিসেবে শতকের পর শতক মরুভূমির পরিবেশে টিকে থাকাকে তুলে আনা হয়েছে বলে মনে করেন লেখকের ছেলে ব্রায়ান। আরবি মূল থেকে পরিবর্তন করে হারবার্ট দেখাতে চেয়েছেন ভাষা কীভাবে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু সিনেমায় যতটুকু আরবি না থাকলেই নয় এভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, আরবি ও ফারসি উচ্চারণগুলো খুবই দুর্বলভাবে তুলে ধরা হয়েছ। যা অনেকটা আমেরিকান ক্যারিকেচারে। কিন্তু যে কারণেই হোক ছবির চরিত্রগুলো আধুনিক ইংরেজি ও মান্দারিন ভাষায় কথা বলে!
একইভাবে সবচেয়ে কৌতূহলের বিষয় ‘জিহাদ’কে এড়িয়ে গিয়ে ‘হলি ওয়ার’ ব্যবহার করা হয়েছে। হাল আমলে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জিহাদের অর্থ জড়িয়ে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে। যদিও হারবার্ট কখনো কখনো ‘ক্রুসেড’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যা আবার খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে যুক্ত, যা কখনো কখনো হলি ওয়ার নামে চিহ্নিত হয়ে আসছে। হারবার্ট একে উপনিবেশবিরোধী যুদ্ধ অর্থে ইতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করেছেন। একই সঙ্গে পল ও বেনে’র ঔপনিবেশিক সহিংসতাকে জিহাদ দ্বারা বুঝিয়েছেন। এখন সময়ের পরিক্রমায় উপন্যাসের জিহাদ থেকে সরে এসেছেন নির্মাতা। জনপ্রিয় সিনেমার দর্শকরা জিহাদকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে দেখে, আবার সাম্রাজ্যবাদীরাও সন্ত্রাসী। এখানে আর ‘জিহাদ’-এর অন্তর্গত অর্থ খোঁজা হয় না।
উপন্যাসে হারবার্ট প্রাচ্যবাদী দুই ক্যাটাগরি ‘ইস্ট’ ও ‘ওয়েস্ট’-এর বাইনারির বোঝাপড়াকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। খ্রিস্টান শুভ্রতা এসেছে সাম্রাজ্যবাদী ও অশ্বেতাঙ্গরা এসেছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি হিসেবে। উপন্যাসের এ ছক উল্টে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের ইউরোপিয়ান খ্রিস্টানদের অবয়ব দেওয়া হয়েছে। মানে আরও বেশি সাদা-কালো হয়ে ধরা দিয়েছে সিনেমা। অর্থাৎ হারবার্টের সাহসের দিকটি ধরে রাখতে পারেননি নির্মাতা। সেখানে সাম্রাজ্যের হাত থেকে ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠে সাদা নায়ক। এভাবে সাদা মানুষের রাজনীতির কাছে তাল হারিয়ে সম্পূর্ণ বাদ পড়েছে মরুভূমির নিজস্ব রূপ।
*লেখাটি পত্রিকার জন্য তৈয়ারকৃত